ঠান্ডায় বরফায়িত

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: মঙ্গল, ২১/১২/২০১০ - ৫:০৪অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

মা-বাবার সাথে হজ্বে গেলাম। সে এক বিরাট কেচ্চা। এতো এতো গরম, এতো এতো হাটা। তখন মনে হয়েছিলো কিভাবে সম্ভব? মক্কাতে প্রায় ৩৯ ডিগ্রী তাপমাত্রা। মদীনাতে গিয়ে তাপমাত্রা নেমে গেলো। ফজরের নামাযে সামার জ্যাকেট পরেও কাপাকাপি অবস্হা।

যাবার সময় তাপমাত্রা বেশ ভালোই। আসার আগমুহূর্তে ভাইয়া ফোন করে বল্লো তাপমাত্রা খুব নেমেছে। মাইনাস ১০ ডিগ্রী। প্লেন নামতেছে না। আমাদের এতো ঝামেলা হয়নি। তাপমাত্রা -৫ ডিগ্রীতে নেমেছি।

প্রায় চার সপ্তাহ ছুটি কাটিয়ে ফিরে আসার একদিন পর অফিস। আবারো হাউ-কাউ-মাউ, ভল্টেজ-কারেন্ট, সেকেন্ড-মিলিসেকেন্ট নিয়ে কাড়াকাড়ি। আমার রিপ্লেইসমেন্টে যাকে দিয়ে গিয়েছিলাম ও আমার জয়েন করার দিনই ছুটিতে যাবে। আমাকে কয়েকঘন্টায় কাজ বুঝে নিতে হবে। ধান্ধা ছিলো ডিসেম্বরে আরো তিনসপ্তাহের ছুটি নিয়ে দেশে যাবো। কাজের অবস্হা আর কলিগদের ছুটির লিষ্ট দেখে চেপে গেলাম।

বিদেশী কোম্পানীতে কাজ করি। উনারা কখন কিভাবে হাত বদল করেন, কি উদ্যেশ্যে করেন, বোঝা মুশকিল। Areva T&D কে Schneider Electric + Alstom কিনেছে। কেনা না বলে হাত বদল বলা যায়। এই কোম্পানী আগে Astom ছিলো। এর আগে AEG ছিলো। তারও আগে কি ছিলো জানি না। কলিগ এক একজন তো ৩০ বছর থেকে একই জায়গায় বসে আছে। ওরা নির্বাক। ৫/৭টা হাত বদল দেখেছে কয়েকজন। যদিও বিক্রির সময় আরো অনেক ভালো কোম্পানী বিড করেছিলো। কিন্তু ফ্রান্সের দুই কোম্পানীকেই দেওয়া হয়। এখন T&D কে ভেঙ্গে T একজন আর D একজন। গতবছর থেকেই এইসব টানা-হেছড়ার মেইল পড়তে পড়তে মেজাজ খারাপ সবার। আপাতত চাকরী বাচিয়ে রাখার ইচ্ছে। যদিও ২০১৩ সালের আগ পর্যন্ত ছাটাইয়ের ভয় নেই।

নতুন কোম্পানীতে সফটওয়্যারের কোম্পানীর নাম ঢুকাতে হবে। একটা কিছু বদলানো মানে পুরো ডিভাইকে নতুনভাবে টেষ্ট করা। বিশেষ করে Measurement & Report। কন্ট্রোল ডিভাইসের IEC-61850 টা আমার তিন বছরের কষ্টের ফসল। এখন ঐ ফিল্ডের যতো টেষ্ট আছে সবই আমার করতে হবে। ডেভোলপার থেকে পুরো টেষ্ট ইন্জিনিয়ার। অবশ্য এখন সব ঝানু-ঝানু পাকলিকও একই কাজ করতেছেন। আগামীতে নতুন প্রসেসরের কাজ। ভাবতেই জানালা দিয়ে লাফ দিতে ইচ্ছে করতেছে মন খারাপ

জার্মানীতে বরফ পড়াটা স্বাভাবিক। স্টুটগার্ড ইউনিতে থাকতে প্রচুর বরফ দেখা হয়েছে। স্টুটগার্ড, মিউনিখের তুলনায় ফ্রাঙ্কফুটে অনেক কম বরফ পড়ে। তবে এইবার যা পড়েছে, আমার গত ৮ বছরে এতো স্নো দেখা হয়নি। রাস্তাতে হাটু পর্যন্ত। কে কতো পরিষ্কার করবে। ভাগ্য ভালো যে স্কুল ছুটি হয়ে গেছে। ছোটবোনকে দেখলাম স্কুলের শেষ দিন খুব সাজতেছে। নাস্তার টেবিল থেকে ডেকে জিঞ্জেস করলাম, বাইরে থাকিয়ে দেখেছো কি অবস্হা? বল্লো, হ্যা। স্নো পড়েছে। বল্লাম হাটু পর্যন্ত। ফোন করে দেখো স্কুল আছে নাকি ছুটি। কতোক্ষন ঘ্যান-ঘ্যান করে বিদায়।

খুব ভোরেই অফিস রওয়ানা হয়ে যাই। এখন গাড়ি চালানোর প্রশ্নই আসে না। উপরে নীচে কয়েক ইঞ্চি বরফের স্তুপ পরিষ্কার করতেই তো আধা ঘন্টা, সাথে এ্যানার্জি ফ্রি লস। হন্টনই ভালো। তাও ফুটপাত রেখে মেইন রাস্তায় হাটতে হবে। গাড়ি গিয়ে বরফ কিছুটা চেপ্টা হয়েছে। কম কষ্টে হাটা যায়। ট্রাম, বাস, ট্রেন সব দেরী করে আসা যাওয়া করতেছে। তারপরও গাড়ি থেকে ভালো। পেট্রোলের দামও আকাশচুম্বি। ১.৫০ ইউরো/লিটার। নামার কোন লক্ষন নেই।

নিজেদের ঘরের সামনের বরফ নিজেরাই পরিষ্কার করতে হবে। না হলে কোন এক্সিডেন্ট হলে জরিমানা ঐ বাসার লোকজনকেই গুনতে হবে। এক্সিডেন্ট না হলেও যাবা হেটে যাবে উনারা মনের সুখে গালি দিয়ে যাবে। আজ স্হানীয় পত্রিকায় দেখলাম বাড়ির সামনের বরফ পরিষ্কার করাকে কেন্দ্র করে একজন আরেকজনকে পিটিয়ে মেরে ফেলেছ। গত সপ্তাহে তো একজন বরফ বিক্রির জন্য e-bay কে অফার দিয়েছে।

শুধু দেশে যেতে ইচ্ছে করে। আবার দেশে গেলে সময় কাটতে চায় না। বন্ধুরা সবাই ব্যস্ত। আত্মীয়স্বজনও খুব একটা নেই। তারপরও যাবার নিয়ত করে ফেলেছি। জানুয়ারীর শেষে একটা কম দামের টিকেট পেয়ে গেলাম। ম্যানেজারকে গিয়ে বল্লাম, আমি তিন সপ্তাহের ছুটি নিবো। বল্লো, মাত্রই তো ৪ সপ্তাহ ছুটি কাটিয়ে এলে। বল্লাম, তোমার বর্তমান প্রজেক্ট তো জানুয়ারীর শেষ পর্যন্ত। আমি জানুয়ারীর ১৫ তারিখেই শেষ করে দিবো। আর পরবর্তি প্রজেক্টের কিছু কাজও তুলে দিয়ে যাবো। বল্লো, তাহলে টিকেট বুকিং দিতে পারো। মনেমনে বল্লাম, তুমি ভাব নিতেছো। ছুটি শেষ হলেই তো তুমি ম্যানেজার বেচে যাও। তখন আর চিন্তা নাই। শুধু কাজ আর কাজ। হজ্ব করে এসে ইচ্ছে ছিলো কয়েকদিন অসুস্ততার জন্য ফাউ ছুটি নিবো। কিন্তু কপাল খাবার। মা-বাবার ঠান্ডা লেগেছে। কিন্তু আমার লাগেনি। আর বর্তমান কাজগুলো নিজেকেই করতে হবে এজন্য আর সামান্য গলা ব্যথার জন্য ছুটি নেওয়া হয়নি।

ছুটি থেকে এসে শুনলাম এক কলিগ মারা গেছে। নাম দেখে খুব খারাপ লাগলো। লোকটা আমাকে ইংল্যান্ডে পাঠানোর অনেক চেষ্টা করেছিলো। আমার পরিবারের অন্য সদস্য এইদেশে সেটা আমি সাধারনত কাউকে বলি না। সেও একদিন কথায় কথায় কোথায় পড়াশোনা করেছি, কি কাজ করি এইসব জিঞ্জেস করতেছিলো। একই কাজ ইংল্যান্ডে আমাদের অন্য ব্রাঞ্চে হচ্ছে। এবং আমরা এখানে চুরাই কাজ করতেছি ( সাবস্টেশন কন্ট্রোল ডিভাইসে IEC-61850 ডেভোলপ করা আমাদের এখানে মানা। এটা শুধু ফ্রান্সে হবে। ইংল্যান্ডে কিছু ডিভাইসে হবে। আমাদের শুধু প্রটেকশন ডিভাইসে করতে হবে)। ও আমাকে ওখানে যেতে নিজের পক্ষ থেকে যোগযোগ করে মেইলও দিয়েছিলো। ইংল্যান্ডে থেকেও হ্যা সুচক সম্মতি ছিলো। আমি আরো এক্সপেরিয়েন্সের কথা বলে বছরখানেক পরে দেখবো বলে দিয়েছিলাম। ৪৫ বছর বয়সের লোকটা ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মারা গিয়েছে।

ফ্রুলিক্স


মন্তব্য

অনিন্দ্য রহমান এর ছবি

বরফে ঠাণ্ডায়িত দেখা যায়।


রাষ্ট্রায়াত্ত শিল্পের পূর্ণ বিকাশ ঘটুক


রাষ্ট্রায়াত্ত শিল্পের পূর্ণ বিকাশ ঘটুক

অতিথি লেখক এর ছবি

চলুক

বাউলিয়ানা এর ছবি

চমতকার ব্লগরব্লগর।

লেখালেখি জারি রাখুন।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।