একাকী ভ্রমণ

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: রবি, ০৩/১০/২০১০ - ৯:৩৫পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

জীবনের হাজারো ব্যার্থতা, মন কষাকষি, চারপাশের দুনিয়াদারির হালচাল প্রায়ই মনটাকে অস্থির করে তোলে। দুনিয়াটাকে প্রায়ই মনে হয় একটা জেলখানা। যেখানে কোনকিছুই ঠিকভাবে হচ্ছেনা। প্রতিদিন বোমাবাজি, রাজনৈতিক কূটচাল,অসাম্য দেখে মন বিষিয়ে ওঠে। এমন সময় চারপাশের সবকিছু থেকে নিষ্কৃতি নিতে পারলে মনে হয় ভালো হতো।যদি দূরে কোথাও সমাজ সভ্যতার আড়ালে চলে যাওয়া যেত।সেটা আসলে কখনোই পাওয়া যায়না।সবশেষে মন চায় একটু একাকীত্ব।

প্রতিদিনের জীবনে কিছু সময় একা থাকাটা মনে হয় একান্ত জরুরী।কিন্তু হল লাইফে এক রুম এ তিনজন থাকাতে সেই চরম বাঞ্ছনীয় একাকীত্ব পাওয়াটা প্রায় সময়ই অসম্ভব হয়ে দাড়ায়।সেই একাকীত্ব উপভোগ করার জন্য রাতের দিকে প্রায়ই বেড়িয়ে পড়ি বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে। বুয়েট ক্যাম্পাসের রাতের বেলার নির্জনতা আমার অসম্ভব প্রিয়। তাই প্রায়ই আমাদের ছোট্ট ক্যাম্পাসটাতে রাতের বেলা একটা চক্কর দেই। ঠান্ডা বাতাসের সাথে একান্ত কাঙ্খিত একাকীত্বটা চরমভাবে উপভোগ করি।

আজকে সারাটাদিন মনমেজাজ অজ্ঞাত কারণে খুবই খারাপ ছিলো। মন ভালো করার জন্য একাকীত্ব উপভোগের সিদ্ধান্ত নিলাম। হল থেকে বেড়িয়ে খানিকটা সময় বুয়েট শহীদ মিনারের বেদীতে একা একা বসে রইলাম।তারপর চললাম ক্যাম্পাসের ভেতরের দিকে।কেমন জানি শীত শীত করছে। কদিন আগে জ্বর থেকে ওঠেছি। জ্বর পুরোপুরি ছাড়েনি নাকি শীতের আগমনী বার্তা বুঝতে পারলামনা। জ্বরের চিন্তা মন থেকে ঝেড়ে ফেলে, ব্যাপারটাকে শীতের আভাস বলে ভেবে নিলাম। শীত আমার অনেক প্রিয়।আধো গ্রাম,আধো মফস্বলের ছেলে আমি(যদিও গত কয়েকবছরে আমার জন্মস্থান পুরোপুরি মফস্বল চরিত্র ধারণ করেছে বলেই মনে হয়।)। মফস্বলের শীতের রূপ আমার মনে চরমভাবে গেঁথে আছে। ঢাকায় আমি সব থেকে বেশি মিস করি এই শীত ঋতুটাকেই।
পা চালালাম আর্কি বিল্ডিং এর দিকে। আর্কি বিল্ডিং এর আলো আঁধারিময় জায়গাটা একটু সময় তাড়িয়ে তাড়িয়ে উপভোগ করে পা চালালাম ওল্ড একাডেমিক বিল্ডিং এর দিকে। ওল্ড একাডেমিক বিল্ডিং পার হয়ে রেজিষ্টার বিল্ডিং, তারপর বুয়েটের খেলাম মাঠের দিকে এগিয়ে চললাম। হালকা কুয়াশা কুয়াশা ভাব মনে হল। মাইক্রোকন্ট্রোলার ল্যাব এর ভাইভা আর নেটওয়ার্কিং ক্লাস টেষ্টের বাঁশ এর কথা বেমালুম ভুলে গেলাম। এর আগে আমাদের ক্যাম্পাসটাকে এতো রূপবতী কখনো মনে হয়েছে বলে মনে করতে পারলামনা। আবার ফিরে এলাম ক্যাম্পাস এর মেইন গেটে।

আজকে আমাদের ক্যাম্পাসে চক্কর দিয়েও তৃপ্তি পাচ্ছিলাম না। বুয়েটের মেইন গেটে এসে তাই রিক্সা নিলাম। টিএসসি’তে চক্কর দিয়ে আসব বলে। রিক্সা ঠিক করে রওয়ানা দিলাম টিএসসি পানে। মাঝপথে রিক্সাওয়ালাকে বললাম ব্রিটিশ কাউন্সিলের সামনে দিয়ে যেতে। রিক্সাওয়ালা তেমন একটা রসিক লোক না। তাই প্রথমে যেতে রাজী হচ্ছিলনা। ১০ টাকা বেশি দেয়ার কথা বলায় রাজী হলো। ওই রাস্তায় ঢোকার মুখে বিশাল ভাষ্কর্য চখে পড়ল। এর মাথায় সবুজ আর সারাদেহের মাঝে মাঝে কমলা বাতি লাগানোর আইডিয়াটা পুরোপুরি বাজে লাগলো। ভাষ্কর্যের সৌন্দর্যটা আগের মতো লাগলোনা ঐ বাতির জন্য। ব্রিটিশ কাউন্সিলের সামনের রাস্তা দিয়ে যেতে যেতে বেশ কয়েক প্রেমিক-প্রেমিকা যুগলকে দেখলাম রাস্তার পাশে ফুটপাতে বসে থাকেতে। তারা আমার মতো রাতের সৌন্দর্য উপভোগ করায়, নাকি একে অপরের সান্নিধ্য উপভোগ করে বেশি আনন্দ পাচ্ছে ঠিক বুঝলামনা। যাই হোক ,তারা সুখেই আছে মনে হলো। “সুখে আছে যারা,সুখে থাক তারা”—তাদের সুখের ভেলায় ভাসতে দেখে সারাদিন পর মনে যে ভালো লাগার আবেশটুকু অনুভব করলাম সেটাকে সাথে নিয়ে এগোলাম টিএসসির দিকে। টিএসসি এসে রিক্সাওয়ালাকে এক কাপ চা আর স্টার ফিল্টার সিগারেট দিয়ে নিজে একটা সিগারেট ধরালাম। আজকের দিনে এই নিয়ে ২য় বারের মতো সিগারেট না খাবার প্রতিজ্ঞা ভংগ করলাম। সিগারেট ছাড়ার ব্যাপক চেষ্টা করছি।কিন্তু এটা প্রায় অসম্ভব পর্যায়ের কাজ মনে হচ্ছে। জীবনে মাঝে মাঝে এমন সময় আসে, যখন আমরা অনেক কিছু ছেড়ে দিতে চাই।কিন্তু যা কিছু ছাড়তে চাই তারা আমাদের ছাড়তে চায় না। এমনই একটা পরিস্থিতিতে পড়ে গেছি আসলে।

রিক্সাওয়ালাকে ভাড়া দিয়ে সদাপ্রাণচঞ্চল টিএসসিতে আরো কিছুটা সময় কাটালাম। আশেপাশে যুগলের সংখ্যাই আজকে বেশি চোখে পড়ছে। টিএসসির মায়া কাটিয়ে হলের ফেরত রাস্তায় পা বাড়ালাম। টিএসসির পাশের তিনকোণা আকৃতির বাঁধানো জায়গাটায় বরাবরের মতোই যুগলের ভিড়। জায়গাটায় আলো বেশ কম। এক যুগলের দিকে চোখ চলে গেল। ছেলেটা আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে,আর পাশের মেয়েটা একমনে কথা বলে যাচ্ছে।ছেলেটার সেই কথায় মনোযোগ খুব একটা আছে মনে হলোনা। আরেকটু সামনে আগালাম।হঠাৎ রাস্তার গাড়ির হেডলাইটের আলোয় আরেক যুগলের দিকে চোখ পড়ল। এখানেও মেয়েটা একমনে কথা বলে যাচ্ছে। আর ছেলেটা গভীর মুগ্ধতায় মেয়েটার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে।এদের একজনের হৃদয়ের নীল বন্দরে অন্যজনের গভীর ছোঁয়া মনে হল আমাকেও ছুঁয়ে গেছে।আজকে সারাটাদিন মন ভালো করার মতো কোন ঘটনা ঘটেনি। কিন্তু মনে হল আমার হৃদয় থেকে সমস্ত আবিলতা এক পলকে মুছে গেছে।মনে নির্মল আনন্দের একটা অবশ করা ঢেউ ওঠেছে। আকাশে তারার সংখ্যা খুব একটা বেশিনা। তারপরও আকাশের দিকে তাকিয়ে এক ধরনের আকুলতায় হৃদয় ছেয়ে গেছে বুঝলাম। মনে পড়ে গেল “রুদ্র শহিদুল্লাহ”র
ভালো আছি ভালো থেকো,
আকাশের ঠিকানায় চিঠি লেখো---গানটার কথা।মন ভালো করে দেয়া সেই যুগলকে মনে মনে বললাম ভালো আছি,ভালো থেকো।একজনের চোখে আরেকজন, আজকের মতোই হারিয়ে যেও। আবার যেদিনই ভারাক্রান্ত হৃদয়ে টিএসসিতে আসি সেদিনও যেনো তোমাদের দেখে মন আজকের মতোই আনন্দে ভেসে যায়। সারাদিনের সমস্ত হতাশা মুছে দেয়ার জন্য তোমাদের মতো যুগলের সংখ্যা যেন ক্রমেই বেড়ে চলে।
আবার ফিরে চললাম হলের দিকে।ক্যাম্পাসে পৌঁছে গেলাম। ক্যাম্পাসটাকে এতো মধুর আগে কখনো মনে হয়নি।দিনের শেষে বুক ভর্তি ভালো লাগা নিয়ে আমার রুমে ঢুকে গেলাম।মন ভালো করা একটা একাকী ভ্রমণের এখানেই শেষ।আর এরকমই আরেকটা একাকী ভ্রমণের জন্য অপেক্ষা এখানে হলো শুরু………


মন্তব্য

জোহরা ফেরদৌসী এর ছবি

একাকী হতে চান? এই জীবনতো পুরোটাই এক একাকী ভ্রমন …

জনারন্যে একাকী বোধ করেননি কখনো? চারিদিকে মানুষ, অথচ কারুর আপনাকে ছুঁয়ে দেয়ার সময় নেই এক ফোঁটা …

যাক গে, আপনার একাকী ভ্রমণ পড়ে ভাল লাগল । প্রিয় নগরী ঢাকার অতি প্রিয় কিছু জায়গায় ঘুরে এলাম আপনার সঙে । ভাল থাকুন ।

……………………………………
বলছি এক জ্যোতির্ময়ীর কথা

__________________________________________
জয় হোক মানবতার ।। জয় হোক জাগ্রত জনতার

রোবো [অতিথি] এর ছবি

"জনারণ্যে একা"--ঠিক এই কথাটাই খুঁজছিলাম লেখার সময়। কিন্তু অনেক চেষ্টায়ও মাথায় আসেনি।জনারণ্যে একাকীত্ব উপভোগ করতেই আসলে এই ভ্রমণ।অনেক ধন্যবাদ "জনারণ্যে একা"--কথাটা মনে করিয়ে দেয়ার জন্য।

বাউলিয়ানা এর ছবি

হুম...শরতের শেষে এমন একটা দিন রিক্সায় একা একা ঘুরে মন ভাল করা, ভাল আইডিয়া।

লেখা ভাল লেগেছে। আরও লিখুন।

রোবো [অতিথি] এর ছবি

ধন্যবাদ।

নীড় সন্ধানী এর ছবি

‍‌দুটো যুগলের দৃশ্যেই দেখলেন, মেয়েটা কথা বলে যাচ্ছে আর ছেলেটা শুনে যাচ্ছে অথবা শুনছে না। মজার ব্যাপার তো, মেয়েরাই কথা বলে? দেশনেত্রীরাও কি.......হাসি

যাকগে, সবচে অবাক হয়েছি ঢাকা শহরের মতো জায়গা একা থাকার মতো দুঃসাহস দেখে। একা থাকুন। ভালো থাকুন।

-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
এ ভ্রমণ, কেবলই একটা ভ্রমণ- এ ভ্রমণের কোন গন্তব্য নেই,
এ ভ্রমণ মানে কোথাও যাওয়া নয়।

‍‌-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?

রোবো [অতিথি] এর ছবি

একা আর কোথায়?? থাকি তো হল এ।এক রম এ তিনজন :শয়তানী হাসি

অতিথি লেখক এর ছবি

আহারে আমার বুয়েট ক্যাম্পাস, নস্টালজিয়া জাগানিয়া কত্তো স্মৃতি!
রোমেল চৌধুরী

অতিথি লেখক এর ছবি

জনারণ্যে একা থাকার অভ্যাস আমারও, সাথে নিশাচর স্বভাবটাও, সেকারনেই গভীর রাতে হলের ছাদেই কাটিয়ে দিতাম রাতের অনেকখানি( শত ইচ্ছা থাকলেও রাতে হলের বাইরে যাওয়ার ক্ষমতা আমার ছিলনা)। আমার হল ছিল নদীর এ পাড়ে, নদীর ওপাড়ে ঘন অন্ধকারে ঢাকা চরের বিশাল মাঠ, মাঠের শেষে কিছু গাছপালার আবছা অবয়ব বসতির ধারনা দিত, আকাশে চাঁদ বা আকাশভরা মিটিমিটি তারা যদি থাকতো তাহলে মনেহত হীরক খচিত স্বর্গে আছি নয়তো চর, নদী, গাছ সবকিছুই অন্ধকারে ঢাকা, মাঝেমধ্যে বাতি জ্বালানো দু'য়েকটা নৌকা নদীতে ভাসতে দেখাযেত, সাথে ঝিরঝির বাতাসতো থাকতোই। ছাদের পেছনপ্রান্তে দাড়ালে এমনটাই দেখাযেতো, তবে সামনের দিকে এসে দাঁড়ালে অন্যরকম। ঘুমন্ত শহরের অংশ, নীরব রাস্তায় আলো জ্বলছে, মাঝে মাঝে পথিক হেঁটে যায়, কখনও পাহারাদার আবার মাঝে মাঝে কুকুর। রাতের মায়া আর কাকে বলে! গভীর রাতে হলের বিশাল ছাদে বেশিরভাগ সময় একাকীত্বে ভাগ বসানোর মানুষ থাকতোনা, বিশাল ছাদ, ছাদের নিরবতা, গভীর রাতে নদীর সৌন্দর্য সব কিছুর একমাত্র মালিক নিজেকে মনেহত, হাজারো অপ্রাপ্তির মাঝে হঠাৎ অনেকখানি সুখ বোধ হত।
সুন্দর লেখা, অনেক পুরোণো কথা মনেকরিয়ে দিল।

ধূসর পেঁচা

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।