রূপক

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: মঙ্গল, ২২/০২/২০১১ - ৯:০৩অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

গতকাল জুলিয়াকে দেখে রীতিমত আঁৎকে উঠেছিল কাটিং মাস্টার। এ ক’দিনে কি হাল হয়েছে মেয়েটার! চোয়াল আর কন্ঠার হাড় ভেসে উঠেছে। গাল দু’টো ভেতরের দিকে ঢুকে গেছে। ঠোঁটগুলো শুষ্ক। চোখের নীচে কালি। দৃষ্টি উদভ্রান্ত-ভীত। জুলিয়া চাকরিতে যাচ্ছে না আজ প্রায় দু মাসের মত হল। প্রথম ক’দিন চাকরিতে যায়নি অসুস্থতার ভান করে। তারপর সে সত্যি সত্যি অসুস্থ হয়ে পড়ে। শেষপর্যন্ত ডাক্তার দেখাতে হল। এই টানাটানির সংসারে উটকো আরেক ঝামেলা।
রেললাইনের এই বস্তিবাসীদের চিকিৎসায় সবসময় সাহায্য সহযোগীতা করে থাকে জমিলার মা। জমিলাম মা বলেছে জুলিয়ার জন্ডিস হয়েছে। ব্যাস, এবার সারাদিন বিছানায় শুয়ে থাকো। জমিলার মা লতাগুল্ম দিয়ে একটি মালা বানিয়ে দিয়েছে। জুলিয়া ওটা মাথায় দিয়ে সারাদিন শুয়ে-বসে কাটায়। জুলিয়ার খারাপ লাগছিল, সংসারের টাকা পয়সার খুবই করুণ অবস্থা। চাকরিতে না গেলে বেতন পাওয়া যাবে না। ছোট বোনটার বিয়ে হয়েছে এক বছর হলো। বড় বোনের আগে ছোট বোনের বিয়ে, নানান লোকে নানান কথা বলছিল। জুলিয়া অমত করেনি। কাঁধের ওপর সমিতির ঋণের বিশাল বোঝা। একমাস কিস্তির টাকা দিতে না পারলে পরের মাসেই সেই বোঝা আরো বেড়ে যাবে। জুলিয়া আর ভাবতে পারছিল না, ভাবতে চাচ্ছিলও না। মা-টাও যেন কেমন, দেখে মনে হয় এসব নিয়ে তার কোন মাথা ব্যাথা নেই।
কাটিং মাস্টার গতকাল বিকেলেই জুলিয়ার দৈহিক অবস্থার কথা পি এম সাহেবকে জানিয়েছিল। পি এম সাহেব সাথে সাথে হায় হায় করে উঠেছিল, সামনের মাসের পাঁচ তারিখ মিস্টার লুই আসছেন। আর মাত্র চব্বিশ পঁচিশ দিন বাকি। উঁচু দরের কোন সুন্দরী দিয়েও লুইকে খুশী করানো যাবে না। লুই জানিয়েছে আগের মেয়েটাকেই তার চাই। সেবার জুলিয়াকে ফুসলিয়ে লুইয়ের রুমে ঢুকিয়ে দিয়েছিল পি এম সাহেব। লুই পরে বলেছিল, সোজা আঙ্গুলে ঘি তুলতে পারেনি তাই তাকে নাকি আঙ্গুলটা বাঁকা করতে হয়েছিল। জুলিয়া প্রথমে ধস্তাধস্তি করেছিল, লাভ হয়ে নি। পরে চিৎকার করেছিল, কিন্তু মনে মনে। লুইয়ের মতে, টাট্টু ঘোড়াকে দমানোর মজাই নাকি আলাদা।
হাজার হোক লুই হল বায়ারের লোক, তাকে খুশী রাখতে না পারলে সর্বনাশ হবে। এমনিতে অন্যান্য ফ্যাক্টরির চাইতে তাদের অবস্থা খুবই খারাপ। পি এম সাহেব পরদিন কাটিং মাস্টারকে আবার পাঠালো জুলিয়াদের বস্তিতে, সাথে দু’হাজার টাকা। যে করেই হোক তাকে এ ক’দিনে খাইয়ে দাইয়ে সুস্থ-তরতাজা করা চাই। তারপর কোনরকমে লুইয়ের রুমে ঢুকিয়ে দিতে পারলেই হল। বাকি কাজ লুইয়ের।
জুলিয়ার মুখ থেকে ভয়ের মেঘ কাটতে শুরু করেছে ধীরে ধীরে। নির্দিষ্ট দিনের পর সাতদিন অতিবাহিত হলেও অবশেষে তার ঋতুস্রাব হয়েছে। সে কতবার যে তার সৃষ্টিকর্তার কাছে শোকরিয়া আদায় করেছে তার কোন ইয়ত্তা নেই। কাটিং মাস্টার জুলমত ভাই সত্যিই খুব ভাল মানুষ। ক’দিন আগে তাকে দু’হাজার টাকা দিয়ে গেছে। ভাল করে অষুধ খেতে বলেছে, খাওয়া দাওয়া করতে বলেছে। তার শরীর নাকি খু্বই খারাপ হয়ে গেছে।
ক’দিন পর কাটিং মাস্টার আবার জুলিয়াকে দেখতে আসে। এ ক’দিনে মেয়েটার স্বাস্থ্য কিছুটা ফিরেছে। কাটিং মাস্টার বুকের কোণে বেদনা অনুভব করে। সে জেনে শুনে মেয়েটাকে..। কিন্তু কোন উপায় নেই। পি এম সাহেবদের হাত বেশ লম্বা। তার কথা মত কাজ না করলে শেষ পর্যন্ত নিজের চাকরি নিয়েই টানাটানি পড়ে যাবে। পি এম জুলিয়াকে দেয়ার জন্য আজ একহাজার টাকা দিয়েছে। গেলবার জুলিয়াকে টাকাটা দেয়ার সময় কাটিং মাস্টারকে কিছুটা অভিনয় করতে হয়েছে। বলেছে, ‘আহা, ভাই থেকে নিতে লজ্জা কিসের.. আচ্ছা ঠিক আছে পরে শোধ কইরা দিও। এখন একটু ভালা কইরা খাওন-দেওন কর।’ সেবার মেয়েটা কোনভাবেই টাকা নিতে চাইছিল না। কিন্তু এবার টাকা দেখতে পেয়ে অনেকটা ছোঁ মেরেই নিয়ে নিল। অভাব বড় কঠিন জিনিস! যেকোন অভাবেই মানুষ কষ্ট পায়, দারিদ্রতার অভাব ছাড়া।
মরিয়ম বানুর মাথা ঘুরছে। হাত একেবারে খালি। মেয়েটা কেন যে অসুস্থ হয়ে পড়ল? ক’দিনের অসুখে শুকিয়ে কাঠি হয়ে গিয়েছিল। এখন অবশ্য স্বাস্থ্য খানিক ফিরেছে। সোমর্থ মেয়ে, স্বাস্থ্য মাশাল্লা ভাল। চোখে পড়ে। মরিয়ম বানু আর কতদিন পাহারা দিয়ে রাখবে এই ধন? বিয়ে দিয়ে দিতে পারলে ভাল হত। কিন্তু ঋণের বোঝাটা সে একা বইবে কি করে? পাশের বস্তির মাছ বাজারের ছেলেটার বড় মায়াকাড়া চেহারা। রাস্তায় দেখা হলে দূর থেকেই তাকে ‘চাচী চাচী’ বলে চিৎকার করে ডাকতে থাকে। মরিয়ম বানুর লজ্জা লাগে। ছেলেটা মন্দ না, দেখা যাক জুলিয়া রাজি হয় কিনা।
মরিয়ম বানুর উপার্জনের অর্ধেকটাই চলে যায় অষুধের পিছনে। এখন হাত একেবারেই খালি। ঘর খরচার টাকাটাই শুধু আছে। অষুধ কেনার পয়সা নাই। পিঠের ব্যাথায় আর টেকা যাচ্ছে না। দু’টি পালা মুরগী ছিল। ক’মাস আগে একটা বিক্রি করে দিয়েছে। সে ঠিক করেছে আজকে বাকীটাও বেচে দেবে। সাত সকালে সে মুরগীটি নিয়ে সামনের বাজারে গেছে বিক্রি করতে। বাজার দরে পাওয়া যাবে না। কিন্তু উপায় নেই। মুরগীঅলাটাও বজ্জাত। গতবারের টাকাটা তিন বারে দিয়েছিল। এভাবে ভেঙ্গে ভেঙ্গে পেলে সেই টাকার কোন বরকত পাওয়া যায় না।
আজ কোন অনুষ্ঠান ছিল না। মরিয়ম বানু শহরের কমিউনিটি সেন্টারগুলোর অনুষ্ঠানে নিয়মিত মসলা পেশার কাজ করে। সেখান থেকেই আঁচলের ভেতর করে সংসারের হলুদ-মরিচ-মাছ-মাংসের চাহিদাগুলো মেটায় সে। এই বস্তির আরো পাঁচজন তার সাথে কাজ করে। সে বয়সে বড় বলে বাকীরা তাকে খুব মানে। একটু আধটু হিসেব পত্র জানে বলে উপার্জনের টাকাটা মরিয়ম বানুর হাত দিয়েই ভাগ ভাটোয়ারা হয়। প্রতিবারেই সে অন্যদের চাইতে বেশী টাকা পায়। পায় মানে একটু এধার ওধার করে নিতে হয় আরকি! দুর্ভাগ্য বশতঃ তার কারসাজিটা গতকাল কিভাবে যেন ধরা পড়ে গেছে। বাকীরা টের পেয়ে গেছে মরিয়ম বানু এতদিন তাদের ঠকিয়ে এসেছে। তাই তারা আর মরিয়ম বানুর সাথে কাজ করবে না বলে ঠিক করেছে। সবাই মিলে হেড বাবুর্চির কাছে মরিয়ম বানুর বিরুদ্ধে নালিশও করেছে। যদিও জানে, এতে কোন লাভ হবে না।
এই বয়সেও মরিয়ম বানুর শরীরটা বেশ ডাঁটো। হেড বাবুর্চির সাথে মরিয়ম বানুর গভীর সম্পর্ক! তবে ব্যাটা বড্ড কষা। হাতের ফাঁক গলে পানি পড়ে না। মাঝে মাঝে মরিয়ম বানু ধার চাইলে দিতে চায় না। কিন্তু তাকে খুশী না রেখেও কোন উপায় নাই। তার কারণেই মরিয়ম বানু নিয়মিত কাজ পায়। গতকাল ‘সানফ্লাওয়ার’ কমিউনিটি সেন্টারের রান্নাঘরের পেছনদিকের ঐ অন্ধকার ঘরটা থেকে বেরুনোর সময় মরিয়ম বানু হেড বাবুর্চির কাছে থেকে কিছু টাকা চেয়েছিল। হারামজাদা দেয় নাই, বলেছে পরে দেবে। শালা অন্ধকারে ঢোকার আগে মিঠা মিঠা কথা বলে, আর বেরুনোর সময় সব ভুলে যায়।
বাজারের দোকানপাট এখনো খোলেনি। মরিয়ম বানু বড় খাঁচাটার পাশে দাঁড়িয়ে আছে। দোকানের মালিক চা খেতে গেছে। যাওয়ার আগে দোকানের ছোকরামত ছেলেটাকে বলে গেছে মুরগীটা মেপে রাখতে। সে ফিরে এসে দাম দেবে। ছোকারা মরিয়ম বানুর মুরগীটাকে ওজন করে বড় খাঁচাটায় ছুঁড়ে দিয়েছে। তারপর বড় খাঁচা থেকে একেকটা মুরগীকে খাবার খাইয়ে পাশের আরেকটা খাঁচায় রাখছে। ছোকরাটার সামনে বড় একটা বাটিতে মুরগীর খাবার রাখা আছে। এমন সময় সেখানে জুলিয়াদের কাটিং মাস্টারকে দেখা গেল। মরিয়ম বানুকে সালাম দিয়ে কাটিং মাস্টার বলল, ‘ফ্যাকটারিতে যাইবার আগে জুলিয়ারে দেখতে আসলাম। সে দেখি ঘরে নাই।’
-ঘরেই তো আছিল.. কাছে কিনারে থাকতে পারে।
-তার শইলের কি অবস্থা?
-আগের চাইতে বালা।
কাটিং মাস্টারের বুকের ভেতর থেকে একটি দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসল, ‘ধরেন.. এই টাকাগুলা তারে দিয়েন.. তারে একটু বালা বালা খাওয়ান.. আজ তো দুই তারিখ.. পাঁচ তারিখ সন্ধ্যার পর পি এম সাহেবের সাথে তারে দেখা করতে বইলেন।’
কক্ কক্ কক্ কক্ করে একটা শব্দ হল। মরিয়ম বানু আর কাটিং মাস্টার দু’জনেই এক সাথে তাকালো সেদিকে। দোকানের ছোকরাটা একটি মুরগীকে কৌশলে হা করিয়ে আঙ্গুল দিয়ে টিপে টিপে খাবার খাওয়াচ্ছে। চিন্তিত কাটিং মাস্টারের হঠাৎ মনে হল, মুরগীটিকে যে খাবার খাওয়াচ্ছে সে আর কেউ নয়, তার পি এম স্বয়ং।

নাসির উদ্দিন খান

Email:


মন্তব্য

রোমেল চৌধুরী এর ছবি

ভালো লেগেছে।

------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
আমি এক গভীরভাবে অচল মানুষ
হয়তো এই নবীন শতাব্দীতে
নক্ষত্রের নিচে।

অতিথি লেখক এর ছবি

সুন্দর গল্প।

হিমাগ্নি

রাতঃস্মরণীয় এর ছবি

চলুক

------------------------------------------------
প্রেমিক তুমি হবা?
(আগে) চিনতে শেখো কোনটা গাঁদা, কোনটা রক্তজবা।
(আর) ঠিক করে নাও চুম্বন না দ্রোহের কথা কবা।
তুমি প্রেমিক তবেই হবা।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।