একটি গণকবর

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: শনি, ২৫/১২/২০১০ - ১১:৫৭অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

সালেক খোকন
মূল রাস্তার পাশেই আলতাফ আলীর বাড়িটি। পাকাবাড়ির পেছন দিকটায় ছোট্ট একটি বাগান। বাগানে শিম, কলা আর হরেক রকমের গাছগাছালি। বাগানীর হাতের ছোয়ায় শিমগাছের মাচায় ঝুলছে শত শত নীল রঙের শিমফুল। মৌমাছিরা মনের আনন্দে ঘুরে বেড়াচ্ছে ফুল থেকে ফুলে। সবুজে ঢাকা বাগানটির সোভা যেন বাড়িয়ে দিচ্ছে শিমফুলগুলো।
গোটা বাগানটি নিখাত সমতল। কোথাও কোন উচু নিচু ভাব নেই। নেই কোন কবর বিশেষের লেশ মাত্র। পায়ে হেঁটে বিনা বাধায় চলে যাওয়া যায় বাগানের এক প্রান্ত হতে অন্য প্রান্তরে। সটকাট রাস্তা হিসেবে গ্রামের লোকেরা এভাবেই চলাচল করে সে পথ দিয়ে।
শিমগাছের পাশেই বাগানের একটি অংশ হঠাৎ যেন বদলে যায়। সমতল জায়গার চারদিকে বসে বাঁশের চারটি ঘুটি। হলুদ রঙের নাইলনের দড়ি দিয়ে ঘিরে দেয়া হয় ঘুটিগুলোকে। যেন একটি কবর বিশেষ। সাধারণ সাইজের কোন কবর নয় এটি। সাধারণ কবরের মতো যতœও নেই, নেই কোন ঘিরে দেয়া ইটশুরকির প্রাচীর। একেবারে পায়ের তলায় মিশে যাওয়া সমতল একটি গণকবর। হ্যাঁ, এরকমই দেখা মিলল ঈশ্বরদী উপজেলার পাকশী ইউনিয়নের বাঘইল গ্রামের শহীদপাড়ার গণকবরটিকে।
জানা গেল আর্ন্তজাতিক অপরাধ ট্রাইবুনালের উচ্চ পর্যায়ের ৬ জন কর্মকর্তা আসবে এই গণকবরটি দেখতে। তাঁরা কথা বলবেন গণহত্যার প্রত্যক্ষদর্শীদের সাথেও। সে কারণেই গণকবরকে চিহ্নিত করার এমন তোরজোড়।
কেউ দেখিয়ে না দিলে অন্যসময়ে এ গণকবরটি খুঁজে বের করা প্রায় অসম্ভব। অথচ ১৯৭১ সালের ২৩ এপ্রিল পাকিস্তানী সেনারা এখানেই নির্মমভাবে হত্যা করেছিল শিশুসহ ২৩ জন নিরপরাধ সাধারণ মানুষকে। যারা শায়িত আছেন এই গণকবরটিতে। মুক্তিযুদ্ধের ৩৯ বছর পরও রক্ষা করা হয়নি এই গণকবরটিকে। বরং অনাদর,অবহেলায় আর মানুষের পায়ের তলায় মাটির সাথে মিশে যাচ্ছে গণকবরটি। মিশে যাচ্ছে দেশের জন্য আত্মহুতী দেয়া ২৩ জন শহীদের আত্মত্যাগের কাহিনীটিও।
১৯৭১ সাল। ঈশ্বরদী উপজেলার বাঘইল গ্রামে গড়ে উঠে একটি পাড়া। সবাই ডাকে নয়াপাড়া বলে। নতুন হওয়ায় পাড়াটির এমন নামকরণ। কিন্ত স্বাধীনতার জন্য আত্মহুতি দেয়া শহীদের রক্ত বদলে দেয় পাড়ার নামটিকে। নাম পাল্টে নতুনপাড়া হয়ে যায় শহীদপাড়া।
ঈশ্বরদী অতি পুরোন একটি উপজেলা। সাহসী বাঙালির নানা কাহিনীতে ভরা এই উপজেলা। পাঁচ শহীদের মোড় আর বিবিসি বাজারটি আজও কালের সাক্ষী। এখানেই রাখা আছে মুক্তিযুদ্ধের সময়ে হার্ডিঞ্জ ব্রিজ এলাকায় নিক্ষিপ্ত বোমার অংশ বিশেষ।
১৯৭১ সালে পাকিস্তানী সেনাবাহিনী ক্যাম্প বসায় পাকশী পেপার মিল ও হার্ডিঞ্জ ব্রিজ এলাকাতে। সেখান থেকে খুব কাছেই শহীদপাড়া। বাঘইলসহ আশপাশের গ্রামের সবাই ছিল মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের। অনেক পরিবারেরই যুবক ছেলেরা গিয়েছে মুক্তিযুদ্ধে। গ্রামটিতে ছিল বিহারীদের আনাগোনা। মাঝেমধ্যেই তাদের সাথে বাঙালিদের হাতাহাতির মতো ঘটনা ঘটতো। বিহারীদের সাথে যোগাযোগ ছিল পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর । তারই সূত্র ধরে ঐদিন বিহারীদের মাধ্যমে পাকিস্তানী সেনাবাহিনী হানা দেয় শহীদপাড়ায়। ফলে নিরীহ, নিরপরাধ মানুষের রক্তে ভিজে যায় শহীদপাড়ার মাটি।
শহীদপাড়ার ঢুকতেই নজরে পড়ে মুক্তিযোদ্ধা সংসদের ভেঙ্গে পড়া একটি বড় বোর্ড। রাস্তার পাশে পরিত্যাক্ত অবস্থায় পড়ে আছে বোর্ডটি। কাছে যেতেই দেখা গেল বোর্ডটিতে শহীদ ও আহতদের নামের তালিকা লিখা। অনেক নামই প্রায় অস্পষ্ট হয়ে গেছে। স্থানীয় একজন জানালেন প্রায় ছয়-সাত মাস আগে ভেঙ্গে পড়েছে বোর্ডটি।
সামনে এগোতেই কয়েকজনের দেখা মিলে। রাস্তার পাশে বাঁশের চাল তৈরীতে ব্যস্ত সবাই। একপাশে দেখলাম বয়সের ভারে নুয়ে পড়া একজন বয়োবৃদ্ধ। কথা হয় তাঁর সাথে। নিজেই নাম জানালেন আব্দুল কাদের পরমানি। এই কাদের পরমানির বাড়িতেই ৭১ এর ২৩ এপ্রিল পাকিস্তানীরা ধরে নিয়ে আসে শিশুসহ পাড়ার প্রায় ৪২জন নিরীহ, নিরপরাধ মানুষকে। বিকেলের দিকে ব্রাশ ফায়ারের গুলিতে ঝাঝরা করে দেয়া হয় তাদেরকে। ৪২জনের মধ্যে সেদিন শহীদ হয় ২৩জন। বাকীরা মারাত্মকভাবে আহত হয়ে প্রাণে বেঁচে যায়। সেদিন বেঁচে যায় আব্দুল কাদের পরমানিও। তিনি জানালেন পাকিস্তানী সেনাবাহিনী প্রথমে সবাইকে লাইন করে দাড় করায়। আর্মির অফিসার তখন হুন্কার দিয়ে বলে , ‘কিতনা আদমি এহাছে’। সংখ্যা জানতেই হঠ্যাৎ ব্রাশফায়ারের শব্দ। নিমেষেই তার ওপর লুটিয়ে পড়ে রক্তাক্ত কয়েকজন। তাঁদের আর্তচিৎকারে ভারী হয়ে ওঠে চারপাশের বাতাস। সাথের লোকদের রক্তে তাঁর শরীরও রক্তাক্ত হয়ে যায়। তিনি কিছু বুঝে উঠতে পারছিলেন না। শুধু অন্যান্যদের সাথে লুটিয়ে পড়েছেন। পাকিস্তানীরা ভেবেছে সবাই গুলিবিদ্ধ। ফলে মৃত্যু অবধারিত।
পাকিস্তান আর্মি চলে গেলে কাদেরসহ অনেকেই দৈবক্রমে আহত অবস্থায় প্রাণে বেঁচে যায়। নিজে বেঁচে গেলেও সেদিনের হত্যাকান্ডে শহীদ হয় তাঁর নিকট আত্মীয়সহ অনেকেই। পাকিস্তানীদের হাত থেকে সেদিন রক্ষা পায় নি ৩ থেকে ৭ বছরের শিশুও। সাত্তার,সাজেদা আর নুরুন্নাহার নামের শিশু ছাড়াও রক্তাত্ত হয় জোসনা নামের একজন নব বিবাহিতাও। ফলে ২৩ টি শহীদকে দাফন করা হয় এই গণকবরে।
প্রশ্ন ছিল গণকবরটির এই হাল কেন? পাশ থেকে স্থানীয় বৃদ্ধ আমজাদ মন্ডল অকপটে বলেন, ‘যাদের রক্তে এ দেশটা স্বাধীন হলো তাদের মনে রাখলো না কোন সরকার’। তিনি জানালেন বছর তিনেক আগে প্রশাসন, মুক্তিযোদ্ধা কমান্ড ও স্থানীয়দের উদ্যোগে সিদ্ধান্ত হয় গণকবরটিকে পাকা করার। কিন্ত পরিকল্পনা করা পর্যন্তই। তারপর আর কোন কাজ এগোয়নি। এমনকি গণহত্যার দিনটিও পালন করার কোন উদ্যোগ নেয়া হয়নি অধ্যাবদি।
গণকবরস্থলে কথা হয় জনাব আলতাফ আলীর সঙ্গে। এ গণকবরেই শায়িত আছেন তার ভাই আইয়ুব আলী, ভাবী মনোয়ারা বেগম আর ভাতিজা সাত্তার। তার জায়গাতেই রয়েছে গণকবরটি। শহীদের পারিবারের সদস্য হিসেবে তিনি জানালেন নানা কষ্ট আর আক্ষেপের কথা। তিনি দাবী করলেন গণকবরটি সংরক্ষণ, একটি স্মৃতিসৌধ তৈরী আর গণহত্যার দিনটিকে সরকারী ভাবে পালনের।
জানা যায় ৭১ এ শহীদপাড়ার এই গণকবরটিতে দাফন করা হয় শহীদ মজিবর রহমান খাঁ, শহীদ আরমান আলী, শহীদ আবুল হোসেন, শহীদ মোসলেম হোসেন, শহীদ শহিদুল ইসলাম,শহীদ উম্মে আলী মন্ডল, শহীদ শফিকুল ইসলাম,শহীদ বাদাম মন্ডল, শহীদ আইয়ুব আলী,শহীদ আঃসবুর খাঁ,শহীদ আজিবুর রহমান, শহীদ আঃসাত্তার, শহীদ ছাকাতন খাতুন, শহীদ রুপজান খাতুন,শহীদ দাছিমন বেগম,শহীদ হাওয়া বেগম,শহীদ মনোয়ারা বেগম,শহীদ রহিমা খাতুন, শহীদ রহিমা বেগমসহ মোট ২৩ জনকে।
‘জরুরীভাবে শহীদপাড়ার মতো গণকবরগুলোকে সংরক্ষণ করা প্রয়োজন। এটি সরকারের প্রধান কাজ হওয়া উচিত। মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার হিসেবে দাবী জানাচ্ছি গণকবরটিকে সংরক্ষণের, একই সাথে শহীদ পরিবারগুলোকে সরকারীভাবে স্বীকৃতি দেয়ার’ - গণকবরটি সম্পর্কে এভাবেই নিজের মতামত তুলে ধরলেন মুক্তিযোদ্ধা সংসদের ঈশ্বরদী উপজেলা কমান্ডার জনাব মোঃ আব্দুর রাজ্জাক। পাশাপাশি তিনি জানালেন সরকারী সহযোগিতা আর আর্থিক সংকটের কারণে তাদের পক্ষে সম্ভব হয়নি গণকবরটিকে সংরক্ষণ করার।
এক ধরণের কষ্ট নিয়ে আমরা ফিরি শহীদপাড়া থেকে। যাদের রক্তে এদেশ স্বাধীন হলো। তাদের মনে রাখলো না এ দেশ। মুক্তিযুদ্ধের এতবছর পরেও শহীদপাড়ার নিরীহ নিরপরাধ মানুষের আত্মত্যাগের কাহিনী তুলে ধরা হয়নি দেশবাসীর কাছে। উদ্যোগ নেয়া হয়নি গণকবরটির নুন্যতম সংরক্ষণের। সরকারীভাবে স্বীকৃতিও পায়নি শহীদপাড়ার শহীদ পরিবারগুলো। এ বরই লজ্জার,বরই দুঃখের।
ভাবতেই অবাক লাগে,৭১ এ পাকিস্তানী বাহিনী ও তাদের এদেশীয় দোসর রাজাকার,আল বদর,আল শামসের লোকেরা গোটা দেশেই তৈরী করেছিল শত শত গণকবর। আর স্বাধীনের পর মানুষের পায়ের তলায় হারিয়ে যাচ্ছে সে গণকবরগুলো। চাপা পড়ে যাচ্ছে বাঙালির আত্মত্যাগের কাহিনীগুলো।
তবু শহীদপাড়ার শহীদ পরিবারগুলো আজো অপেক্ষায় আছে। কবে সংরক্ষণ করা হবে শহীদপাড়ার গণকবরটিকে? কবে নির্মিত হবে একটি স্মৃতিস্তম্ভ? এদেশের পরবর্তী প্রজম্ম কবে জানবে ২৩ নভেম্বর দিনটির কথা ? কবে এই গণকবরে কোমলমতি ছেলেমেয়েরা একগুচ্ছ ফুল দিয়ে বলবে, ‘আমরা তোমাদের ভুলবো না’।

সালেক খোকন


মন্তব্য

রাতঃস্মরণীয় এর ছবি

গোটা বাংলাদেশটাইতো একটা গণকবর!

======================================
অন্ধকারের উৎস হতে উৎসারিত আলো, সেইতো তোমার আলো।
সকল দ্বন্ধ বিরোধ মাঝে জাগ্রত যে ভালো, সেইতো তোমার ভালো।।

------------------------------------------------
প্রেমিক তুমি হবা?
(আগে) চিনতে শেখো কোনটা গাঁদা, কোনটা রক্তজবা।
(আর) ঠিক করে নাও চুম্বন না দ্রোহের কথা কবা।
তুমি প্রেমিক তবেই হবা।

ইমরান [অতিথি] এর ছবি

ভাই সালেক,
আপনার দাবির প্রতি সহমত জানিয়ে গেলাম।

.. উপরে একবার তারিখ ২৩ এপ্রিল, আবার নিচে ২৩ নভেম্বর দেয়াতে তারিখ সংক্রান্ত একটা ভুল বুঝাবুঝি হচ্ছে। দয়া করে ঠিক করে দিয়েন। ধন্যবাদ।

সালেক খোকন [অতিথি] এর ছবি

আপনাকে ধন্যবাদ। আমি দুঃখতি। তারখিটি ২৩ এপ্রলিই হব।ে

মানিক চন্দ্র দাস এর ছবি

আমরা বড্ড নিষ্ঠুর, বিস্মৃতিপরায়ন জাতি। আমরা আমাদের দেশের সূর্য্যসন্তান দের সন্মান দিতে জানিনা। কতো দিন এই অপরাধ বোধ নিয়ে বাঁচবো??

সচল কতৃপক্ষকে অনুরোধ জানাই যাতে এই সব অজানা গনকবর গুলো লেখকরা খুঁজে তুলে আনবেন এই সচলে। আমরা চাইলেই সচলের সমস্ত লেখক,পাঠকদের কাছ থেকে দেশের জন্যে জীবন দেয়া শহিদ দের গনকবর গুলোকে পাকা করে দিতে পারি আমরা চাঁদা দিয়ে। এতে কোন বিজনেস ম্যাগনেটের টাকা নেয়া হবেনা। এই শহিদেরা জীবন দিয়েছেন আমাদের জন্যই। আমজনতার জন্যে। আমরা তাঁদের কবর বাঁধিয়ে দিতে পারবোনা??

প্রিয় মডু,
এই ব্যাপারে আপনাদের সাহায্য চাইছি। একটা মুক্তিযুদ্ধ বদ্ধভূমি ফান্ড হোক। তাতে আমরা যে যাই পারি প্রতি মাসে দেবো এবং শহিদদের প্রতি সন্মান জানাবো। সচলের জন্যে আলাদা একটা ব্যঙ্ক অ্যাকাউন্ট থাকুক। সেখানে আমরা প্রতি মাসে আমাদের আয়ের একটা অংশ তাঁদের সন্মানে জমা দেবো। একটা করে বদ্ধভূমি ধরে আমরা কাজ করে যেতে পারি। প্লীজ মডু। দেখুন এই কাজটা করা যায় কিনা। করতেই হবে। এই অন্যায় মেনে নেয়া যায়না।

অতিথি লেখক এর ছবি

অথচ আমাদের সবাই, সরকার, বিরোধী দল, আমজনতা, সংস্কৃতির ধারক-বাহক এবং আমি নিজে নাকি মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদবুদ্ধ????????????????????????

নিজেকে এতটা হেয় কখনও লাগে না যখন এসব দেখি; জন্মভূমি নিয়ে গর্ব হলেও জন্ম টাকে দূষিত লাগে।

এইসব বীর শহীদদের কিংবা বেঁচে থাকা অবহেলিত মুক্তিযোদ্ধাদের মনে হয় খোদ আমাদের চাইতে বড় অপমান কেউ করে নাই, করবেও না।

-অতীত

সুমন চৌধুরী এর ছবি
দ্রোহী এর ছবি
অতিথি লেখক এর ছবি

আমরা তোমাদের ভুলবো না
মুনতাসীম মুনিম মিশু

বইখাতা এর ছবি

চলুক আপনাকে ধন্যবাদ শহীদপাড়ার গণকবরটি সম্পর্কে আমাদের জানানোর জন্য। সংরক্ষণের কেউ নাই, লিখে রাখার মতো কেউ নাই বলে এইসব ঘটনা, ইতিহাসের অংশ ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।