দ্য পিকচার অব ডোরিয়ান গ্রে | দ্বিতীয় কিস্তি |

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: বুধ, ০১/০৯/২০১০ - ৩:৩৪পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

‘জীবন তার সব সুধা নিয়ে তোমার জন্যে অপেক্ষা করছে, ডোরিয়ান। কেবল তুমিই সত্য, আর সত্য তোমার অসাধারণ সৌন্দর্য, আকর্ষণ এবং সম্পদ, বাকি সবকিছু মিথ্যে।’

শক্তিশালী কথা, তবু একটা ব্যথার কামড় টের পেল ডোরিয়ান। মনে পড়ে গেছে ছবিটার ভাগ্যে কী ঘটবে। এখন এটা একটা দানো হয়ে উঠবে! আর এ লজ্জা তাকে বয়ে বেড়াতে হবে গোপনে!

এক মুহূর্তের জন্য সে ভাবল প্রার্থনা করবে যেন ছবিটার সাথে তার অদ্ভুত সম্পর্কের এখানেই ইতি ঘটে। ছবিটায় প্রার্থনার জবাব রয়েছে। খুব সম্ভব একটা নতুন প্রার্থনা ছবিটার পুরোনো রূপটি ফিরিয়ে দেবে।

কিন্তু ডোরিয়ান প্রার্থনা করল না। অনন্ত যৌবন লাভের হাতছানি সে উপেক্ষা করতে পারছে না। এই ছবিটা একটা জাদুকরি আয়না হয়ে উঠবে!

শুধু যদি সে এতটা বোকা আর এতটা অসার না হতো! সে আর আগের জীবনে কখনোই ফিরতে পারবে না।

প্রথম কিস্তি

দ্বিতীয় কিস্তি

পর্ব সাত ॥ বিপর্যয় ॥

গাড়িতে চড়ে থিয়েটারের উদ্দেশে চলেছেন দুই বন্ধু—লর্ড হেনরি এবং বাসিল। ডোরিয়ানও আছে সাথে। তাঁরা দুজনই সিবিল ভেনকে নিয়ে একটু উৎকণ্ঠায় আছেন। সত্যি বলতে কি, এমন একটি তন্বী সুন্দরী, যে কিনা ডোরিয়ানের হৃদয় দখল করে নিয়েছে, কৌতূহলী করে তুলছে তাদের দুজনকে। মেয়েটি কি তাঁদেরও আকৃষ্ট করতে পারবে? নাকি ডোরিয়ান আরও যোগ্য স্ত্রী বেছে নেয়ার সুযোগ হাতছাড়া করছে?

একজন হৃষ্টপুষ্ট ম্যানেজার, দুহাতে রত্নখচিত আংটি-পরা, পথ দেখিয়ে তাঁদের নির্ধারিত আসনে নিয়ে গেল। ‘রোমিও এবং জুলিয়েট’ নাট্যের দৃশ্য এটা, নাটুরেরা জীর্ণ কাপড় পরিহিত। হঠাৎ, তুমুল করতালির মধ্যে সিবিল ভেন খিল-আঁটা মঞ্চে পা রাখল। তার হাতগুলো যেন শীতল আইভরি দিয়ে তৈরি। হ্যাঁ, সে নিশ্চিতভাবেই মোহনীয় দেখতে, লর্ড হেনরি ভাবলেন, তাঁর দেখা অন্যতম আকর্ষণীয় নারী।

তাঁরা তিনজন পালাটির একটা বিখ্যাত দৃশ্যে তাকে অভিনয় করতে দেখলেন। এটা ছিল একটা সাড়া জাগানো ও নাটকীয় মুহূর্তের দৃশ্য, যা সিবিল অনেকবার করেছে এর আগে। প্রতিবার সে দর্শকশ্রোতাকে মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখত। কিন্তু আজ রাতে, কী এক অদ্ভুত কারণে সিবিলকে অমনোযোগী আর ভোঁতা দেখায়। তার মুখে আনন্দের কোনো ছাপ পড়ে না যখন, যেমনটি জুলিয়েট করে, সে রোমিওর দিকে তাকায়। তার কথাগুলো কেমন মেকি শোনায়।

সিবিল খুবই বাজে অভিনয় করল। আস্তে আস্তে ডোরিয়ান গ্রের মুখ ফ্যাকাশে হয়ে আসছিল। বাসিল এবং লর্ড হেনরি সিবিলের অভিনয়কে অনভিজ্ঞ হিসেবে রায় দিয়ে বাতিল করে দিলেন। সত্যি, দেখতে সে কমনীয়, কিন্তু তার অভিনয় জঘন্য। নাটকের দ্বিতীয় অঙ্ক শেষ হলে সিটি বাজানোর শব্দে হল ভরে উঠল।

লর্ড হেনরি চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন, গায়ে কোট চাপাচ্ছেন। ‘সে বিশিষ্ট সুন্দরী, ডোরিয়ান, কিন্তু সে অভিনয় জানে না। চলো যাই।’

সিবিলের ব্যর্থতা ডোরিয়ানকে বিপদে ফেলে দিয়েছে। তার প্রিয় বন্ধুদের সামনে সে অপমানিত বোধ করছে। ‘আমি দুঃখিত তোমাদের একটি সন্ধ্যা অপচয় হলো,’ সে ক্ষমা চাইল। ‘সে একটি নগণ্য, তুচ্ছ অভিনেত্রী।’

‘এভাবে কথা বলো না, ডোরিয়ান। বিশেষ করে তুমি যাকে ভালোবাস তার সম্পর্কে,’ বাসিল সতর্ক করলেন। ‘আমার ধারণা মিস ভেন আজ অসুস্থ। শিল্পসাধনা থেকে প্রেম অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ।’

‘এ ব্যাপারে চিন্তা করো না, ডোরিয়ান,’ লর্ড হেনরি উপদেশ দিলেন। ‘আমার তো মনে হয় না তুমি বিয়ের পরেও বউকে দিয়ে অভিনয় করাতে চাইবে। তাই, কী আসে-যায় এতে? বাসিল এবং আমার সাথে ক্লাবে চলো। আমরা সিবিল ভেনের রূপকে উদ্দেশ্য করে পান করব।’

কিন্তু ডোরিয়ানের দুঃখ বন্ধুদের সান্ত্বনায় দূর হওয়ার নয়। ‘দূর হও!’ সে চিৎকার করল। ‘আমার হৃদয় ভেঙে গেছে।’

প্রদর্শনীর বাকি সময়টুকু সে নিশ্চুপ বসে থাকল। তারপর ঝড়ের বেগে ঢুকল সিবিলের সজ্জাকক্ষে। মেয়েটি দাঁড়িয়ে ছিল সেখানে। মুখে বিমূঢ় চাউনি। চোখ জ্বলছে ভাটার মতো। শরীর থেকে যেন গরম আভা ঠিকরে বেরোচ্ছে।

‘কত্ত বাজে অভিনয় করলাম আজ!’ সে চেঁচাল।

‘ভয়ংকর,’ উত্তর এল। ‘এটা ছিল একটা জঘন্য অনুষ্ঠান। তুমি কি অসুস্থ?’

‘আমি আর কখনোই ভালো অভিনয় করতে পারব না,’ আনমনা কণ্ঠে সে বলল। ‘তুমি বুঝবে না, বুঝবে তুমি? যখন তোমাকে চিনতাম না, অভিনয় ছিল আমার জীবনের একমাত্র বাস্তবতা। এই প্রথম, আজ রাতে, আমি রঙ্গমঞ্চের মেকি, তুচ্ছ রূপটি দেখতে পেয়েছি।’

‘তুমি আমাকে এর চেয়ে ভালো কিছু দিয়েছ। তুমি আমাকে বুঝতে শিখিয়েছ ভালোবাসা কী? কোনো মঞ্চ আমার জন্যে যতটুকু, তার চেয়ে তুমি অনেক বেশি কিছু! আমার প্রেম! আমার প্রিন্স চার্মিং! তুমি আমার সব!’

‘কিন্তু তুমি কি বুঝতে পারনি কী করেছ? তোমার প্রতি আমার ভালোবাসাকে হত্যা করেছ,’ ডোরিয়ান ঠাণ্ডা গলায় উত্তর দিল। কঠোর চোখে তাকাল মেয়েটির দিকে। ‘আমি তোমাকে ভালোবাসতাম, কারণ তুমি ছিলে সেরা। কারণ তোমার ছিল এত্ত প্রতিভা! এখন দেখছি তুমি বোকা আর ভাসা-ভাসা। কী গাধাই না ছিলাম একটা! আমি আর তোমাকে দেখতে চাই না!’ সে রাগে চেঁচিয়ে উঠল।

সিবিল আতঙ্কিত হয়ে পড়েছে। কী করে তার প্রিন্স চার্মিং এত নিষ্ঠুর হতে পারে? সে তো বলেছে ভালোবাসে তাকে, চুমু খেয়েছে তাকে, বিশ্বের সবকিছু এনে দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। কেন সে এত বদলে গেছে? সিবিল কাঁদতে শুরু করল, কাঁদতে কাঁদতে মেঝের ওপর আছড়ে পড়ল। নিজের জীবন রক্ষায় ডোরিয়ানের হাঁটু আকড়ে ধরার চেষ্টা করল। ‘দয়া করো, প্রিয়তম। আমি কঠোর পরিশ্রম করে উন্নতির চেষ্টা করব। কথা দিচ্ছি আরও ভালো অভিনেত্রী হয়ে উঠব। আমি তোমাকে অনেক ভালোবাসি। আমাকে ছেড়ে যেয়ো না!’

তীব্র অবজ্ঞায় ডোরিয়ানের ঠোঁট বেঁকে যাচ্ছে, জ্বলন্ত চোখে তাকাল মেয়েটির দিকে। মেয়েটার কান্না তার বরফ-কঠিন হৃদয়ে একটুও আঁচড় কাটতে পারছে না। সিবিলকে একপাশে ছুড়ে মেরে গোড়ালির ওপর ভর দিয়ে ঘুরে দাঁড়াল সে।

‘আমি যাচ্ছি,’ শান্ত, পরিষ্কার কণ্ঠে সে বলল। ‘আর দেখা হবে না। তুমি আমাকে প্রচণ্ড হতাশ করেছ।’

ডোরিয়ান আর দেরি করল না। ঝড়ের বেগে থিয়েটার থেকে বেরিয়ে গেল।

পর্ব আট ॥ আতঙ্ক শুরু ॥

ডোরিয়ান সে রাতে ইতস্তত এদিক-সেদিক ঘোরাঘুরি করছিল। সে হতাশ এবং দ্বিধাগ্রস্ত। গাছ থেকে ঝরে পড়া ফুলে তার ঘোড়ায় টানা বড় গাড়িটা ভরে ওঠে। সে দ্যাখে কৃষক ভায়েরা তাদের ওয়াগন থেকে মাল নামাচ্ছে। পুরোটা সময়জুড়ে সে মনোবেদনায় অস্থির হয়ে রইল। সকালে সে ম্যানশনে ফিরে এল ক্লান্ত এবং নিঃশেষ হয়ে।

দরজা খুলে প্রথমেই তার চোখ গেল বাসিল হলওয়ার্ডের আঁকা তার নিজের ছবিটার দিকে। আর দেখেই সে চমকে গেল। ছবিতে তার মুখের আকৃতি বদলে গেছে। এও কি সম্ভব? এটা বিস্ময়কর, কিন্তু ছবিতে মুখের আদলটা এখন অন্যরকম। একটা নিষ্ঠুরতার ছাপ পড়েছে সে মুখে, যা আগে ছিল না।

সে কি স্বপ্ন দেখছে? সে ছবিটা আরও কাছ থেকে পরীক্ষা করে দেখল। জানালার পর্দা সরিয়ে দিতেই সকালের উজ্জ্বল আলোয় ঘর যেন হেসে উঠল। অবশ্য ছবির অদ্ভুত মুখটার কোনো পরিবর্তন হলো না তাতে। সে একটা আয়না তুলে নিয়ে নিজের মুখাবয়ব খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখল। সে দেখতে একই রকম আছে, শুধু ছবির মুখটা বিকৃত হয়ে গেছে।

সে তাহলে স্বপ্ন দেখছিল না! এটা কী ভয়ংকর! কী এর মানে? একটা চেয়ারে বসে পড়ে সে ভাবনায় ডুবে যায়। হঠাৎ তার মনে পড়ে বাসিলের স্টুডিওতে, ছবিটা আঁকা শেষ হতে যে উক্তিগুলো সে করেছিল।

সে একটা উন্মত্ত ইচ্ছা প্রকাশ করেছিল। সে তরুণ থাকতে চেয়েছিল, আর চেয়েছিল তার হয়ে বয়স বাড়বে শুধু ছবিটার। এখন, তার সেই পাগল-অভিপ্রায় সত্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। ডোরিয়ান তরুণ আর সুদর্শন থেকে যাবে এবং তার পাপের প্রায়শ্চিত্ত করবে তারই ছবি বহন করা ক্যানভাসটা!

কিন্তু এ ধরনের কোনো কিছু তো অসম্ভব। এমনকি এটা নিয়ে চিন্তা করাটাও ভয়ংকর।

ডোরিয়ান স্বার্থপর, শুধু তাই নিজের ভাগ্যের কথাই ভাবে। সে মোটেই চিন্তা করে না যে সিবিল ভেনের কষ্টের জন্য সে-ই দায়ী। তার বদলে, একটা মহান শিল্পকলার জন্য তার দরদ উথলে ওঠে। ছবিটার সৌন্দর্য চলে যাওয়ায় তার দুঃখ হতে থাকে।

হঠাৎ ডোরিয়ান উপলদ্ধি করে অশুভ ছবিটা তার জীবনের গোপন রহস্য বহন করছে! এটা তার গল্পই বলছে। ছবিটার রূপান্তর ইতিমধ্যে শুরু হয়ে গেছে। এটার সোনালি রং ধীরে ধীরে ছাই হয়ে যাবে। কী ভয়ংকর! সে যা পাপ করবে, তার দাম চুকাবে তার ছবিটা। সে এ কী করেছে! একটা ছবি কি শেখাবে তাকে নিজের আত্মাকেই ঘৃণা করতে?

এই দারুণ প্রহেলিকায় ভয় পেয়ে গিয়ে, ডোরিয়ান সিদ্ধান্ত নিল আর পাপ করবে না। সে সবরকম লোভ-লালসা থেকে দূরে থাকবে। লর্ড হেনরির কাছ থেকেও সে দূরে থাকবে, তাঁর দূষিত কথায় আর কান দেবে না।

ডোরিয়ান সিদ্ধান্তে পৌঁছায়। সে সিবিল ভেনের কাছে ফিরে যাবে, ক্ষমা চাইবে, তারপর বিয়ে করবে তাকে। সে বুঝতে পারছে সিবিলের প্রতি অন্যায় ও স্বার্থপর আচরণ করা হয়েছে। কিন্তু সে এটা ঠিক করে নেবে। তারা সুখী হবে। তাদের সংসার হবে সুন্দর ও পবিত্র।

ডোরিয়ান গ্রে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। চোখে পড়লেই কাঁপুনি উঠে যাচ্ছে, তাড়াতাড়ি সে পর্দা টেনে ছবিটা ঢেকে দিল। তারপর দরজা খুলে বেরিয়ে পড়ল ঘর থেকে। নরম ঘাসের ওপর দাঁড়িয়ে শ্বাস টানল বড় করে। আহ্! সকালের টাটকা বাতাসে তার ভেতরের দানোটা যেন মরে যাচ্ছে। অবশেষে, সে যখন বিছানায় শুতে গেল, তার মনজুড়ে শুধু সিবিল।

পর্ব নয় ॥ জাগরণ ॥

ডোরিয়ানের ঘুম ভাঙল বেশ খানিকটা বেলা গড়িয়ে যাওয়ার পর। ভিক্টর, তার ফ্রেঞ্চ খানসামা, কয়েকবারই চুপিসারে তার ঘরে ঢুকেছিল। কিন্তু ডোরিয়ান গ্রে-কে মড়ার মতো পড়ে থাকতে দেখে ফিরে যেতে হয়েছে তাকে। অবশেষে বেল বেজে উঠল। ভিক্টর চায়ের কাপ আর একরাশ চিঠি নিয়ে ঘরের ভেতরে ঢুকল।

একটু পরেই ডোরিয়ান বিছানা ছেড়ে উঠে পড়ল। গায়ে কাশ্মীরি বাথরোব গলিয়ে নিল স্নান করার জন্য। পানির ঠাণ্ডা স্পর্শ তাকে দ্রুত তাজা করে তুলল। গত রাতের যুক্তি-তর্ক যেন সম্পূর্ণ ভুলে গেছে। সে শোবার ঘরে ফিরে এল। চিঠিগুলো তুলে নিল হাতে, ঠাণ্ডা হয়ে আসা চায়ে চুমুক দিচ্ছে।

লর্ড হেনরির একটা চিঠি, আজই সকালে পত্রবাহকের মাধ্যমে এসেছে। একটু ইতস্তত করে সে সরিয়ে রাখল সেটা। অন্য খাম কটি ছিঁড়ে দেখল। সেগুলোতে রয়েছে রোজকার পাঁচমিশালি বিষয়। যেমন—ডিনারের নিমন্ত্রণ, চ্যারিটি কনসার্ট ও ব্যক্তিগত চিত্রপ্রদর্শনীর টিকিট ইত্যাদি।

হঠাৎ করেই তার চোখ গিয়ে পড়ল পর্দা-ঢাকা ছবিটার ওপর। এসব কি সত্যি? ছবিটা কি সত্যিই বদলে গেছে? নাকি এটা শুধুই তার উচ্চমার্গীয় কল্পনাশক্তি, যার ফলে সে হাস্যমুখের জায়গায় অশুভ দৃষ্টির ছায়া দেখতে পাচ্ছে? একটা ছবি তো আর বদলে যেতে পারে না!

ছবিটা আবার পরীক্ষা করতে হবে, তাই সে একা হওয়ার অপেক্ষায় থাকে। কফি দেয়া শেষ হওয়ায় ভিক্টর ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। ডোরিয়ান উঠে গিয়ে ছবির সামনে রাখা স্প্যানিশ কাউচটায় বসল।

কী হবে যদি ছবির এই ভয়ংকর পরিবর্তন অন্য কেউ দেখতে পায়? সে কী করবে যদি বাসিল এটা আবার দেখতে চায়? ডোরিয়ান উঠে দরজায় তালা লাগিয়ে দিল। কমপক্ষে সে তো একাকী থাকবে, তার কলঙ্কিত মুখোশটি দেখার সময়। তারপর সে পর্দা একপাশে সরিয়ে দিয়ে নিজের মুখোমুখি হলো। নিরেট সত্য এটা। ছবিটা বদলে গেছে।

এ তো অবিশ্বাস্য! এ কী করে সম্ভব? তার ভেতরে থাকা আত্মার সাথে ক্যানভাসে আঁকা ছবিটার কোনো সংযোগ আছে কি? সে ছবিটার দিকে পলকহীন চোখে তাকিয়ে থাকল। ভয় ও আতঙ্কে তার শরীর গুলিয়ে উঠছে।

এই ভোল-পালটে-ফেলা ছবিটা তাকে বুঝিয়ে দিচ্ছে সে সিবিল ভেনের সাথে কতটা অন্যায্য, কতটা কঠোর আচরণ করেছে। এখনও মাসুল দেয়ার সময় আছে। সিবিল এখনও তার পত্নী হতে পারে। তাহলে হয়তো তার স্বার্থপরতা মোড় নিতে পারে কিছুটা মহত্তর অনুভূতির দিকে।

অবশেষে সে সিবিলকে চিঠি লেখার সিদ্ধান্ত নিল। তার কাছে ক্ষমা চাইবে, বলবে তাকে কতটা ভালোবাসে। চিঠি লেখা শেষ হতে না হতেই দরজায় নক করার শব্দ হলো। একজন ভৃত্য ঘোষণা করল যে লর্ড হেনরি উদ্বিগ্ন হয়ে অপেক্ষা করছেন তার জন্য। অনুমতির তোয়াক্কা না করে, লর্ড হেনরি নিজেই ডোরিয়ানের শোবার ঘরে সবেগে প্রবেশ করলেন।

‘আমি অত্যন্ত দুঃখিত, ডোরিয়ান,’ লর্ড হেনরি শুরু করলেন।

‘তুমি কি সিবিল ভেনের কথা বোঝাতে চাইছ?’ ডোরিয়ান জানতে চাইল।

‘তুমি কি অভিনয়ের শেষে তাকে দেখতে গিয়েছিলে?’ তার বন্ধু পালটা অনুসন্ধান করলেন।

‘হ্যাঁ এবং বর্বর আচরণ করেছি তার সাথে,’ সায় দিল ডোরিয়ান। ‘কিন্তু এখন আমি অনেকটাই স্বাভাবিক হয়ে এসেছি। আর আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি এখন থেকে শুধু ন্যায় পথে চলব। আমি সিবিলকে বিয়ে করতে চাই। আজই দেখতে যাব তাকে, আমার জঘন্য ব্যবহারের জন্যে ক্ষমা চাইব।’

‘অনেক দেরি হয়ে গেছে!’ চেঁচিয়ে উঠলেন লর্ড হেনরি। ‘সিবিল ভেন এখন মৃত!’
ডোরিয়ান লাফিয়ে উঠল। তীক্ষ্ণ আর্তচিৎকার বেরিয়ে এল তার গলা চিড়ে, ‘মৃত! সিবিল মৃত! এটা সত্য নয়! এটা একটা জঘন্য মিথ্যে! এ কথা বলার সাহস তোমার কীভাবে হলো?’

‘এটা পুরোপুরি সত্য, ডোরিয়ান,’ লর্ড হেনরির কণ্ঠ অত্যন্ত গুরুগম্ভীর শোনায়। ‘আজ সকালের সব কটা দৈনিকে খবরটা এসেছে। তোমাকে সতর্ক করার জন্যে একটা বার্তা পাঠিয়েছিলাম যেন আমি না আসা পর্যন্ত কারও সাথে দেখা না কর। ঘটনার একটা তদন্ত হবেই, আর তাতে তোমার জড়িয়ে পড়া চলবে না। যদি তোমার সন্ধান পায়, ভয়াবহ কলঙ্ক রটবে। থিয়েটারের ওরা তোমার নাম জানে কি?’ তিনি জানতে চাইলেন। ‘যদি না জানে, তাহলে সব ঠিক আছে। গত রাতে তোমাকে কেউ মেয়েটার সজ্জাকক্ষে যেতে দেখেছে কি? এটা গরুত্বপূর্ণ।’

ডোরিয়ান কয়েক মুহূর্ত উত্তর দিতে পারল না। আতঙ্কে তার বুদ্ধি লোপ পাচ্ছে যেন। অবশেষে সে রুদ্ধশ্বাস কণ্ঠে বলল, ‘হ্যারি, আমি এটা সইতে পারছি না! দয়া করে কী ঘটেছে আমাকে খুলে বলো।’

পর্ব দশ ॥ আত্মহত্যা ॥

লর্ড হেনরি ব্যাখ্যা করলেন যে সিবিল যখন মায়ের সাথে থিয়েটার ছেড়ে বেরোচ্ছিল, তখন কিছু একটা ফেলে আসার ছুঁতোয় সে আবার ফিরে যায়। তার ফিরতে দেরি হচ্ছিল দেখে একজন সহকারী এগিয়ে যায় খোঁজ নেয়ার জন্য। সিবিলকে সে মেঝের ওপর মৃত পড়ে থাকতে দেখে। অনেকখানি বিষ মুখে দিয়েছিল সে, সাথে সাথে মারা যায়।

‘আমি খুন করেছি সিবিল ভেনকে,’ ডোরিয়ান বলল, লজ্জায় মাথা ঝুঁকে আছে তার, ‘নিশ্চয়ই খুন করেছি তাকে, যেন আমিই ছুরি চালিয়েছি তার ছোট্ট গলায়।’ লর্ড হেনরি তাঁর বন্ধুকে সান্ত্বনা দিলেন এই বলে যে সিবিল ছিল অতি রোমান্টিক একটি মেয়ে যে নিজের জীবন নিজেই নিয়েছে। তাঁর মতে অন্য কেউ এর জন্য দায়ী নয়।

লর্ড হেনরির কথা ডোরিয়ানের কানে গেল। সে অনুভব করল সময় হয়েছে নিজের মনকে প্রস্তুত করার।

নাকি ইতিমধ্যেই সিদ্ধান্ত নেয়া হয়ে গেছে? তার হয়ে জীবন নিজেই এটি নিয়েছে। অনন্ত যৌবন, ভোগবিলাস, বন্য আনন্দ আর কামনাময় জীবন—এ সবকিছু সে পাবে।

‘ওহ্, হ্যারি, তাকে কী ভালোবাসতাম একসময়! মনে হয় যেন কয়েক বছর আগের কথা। সে-ই ছিল আমার সবকিছু। তারপর সেই ভয়ংকর রাতটি এল— সত্যিই কি এটি মাত্র গত রাতের কথা—সে খুব বাজে অভিনয় করল আর আমার মন ভেঙে গেল।’

‘সে সবকিছু ব্যাখ্যা করেছিল। কিন্তু আমি একটুও টলিনি। ভেবে নেই সিবিল একটি স্বল্পবুদ্ধির মেয়ে। এর পর কিছু একটা ঘটে যা আমাকে ভীত করে তোলে। এটা কী ছিল তা তোমাকে বোঝাতে পারব না,’ সে বলল, তার মাথায় ঘোরপাক খাচ্ছে সেই অদ্ভুত ছবিটার কথা। ‘কিন্তু এটা আমার হয়ে সিদ্ধান্ত নেয়। আমাকে সিবিলের কাছে ফিরে যেতে হবে।’

লর্ড হেনরি কোনো কথা না বলে বন্ধুর কথা শুনে গেলেন। তিনি আত্মহত্যার ঘটনাটিকে একটি শ্রেষ্ঠ গর্ভনাটিকা হিসেবে আবিষ্কার করলেন; সত্যি বলতে, তিনি শুধু ডোরিয়ানের সুনাম রক্ষায় আগ্রহী।

‘হ্যারি,’ ডোরিয়ান গ্রের গলা চড়ে গেল, বসল গিয়ে বন্ধুর পাশে, ‘আমার ভেতর বিয়োগান্তক কিছু কাজ করছে না। আমি কি পাষাণ?’

‘না, তুমি শুধু খুবই তরুণ আর খুবই রোমান্টিক। সময় দাও, তোমার ঘা সেরে যাবে। আজ রাতে আমার সাথে অপেরায় চলো, এটা তোমাকে ভুলিয়ে রাখবে,’ লর্ড হেনরি পরামর্শ দিলেন।

ডোরিয়ান তক্ষুনি আমন্ত্রণ গ্রহণ করল। সে সিবিলকে নিয়ে দ্বিতীয়বার চিন্তা না করার ওয়াদা করল। ডোরিয়ানের কাছে, শুধু তার নিজের সুখ অগ্রাধিকার পাবে। সে দ্রুতই মৃত সিবিল ভেনকে ভুলে যাবে।

‘একটা খারাপ সময় কাটিয়ে উঠতে আমাকে সাহায্য করছ, হ্যারি। এখন আমার অবাক লাগছে ভাগ্যে কী লেখা আছে ভেবে,’ সে বলল।

‘জীবন তার সব সুধা নিয়ে তোমার জন্যে অপেক্ষা করছে, ডোরিয়ান। কেবল তুমিই সত্য, আর সত্য তোমার অসাধারণ সৌন্দর্য, আকর্ষণ এবং সম্পদ, বাকি সবকিছু মিথ্যে।’

শক্তিশালী কথা, তবু একটা ব্যথার কামড় টের পেল ডোরিয়ান। মনে পড়ে গেছে ছবিটার ভাগ্যে কী ঘটবে। এখন এটা একটা দানো হয়ে উঠবে! আর এ লজ্জা তাকে বয়ে বেড়াতে হবে গোপনে!

এক মুহূর্তের জন্য সে ভাবল প্রার্থনা করবে যেন ছবিটার সাথে তার অদ্ভুত সম্পর্কের এখানেই ইতি ঘটে। ছবিটায় প্রার্থনার জবাব রয়েছে। খুব সম্ভব একটা নতুন প্রার্থনা ছবিটার পুরোনো রূপটি ফিরিয়ে দেবে।

কিন্তু ডোরিয়ান প্রার্থনা করল না। অনন্ত যৌবন লাভের হাতছানি সে উপেক্ষা করতে পারছে না। এই ছবিটা একটা জাদুকরি আয়না হয়ে উঠবে!

শুধু যদি সে এতটা বোকা আর এতটা অসার না হতো! সে আর আগের জীবনে কখনোই ফিরতে পারবে না।

পর্ব এগারো ॥ রহস্য প্রায়-উন্মোচিত ॥

পরদিন বাসিল হলওয়ার্ড ডোরিয়ান গ্রে-কে দেখতে এলেন। তিনি সিবিলের মৃত্যুতে সহানুভূতি জানাতে চান। তিনি বন্ধুকে এও জিজ্ঞেস করবেন ছবিটি সে প্যারিসের কোনো গ্যালারিতে রাখতে চায় কি না।

ডোরিয়ান লাঞ্চ করছে, এই সময় বাসিল ঘরে প্রবেশ করলেন। ‘দ্য গ্লোব-এ সিবিলের কথা ছেপেছে। ক্লাবে বেড়াতে গিয়ে এটি আমার হাতে আসে, আমি তক্ষুনি রওনা হই,’ বাসিল বললেন। ‘আমি যে কতটা দুঃখ পেয়েছি তা বলার মতো নয়। আমি জানি তোমার অনুভূতি ভয়ংকর। তুমি কি তার মায়ের সাথে সাক্ষাৎ করে এসেছ?’

‘অবশ্যই না,’ গজগজ করে উঠল ডোরিয়ান গ্রে। বিরক্তি নিয়ে চুমুক দিল গ্লাসে ঢালা হলুদ ওয়াইনে। ‘আমি অপেরায় ছিলাম।’

‘তুমি অপেরায় গিয়েছিলে!’ বিস্ময়ে বাসিলের গলা চড়ে গেল। ডোরিয়ানের নির্দয় আচরণ তাকে আহত করছে। ‘তুমি অপেরায় গিয়েছিলে যখন সিবিল ভেন মৃত পড়ে আছে?’

‘বাদ দাও তো এসব!’ ডোরিয়ান চিৎকার করল। ‘অতীত হলো অতীত।’

‘গতকাল তোমার কাছে অতীত?’ তার আতঙ্কিত বন্ধুটি প্রশ্ন করলেন। ‘ডোরিয়ান, এটা ভয়ংকর। কিছু একটা তোমাকে পুরোপুরি বদলে দিয়েছে। তোমার কথা শুনে বোঝার কোনো উপায় নেই যে তোমার হৃদয় বলতে কিছু আছে। এ সবকিছুর জন্যে দায়ী হ্যারির কু-প্রভাব।’

ডোরিয়ান হাত নেড়ে বাসিলের কথা উড়িয়ে দিল। ‘আমি চাই না কেউ দয়া দেখিয়ে আমার অনুভূতিকে খাটো করুক। যে নিজের নিয়ন্তা সে দুঃখকে যেমন দ্রুত মাটি চাপা দিতে পারে, তেমনি পারে নতুন আনন্দ খুঁজে নিতে। আমি চাই সিবিলের একটা ছবি এঁকে দেবে আমাকে, বাসিল। তাকে মনে রাখার জন্যে কিছু একটা আমার চাই।’

‘ঠিক আছে,’ বাসিল রাজী হলেন। ‘যদি তোমাকে এটা শান্তি দেয়। কিন্তু বিনিময়ে তোমাকেও কিছু করতে হবে আমার জন্যে। আমার স্টুডিওতে বসবে তুমি, আমি তোমার আরেকটি ছবি আঁকতে চাই।’

‘আমি আর কখনোই তোমার জন্যে বসতে পারব না, বাসিল। এটা অসম্ভব!’ ডোরিয়ান রাগের সাথে দিব্যি কাটল।

চিত্রশিল্পী একদৃষ্টিতে তাকালেন তার দিকে। ‘বোকার মতো কথা বলো না। তোমার যে ছবিটা আমি করে দিয়েছি তা কি তোমার পছন্দ নয়?’ বাসিল প্রশ্ন করলেন। ‘তা এটার সামনে পর্দা ঝুলিয়ে রেখেছ কেন? এটা আমার সেরা কাজ। সত্যি খারাপ লাগছে যে আমার কাজটি তুমি গোপন করে রেখেছ।’

‘কড়া আলোয় ছবিটার ক্ষতি হতে পারে,’ ডোরিয়ান দ্রুত ব্যাখ্যা দিল।

‘কড়া আলো! নিশ্চয়ই না। ছবিটা ঝোলানোর এটাই আদর্শ জায়গা। দেখতে দাও আমাকে।’ বাসিল ছবিটার দিকে হাঁটা ধরলেন।

ডোরিয়ান গ্রের মুখ দিয়ে একটা ভয়ংকর চিৎকার বেরিয়ে এল। দ্রুত ছুটে গেল বাসিল আর ছবিটার মাঝখানে। ‘তুমি অবশ্যই এটার দিকে তাকাবে না!’

‘কেন তাকাব না?’ বাসিল প্রশ্ন করলেন, তাঁর কিছুটা হাসি পাচ্ছে।

‘তুমি যদি তাকাতে চেষ্টা কর, বাসিল, শপথ করে বলছি আর তোমার সাথে কথা বলব না। আমি মোটেই ঠাট্টা করছি না।’

বাসিল যেন বজ্রাহত হয়েছেন, চূড়ান্ত বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে আছেন ডোরিয়ানের দিকে। তার এই উগ্র রূপ তিনি আগে কখননো দেখেননি। ভীষণ রাগে ডোরিয়ানের মুখ ফ্যাকাশে দেখাচ্ছে। হাতগুলো মুষ্টিবদ্ধ, ভয়ানকভাবে নড়ছে তার পুরো শরীর।

‘তুমি না চাইলে আমি তাকাব না,’ বাসিল শীতল গলায় বললেন। গোড়ালির ওপর ভর দিয়ে ঘুরে দাঁড়ালেন তিনি। আস্তে আস্তে এগিয়ে যাচ্ছেন জানালার দিকে। ‘কিন্তু সত্যি, এটা অদ্ভুত যে নিজের কাজ দেখার অনুমতি আমার নেই, বিশেষ করে যখন আসছে শরতে এটি প্যারিসে প্রদর্শন করতে যাচ্ছি।’

‘প্রদর্শন করবে! তুমি এটা প্রদর্শন করতে চাও?’ ডোরিয়ান বিস্ময়ে চেঁচিয়ে উঠল, একটা ভয়ংকর অনুভূতি ধীরে ধীরে গ্রাস করছে তাকে। তার গোপন রহস্যটি সবাই জেনে যাবে?

‘কেন তুমি আপত্তি করবে?’ জানতে চাইলেন বাসিল। ‘ছবিটা তুমি ঢেকে রেখেছ, তার মানে এটা তোমার পছন্দ নয়।’

ডোরিয়ান গ্রে তার কপালে হাত বোলাল। সেখানে ঘামের বিন্দু ফুটে আছে। বুঝতে পারছে সে একটা ভয়াবহ খাদের কিনারে এসে দাঁড়িয়েছে।

‘তুমি এটা ভুলে যেতে পার না যে আমাকে নিশ্চিত করেছিলে ছবিটি প্রদর্শন করবে না,’ ডোরিয়ান চেঁচিয়ে উঠল। তারপর তার মনে পড়ল লর্ড হেনরি একবার কিছুটা কৌতুক মিশিয়ে বলেছিলেন সে যেন বাসিলকে প্রদর্শনীতে ছবিটা পাঠাতে না চাওয়ার কারণ জিজ্ঞেস করে।

‘বাসিল,’ সে বলল, সরাসরি তাকাল বন্ধুর চোখের দিকে। ‘তুমি কেন ছবিটি প্রদর্শন করার প্রস্তাবে আগে বাধা দিয়েছিলে?’

চিত্রশিল্পী এবার নিজেই কেঁপে উঠলেন। ‘তোমাকে যদি বলি, হেসে উড়িয়ে দেবে। তোমার ছবিটা যদি আমাকে দেখাতে না চাও, আমি কোনো প্রশ্ন তুলব না। তোমার বন্ধুত্ব আমার কাছে ছবিটির চেয়ে বেশি মূল্যবান।’

‘না, বাসিল, তোমাকে বলতেই হবে,’ জেদ ধরল ডোরিয়ান। ‘আমার জানার অধিকার আছে।’ বাসিল হলওয়ার্ডের রহস্যটি জানার জন্য সে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।
‘বসো, ডোরিয়ান,’ বাসিল বললেন, তাঁকে উত্তেজিত দেখাচ্ছে। ‘শুধু একটি প্রশ্নের উত্তর দাও—তুমি কি ছবিটিতে অদ্ভুত কিছু লক্ষ করেছ? এমন কিছু যা তোমার প্রথমে নজরে আসেনি, পরে উন্মোচিত হয়েছে তোমার কাছে?’

‘বাসিল!’ আঁতকে উঠল ডোরিয়ান, চেয়ারের হাতল খামচে ধরে বন্য চোখে তাকিয়ে আছে।

‘ও, লক্ষ করেছ তাহলে। কথা বলো না,’ বাসিল উত্তর দিলেন। ‘তোমার ব্যক্তিত্ব অস্বাভাবিক রকম প্রভাব ফেলেছে আমার ওপর। নিয়তিপূর্ণ সেই দিনে, আমি তোমার একটি ছবি আঁকার সিদ্ধান্ত নেই, ঠিক তোমার মতো করে। হয় বস্তুস্বাতন্ত্র্যবাদের নিয়মে অথবা তোমার ব্যক্তিত্বের জাদুতে, কিছু একটা ঘটে যায়। আমি কঠোর পরিশ্রম করি যার ফলে চূড়ান্ত সাফল্য আসে। কিন্তু আমি আমার পুরোটাই এতে ঢেলে দিয়েছি। তোমার জন্যে আমার অনেকটুকু প্রশংসা। তাই আমি সিদ্ধান্ত নেই ছবিটি প্রদর্শন না করার।’

বাসিল বলে চললেন, ‘ডোরিয়ান, এটা অবাক করার মতো বিষয় যে তুমি ছবিটাতে এর প্রতিফলন দেখতে পেয়েছ।’

‘আমি কিছু একটা দেখেছি,’ থেমে থেমে উত্তর দিল ডোরিয়ান, ‘কিছু একটা—যা কৌতূহল উদ্রেককারী।’

‘ঠিক আছে, তাহলে,’ ভারমুক্ত কণ্ঠে বাসিল বললেন, ‘নিশ্চয়ই কিছু মনে করবে না এখন, যদি আমি কাজটি প্রদর্শনীতে পাঠাই।’

‘কক্ষনো না,’ ডোরিয়ান গর্জে উঠল।

বাসিল বন্ধুর সাথে তর্ক না করার সিদ্ধান্ত নিলেন। ‘এটি তোমার সিদ্ধান্ত এবং আমি একে সম্মান করি, ডোরিয়ান। তুমি একজন বিশেষ ব্যক্তি আমার জীবনে, যে সত্যি আমার শিল্প সাধনায় প্রভাব ফেলেছে।’

বাসিল তাঁর হ্যাট ও কোট তুলে নিয়ে বন্ধুর দিকে ঘুরে দাঁড়ালেন। ‘তুমি কি আমার জন্যে আবার বসবে?’ জানতে চাইলেন তিনি।

‘অসম্ভব!’ ডোরিয়ান বলল। ‘আমি তোমাকে ব্যাখ্যা করে বোঝাতে পারব না, বাসিল, কিন্তু এটা নিশ্চিত যে আমি আর ছবি আঁকাতে বসব না। বিপজ্জনক কিছু আছে এই ছবিতে। যেন এর নিজস্ব প্রাণ রয়েছে।’

সে বাসিলকে শুভবিদায় জানাল। দরজা বন্ধ করে হঠাৎ তার নিজের মনে হাসি পেল। সে বন্ধুকে বোকা বানাতে সক্ষম হয়েছে। ভয়ংকর এই ছবিটির আসল সত্য বাসিল কোনোদিনই জানতে পারবেন না। তবুও, সে উদ্বিগ্ন হয়ে উঠল। যে কোনো মূল্যে ছবিটি লুকিয়ে রাখতে হবে। এটি প্রকাশ হয়ে যাবার ঝুঁকি সে আর নিতে পারে না!

পর্ব বারো ॥ একটি অশুভ বই ॥

ডোরিয়ান একজন ভৃত্যকে আদেশ করল ছবিটিকে তৃতীয় তলায় নিয়ে যাওয়ার জন্য। সেখানেই তার পুরোনো খেলার ঘরে ঠাঁই হলো ওটার।

কেউ যেন সে ঘরে প্রবেশ করতে না পারে এ মর্মে তার বিশ্বস্ত ভৃত্যকে কড়া নির্দেশ দেয়া আছে। মোটা কাঠের দরজাটায় তালা দেয়া থাকে সব সময়। একমাত্র চাবিটা ডোরিয়ানের কাছে। সেখানে, সে ভাবল, তার ভয়ংকর সত্যটি দুনিয়া থেকে নিরাপদে থাকবে।

দরজাটা বন্ধ করা হয়েছে, ডোরিয়ান চাবিটা পকেটে ঢুকিয়ে রাখল। চোখ বোলাল ঘরের চারদিকে। সপ্তদশ শতকের একটা বড় বেগুনি রেশমি কাপড় তার দৃষ্টি কেড়ে নিল। এটা তার নানা ইতালির এক মঠ থেকে নিয়ে এসেছিলেন। হ্যাঁ, এটা দিয়ে ভয়ংকর ছবিটা ঢেকে রাখা যাবে। এমনিতে মৃতদেহের মোড়ক হিসেবে কাজে আসে, এখন এটা লুকিয়ে রাখবে এমন কিছুকে যার নিজস্ব পচন রয়েছে। যদিও মৃতদেহের পচন থেকে এটা বেশি ভয়াবহ—আতঙ্ক ছড়াবে অথচ নিজে কখনও মরবে না!

সে বেরিয়ে এসে দরজায় তালা দিল। সিঁড়ি ভেঙে নেমে এল বসার ঘরে। সে ওইদিনের একটা পত্রিকা হাতে তুলে নিল। সিবিলের মৃত্যুর খবরে ছেয়ে আছে পত্রিকাটি। ডোরিয়ানের সৌভাগ্য, তার নাম কোথাও উল্লেখ করা হয়নি। বাজে প্রচার এড়ানো গেছে ভেবে ডোরিয়ান ভারমুক্ত হলো। আরেকবার প্রতিজ্ঞা করল ভবিষ্যতে সে শুধু নিজের সুখের কথা চিন্তা করবে।

ঠিক বিকেল পাঁচটার একটু পরই প্রধান ফটকে বেল বেজে উঠল। একটা পার্শেল এসেছে লর্ড হেনরির তরফ থেকে। ডোরিয়ানকে উৎফুল্ল করার জন্য একটা ছোট্ট হলুদ মলাটের বই পাঠিয়েছেন তিনি। এত অদ্ভুত বই ডোরিয়ান জীবনেও পড়ে দেখেনি।

দুনিয়ার সব পাপের কথা উল্লেখ করা আছে বইটায়। উপন্যাসটির কোনো প্লট নেই আর চরিত্রও মাত্র একটি। একজন তরুণ প্যারিসবাসী যে বাস করে ঊনবিংশ শতাব্দীতে, কিন্তু জীবন কাটিয়ে দেয় আগের প্রতিটি শতাব্দীর লালসা চরিতার্থ করার কাজে। এটা একটা অশুভ বই।

কিন্তু ডোরিয়ান এতটাই মোহিত হয়ে যায় যে সে পড়া থামাতে পারে না। পরবর্তী বছরগুলোয় ডোরিয়ান গ্রে কখনোই মুক্ত হতে পারে না অশুভ এই বইটার প্রভাব থেকে। এমনকি সে কখনও চেষ্টাও করে না। বরং সে প্যারিস থেকে বইটির আরও কয়েকটি কপি আনিয়ে নেয়।

সে বইগুলো বিভিন্ন রঙের মলাটে বাঁধিয়ে নেয় যেন সেগুলো তার মেজাজের সাথে খাপ খেয়ে যায়। উপন্যাসের নায়কটি একই সাথে বৈজ্ঞানিক ও রোমান্টিক ভাবধারার একজন তরুণ প্যারিসবাসী। অদ্ভুত মিল রয়েছে তার ডোরিয়ানের সাথে। চরিত্রটি এত বেশি তার মতো যে মনে হতে থাকে কাহিনিটি তার নিজের জীবনের, যদিও সেটি এখনও সে অতিবাহিত করেনি!

ডোরিয়ানের সৌন্দর্য সবাইকে মোহিত করে রাখে। এমনকি যারা তার খারাপ স্বভাব সম্পর্কে শোনে, তারাও বিশ্বাস করে না। তাকে দেখে মোটেও শয়তান মনে হয় না। বরং তাকে দেখে এমন একজন ব্যক্তির মতোই মনে হয় যে এখনও পবিত্র রয়েছে।

যদিও, ডোরিয়ান লর্ড হেনরির বইয়ে লেখা জীবন অনুসরণ করতে শুরু করেছে। এবং এটা খুবই সহজ। সে ধনী। তার সুন্দর চেহারায় যে কেউ আকৃষ্ট হয়। আনন্দ এবং নিষ্ঠুরতা দুটোই তার জানা। সে যা চায় তা-ই পেতে পারে।

তার সম্পর্কে আশ্চর্য সব গল্প লন্ডনজুড়ে ছড়িয়ে পড়ল। সে দেখতে এখনও পবিত্র, কিন্তু আসলেই কি তাই? ডোরিয়ানের লম্বা, রহস্যময় অনুপস্থিতি প্রায়ই ঘটতে থাকে। ফিরে এসে, সে সিঁড়ি ভেঙে তালাবদ্ধ ঘরটায় যায় এবং বাসিলের আঁকা তার নিজের ছবিটার সামনে দাঁড়িয়ে থাকে।

সেখানে, সে ক্যানভাসের ওপর অশুভ, কুৎসিত ও বয়স্ক চেহারা দেখতে পায়। ছবিটা থেকে যতই তার চেহারা হারিয়ে যেতে থাকে, ততই সে নিজের আত্মাকে আরও বেশি দূষিত করার দিকে আগ্রহী হয়ে ওঠে!

কেউ জানে না সে কোথায় যায়। বন্দরের কাছের নোংরা সরাইখানার সেই ঘরটি সম্পর্কেও কেউ জানে না। ছদ্মবেশ ও ধার করা নাম নিয়ে ডোরিয়ান গ্রে অনায়াসে এসব ভয়ংকর জায়গায় ঘুরে বেড়ায়।

যেসব পাপের কথা সে ছোট্ট হলুদ মলাটের বইটাতে পড়েছে সেসব তার জীবনে সত্যি হয়ে দেখা দিল।

অসৎ চরিত্র নিয়ে, ডোরিয়ান গ্রে ধ্বংস ও রোমাঞ্চের উন্মত্ত ক্ষুধা মিটিয়ে যায়! সে তার প্রতিটি মর্জি, প্রতিটি বাতিক, প্রতিটি চাহিদা পূরণ করে। সব ইন্দ্রিয়ের গভীর রহস্য সে উন্মোচন করে।

একই সময়ে, ডোরিয়ান শহরে সুপরিচিত। সে বিখ্যাত তার বাহারি পোশাক-আশাকের জন্য। সে ধনী এবং প্রতিটি খোশখেয়াল পূরণে সক্ষম। সে বাদ্যযন্ত্র, দামি গহনা এবং দুর্লভ শিল্পকর্ম সংগ্রহ করতে শুরু করেছে। তার বাড়ি আছে লন্ডনে, আছে বিশাল বিষয়-সম্পত্তি।

সে দুহাতে টাকা ওড়াতে থাকে।

কিন্তু তার সব সম্পদ, সব সঞ্চয়—পলায়নের উপায় মাত্র। যেখানে তার শৈশব কেটেছে সেই নিঃসঙ্গ, তালাবদ্ধ ঘরটার দেয়ালে আঁটা তার গন্তব্য। ভয়ংকর ছবিটি সে ঝুলিয়ে রেখেছে সেখানে, যার ধারাবাহিক পরিবর্তন প্রকাশ করছে তার নৈতিক অধঃপতনকে। দৃষ্টি থেকে আড়ালে রাখতে, সে যবনিকা টেনে রেখেছে সেটির ওপর। কয়েকটি সপ্তাহ সে তালাবদ্ধ ঘরটি থেকে দূরে থাকল। ভুলেই গেল ভয়ংকর চিত্রিত বস্তুটির কথা। কিছু সময়ের জন্য, সে হালকা হৃদয়ে আনন্দময় মুহূর্ত উপভোগ করল।

তারপর হঠাৎ এক রাতে সে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়ল। ব্লু গেট ফিল্ডের ভয়ংকর জায়গাগুলোয় হানা দিল সে। যত দিন না তাকে তাড়িয়ে দেয়া হলো সেখানেই থাকল। ফিরে এসে, সে ছবিটির সামনে বসে থাকল—কিছুক্ষণ ঘৃণা করল নিজেকে এবং নিজের ছবিটিকে। কয়েক বছর পর থেকে সে আর লম্বা সময়ের জন্য ছবিটি থেকে আলাদা হতে পারত না। সে ইটালিতে লর্ড হেনরির সাথে ভাগাভাগি করা ভিলাটি ত্যাগ করল এবং শীতের মওসুমে আলজিয়ার্সের ছোট্ট সাদা বাড়িটাতে যাওয়া বন্ধ রাখল।

ছবিটি নিয়ে দুশ্চিন্তা করা যেন ডোরিয়ান গ্রের জীবনের অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কী হবে যদি এটি চুরি হয়ে যায়? কী হবে যদি তার অনুপস্থিতিতে কেউ ঘরটায় ঢুকে পড়ে, জেনে যায় তার সব রহস্য? চিন্তায় চিন্তায় সে পাগল হয়ে ওঠে। নাকি দুনিয়া ইতিমধ্যেই সন্দেহ করা শুরু করেছে?

মোটের ওপর, কিছু লোক তো আছে যারা তাকে অবিশ্বাস করে। ওয়েস্ট এন্ডের এক ক্লাবে আরেকটু হলে তাকে ভেটো দেয়া হতো। একদিন এক বন্ধু তাকে লন্ডন ক্লাবে নিয়ে যেতেই ডিউক অব ডারউইকসহ বেশকিছু ভদ্রলোক সেখান থেকে উঠে বেরিয়ে যান।

পঁচিশতম জন্মদিনে, তার কু-কীর্তির কথা ভদ্রসমাজে আবার ছড়িয়ে পড়ল। বলা হয় তাকে বিদেশি নাবিকদের সাথে লড়তে দেখা গেছে, তস্করদের সাথেও ভিড়তে দেখেছে কেউ কেউ।

মেয়েমহল খুবই ভক্ত ছিল তার, এখন এড়িয়ে চলে তাকে। গণ্যমান্য ব্যক্তিরা ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যান, যদি সে তাদের ক্লাবে ঢোকে। একসময়ের নিষ্পাপ এই ছেলেটির এ কী হলো? শুধুমাত্র ডোরিয়ান গ্রে জানে এর উত্তর। লর্ড হেনরির বই তাকে দূষিত করে ফেলেছে।

তার কাছে, পঙ্কিলতাই এখন সুন্দর।

(চলবে...)

******
কুটুমবাড়ি

******
ছবিসূত্র : ১. latemag.com

২. best-horror-movies.com


মন্তব্য

বইখাতা এর ছবি

ভালই হয়েছে। তবে কিছু কিছু বাক্য কেমন যেন কাঠ কাঠ লেগেছে, পড়ে আরাম পাইনি।

অতিথি লেখক এর ছবি

ধন্যবাদ। সাথে থাকার জন্য

কুটুমবাড়ি

রোমেল চৌধুরী [অতিথি] এর ছবি

প্রাঞ্জল বর্ণনা ! কী অপরূপ জিনিস, এক বসাতেই ফিনিশ !

অতিথি লেখক এর ছবি

ধন্যবাদ, ভাইয়া। আপনার মন্তব্য পেয়ে ভালো লাগল খুব হাসি

কুটুমবাড়ি

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।