রাতের শেষে আলোর আহবান।

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: শুক্র, ২৮/০৫/২০১০ - ২:১৪পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

ঘুম নিয়ে ব্যাপক ঝামেলায় আছি। যখন ঘুমানোর দরকার তখন চোখ জোড়া অপলক টিভির দিকে চেয়ে থাকে। আবার যখন উঠা দরকার তখন কাঠালের আঠারমত চোখের পাতা লেগে থাকে। ঘুমের অনিয়ম আর খামখেয়ালীপনার কারণে জীবনের অবস্থা গুরুচরণ। ঘুমের স্বেচ্ছাচারিতায় সকালে যে দিন দশ মিনিট বিলম্বে বাসা থেকে বের হই সেদিন রাস্তায় জ্যামে আটকে পড়ার বিড়ম্বনার সাথে বোনাস টক হিসেবে যোগ হয় বসের গুরুগম্ভীর তিরস্কার। তারপরও ঘুমকে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হচ্ছে না। অনেক চেষ্টা করেও ঘুমকে নিজের কব্জায় আনতে পারছি না। ঘুমকে আমার কাছে বাংলাদেশের যেকোন সময়ে সরকারী দলের ছাত্র সংগঠনের মত মনে হয়। ঘুমের বেপরোয়া আচরণে নিজের দৈনন্দিন জীবন দুর্বিষহ মনে হয়।

নিয়ন্ত্রণহীন ঘুমকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য নিজেকেই নিয়ন্ত্রিত হতে হয়। আড্ডা থেকে তাড়াতাড়ি বাসায় ফেরা, চটজলদি রাতের খাবার খেয়ে শরীরটাকে বিছানায় সমর্পণ করা, টিভির রিমোর্ট যথা সম্ভব দূরে রেখে ঘুমের জন্য আবহ তৈরি করা, প্রচন্ড বিরক্তি নিয়ে এইসব স্বভাববিরুদ্ধ কাজ করতে হয় । স্বৈরাচারী ঘুম তারপরও টলতে চায়না, নিজের স্বৈরতান্ত্রিক মনোভাবটা চোখের পাতায় জাগিয়ে রাখে। আমিও একদফা এক দাবীতে বিছানায় অনড় থাকি। ঘুমের জন্য নিজের ইচ্ছে গুলোকে হরতালের ফাঁদে আটকে রেখে মনের ভেতর পিকেটিং করি। ঘুম তোমাকে আসতেই হবে মনে মনে এই ধরনের শ্লোগানও দেই। আমার আপষহীন মনোভাবের কারণে ঘুমের আচরণে পরিবর্তন আসে। চতুর ঘুম আবদ্ধ চোখের পাতায় আটকা পড়ে। দূরন্ত আর দস্যিপনা ছেড়ে দিয়ে ঘুম পোষ মানতে বাধ্য হয়।

নিজের আচরণের বিরুদ্ধে নিজে সংগ্রাম, আন্দোলন আর হরতাল করে ঘুমকে নিয়ন্ত্রণে এনে শান্তিতেই রাত্রিযাপন করতেছিলাম। হঠাৎ একদিন আমার নিয়ন্ত্রিত ঘুমকে অপহরন করে নিলো একটা মোবাইল কল। যেমন করে প্রতিনিয়ত আমাদের গণতন্ত্রকে অপহরণ করে দূর্নীতি। আমি সাধারণতঃ সাবধানতা অবলম্বন করেই ঘুমানোর চেষ্টা করি। মানে মোবাইলের গলা চেপে ধরে রাখি, মোবাইলের বাক স্বাধীনতা স্তব্ধ করে দেই। সেদিন আমি একটু বেশি স্বাধীনতা প্রিয় ও বাকস্বাধীনতার স্বপক্ষের বনে গিয়েছিলাম। মোবাইলকে কথা বলার অবাধ স্বাধীনতা দিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। আমি আবার কুম্ভকর্ণ প্রকৃতির লোক না। যৎসামান্য শব্দ দূশণে আমার ঘুমের বারোটা বাজে। সেদিন রাত দুইটায় মোবাইলের অনাকাঙ্ক্ষিত ক্রন্দন আমার কর্ণ কুহরে পৌছা মাত্র লাফিয়ে উঠি। হুড়াহুড়ি করে মোবাইলকে হাতের মুঠোয় নিতেই ক্রন্দন বন্ধ হয়ে যায়। ঢুলুঢুলু চোখে নম্বরটা চেনার চেষ্টা করি, কিন্তু শান্ত শীতল মস্তিষ্কও নম্বরটি চিনে বলে সনদপত্র দিতে পারে না। আমি দুষ্টলোকের উৎপাত ভেবে আবার ঘুমানোর চেষ্টা করি, কিন্তু ততক্ষণে ঘুমের তেরোটা বেজে গেছে। ঘুম বেটা সুযোগ পেয়ে আবার স্বৈরাচারী হয়ে উঠে। আমিও মনে মনে ঘুমের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করি, কিন্তু আমার দূর্বল আন্দোলের কাছে ঘুমের জয় হয়। আমি নিরুপায় হয়ে সিলিং ফ্যানের দিকে চেয়ে থাকি। ডিম লাইটের ঝাপসা আলোতে সিলিং ফ্যানের ঘূর্ণায়মান পাখা গুলো একটা বৃত্ত তৈরি করে, আমি সেই বৃত্তে আবর্তিত হতে থাকে।

বেশ কিছুক্ষণ পার হয়ে যায়, আমার ঘুম আর আসে না। মেজাজটা খিটমিটে হয়ে যায়। এপাশ ওপাশ করেও স্বস্তি পাচ্ছিলাম না। শেষে মোবাইলটা হাতে তুলে নিলাম। মিসড্ কল তালিকা থেকে নম্বরটা বের করে ডায়াল করলাম। প্রথম রিংয়েই ফোন রিসিভ হলো। আমি মনে মনে একটু হোচট খেলাম। ভাবলাম আমার ফোনের জন্যই মনে হয় জেগেছিলো। মোলায়েম কন্ঠস্বরে আমার রাগ কিছুটা স্থমিত হলো। আমি ভদ্র ভাবে ও শালীনতা বজায় রেখে তার পরিচয় জানতে চাইলাম। অপর প্রান্তের মোলায়েম মধুর কন্ঠস্বরটা মিনমিনে হয়ে আসলো। সিলিং ফ্যানের শোঁ শোঁ শব্দটাও তার কন্ঠস্বরের চেয়ে বেশি স্পষ্ট মনে হলো। আমি আবার জানতে চাইলাম "কে বলছেন?" এবার কন্ঠস্বরটা একটু স্পষ্ট হয়, কিছুটা সাবলীলও মনে হলো। সে আন্তরিক দুঃখ প্রকাশ করলো।

আমি চরিত্রগত ভাবে খুব একটা সাধু নই, কিছুটা লুলু প্রজাতির বললে ভুল বা অতিরঞ্জিত বলা হবে না। মেয়ে মানুষের কন্ঠস্বরে আমি বিরক্তির বদলে পুলকিত হয়েছিলাম। কথা বলার পায়তারা খুঁজতেছিলাম। জানতে চাইলাম আমার নম্বরটা সে কী করে পেলো? সে কেমন বা কি প্রকৃতির ললনা তা আমার জানার কথা না বা আমার জানার ক্ষেত্রসীমায় পড়ে না। অপরিচিত একজন মানুষ সম্পর্কে মন্তব্য করাটাও আমার কাছে শালীনতা বিবর্জিত মনে হয়েছিলো। তবে তার চটুল প্রতিক্রিয়া আর কথপোকথনে আমার কাছে নম্র ও ভদ্র মনে হলো, তবে সন্দেহ প্রবণ মনে সন্দেহ থেকেই গেলো। সে আমার প্রশ্নের উত্তরে বলল-"আমার এক বান্ধবীকে কল করতে গিয়ে একটা ডিজিট পরিবর্তন হয়ে আপনার কাছে চলে গেছে। আপনার ঘুমের ব্যাঘাত সৃষ্টি করার জন্য দুঃখিত। প্লিজ কিছু মনে করবেন না। " মনে মনে বললাম কোন ভালো মেয়ে এতো রাতে কি কাউকে ফোন করে? আমি আবার কথা বাড়ানোর ধান্ধা করছিলাম। মেয়েটির কথা শুনার ফাঁকে পরবর্তী কথাটা খুঁজে বেড়ালাম। কথা শেষ হতে হতেই আমার কথা প্রস্তুত হয়ে গেলো। আমিও কিছুটা বিনয়ের সাথে মিনতি করে বললাম-"ভুল করে ঘুম ভেঙেছেন, এখন ঘুম পারায় দেন।" কথাটা শুনে মেয়েটির চেহারা কেমন হয়েছিলো এপাশ থেকে বুঝা না গেলেও কথাটা যে তাঁর মনপুতঃ হয়নি সেটা নীরবতা থেকেই বুঝা গেলো। আমার এহেন অনভিপ্রেত প্রস্তাবে মেয়েটি নিশ্চুপ হয়ে গেলো। বুঝতে পারলাম কথাটা ঠিক শোভনীয় হয়নি। আমি পরিবেশটা স্বাভাবিক করার জন্য বললাম-"ঠিক আছে ঘুম পারায় দিতে হবে না, অন্য একটি কাজ করুন।" মেয়েটি চটপট এবং কোন প্রকার জরতা না রেখে বলল-"বলুন কী করতে পারি?" আমি মওকা পেয়ে গেছি ভেবে আনন্দে লাফিয়ে উঠেছিলাম। বিছানায় উঠে বসলাম। মোবাইলটা কান পরিবর্তন করে বললাম-" আমার ঘুম না আসা পর্যন্ত গল্প করুন।" মেয়েটি কোন রকমের বনিতা না করে সোজা সাপটা মুখের উপর বলে দিলো-"সরি কাল সকাল দশটায় আমার একটা গরুত্বপূর্ণ ক্লাস আছে, ইচ্ছে থাকলেও উপায় নাই। অনাকাঙ্ক্ষিত যন্ত্রণা দেবার জন্য আমি খুবই দুঃখিত এবং ক্ষমাপ্রার্থী।"

আমি রাতের চেয়েও বেশি নীরব হয়ে গেলাম। কন্ঠস্বর থেমে গেলো। আশাহত হয়ে আবার বিছানায় চিৎপটাং হয়ে পড়লাম। কথা বলার দূরন্ত স্রোতটা অনাকাঙ্ক্ষিত নিষ্ঠুর বাঁধে বাঁধা পড়ল । পুশ ব্যাক হয়ে নিজস্ব পৃথিবীতে ফিরে এলাম। কিছু একটা বলবো এমন সময় মেয়েটা আবার বলল-"একটা অনুরোধ করবো, রাখবেন?" আমি ভাবলাম এই বুঝি আবার সুযোগ ফিরে এলো, অনুগত প্রিয়মানুষের মত বললাম-"অবশ্যই, বলুন কি করতে হবে?" আমি আনন্দে উদ্বেলিত, প্রত্যাশিত শুভ সংবাদে উচ্ছ্বিত, মেয়েটির কথা শুনার জন্য কান খাড়া করলাম। মেয়েটি তার স্বভাব সুলভ স্বাভাবিক সাবলীল ভাষায় বলল-"আমি খুব খুশী হবো যদি আপনি এই নাম্বারে কোন দিন ফোন না করেন। এবং আমার বিশ্বাস আপনি তা করবেন না। ভালো থাকবেন, সুস্থ থাকবেন। শুভরাত্রি।" হুট করেই ফোনটা কেটে দিলো, আমাকে কিছু বলার সুযোগ দিলো না। মেয়েটি মুখের উপর ফোন রেখে দেয়ার আচরণে অভদ্র এবং অসামাজিক মনে হলো, মনে মনে কয়েকটা খারাপ বাক্য বাতাসে উড়িয়ে দিলাম। তারপর স্বপ্ন ভঙ্গের বেদনা নিয়ে ঘুমানোর জন্য যুদ্ধ শুরু করলাম। কখন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম জানি না। সকালে যখন ঘুম ভাঙে তখন দেখি আমার মোবাইল ফোনে তার পাঠানো শর্ট মেসেজ-"চাইলে ফোন দিতে পারেন।"
===========


মন্তব্য

এস এম মাহবুব মুর্শেদ এর ছবি

প্রচুর বানান ভুল। নিজে প্রায়ই ভুল বানান লিখি। তবু অন্যের ভুল বানান দেখলে মনে চটকানা খাচ্ছি। ঠিক করে নিয়েন প্লিজ।

এমনিতে গল্পটা মজার।

====
চিত্ত থাকুক সমুন্নত, উচ্চ থাকুক শির

অতিথি লেখক এর ছবি

মুর্শেদ ভাই, ধন্যবাদ পড়ার জন্য। বানান ভুলের অপবাদ থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য চেষ্টা করে যাচ্ছি, কিন্তু পারছি বলে মনে হচ্ছে না। এই অপবাদের কারণে অনেকদিন সচলায়তন থেকে দূরে ছিলাম। এটা হয়তো আমার অপরাগতা বা জ্ঞানের সীমাবদ্ধতা। কিছু জিনিস হয়তো আমার জানার ভুল, কিছু হয়তো আমার অজানা। চেষ্টা করছি এবং আরো চেষ্টা করবো শুদ্ধ বানানে লেখা দেবার। আপনাকে আরেকবার গল্পটাকে ভালো বলার জন্য।

===========
ডি, এম, কামরুজ্জামান স্বাধীন।

ধুসর গোধূলি এর ছবি
guest writer এর ছবি

ভাল লেগেছে। হো হো হো তবে মেয়েদের মোবাইলে যখন তখন কল করা ঠিক না।

স্পর্শ এর ছবি

দারুণ লেগেছে লেখাটা!
সেই প্রথম ভুল নাম্বার থেকে নারী কন্ঠের ফোনের কথা মনে করিয়ে দিলেন! চলুক
সবারই মনে হয় বলার মত গল্প আছে এরকম!

লেখার উন্নতি হচ্ছে। চলুক


ইচ্ছার আগুনে জ্বলছি...


ইচ্ছার আগুনে জ্বলছি...

বাউলিয়ানা এর ছবি

ভাই লুলু প্রজাতির ব্যাপারটা আসলে কী?

দুষ্ট বালিকা এর ছবি

বেশ খানিকটা গুরুচন্ডালী দোষাবৃত হয়ে গেলোনা? ইয়ে, মানে...

-----------------------------------------------------------------------------------
...সময়ের ধাওয়া করা ফেরারীর হাত থিকা যেহেতু রক্ষা পামুনা, তাইলে চলো ধাওয়া কইরা উল্টা তারেই দৌড়ের উপরে রাখি...

**************************************************
“মসজিদ ভাঙলে আল্লার কিছু যায় আসে না, মন্দির ভাঙলে ভগবানের কিছু যায়-আসে না; যায়-আসে শুধু ধর্মান্ধদের। ওরাই মসজিদ ভাঙে, মন্দির ভাঙে।

মসজিদ তোলা আর ভাঙার নাম রাজনীতি, মন্দির ভাঙা আর তোলার নাম রাজনীতি।

অতিথি লেখক এর ছবি

যা ঘটেছিলো তাই লিখার চেষ্টা করেছি, গুরুচন্ডালী হলে কি করার। পড়ার জন্য ধন্যবাদ।

কামরুজ্জামান স্বাধীন।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।