বিদ্যুৎ বিভাগের কাছে আমরা যারা প্রান্তিক

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: বিষ্যুদ, ০৮/০৭/২০১০ - ৭:০৪অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

গ্রামের বাড়িতে গেলে বাপ-চাচারা চিন্তায় পড়েন- লোডশেডিঙের কষ্ট সইতে পারবো কিনা! সন্ধ্যে ছয়টা থেকে রাত এগারটা পর্যন্ত বিদ্যুৎ তো থাকেই না, বরং গভীর রাতে শুরু হয় বিদ্যুতের আসা-যাওয়ার মান-অভিমান খেলা। আমরা হেসে ফেলি- ‘কিচ্ছু হবে না। ওসবে আমাদের অভ্যাস আছে।‘ বাপ-চাচারা বিশ্বাস করতে চান না- ‘ঢাহায় আবার কারেন্ট যায় নাহি?’

বিদ্যুৎ বিভাগের কাছে মফস্বল শহরগুলোই প্রান্তিক; গ্রাম তো সেখানে আরেকটু দূরের পথ। রাজধানী আলোকিত না করে সারা দেশকে আলোকিত করার কোনো মানেই হয় না। রাজধানীতে থাকেন নীতিনির্ধারকেরা, চিন্তুকেরা, বড় বড় মানুষেরা, বড়লোকেরা। যতোটুকু বিদ্যুতই উৎপাদিত হোক না কেন, শহুরে জীবনের এসি/ফ্যান/ঝলমল আলোকবাতি বাদ দিয়ে গ্রামে বিদ্যুৎ দেওয়াটা তাই বিলাসিতার পর্যায়েই পড়ার কথা। বাপ-চাচারা তাই ভাবেন- আহা! ছেলেমেয়েরা ঢাকায় কতোই না এসি/ফ্যান/বিজলি বাতির চমকে থাকে! গ্রামের লোডশেডিং কি তাদের সহ্য হবে?

বাপ-চাচারা বিশ্বাস করেন না, এই শহুরে ঢাকায়ও দুটো শ্রেণী থাকে। একটি শ্রেণী তুলনামূলকভাবে বেশি বিদ্যুৎ পায়, আরেকটি শ্রেণীর বিদ্যুৎ নিয়ে বিদ্যুৎ বিভাগ চাইলেই একটু মশকরা করতে পারে। আজকের ঢাকা শহরও ধনীলোকের, বড়লোকের এলাকা আর সাধারণ মানুষের এলাকায় বিভক্ত। ধানমন্ডি, মিন্টু রোড, বেইলি রোড, পরীবাগ, বারিধারা, মতিঝিল, গুলশান ইত্যাদি এলাকায় বড়লোকদের বাস। শেওড়াপাড়া, বাসাবো, খিলগাঁও, আজিমপুর, নদ্দা- এগুলোতে থাকে সাধারণ মানুষেরা। বিদ্যুৎ বিভাগ দায়িত্বের প্রতি সদা সতর্ক- কতো কমে লোডশেডিং করা যায় বড়লোকের এলাকাগুলোয়। আর বাকি এলাকাগুলো? এগুলো সময় সময় বিদ্যুৎ বিভাগের দয়ার প্রমাণ পায়।

একটা সময় পরীবাগে থাকতাম- তখন বিদ্যুৎ যাওয়া মানে ছিল বিনোদন। সপ্তাহে এক-দুবার বিদ্যুৎ গেলে চাঁদের আলোয় নগর দেখা বা অমাবস্যার অন্ধকারে শহুরে জীবন অনুভব করার বিনোদন তো কম কিছু না! শুনে সাধারণ লোকেদের এলাকায় বসবাস করা বন্ধুরা হিংসা করত। ওদের হিংসা অমূলত মনে হতো- পরীবাগে একবারও বিদ্যুৎ যাবে না, কিন্তু ওসব এলাকায় যাবে কেন? আর এখন! থাকি বাসাবোতে? বিদ্যুৎ এখন বিনোদনের পরিবর্তে বিড়ম্বনা। তাই বিদ্যুৎ গেলেই বড়লোকদের এলাকায় বসবাসরত বন্ধুবান্ধবদের ফোন দিয়ে জেনে নিই ওদের বিদ্যুতের অবস্থা। জানি, বিদ্যুৎ ঘাটতি আছে। কিন্তু তাই বলে এক এলাকায় সারা দিনে দুবার বিদ্যুৎ যাবে, আরেক এলাকায় দশ-বারোবারের কম হবে না এবং তাও প্রতিবার এক ঘণ্টার বেশি সময় ধরে- এই বৈষম্য কেন বুঝতে পারি না। তবে কি আমরা বিদ্যুৎ বিল কম দিই? না তো! বিল চেক করে দেখি ইউনিট প্রতি খরচ তো সমানই, বিলও সমান। তাহলে? বিশ্বকাপে খেলার মাঝেও দুবার ইলেকট্রিসিটি যায় আজকের বাসাবো, নদ্দা, খিলগাঁওতে। এই এলাকার মানুষগুলো কয়টি খেলা নিরবিচ্ছন্নভাবে দেখতে পেরেছে আর বড়লোকদের এলাকার মানুষ কয়টি দেখেছে? হিসাব করলে বঞ্চনার গ্লানি মনে জমা হবে। থাক না হয়!

পত্রিকায় এটা নিয়ে রিপোর্ট দেখি না। জানি, রিপোর্ট হলেও বিদ্যুত বিভাগের কর্মকর্তারা স্বীকার করবেন না। কিন্তু আমাদের তো পোকামাকড়ের জীবন! থাকতে হয় কোনোমতে আবদ্ধ চারটি ইটের দেয়ালের ভেতর, বাড়িওয়ালার অনাগ্রহে যেখানে বাতাস ঢোকে না কিন্তু মশার সঙ্গীত সহজলভ্য। পরবর্তী জীবনে যাতে এসি পাই সেজন্য সোয়াব অর্জনের চেষ্টায় থাকি, সুতরাং একটা ফ্যান যে আমাদের কাছে কতোটা গুরুত্বপূর্ণ- বিদ্যুত বিভাগের কর্মকর্তারা এটা বুঝলে তো সপ্তাহে অন্তত একটা রাত, আবারও বলি, অন্তত একটা রাত শান্তিতে ঘুমাতে পারি।

বিদ্যুত নিয়ে প্রান্তিক মানুষের ভাবনা জানতে এখন আর গ্রামে না গেলেও চলে। কোনো গবেষক, কোনো বুদ্ধিজীবি, কোনো লেখক যদি জানতে চান, তাহলে চলে আসুন এই সাধারণ লোকেদের এলাকায়। থেকে যান একটা দিন। আদরযত্নের কমতি হবে না, শুধু ওই ইলেকট্রিকের আলো আর বাতাসটা ছাড়া। আর যদি আসতে চান বিদ্যুৎ বিভাগের কোনো কর্মকর্তা- প্লিজ দয়া করে তারিখটা জানাবেন। আমরা আমাদের সব কর্মকাণ্ড বাদ দিয়ে আপনাকে স্বাগত জানাবো। আপনি আসা উপলক্ষ্যে যদি কয়েকটা ঘণ্টা বিদ্যুত থাকে!

কবে বিদ্যুতের এই অত্যাচার থেকে মুক্তি পাবো তা জানতে চাই না, তবে দয়া করে যদি সাধারণ মানুষের এলাকায় প্রতিদিন একটি নির্দিষ্ট সময় লোডশেডিং করেন, তাহলে নিজেদের জীবনযাত্রা সেভাবেই বদলে ফেলব। বিদ্যুত বিভাগের কাছে ঢাকা শহরে প্রান্তিক মানুষদের এই চাওয়া কি বেশি হয়ে যায়?

আসিফ আহমেদ


মন্তব্য

ফরিদ এর ছবি

পরীবাগ ছেড়েছেন বহুদিন মনে হয়। পরীবাগের পাওয়ার হৌসের পাশেই থাকি। গরমের আটমাস দিব্যি আলো আঁধারীর বাইনারীর মধ্যে দিনরাত কাটাই।

সিরাত এর ছবি

এক মাস ট্র্যাকিং করুন। তারপর প্রমানসহ এ্যাটাক করুন।

অতিথি লেখক এর ছবি

বাঙ্গালী মাত্রই এই ঘটনার সাথে পরিচিত। আমার মনে হয় কোন সমাধান আসবে না যতদিন না আমাদের ভাইরা কোন এক আশ্চর্য (না হোক সাধারণ মানের হলেও চলবে) আবিস্কার না আবিস্কার করছে। এ্যাটক করলে লাভবান হব এ আশা ছেড়েছি অনেক আগে। লেখাটা পড়ে এতটুকু মিথ্যা মনে হয়নি।

শাফি।

কৌস্তুভ এর ছবি

অসাম্য এই দুনিয়ায় কোথায় নেই ভাই? যেগুলোকে আমাদের প্রাথমিক অধিকার বলে ভাবি সেগুলোও যে আসলে কিছু প্রিভিলেজ মাত্র, এই ঘটনাগুলো সেটা স্পষ্ট করে দেখিয়ে দেয়। অন্যের মেজাজমর্জির উপর নির্ভর করেই এই নগন্য জীবনটা টেনে যেতে হয়...

অতিথি লেখক এর ছবি

কিছু করার নাই ভাই। আপনি তো দুইটি সুদুর এলাকার কথা বল্লেন। আমি কাছাকাছি ২ টা এলাকার কথা বলি। যাত্রাবাড়ী এলাকার পাশে ২ টা এলাকা। পশ্চিম আর পূর্ব হিসেবে ভাগ করা। পশ্চিম পাশে মহান কমিশনার থাকেন, সেখানে অন্তত ছুটির দিনে লোডশেড করা হয় না। আর পূর্ব পাশে শীতের দিনেও ৪ বার যায়। কাজলা তে দিনে যায় ৪ বার, আর কাজলার পাশের এলাকা দনিয়া শনির আখরা তে যায় ৭ থেকে ৮ বার।

ভোলামন।

গৌতম এর ছবি

একমত।

.............................................
আজকে ভোরের আলোয় উজ্জ্বল
এই জীবনের পদ্মপাতার জল - জীবনানন্দ দাশ

শিক্ষাবিষয়ক সাইট ::: ফেসবুক

.............................................
আজকে ভোরের আলোয় উজ্জ্বল
এই জীবনের পদ্মপাতার জল - জীবনানন্দ দাশ

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।