দ্য পিকচার অব ডোরিয়ান গ্রে | নিন, প্রথম ৫ পর্ব একসাথে পড়ুন, সাথে নতুন ১ পর্ব |

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: শুক্র, ০৯/০৭/২০১০ - ৮:২৩অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

তার সম্পর্কে আশ্চর্য সব গল্প লন্ডনজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে। সে দেখতে এখনও পবিত্র, কিন্তু আসলেই কি তাই?

সে তার প্রতিটি মর্জি, প্রতিটি বাতিক, প্রতিটি চাহিদা পূরণ করে। সব ইন্দ্রিয়ের গভীর রহস্য সে উন্মোচন করে। অসৎ চরিত্র নিয়ে, সে ধ্বংস ও রোমাঞ্চের উন্মত্ত ক্ষুধা মিটিয়ে চলে!

কিন্তু তার সব সম্পদ, সব সঞ্চয়—পলায়নের উপায় মাত্র। যেখানে তার শৈশব কেটেছে—সেই নিঃসঙ্গ, তালাবদ্ধ ঘরটার দেয়ালে আঁটা তার গন্তব্য। ভয়ংকর ছবিটা সে ঝুলিয়ে রেখেছে সেখানে, যার ধারাবাহিক বিবর্তন প্রকাশ করছে তার নৈতিক অধঃপতনকে। দৃষ্টি থেকে আড়ালে রাখতে, সে যবনিকা টেনে রেখেছে সেটার ওপর।

তার কাছে, পঙ্কিলতাই এখন সুন্দর!

একসময়ের নিষ্পাপ এই ছেলেটার এ কী হলো? শুধুমাত্র ডোরিয়ান গ্রে জানে এর উত্তর। লর্ড হেনরির বই তাকে দূষিত করে ফেলেছে!

***
প্রথম ৫ পর্ব আগে পড়া থাকলেও ক্ষতি নেই, আবার পড়ুন। কিছুটা ঘষামাজা করে আবার আপালাম। সাথে নতুন একটি পর্ব বাগদান নিয়ে আলোচনা। হাসি

***

পর্ব ১ : নিয়তি-নির্ধারিত বৈঠক

বাসিল হলওয়ার্ডের লন্ডন স্টুডিও। গোলাপের গন্ধে ম ম করছে চারপাশ। বাগানের গাছগুলো গ্রীষ্মের মৃদুমন্দ বাতাসে নড়ে উঠছে। লিলি ফুলের তীব্র গন্ধ খোলা দরজা দিয়ে এসে ঘরে ঢুকল। বাসিল একজন চিত্রশিল্পী তাই সুন্দরকে ঘিরে থাকতে ভালোবাসেন।

একটা ছবি আঁকার কাজ চলছে ক-দিন ধরে। কাজটা বেশ গুরুত্বপূর্ণ। বাসিল তাঁর বন্ধু লর্ড হেনরি অটনকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন ছবিটা দেখার জন্য। হেনরি নিজেও একজন সৌন্দর্যের পূজারি, তাঁর বন্ধুর মতোই। আমন্ত্রণ পেয়ে আর দেরি করেননি। চলে এসেছেন।

ছবিটা একজন বিশ বছর বয়সী যুবকের। তার নাম ডোরিয়ান গ্রে। ছবি দেখেই বোঝা যাচ্ছে সে কত বেশি সুন্দর। লর্ড হেনরি রীতিমতো অভিভূত হয়ে পড়ছিলেন। বাসিলের প্রতিভা দেখে সন্তুষ্ট, তাই কর্কশ মুখেও হাসির ছাপ ফুটে উঠল।

'এটা তোমার সেরা কাজ, বাসিল। হ্যাঁ, যা কাজ করেছ এ পর্যন্ত, সবগুলোর মধ্যে এটাই সেরা!' লর্ড হেনরি উত্তেজিত স্বরে বললেন, 'তুমি অবশ্যই এটা অ্যাকাডেমিতে পাঠাবে।'

ছবিটায় একটা মায়াময় মূর্তি ধরা পড়েছে। সেদিকে তাকিয়ে বাসিলের মুখ থেকে হাসি মুছে গেল। চোখ বন্ধ করে ফেললেন তিনি, কী যেন গভীরভাবে চিন্তা করছেন।

অনেকক্ষণ পর বাসিল কথা বলে উঠলেন, 'কোথাও ছবিটা পাঠানোর কথা ভাবছি না। উঁহু...' মাথা নেড়ে ভ্রুকুটি করলেন তিনি।

'কোথাও পাঠাবে না?' লর্ড হেনরি প্রশ্ন করলেন, 'কী কারণে, জানতে পারি? সত্যি কী অদ্ভুত হও তোমরা, এই শিল্পীরা! এ পৃথিবীতে এমন কোনো কাজ নেই যা তোমরা নামের জন্যে কর না। এখন তোমার হাতে একটা সুযোগ এসেছে। আর তুমি চাইছ তা ছুড়ে ফেলে দিতে! এমন একটা ছবি তোমাকে বিখ্যাত করে তুলতে পারে।' যোগ করলেন তিনি, আশা করছেন বন্ধুকে প্রভাবিত করতে পারবেন।

'আমি জানি তুমি হাসবে, হ্যারি। কিন্তু অমি পারব না। ছবিটায় আমি নিজেকে দেখতে পাই। ওটা খুব বেশি আমার মতো!' বাসিল বললেন।

'কিন্তু, বাসিল,' লর্ড হনরি হাসলেন, ভ্রু জোড়া ওপরে তুলে বিস্ময় নিয়ে তাকালেন তাঁর বন্ধুর দিকে, 'আমি তো কোনো মিল দেখতে পাচ্ছি না। তোমার চুল কালো আর চেহারা রুক্ষ। অথচ দেখো, এ তরুণটির কী সুন্দর সোনালি চুল! কী চমৎকার গায়ের রং! আমি তো কোনো মিল দেখতে পাচ্ছি না। আসলে তুমি যে এত অহংকারী! তা, আগে আমার কখনোই মনে হয়নি, বাসিল। কিন্তু এ সত্য নয়। মিছেই তোমার আত্মতৃপ্তি! তুমি মোটেও ডোরিয়ান গ্রের মতো দেখতে নও।'

'তুমি আমাকে বুঝতে পারনি, হ্যারি।' বাসিল দীর্ঘশ্বাস ফেললেন, 'অবশ্যই আমি তার মতো দেখতে নই। তেমনটি হলে আমি দুঃখিতই হতাম। এ ধরনের শারীরিক সৌন্দর্যের রয়েছে ধ্বংসাত্মক গুণ! আমি মনে করি অন্যদের চেয়ে খুব ব্যতিক্রম না হওয়াটাই ভালো।'

'বাসিল, আমি সত্যিই অবাক হয়েছি। ডোরিয়ান গ্রের সাথে তোমার কীভাবে সাক্ষাৎ হলো?' লর্ড হেনরি জানতে চাইলেন।

'লেডি ব্র্যান্ডন-এর একটা পার্টিতে গিয়েছিলাম। তুমি তো জানো, আমরা, দরিদ্র শিল্পীরা, সোসাইটিতে বারবার মুখ দেখাই শুধু আমজনতাকে এটা মনে করিয়ে দিতে যে আমরাও অসভ্য নই।'

বাসিল হাসলেন। তারপর তিনি বলে চললেন, 'দশ মিনিট যেতে না-যেতে ডোরিয়ান গ্রের সাক্ষাৎ পেলাম। লেডি ব্র্যান্ডন আমাদের পরিচয় করিয়ে দিলেন। শুনতে হাস্যকর লাগতে পারে, কিন্তু পরিচয় হওয়ার পর মুহূর্ত থেকে আমি তাকে মোহিনী ব্যক্তিত্ব হিসেবে আবিষ্কার করলাম। আমি তাকে দেখে একটা আশ্চর্য অনুভূতি বহন করছিলাম। আমি জানতাম সে একটা ফল বয়ে আনবে আমার চিত্রকর্মের জন্যে।'

ধন্যবাদ দিতে হয় ডোরিয়ান গ্রে-কে, বাসিল জেদ ধরায় সে রাজি হয়। এখন বাসিলের সর্বশ্রেষ্ঠ কীর্তি হয়ে দাঁড়িয়েছে এ ছবিটি। বলতেই হয় ডোরিয়ানের ব্যক্তিত্বগুণে শিল্পের সম্পূর্ণ নতুন এক উৎকর্ষে পরিণত হয়েছে তা। 'যদিও আমি নিশ্চিত ডোরিয়ান গ্রে-কে তার সুন্দর আকৃতির জন্যে ভুগতে হবে।' বাসিল যোগ করলেন।

লর্ড হেনরি খুবই অবাক হচ্ছিলেন। এই রহস্যময় তরুণটি সম্পর্কে আরও জানার জন্য তাঁর দারুণ আগ্রহ তৈরি হলো। তিনি ডোরিয়ান গ্রে-কে দেখতে চাচ্ছিলেন। তবে লর্ড হেনরির এই আগ্রহ সত্ত্বেও বাসিল চাচ্ছিলেন না তাঁর সাথে ডোরিয়ানের পরিচয় হোক। এই সময় বাটলার ঘোষণা করল, 'মি. ডোরিয়ান গ্রে আপনার সাক্ষাৎপ্রার্থী, স্যার!'

অত্যন্ত গুরুগম্ভীর মুখের ভাব নিয়ে বাসিল চকিতে তাকালেন লর্ড হেনরির দিকে। 'ডোরিয়ান গ্রে আমার প্রিয়তম বন্ধুতে পরিণত হয়েছে, হ্যারি।' তিনি বললেন, 'তাকে প্রভাবিত বা নষ্ট করার চেষ্টা করবে না। তোমার প্রভাব তার জন্যে শুভ হবে না।'

শুধু যদি লর্ড হেনরি তাঁর উপদেশ গ্রহণ করতেন!

বাটলার ডোরিয়ান গ্রে-কে ঘরের ভেতরে নিয়ে এল।

সে যুবকটি তৎক্ষনাৎ পিয়ানোর সামনে বসে মোজার্টের একটা স্বরলিপির পৃষ্ঠা উলটাতে লাগল। বাসিল এবং লর্ড হেনরি উভয়েই মুগ্ধ দৃষ্টিতে দেখছিলেন তাকে। সে নিশ্চিতভাবেই অতি সুদর্শন, তার চোখ ঘন নীল আর চুল সোনালি রঙের। তারুণ্য আর বিশুদ্ধতার একটি সূক্ষ্ম প্রভা যেন তাকে ঘিরে রেখেছে।

কিন্তু বাসিল চিন্তিত হয়ে পড়েছেন। তাঁর ধারণা লর্ড হেনরি ডোরিয়ানকে দূষিত করতে চাইবেন।

'তুমি আমাকে অবশ্যই স্বরলিপির এই পাতাটা ধার দেবে, বাসিল। আমি এটা শিখতে চাই। এটা খুব সুন্দর।' ডোরিয়ান ঘোষণা করল।

'সেটা নির্ভর করবে কীভাবে তুমি আজ আমার জন্যে বস তার ওপর, ডোরিয়ান।' বাসিল উত্তর দিলেন।

'ওহ্! আমি বসার ব্যাপারে ক্লান্ত হয়ে পড়েছি আর আমি জানি না সত্যিই আমি আমার আত্ম-প্রতিকৃতিটি চাই কি না।' জেদের সাথে পিয়ানোটার চারপাশে ঘুরতে ঘুরতে ডোরিয়ান জবাব দিল। এতক্ষণে লর্ড হেনরির ওপর দৃষ্টি পড়ল তার। সাথে সাথে থেমে গেল সে। 'তোমার কাছে ক্ষমা চাই, বাসিল। আমি বুঝতে পারিনি তোমার একজন সঙ্গী রয়েছেন।'

'ডোরিয়ান, ইনি লর্ড হেনরি অটন, আমার পুরোনো অক্সফোর্ড-বন্ধু। সাবজেক্ট হিসেবে কী অসাধারণ তুমি, তা তাকে মাত্রই বলছিলাম।' বাসিল বললেন।

'আপনার সাথে মিলিত হয়ে প্রীত হলাম, মি গ্রে,' লর্ড হেনরি বললেন। এগিয়ে এসে হাত বাড়িয়ে দিলেন ডোরিয়ান গ্রের দিকে, 'আমার আন্টি প্রায়ই আপনার কথা বলেন। আপনি তাঁর প্রিয় ব্যক্তিদের একজন।'

'আমি এ মুহূর্তে লেডি আগাথার মন্দ-তালিকায় আছি।' ডোরিয়ান উত্তর দিল। 'গত মঙ্গলবার তাঁর সাথে হোয়াইট চ্যাপেলের একটি ক্লাবে যাওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম। তারপর যথার্থই সেটি সম্পূর্ণ ভুলে বসি। আমাদের দু জনের একসাথে একটি দ্বৈতসংগীত করার কথা ছিল সেখানে।'

'আমি আমার আন্টিকে শান্ত করব। তিনি আপনাকে খুব পছন্দ করেন।' লর্ড হেনরি তাকালেন ডোরিয়ানের দিকে। তার সুঠাম, সুন্দর অবয়ব আরেকবার মুগ্ধ করল তাঁকে। বাইরের কালিমা থেকে যেন সে অদ্ভুতভাবে মুক্ত। সত্যি, ডোরিয়ান গ্রে-কে দেখে ভালো আর বিশুদ্ধতার প্রতীক বলে মনে হয়।

সেই মুহূর্তে লর্ড হেনরি বাসিলের সাবধানবাণীকে গুরুত্ব না দেয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। যদিও বাসিল লর্ড হেনরির কলঙ্কজনক খ্যাতি সম্পর্কে ডোরিয়ানকে সাবধান করেছেন, ডোরিয়ানও তা অস্বীকার করল।

লর্ড হেনরির কথাগুলো তরুণ ডোরিয়ানের মনে এক সুগভীর ছাপ ফেলল। সে উত্তেজনার সাথে শুনতে লাগল, যখন লর্ড হেনরি তাঁর সৌন্দর্যের তত্ত্ব ব্যাখ্যা করতে শুরু করলেন।

'আমার কাছে সৌন্দর্য হলো বিস্ময়ের বিস্ময়! স্বল্পবুদ্ধির লোকেরাই শুধু বাহ্য আড়ম্বরের গুরুত্ব বোঝে না।' লর্ড হেনরি দাঁত বের করে হাসলেন। তিনি তাকালেন যুবকটির দিকে। 'ডোরিয়ান, ঈশ্বর তোমার প্রতি সদয় আছেন। কিন্তু ঈশ্বর যা দেন তা খুবই ক্ষণস্থায়ী। তোমার এই বেঁচে থাকা অল্প কয়েক বছরের জন্যে। তারপর তোমার যৌবন চলে যাবে, সৌন্দর্যও চলে যাবে সেই সাথে। তখন তুমি আবিষ্কার করবে—তোমার জন্যে সুখী হওয়ার মতো আর কিছুই বাকি নেই।'

এই বক্তৃতায় ডোরিয়ানের ভ্রু কুঁচকে যাচ্ছিল। কিন্তু আরও কিছু অপেক্ষা করছিল তার জন্য!

***

পর্ব ২ ॥ ইচ্ছেপূরণ ॥

লর্ড হেনরি একটানা কথা বলে গেলেন, তাঁর কণ্ঠে আদেশের সুর। ‘যৌবন কী, তা বোঝার চেষ্টা করো। একদিন তোমার সময় শেষ হয়ে আসবে। বুড়ো হয়ে যাবে তুমি। যৌবন খুবই ক্ষণস্থায়ী। পাহাড়ে যেসব ফুল ধরে তাদের কথা ভাবো! শুকিয়ে যায়, তবে আবার ফুল ফোটে সেখানে। কিন্তু হায়, আমরা হচ্ছি মানব জাতি! আমরা কখনোই যৌবন ফিরে পাই না। আমাদের অঙ্গ অসাড় হয়ে আসে, ইন্দ্রিয় লোপ পেতে থাকে। আমরা ধেয়ে চলি একটি কুৎসিত বয়সের দিকে। তারপর স্মৃতি আমাদের তাড়িয়ে বেড়ায় যা আমাদের ভয় পাইয়ে দেয় এবং বলে—কখনও আত্মসমর্পণ করবে না! তোমার সোনালি দিনগুলো অপব্যয় করবে না। বাঁচো! সন্ধান করো নতুন অনুভূতির! কোনো কিছুর তোয়াক্কা করবে না!’

ডোরিয়ান খুব মনোযোগ দিয়ে শুনছিল। ধীরে ধীরে তার চোখ বড় বড় হয়ে ওঠে। এই বিপজ্জনক বক্তৃতাটি বাসিলেরও কানে আসছিল।

আনাড়ি, ছেলেবয়সী বন্ধুটির কথা ভেবে চিন্তা বাড়ছিল তাঁর। কিন্তু তিনি তখন ছবিটায় তুলির শেষ আঁচড় দিতে ব্যস্ত। ডোরিয়ানকে সান্ত্বনা দেয়া বা স্যার হেনরিকে থামানো—কোনোটাই আর করা হয়ে ওঠে না।

বাসিল দীর্ঘ সময় ধরে ছবিটার সামনে দাঁড়িয়ে থাকেন। হাতের বড় রংতুলি দিয়ে পোঁচ দিয়ে চলেছেন। চোখে কঠোর দৃষ্টি।

‘শেষ!’ অবশেষে বাসিলের কণ্ঠ শোনা গেল। এ মুহূর্তে তাঁকে বেশ অহংকারী দেখাচ্ছে। উবু হয়ে বসে ছবির বাম কোনে বড় বড় লাল অক্ষরে নিজের নাম সই করলেন তিনি।

‘আমার অভিনন্দন গ্রহণ করো, বাসিল!’ লর্ড হেনরি বললেন। ‘বর্তমান সময়ে যে কটি পোর্ট্রেট তৈরি হয়েছে—এটা তার মধ্যে সুন্দরতম। ডোরিয়ান নিজেকে দেখবে এসো।’

ছবির দিকে তাকিয়ে ডোরিয়ানের চেহারা প্রথমে লাল হয়ে উঠল লজ্জায়। স্থাণুর মতো তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ ছবির দিকে। মনে হলো যেন নিজের সৌন্দর্যই তাকে আঘাত করে বসেছে। তবে আকস্মিক একটা আনন্দের জোয়ারও বয়ে গেল তার মুখে। চোখে আনন্দের দীপ্তি, যেন সে নিজেকে এই প্রথম দেখছে।

যদিও, হঠাৎ একটা ঠাণ্ডা স্রোত তার শিরদাঁড়া দিয়ে বয়ে গেল। একদিন তার বয়স বেড়ে যাবে। চামড়ায় ভাঁজ পড়বে। ছিপছিপে শরীরটায় আর বল থাকবে না তখন। চুল ঝরে পড়বে।

‘কী ভয়ানক এটা!’ ডোরিয়ান আনমনা কণ্ঠে বলল, ‘আমার বয়স বেড়ে যাবে, অথচ এই ছবিটা থাকবে চিরযৌবনা। যদি অন্য কোনো পথ থাকত! শুধু যদি আমি তরুণ থেকে যেতাম আর বয়স বাড়ত কেবল ছবিটার! তার জন্যে আমি সব ছাড়তে রাজি! এমনকি যদি আমার আত্মা দিয়ে দিতে হয়, তাও!’

বাসিল বিস্ময়-ভরা চোখে তাকালেন। এটা খুবই অসঙ্গত যে ডোরিয়ান এভাবে ভাবছে ও কথা বলছে। কী হয়েছে তার? তাহলে কি লর্ড হেনরির অশুভ প্রভাব ইতিমধ্যেই কাজ করতে শুরু করেছে?

‘সৌন্দর্য অক্ষয় থাকে এমন সবকিছুর ওপর আমার হিংসে হচ্ছে।’ ডোরিয়ান বলল তিক্ততার সাথে। ‘আমি এখন জানি যে যখন কেউ তার সুন্দর চেহারা হারায়, তখন তার সবকিছু হারিয়ে যায়। তোমার ছবিটা আমাকে সেই শিক্ষাই দিয়েছে। লর্ড হেনরি-ই ঠিক। যৌবন ছাড়া আর কোনো কিছুর মূল্য নেই। যখন দেখব বুড়ো হয়ে যাচ্ছি,’ সে চেঁচিয়ে উঠল, ‘নিজেকে খুন করে ফেলব আমি!’

নিজের কানকেই যেন বিশ্বাস করতে পারছেন না বাসিল। কিন্তু কিছু বলার আগেই ডোরিয়ান আবার চিৎকার করল, ‘আমার ছবিকেই আমার হিংসে হচ্ছে। এটা বিদ্রুপ করছে আমাকে, বাসিল! আমি এটাকে ঘৃণা করি। তুমি কেন এটা এঁকেছ?’ সেই সাথে, নিজেকে সে ছুড়ে মারল সোফার ওপর। কান্নার দমকে কাঁপতে শুরু করেছে তার শরীর।

‘এসব কিছু তোমার কারণে, হ্যারি।’ বাসিল রাগের সাথে বললেন।

লর্ড হেনরি শ্রাগ করলেন, ‘এই হচ্ছে আসল ডোরিয়ান গ্রে। ব্যস, এতটুকুই।’

এই অভিযোগ অবশ্য সামান্যই কানে গেল ডোরিয়ানের। সে শুধু দেখতে পেল ছবিটা ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করার জন্য বাসিল ছুরি হাতে নিয়েছেন।

‘না, বাসিল!’ ডোরিয়ান চেঁচাল। ‘এটা হবে খুন করার নানান্তর।’

‘যাক, খুশি হলাম যে তুমি শেষ পর্যন্ত আমার কাজের প্রশংসা করলে।’ বাসিল শীতল গলায় বললেন।

‘শুধু প্রশংসা? আমি এটার প্রেমে পড়ে গেছি, বাসিল। আমার একটা অংশ এটা। আমি অনুভব করি তা,’ ডোরিয়ান ব্যাখ্যা করল। ‘এটা তো সত্য, আমিই চেয়েছি তুমি ছবিটা আঁকো।’

‘ঠিকাছে। শুকিয়ে গেলে আর দেরি করব না। বাঁধাই শেষ করে তোমার ঠিকানায় পাঠিয়ে দেবো।’ বাসিল ছুরিটা নামিয়ে রাখলেন, তাঁর কণ্ঠে আবার সৌজন্যের ছাপ ফিরে এসেছে।

ডোরিয়ান এরপর শান্ত হয়ে এল। সে লর্ড হেনরির সাথে ডিনার করার পরিকল্পনা করল। বাসিল অবশ্য বাধা দেয়ার চেষ্টা করেছিলেন। তাঁর মনে একটাই ভয়—বয়স্ক লোকটির কু-প্রভাব তাঁর বন্ধুটিকে বিপথে নিয়ে যেতে পারে।

কিন্তু ডোরিয়ানের মনোযোগ তাঁর সাবধানবাণীতে নেই। এবং তার জীবনটাও আর একই রকম থাকবে না!

***

পর্ব ৩ ॥ একটি রোমান্টিক পটভূমি ॥

পরের দিন। সকাল গড়িয়ে গেছে অনেকক্ষণ দুপুর বেলা। লর্ড হেনরি কার্জন স্ট্রীট থেকে বেরিয়ে আস্তে আস্তে হাঁটছেন আলবেনি ক্লাবের দিকে। তিনি তাঁর চাচা জর্জের সাথে দেখা করতে যাচ্ছেন। কঠোর মনের এই প্রৌঢ় ব্যাচেলরটি ডিপ্লোমেটিক সার্ভিসে ছিলেন, এখন অবসর নিয়েছেন। এই জ্যেষ্ঠ ভদ্রলোক তাঁর বাটলারের কাছে হিরো হলে কী হবে! অধিকাংশ আত্মীয়ের কাছে তিনি যেন মূর্তিমান আতঙ্ক। লর্ড হেনরি অবশ্য তাঁর সঙ্গ উপভোগই করেন।

আলবেনি ক্লাবে ঢুকে লর্ড হেনরি তাঁর চাচাকে পেলেন একটি বাদামি রঙের শিকারি জ্যাকেট পরা অবস্থায়, সিগার খেতে খেতে অসন্তোষ নিয়ে খবরের কাগজ পড়ছেন।

'কী ব্যাপার, হ্যারি!' বৃদ্ধ বললেন, 'এই সাত-সকালে এদিকে যে? আমি তো জানতাম তোমরা, আজকালকার ছোকরারা, দুপুর দুটার আগে ঘুম থেকেই ওঠো না! আর বিকেল পাঁচটার আগে তোমাদের চেহারা দেখা যাওয়ার তো প্রশ্নই ওঠে না!' লর্ড হেনরি একটু লজ্জা পেলেও সামলে উঠলেন। তাঁর চাচা এখনও তাঁকে ছোকরা মনে করেন!

'পরিবার-আসক্তি, চাচা। সেই সাথে, কিছু জানতে চাই তোমার কাছে। আমার কিছু তথ্য প্রয়োজন মি. ডোরিয়ান গ্রে সম্পর্কে।' লর্ড হেনরি উত্তর দিলেন।

'মি. ডোরিয়ান গ্রে! কে সে?' সাদা ঘন ভ্রু কুঁচকে জর্জ জিজ্ঞেস করলেন।

'এটা জানতেই আমি এসেছি। বরং আমি তার পরিচয়টা দিই। সে মৃত লর্ড কেলসোর নাতি। তার মায়ের নাম লেডি মার্গারেট ডেভেরুক্স। ডোরিয়ানের মা সম্পর্কে কিছু বলতে পারবে? সে দেখতে কেমন ছিল? সে কাকে বিয়ে করেছিল?'

'কেলসোর নাতি!' বৃদ্ধ ভদ্রলোক প্রতিধ্বনি করলেন। 'অবশ্যই। তার মাকে আমি জানতাম। সে ছিল অসাধারণ রূপসী এক মেয়ে। আর বহু পুরুষের হৃদয় ভেঙে দিয়ে সে ভেগে গিয়েছিল এক কপর্দকশূন্য, তরুণ কর্পোরালের সাথে।'

'সেই গরিব ছোকরাটি বিয়ের কয়েক মাস পর ডুয়েল লড়তে গিয়ে মারা পড়ে। এর পেছনে একটা কদর্য গল্প আছে। বলা হয় কেলসো কিছু বর্বর বেলজিয়ানকে ভাড়া করেন তাঁর মেয়েজামাইকে সবার সামনে অপমান করার জন্য। সে বেচারা সম্মান বাঁচাতে দ্বন্দ্বযুদ্ধে নামতে বাধ্য হয়। তার প্রতিদ্বন্দ্বীর নিশানা ছিল অব্যর্থ। বাঁচার কোনো সুযোগই পায়নি সে।'

'তার স্ত্রী—মানে, ডোরিয়ানের মায়ের কী হলো?' লর্ড হেনরি জানতে চাইলেন।

'কেলসো তাঁর কন্যাকে ফিরিয়ে নেন নিজের কাছে। শুনেছি মেয়েটি আর কখনও বাবার সাথে কথা বলেনি। একই বছর মারা যায় সে। একটি পুত্র সন্তান রেখে গেছে।' তারপর তিনি ব্যাখ্যা করলেন যে ডোরিয়ানের নানা লর্ড কেলসো এবং মা ডেভেরুক্স অনেক অর্থকড়ির মালিক ছিলেন। এবং আইনত ডোরিয়ান পারিবারিক সম্পত্তি সেলবি-র উত্তরাধিকারী। 'ডোরিয়ান গ্রে,' তিনি বললেন, 'একদিন অনেক ধনী ব্যক্তিতে পরিণত হবে।'

'তথ্যের জন্যে ধন্যবাদ। নতুন বন্ধুদের সম্পর্কে জানাটা আমার চিরকালের পছন্দ।' লর্ড হেনরি হাসলেন।

পালটা হেসে জর্জ তাঁর ভাতিজাকে জিজ্ঞেস করলেন দুপুরে সে কোথায় খাবে। 'আগাথা আন্টির সাথে, মি. গ্রে-ও থাকবে সেখানে। সে মহিলাটির সর্ব সাম্প্রতিক আশ্রয়।'

জর্জ অনুমোদনসূচক গোঁ গোঁ আওয়াজ করলেন। প্রায় একই সময়ে তিনি বেল বাজালেন ওয়েটারকে ডাকার জন্য। লর্ড হেনরি তাঁর চাচার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে এলেন। হেঁটে হেঁটে বার্লিংটন স্ট্রিটে ঢুকলেন এবং বাঁক নিয়ে পা বাড়ালেন বার্কলি স্কোয়ারের দিকে।

তো, এটাই তাহলে ডোরিয়ান গ্রের বাবা-মার কাহিনি! রোমান্স আর ট্রাজেডির এই যুগলবন্দি লর্ড হেনরিকে আলোড়িত করছিল। একটি সুন্দরী নারী তার সব হারানোর ঝুঁকি নিয়েছে শুধু ভালোবাসায় অন্ধ হয়ে! দুরন্ত আনন্দময় কয়েকটি সপ্তাহের অবসান ঘটে শুধু একটি প্রতারণার জন্য! দিনের পর দিন অসহায় মেয়েটি দুঃসহ মানসিক যন্ত্রণা সহ্য করে বেঁচে ছিল। তারপর তার শিশুটি ভূমিষ্ঠ হয়।

মৃত্যু তাকে ছিনিয়ে নিয়েছে, ছেলেটিকে একা আর একটি হৃদয়হীন বৃদ্ধের নিষ্ঠুর শাসনে ফেলে রেখে। 'হ্যাঁ,' ভাবলেন লর্ড হেনরি, 'এটা একটা আকর্ষণীয় পটভূমি। ডোরিয়ান গ্রে প্রেম আর মৃত্যুর সন্তান।'

***

পর্ব ৪ ॥ প্রেমে ঝাঁপ ॥

এক মাস পর। মে ফেয়ার। লন্ডনের অন্যতম অভিজাত পাড়া।

লর্ড হেনরির বাড়ির লাইব্রেরি। ডোরিয়ান গ্রে অনেকক্ষণ হয় একটা অ্যান্টিক চেয়ারে বসে আছে। একজন ভদ্র, শিক্ষানুরাগীর হাতের ছোঁয়া পেয়ে কক্ষটি সত্যি মন্ত্রমুগ্ধকর হয়ে উঠেছে।

বড় নীল রঙের চীনা জার আর ম্যান্টলপিসের ওপর হলুদ টিউলিপ শোভা পাচ্ছে। ভারী ওক কাঠের বুককেস দেয়ালজুড়ে। জানালায় সিসের প্রলেপ দেয়া ছোট্ট ছোট্ট কাঁচের পাত, গ্রীষ্মের তপ্ত কমলা-লাল রঙের রোদ তার ভেতর দিয়ে অবাধে প্রবাহিত হচ্ছে।

ডোরিয়ান বন্ধুর জন্য ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করছে। সবাইকে অপেক্ষায় রাখাটা লর্ড হেনরির একটা অভ্যাস। তিনি অবশ্য নীতিগতভাবেই দেরি করার পক্ষে। তিনি বলতে ভালোবাসেন যে সময়ানুবর্তিতার কারণে আমাদের প্রচুর সময় নষ্ট হয়। তাঁর এ ধরনের আরও কিছু কথায় প্রমাণ হয় নিজেকে তিনি কতটা আলাদা দেখাতে চান।

‘দেরি হওয়ায় দুঃখিত, ডোরিয়ান। এক টুকরো কাপড় কিনতে গিয়ে ওয়ার্দুর স্ট্রীটে আটকা পড়েছিলাম। দরদাম করতে গিয়ে কতগুলো ঘণ্টা নষ্ট হলো। কী দিনকাল যে পড়েছে, সবাই শুধু দরটাই বোঝে কিন্তু মূল্য জানে না কিছুরই।’ লর্ড হেনরি দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন।

‘ভাবী এসে আমাকে অপেক্ষা করতে বলে গিয়েছিলেন,’ ডোরিয়ান জানাল তাঁকে। লর্ড হেনরির স্ত্রী খানিকটা চটুল স্বভাবের আর পরিপাটি পোশাকের মহিলা। দু জনের জীবনযাপনের ধরন সম্পূর্ণ ভিন্ন। বিয়ের প্রতি লর্ড হেনরির অবজ্ঞা অবশ্য সব মহলে পরিচিত।

‘সাদা চুলের মেয়েকে কখনও বিয়ে করো না,’ লর্ড হেনরি দৃঢ়তার সাথে বললেন।

‘কেন, হ্যারি?’ জানতে চাইল ডোরিয়ান।

‘কারণ তারা খুবই আবেগপ্রবণ।’ টাই বিন্যস্ত করার ফাঁকে উত্তর দিলেন তিনি। ‘তোমার প্রতি আমার উপদেশ- কখনও বিয়েই করো না।’

‘চিন্তা করো না,’ ডোরিয়ান হাসল। ‘বিয়ে করব না। আমি একটি মেয়ের প্রেমে পড়েছি। এটা তোমার অন্যতম অভিমত ছিল, হ্যারি,’ তার মুখে রক্ত জমছে, ‘এবং নিজেকে এটা রপ্ত করায় নিয়োজিত করেছি। তার নাম সিবিল ভেন। সে একজন অভিনেত্রী। একটি সত্যিকারের প্রতিভা।’

‘তোমার প্রতিভাটি সম্পর্কে বলো আমাকে,’ লর্ড হেনরি উসকে দিলেন। ‘তাকে কত দিন ধরে জানো?’

ডোরিয়ান খুবই উত্তেজিত হয়ে আছে। সে জানাল যে লর্ড হেনরি-ই তার এই আনন্দের জন্য দায়ী। তার খামখেয়ালি বন্ধুটিই তাকে জীবনের অর্থ খুঁজে বের করার প্রতি আগ্রহী করে তুলেছে। আর তাই ডোরিয়ান পুরো লন্ডন চষে বেড়িয়েছে নতুন অভিজ্ঞতা সঞ্চয়ের জন্য।

সে সব জায়গায় গিয়েছে- সুরম্য মিউজিয়াম থেকে শুরু করে নোংরা কানাগলি- তার লক্ষ্য ছিল অ্যাডভেঞ্চার। সেন্ট জেমস পার্ক থেকে পিকাডিলি সার্কাস, ডোরিয়ান চাঞ্চল্যকর কিছু খুঁজে পেতে চেষ্টা করেছে। ‘আমি অনুভব করছিলাম এই লন্ডন শহরের ভাণ্ডারে অবশ্যই কিছু একটা আছে আমার জন্যে,’ সে বলল।

‘হ্যারি, তোমার মনে পড়ে প্রথম যেদিন তোমার সাথে ডিনার করি? তুমি বলেছিলে জীবনের গোপন রহস্যটি হলো সৌন্দর্যের সন্ধান করা। তোমার সেই উপদেশটি আমার অন্তর ছুঁয়ে যায়। তার পর থেকেই আমি সৌন্দর্যের সন্ধানে ছিলাম।’

‘কী ঘটেছে বলি তাহলে,’ আনন্দের সাথে ব্যাখ্যা করল ডোরিয়ান। ‘ছোট্ট একটা থিয়েটারের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলাম। গ্যাসবাতির উজ্জ্বল আলো আর কুৎসিত বিজ্ঞাপনে ছেয়ে আছে জায়গাটা। অদ্ভুত একটি লোক থিয়েটারের বাইরে দাঁড়িয়ে ছিল। গায়ে তার আজব এক ফতুয়া, হাতে সিগার জ্বলছিল।'

'সে আমাকে ছোট একটি নির্জন ঘরে নিয়ে যায়। সেখান থেকে আমি স্বচ্ছন্দে মঞ্চ দেখতে পাচ্ছিলাম। এটা ছিল একটা বেশি ভাড়ার পর্দাঘেরা আসন, রং দিয়ে কিউপিড আর ফুলের ছবি আঁকা। কিছু মহিলা কমলা, আদার তৈরি বিস্কুট এবং বিয়ার বিক্রি করছিল,’ সে যোগ করল।

ডোরিয়ান একটানা বলে গেল। সে বর্ণনা করল শেক্সপিয়ারের যে নাটকটি সে দেখেছে সেই ‘রোমিও এবং জুলিয়েট’-এর কথা। খুবই নিম্ন মানের বাজনা বাজছিল। তারপর একটি তন্বী, রূপসী অভিনেত্রীকে সে মঞ্চে আসতে দেখে। অবিলম্বে সে নিজের ভেতর আবেগ ও ভালোবাসার অনুভূতি লক্ষ করে। কী অসাধারণ সেই মেয়েটির কণ্ঠ! কী অপূর্ব তার রূপ! তক্ষুনি সে অভিনেত্রী সিবিল ভেনের প্রেমে পড়ে যায়।

‘আমি মোটেও অবাক হইনি, ডোরিয়ান। কিন্তু এটাই কি তোমার আসল প্রেম?’ লর্ড হেনরি আশ্চর্য হলেন। ‘তুমি সব সময়ই ভালোবাসা পাবে, ভালোবাসবেও। যাদের কোনো কাজ নেই, প্রেম নিয়ে তারাই বেশি মাতামাতি করে,’ তিনি বললেন, তাঁর চোখ মিটমিট করে। ‘তবুও আমার কৌতূহল হচ্ছে। তুমি কীভাবে তার সাথে দেখা করলে?’

‘আমি রোজ থিয়েটারে যাওয়া শুরু করি। তৃতীয় রাতে আমার ভাগ্য সুপ্রসন্ন হয়ে ওঠে,’ ডোরিয়ান জবাব দিল। ‘আমি ওই অদ্ভুত লোকটির কাছে দৌড়ে যাই। থিয়েটারের সাথে তার কিছু একটা যোগসূত্র থেকে থাকবে। সে-ই আমাকে সিবিলের ম্যানেজার পর্যন্ত পৌঁছে দেয়। এক রাতে সিবিলকে ফুল ছুড়ে মেরেছিলাম। সে তখন ওপরে তাকিয়ে আমাকে দেখছিল। এটা বৃদ্ধ ম্যানেজারের চোখে পড়েছিল। সে তখন সিদ্ধান্ত নেয় আমাকে তার সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়ার। আমি খুবই আনন্দিত যে সে এটা করেছে!’

‘তোমার অভিনেত্রীটি দেখতে কেমন?’ লর্ড হেনরি জানতে চাইলেন।

‘তার চুল গাঢ় বাদামি, চোখ নীল আর ঠোঁট কমনীয়। তার বয়েস মাত্র সতেরো। তার চেয়ে বেশি মনোরম কিছু আমি আজ পর্যন্ত দেখিনি!’ দাবি করল ডোরিয়ান। ‘সে আমার কাছে সবকিছু। আমি প্রতি রাতে তার অভিনয় দেখতে যাই। আমার কাছে মনে হয় সে প্রতি রাতেই আগের রাতের চেয়ে ভাল করছে।’

‘সে খুবই লাজুক এবং কোমল। সিবিল বলে আমি নাকি দেখতে প্রিন্সের মতো। সে অবশ্য আমার আসল নাম জানে না,’ ডোরিয়ান যোগ করল, ‘আমাকে ডাকে প্রিন্স চার্মিং নামে।’

লর্ড হেনরি অবাক দৃষ্টিতে বন্ধুকে দেখছিলেন। প্রথম যেদিন তাকে বাসিলের স্টুডিওতে দেখেছিলেন, সে ছিল শান্ত। আর এখন কত বদলে গেছে! ডোরিয়ান বড় হয়ে উঠছে। সে পরিণত হয়ে উঠেছে আর উপভোগ করছে তার প্রথম প্রেম।

‘আমি চাই বাসিলকে নিয়ে তুমি সিবিলের অভিনয় দেখতে যাবে,’ ডোরিয়ান জোর দিয়ে বলল। তার চোখ জ্বলছে, ‘আমি নিশ্চিত যে তোমরা তার প্রতিভার উচ্চ প্রশংসা করবে। আমি ঠিক করেছি ওয়েস্ট এন্ড থিয়েটার ভাড়া করব। শহরের গণ্যমান্য সমালোচকদের সেখানে রেখে তাকে পরিচয় করিয়ে দেব। আমি আমার প্রিয়তম সিবিলকে স্টার হিসেবে দেখতে চাই।’

‘ভাবতে দাও,’ ডোরিয়ানকে কথা দেয়ার আগে লর্ড হেনরি একটু বিরতি নিলেন। ‘আজ মঙ্গলবার। এসো আমরা কাল দেখা করি। সন্ধ্যে আটটায়, ব্রিস্টল-এ। আমি বাসিলকে নিয়ে আসব।’

‘আটটায় না, হ্যারি। এসো ছ-টায় দেখা করি। মঞ্চের পর্দা ওঠার আগেই আমাদের থিয়েটারে পৌঁছে যেতে হবে। যাই তাহলে। শুভ বিদায়।’

ডোরিয়ানের কথা শোনার সময় লর্ড হেনরি একটা বিষয়ে সচেতন ছিলেন- এবং চিন্তাটা তাঁর বাদামি চোখে ঝিলিক নিয়ে এল- এটা নিশ্চিত যে তাঁরই কথার সূত্র ধরে ডোরিয়ান মেয়েটির প্রেমে পড়েছে। বড় পরিসরে বললে, তিনি ডোরিয়ানের রোমান্টিক স্বভাবকে উসকে দিয়েছেন। কখনও বই ব্যাপক ভূমিকা রাখে। কখনও ভূমিকা রাখে ব্যক্তি। লর্ড হেনরি বুঝতে পারছেন ডোরিয়ান গ্রের চালচলনে তাঁর বড় ধরনের প্রভাব পড়েছে।

কিন্তু কে এই রহস্যময়ী যে কিনা ডোরিয়ানের হৃদয় দখল করে নিয়েছে? সিবিল ভেন তাঁকে কৌতূহলী করে তুলছে। সত্যি বলতে কি লর্ড হেনরি উন্মুখ হয়ে আছেন তাকে দেখার জন্য। পরের রাতেই সিবিলের অভিনয় দেখতে যাবেন এই মর্মে চুক্তি করে দুই বন্ধু আলাদা হলেন।

পরে, একাকী বসে, লর্ড হেনরি ভাবছিলেন ডোরিয়ানের নতুন প্রেমের কথা। জানালা দিয়ে বাইরের খোলা দৃশ্য দেখতে দেখতে তিনি প্রেমের রহস্যময়তায় বিস্মিত হচ্ছিলেন। সূর্য ডুবছে। বাড়িঘরের ছাদগুলো জ্বলছে তপ্ত লোহার মতো। মাথার ওপরে আকাশটা ম্লান গোলাপি রং ধারণ করেছে।

ডোরিয়ানের ভাগ্যে কী অপেক্ষা করছে ভেবে হেনরি অবাক হচ্ছিলেন। কিন্তু ভবিষ্যৎ নিয়ে আর কোনো অনুমান করার আগে, একটা চমক পেলেন তিনি। ডোরিয়ান একটা টেলিগ্রাম পাঠিয়েছে। সেটায় ঘোষণা করা হয়েছে সে এবং সিবিল ভেন বিয়ের বাগদান সম্পন্ন করে ফেলেছে!

***

পর্ব ৫ ॥ ভেন-পরিবার ॥

গোটা ভেন-পরিবারই যেন দিশা হারিয়ে ফেলেছে। সবাই একসঙ্গে আকুল হয়ে উঠেছে পাণিপ্রার্থীটিকে দেখতে। সবচেয়ে বেশি ভেঙে পড়েছেন সিবিলের মা। তাঁর স্বপ্ন ছিল সিবিল একদিন বড় অভিনেত্রী হবে। তিনি মেয়ের জন্য অন্য আর সবকিছুর পরিকল্পনা করে রেখেছিলেন। শুধু বিয়েটা ছাড়া।

‘মা, আমি এত্ত খুশি!’ ক্লান্ত, ম্লান চেহারার মায়ের কোলে মুখ গুঁজে দিয়ে সিবিল ফিসফিস করে বলল। মলিন একটা ঘর। সিলিং থেকে ঝোলা বাতিটি কর্কশ আলো ছড়িয়ে যাচ্ছে। সিবিলের মা বাতির দিকে পেছন ফিরে একটি চেয়ারে বসে আছেন।

মিসেস ভেন তাঁর চিকন চিকন সাদা দুটি হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন মেয়ের মাথায়। ‘খুশি!’ যেন সিবিলের কথাটাই ফিরিয়ে দিলেন। ‘সিবিল, শুধু তুই অভিনয় করলেই আমি খুশি। তোর আর অন্য কিছু ভাবার দরকার নাই। মি. আইজ্যাক বড়ই দয়ালু। আর তিনি আমাদের কাছ থেকে টাকাও পাওনা আছেন অনেক।’

‘টাকা, মা?’ ঘেন্নায় ঠোঁট ওলটাল মেয়েটি। ‘টাকায় কী আসে-যায়, মা? টাকার চেয়ে প্রেমের দাম অনেক বেশি!’

‘কী জানিস তুই ওই ছেলেটা সম্পর্কে? ঠিক করে তার নামটা পর্যন্ত বলতে পারিস না! সে যা হোক, আমি যেমনটা আগেও বলেছি, সে যদি সত্যিই ধনী হয়ে থাকে...’ মিসেস ভেন তাঁর প্রস্তাবটি যেন শূন্যে ভাসিয়ে দিলেন।

‘মা, তুমি কেন যে এত টাকার কথা ভাব? আমি শুধু ভালোবাসার কথাই ভাবতে পারি,’ সিবিল বলল। ঝকঝকে চোখ দুটো তুলে তাকিয়ে আছে তার মায়ের দিকে।

হ্যাঁ, সিবিল যদি সত্যিই তেমন পাত্র বেছে নিয়ে থাকে, তাহলে আরেকটু বেশি ভদ্রলোক হয়ে ওঠা যাবে—মনে মনে ভাবছিলেন মিসেস ভেন। প্রেমে পড়া মেয়ের প্রতি এখন তাঁর একটাই প্রশ্ন বাকি আছে। যুবকটি কি ধনী? সিবিল তার মাকে আশ্বস্ত করল যে তার বাগদত্ত প্রিন্স চার্মিং একজন চমৎকার তরুণ ভদ্রলোক। সে একই সাথে ধনী আর অসাধারণ।

ঠিক তক্ষুনি দরজাটা খুলে গেল। কর্কশ, বাদামি চুলের একটা ছেলে ঘরের ভেতর এসে ঢুকল। ছেলেটার নাম জেমস ভেন, সিবিলের ভাই। গাট্টাগোট্টা আর বেঁটে ধরনের। চলাফেরায় অপটু, হাত-পা বড় বড়। সে একটুও তার বোনের মতো নয়।

সে তার লোভী মায়ের মতোও নয়, যাকে সহজে পটানো যায়। তবে সে সিবিলের খুব ভক্ত। তার মনে একটাই ভয় সিবিলের বাগদত্ত কোনো বখে যাওয়া টাকার কুমিরই হবে। হয়তো ওই লোকটা তার বোনের দুর্বলতা থেকে ফায়দা ওঠাতে চায়। এতই যখন ধনী তাহলে সে কেন বিয়ে করবে তার চেয়ে অনেক নীচু শ্রেণীর একটি মেয়েকে? অনায়াসেই তো সে অভিজাত পরিবারের কোনো মেয়েকে সঙ্গীনী হিসেবে পেতে পারে!

জেমস ভেন তার বোনের মুখের দিকে তাকিয়ে তন্ন তন্ন করে কিছু খোঁজে। ‘তোকে নিয়ে একটু হাঁটতে যাব, সিবিল। আজই আমি অস্ট্রেলিয়া রওনা হবো। আশা করি এই জঘন্য লন্ডন শহরটা আর দেখতে হবে না!’

‘দাঁড়াও, কাপড় ছেড়ে আসি। এক্ষুনি ফিরব।’ সিবিল সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠতে উঠতে বলল।

‘আহ্, জেমস,’ মায়ের কণ্ঠে স্পষ্ট বিরক্তি। ‘আমি চাই না তুই বিদেশে যা। এর চেয়ে কেরানির কাজ করাও অনেক ভালো। উকিল হওয়াটাও খারাপ না, অন্তত ভদ্রলোক বলে পরিচয় দেয়া যায়। আমার ভাবতে খারাপ লাগে যে তুই শুধু অস্ট্রেলিয়া যেতে চাস। কী আছে ওখানে? কলোনি দিয়ে ভরা একটা দেশ। আমার তো মনে হয় না সেখানে সমাজ বলতে কিছু আছে!’

‘অফিস আর কেরানি। কেরানি আর অফিস। ঘৃণা করি এগুলোকে,’ জেমস উত্তরে জানাল। ‘আমি আমার নিজের জীবন ঠিক করে নিয়েছি। আমি শুধু বলতে চাই তুমি সিবিলকে দেখে রাখবে, মা। তার কোনো ক্ষতি যেন না হয়। মা, তুমি তাকে অবশ্যই রক্ষা করবে।’

‘জেমস, তোর কথাবার্তা কী অদ্ভুত! অবশ্যই আমি আমাদের সিবিলকে দেখে রাখব।’

‘শুনেছি, কে এক ভদ্রলোক সিবিলের পেছনে ঘুরঘুর করছে! প্রতিদিনই থিয়েটারে যায়। মঞ্চের পেছনে গিয়ে বসে থাকে সিবিলের সাথে কথা বলার জন্যে। তার ব্যাপারটা কী?’

মিসেস ভেন তাড়াতাড়ি ব্যাখ্যা করলেন যে যুবকটি সত্যিকারের একজন ভদ্রলোক। এবং এ ব্যাপারে তাঁর মনে কোনো সন্দেহই নেই। ‘সে যথেষ্ট নম্র,’ তিনি বললেন, ‘সে একই সাথে ধনী এবং সংস্কৃতিমনা।’

‘তোমরা তার নামটা পর্যন্ত জানো না।’ জেমসের মুখ তিক্ত হয়ে উঠল কথা বলতে গিয়ে।

‘না,’ মুখে শান্তভাব ধরে রেখে মিসেস ভেন সায় দিলেন ছেলের কথায়, ‘সে এখনও তার আসল নাম প্রকাশ করেনি। তবে বোঝা যায় অভিজাত সমাজের কেউ হবে। আর সে যদি সত্যিই ধনী হয়, তাহলে,’ ধূর্ত ইঙ্গিত ফুটে উঠল তাঁর কণ্ঠে, ‘কেন সিবিল তাকে বিয়ে করবে না।’

জেমস ভেন ঠোঁট কামড়ে ধরল। ‘সিবিলকে দেখে রাখবে মা,’ সে আবার বলল, ‘দয়া করে তাকে দেখে রাখবে।’

‘বেটা, তোর এ ধরনের কথায় আমি কষ্ট পাই। সিবিলকে তো আমি সব সময়ই যত্নে রাখি। সত্যিই যদি ওই পাণিপ্রার্থী যুবকটি ধনী আর ভদ্রঘরের হয়, তো মেয়েকে তার কাছে তুলে দিতে আপত্তি কোথায়? আমাকে বলতেই হচ্ছে, এটা একটা চমৎকার বিয়ে হবে। দুটোকে যা মানাবে না! সবাই ব্যাপারটা লক্ষ করেছে। ছেলেটার সুন্দর চেহারা সত্যিই মনে রাখার মতো।’

জেমস বিড়বিড় করে কী যেন বকল। হাত দিয়ে জানালায় ঘুষি মেরে ঘুরে দাঁড়াল শক্ত কিছু বলার জন্য। কিন্তু সিবিল চলে এসেছে।

‘তোমরা দু জনেই এত গম্ভীর!’ সে চেঁচিয়ে উঠল, ‘কী হয়েছে?’

‘কিছু না,’ জেমস গজগজ করে উত্তর দিল, ‘এমন কিছু কিছু সময় আসে যখন গম্ভীর থাকাই ভালো। আসি মা, বিকেল পাঁচটার মধ্যে ফিরে এসে ডিনার করব। সব গোছগাছ করা আছে।’

‘আয়, সিবিল,’ তার ভাই যোগ করল, ‘আমাদের হণ্টন পর্ব শুরু করি।’

***

বাইরে রৌদ্র-ছায়ার লুকোচুরি, বাতাস বইছে একটানা। বিষণ্ন ইউস্টন রোড ধরে দু ভাই-বোন ধীরে-সুস্থে হেঁটে চলেছে। পথচারীরা যেতে যেতে ঘুরে তাকায় এই ব্যতিক্রমী জুটিটির দিকে—একটি গোমড়ামুখো নীরস যুবক, অন্যটি লাবণ্যময়ী, মার্জিত তরুণী। মনে হয় যেন বাগানের একটি গোলাপ ফুল তার মালীর সাথে হাঁটছে।

সিবিল কিন্তু তার ভাইয়ের ভাবান্তর লক্ষ করেনি। সে হাসছিল, ভাবছিল প্রিন্স চার্মিং-এর কথা, কখন আবার তাকে দেখতে পাবে। তার ভাই জেমসও বোনের পাণিপ্রার্থীটি সম্পর্কে ভাবছিল।

‘শুনলাম একটা নতুন বন্ধু জুটিয়েছিস। কে সে? তার কথা আমাকে কেন বলিসনি? নিশ্চয়ই তার মনে কোনো কুমতলব আছে,’ দাঁত খিঁচিয়ে বলল জেমস।

‘ব্যস, জিম!’ যন্ত্রণায় কঁকিয়ে উঠল সিবিল। ‘তার নামে কিচ্ছু বলবি না। আমি তাকে ভালোবাসি।’

‘কেন? তার নামটা পর্যন্ত জানিস না তুই!’ তার ভাই উত্তর দিল। ‘কে সে? আমার সেটা জানার অধিকার আছে!’

‘আমি তাকে ডাকি প্রিন্স চার্মিং নামে। তোর পছন্দ নয় নামটা? তুই যদি শুধু তাকে দেখতি,’ সিবিল বলল, ‘দুনিয়ার সবচেয়ে অসাধারণ ব্যক্তি মনে করতি তাকে। অস্ট্রেলিয়া থেকে ফিরে এসে তার সাথে দেখা করবি। আজই যদি থিয়েটারে আসতে পারতি! সে ওখানে আসবে।’

‘আমি চাই সাবধান থাকবি তার কাছ থেকে,’ হুঁশিয়ার করল জেমস। বোনের খুশির জন্য তার মরিয়া ভাব প্রকাশ পেল। ‘যদি তোর প্রিন্স চার্মিং কখনও আঘাত করে তোকে,’ গর্জন করল সে, ‘শপথ করে বলছি তাকে খুন করব আমি!’

***

পর্ব ছয় ॥ বাগদান নিয়ে আলোচনা ॥

‘আমার ধারণা তুমি সংবাদটি পেয়েছ, বাসিল?’ সেই বিকেলে লর্ড হেনরি জানতে চাইলেন। তাঁরা দু বন্ধু ব্রিস্টল-এ এসেছেন ডিনার সারতে।

‘না, হ্যারি,’ প্রণামরত ওয়েটারের দিকে হ্যাট এবং কোট বাড়িয়ে দিতে দিতে উত্তর দিলেন বাসিল। ‘সংবাদটি কী?’

‘ডোরিয়ান গ্রে বাগদান সেরে ফেলেছে,’ বন্ধুর দিকে সতর্ক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে লর্ড হেনরি বললেন।

‘ডোরিয়ান গ্রে বাগদান সেরে ফেলেছে! অসম্ভব!’ বলতে বলতে ভ্রু কুঁচকে গেল বাসিলের।

‘এটাই সত্য,’ লর্ড হেনরি বললেন।

‘কার সাথে?’ বাসিল তৎক্ষণাৎ জানতে চাইলেন।

‘কোনো এক অচেনা অভিনেত্রীর সাথে,’ উত্তর এল।

‘আমি এটা বিশ্বাস করি না!’ বাসিল বললেন, ‘ডোরিয়ান আরও অনেক বেশি সু-বুদ্ধিসম্পন্ন।’

‘ডোরিয়ান মোটেও এতটা চালাক নয়। এমন আচরণ সে যখন-তখন করতে পারে।’ স্যার হেনরি রায় দিলেন।

‘বিয়ে ব্যাপারটা এত সহজ নয় যে সেটা কোনো ব্যক্তি যখন-তখন করতে পারে।’ বাসিল বন্ধুকে মনে করিয়ে দিলেন।

‘কিন্তু আমি তো বলিনি সে বিয়ে করতে যাচ্ছে। আমি বলেছি সে বিয়ের জন্যে অঙ্গীকারাবদ্ধ হয়েছে। এখানে একটা পার্থক্য আছে।’ লর্ড হেনরি তার বিশেষ ভঙ্গিতে হাসলেন।

‘কিন্তু ডোরিয়ানের জন্ম, অবস্থান আর সম্পদের কথা ভাবো!’ বাসিল বললেন, ‘নীচু শ্রেণীর একটি মেয়েকে বিয়ে করা চরম নির্বুদ্ধিতা হবে তার জন্যে।’

‘তো, তুমি চাও না ডোরিয়ান মেয়েটিকে বিয়ে করুক! তাহলে সেটা তাকে বলো, বাসিল। সে নিশ্চয়ই তোমার কথা মেনে নেবে।’ লর্ড হেনরি মৃদু তিরস্কার করলেন তাঁর বন্ধুকে।

‘আশা করি মেয়েটি ভালো, হ্যারি,’ বাসিল দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন।

‘সে ভালোর চেয়েও বেশি, অপূর্ব সুন্দরী,’ চাপা আনন্দ নিয়ে ওয়াইনের গ্লাসে চুমুক দিতে দিতে লর্ড হেনরি বললেন।

‘হতে পারে সে অপূর্ব সুন্দরী, হ্যারি। কিন্তু তবুও আমি চাই না ডোরিয়ান কোনো বাজে নারীর পাল্লায় পড়ুক,’ বাসিল দৃঢ়তার সাথে বললেন।

‘আজ রাতে তুমি নিজেই দেখে নাও না কেন। ডোরিয়ান এই এল বলে। ও এলে আমরা একসাথে থিয়েটারে যাব মেয়েটিকে দেখতে।’

‘কিন্তু তুমি কি এটা সমর্থন কর, হ্যারি?’ বাসিল জিজ্ঞেস করলেন, ঠোঁট কামড়ে ধরে পায়চারি করছেন। ‘এটা সম্ভবত ছেলেমানুষি মতিভ্রম মাত্র।’

‘আমি সমর্থন বা বিরোধিতা কোনোটাই করব না এখন,’ লর্ড হেনরি উল্লেখ করলেন। ‘এটা ডোরিয়ানের সিদ্ধান্ত।’

ঠিক তখন ডোরিয়ান নিজেই প্রবেশ করল। সে তার সান্ধ্য-গাউনটি খুলে রেখে উভয় বন্ধুর সাথে হাত মিলাল।

‘হ্যারি, বাসিল, তোমাদের দুজনারই উচিত আমাকে অভিনন্দন জানানো। আমি এতটা সুখী আর কখনোই ছিলাম না!’ আনন্দ আর উত্তেজনায় ডোরিয়ানের মুখ ঝলমল করছে। তাকে আজ ভারি সুন্দর দেখাচ্ছে।

‘তুমি সব সময়ই খুব সুখে থাকবে, ডোরিয়ান,’ বাসিল আশা প্রকাশ করলেন। ‘এত দ্রুত কীভাবে সিদ্ধান্ত নিলে বিয়ের প্রস্তাব দেবে?’

ডোরিয়ান জানাল এটা মাত্র গত রাতে ঘটেছে। ‘হ্যারি, গতকাল তোমার কাছ থেকে চলে আসার পর আমি তৈরি হয়ে নেই। তারপর ডিনার করি রুপার্ট স্ট্রিটের একটি ইটালিয়ান রেস্তোরাঁয় এবং থিয়েটারে চলে যাই। সিবিল বরাবরের মতোই অসাধারণ অভিনয় করছিল। সত্যিই সে একটা জন্মগত প্রতিভা। আমি সেই মলিন, পর্দা-ঘেরা আসনে বসে বসে অভিভূত হচ্ছিলাম। আমি ভুলেই গিয়েছিলাম যে ঊনবিংশ শতাব্দীর লন্ডন শহরে বসে আছি।’

‘একসময় শেষ হলো অভিনয়। আমি মঞ্চের পেছনে চলে যাই। কথা বলি তার সাথে। দু জন একসাথে বসে আছি, তার চোখের দৃষ্টিতে প্রত্যাশা দেখতে পাই। আমার ঠোঁট তার দিকে এগিয়ে যায়। আমরা চুমু খাই। সে কেঁপে ওঠে। এটা ছিল আমার জীবনের সেরা মুহূর্ত।’ ডোরিয়ান শান্তভাবে বলল।

‘অবশ্যই, আমাদের বাগদান এখন পর্যন্ত গোপন রাখা হয়েছে। আমার অভিভাবকরা কী বলবেন জানি না। আমি যেটা জানি,’ সে বলল, ‘তা হলো আমি সিবিল ভেনকে ভালোবাসি এবং পুরো দুনিয়াকে জানাতে চাই সে আমার।’

‘তা ছাড়া আরও একটি বিষয়, হ্যারি। যখন আমি সিবিলের সাথে থাকি, তোমার দেয়া সবক আমি ভুলে যাই। তার সঙ্গ আমাকে বদলে দেয়। কেবল একটি হৃদয়হীন পশুই তার অনিষ্ট চিন্তা করতে পারে। সে আমাকে ভালো করে তোলে। আমরা যখন একত্র হই, আমি তোমার সব বিষাক্ত আর দুষ্টবুদ্ধিগুলো ভুলে যাই,’ ডোরিয়ান ঘোষণা করল।

‘এবং ওইগুলো হলো....?’ জানতে চাইলেন লর্ড হেনরি, মিষ্টান্ন নেয়ার জন্য হাত বাড়িয়েছেন।

‘.... জীবন সম্পর্কে তোমার মতবাদ,’ ডোরিয়ান উত্তর দিল। এর পর আর তাঁদের আলোচনা এগোল না। দ্রুত ডিনার শেষ করে যে যার কোট তুলে নিল সবাই। একজন দারোয়ান একটি গাড়ি ডেকে দিল তাঁদের জন্য। সেটায় চড়ে তাঁরা রওনা হয়ে গেলেন থিয়েটারের উদ্দেশে।

***

ছবি-কৃতজ্ঞতা : www.dvdbeaver.com

(চলবে...)

কুটুমবাড়ি


মন্তব্য

এস এম মাহবুব মুর্শেদ এর ছবি

গল্প শেষ? আরাম করে পড়া যাবে। হাসি

অতিথি লেখক এর ছবি

না, এখানে প্রথম ৬ পর্ব। আর মাত্র ১৪ পর্ব বাকি! হাসি

কুটুমবাড়ি

বইখাতা এর ছবি

চলুক

অতিথি লেখক এর ছবি

হাসি

কুটুমবাড়ি

খেকশিয়াল এর ছবি

মজার ব্যাপার হইলো গিয়া 'দ্য পিকচার অব ডোরিয়ান গ্রে' আমি পড়তাসিলাম, কার জানি অনুবাদ মনে নাই, ভাল লাগতাসিলো না তেমন। এরপর তাই ওইটা বাদ দিয়া মার্ভেল এর গ্রাফিকস নভেল ভার্সনটা পড়া শুরু করলাম, এক কথায় দারুণ! এখনো শেষ করি নাই যদিও। এখন পাইলাম আপ্নেরটা। পুরাটা শেষ করেন, আপ্নেরটাও পড়তে হইবো।

------------------------------
'..দ্রিমুই য্রখ্রন ত্রখ্রন স্রবট্রাত্রেই দ্রিমু!'

-----------------------------------------------
'..দ্রিমুই য্রখ্রন ত্রখ্রন স্রবট্রাত্রেই দ্রিমু!'

অতিথি লেখক এর ছবি

অনুবাদ ভালো লাগসে জেনে খুশি হলাম। হাসি

দ্য পিকচার অব ডোরিয়ান গ্রের বঙ্গানুবাদ আমিও আগে পড়সিলাম। সেটা অনেক আগের কথা, পাবলিক লাইব্রেরিতে বসে--কার অনুবাদ ছিল আমিও মনে করতে পারসি না। আমারও ভালো লাগে নাই, বলাই বাহুল্য, কারণ আমিও পুরাটা পড়ি নাই তখন। ওঁয়া ওঁয়া

তখন কি জানতাম এত চমৎকার একটা উপন্যাস মিস করসি! খাইছে

কুটুমবাড়ি

মাহবুব লীলেন এর ছবি

চমৎকার

অতিথি লেখক এর ছবি

ধন্যবাদ, লীলেনদা। হাসি

কুটুমবাড়ি

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।