আফ্রিকার প্যারিস- আবিদজান।

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: বিষ্যুদ, ২৬/০৫/২০১১ - ১২:৩৭অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

আফ্রিকার প্যারিস- আবিদজান
- সুমাদ্রি শেখর

প্যারিস-কে বলা হয় শিল্পের নগরী,সৌন্দর্যের দেবী যেন এ শহরে অধিষ্ঠাত্রী হয়ে আছেন।২য় বিশ্বযুদ্ধে হিটলারের বোমারু বিমানগুলো ইউরোপের বড় বড় শহরকে ভূলন্ঠিত করলে ও প্যারিসের উপর কী এক অদ্ভুত কারণে তারা বারুদের ছোঁয়া ও লাগায়নি।২০০৮ সালের শরতে প্যারিস-কে দেখে বুঝেছিলাম কোন দৈববলে দেবী নাজীদের পাষান হৃদয়ে ও সুরের ঝংকার তুলেছিলেন।আফ্রিকা মহাদেশের এককোনায় ও শুনেছিলাম ছোট্ট একটা প্যারিস আছে কিন্তু তার নাম ভিন্ন।আবিদজান।খোঁজ নিয়ে জেনেছিলাম,আবিদজান আইভরী কোস্ট নামক একটা সাবেক ফরাসী উপনিবেশের রাজধানী।ফরাসীদের যখন উপনিবেশ তখন হয়ত ব্যাপার একটা আছে,মনে মনে ভেবেছিলাম।তখন কল্পনাও করিনি বছর তিনেক পর সেই উপনিবেশেই রাজনৈতিক অস্থিরতার সুযোগে জাতিসঙ্ঘের একটা চাকরী নিয়ে আমি কাজ করতে আসব দীর্ঘদিনের জন্য।আইভরী কোস্ট-এর প্রত্যন্ত একটা মফঃস্বল শহরে যখন ধুলিমাখা হয়ে আসি,তখন সেখানে রীতিমত যুদ্ধের প্রস্তুতি চলছে।প্রায় দশ বছর ধরেই দেশটা ভাগ হয়ে আছে দুভাগে,সরকার সমর্থিত দক্ষিণভাগ আর বিদ্রোহীদের দখলে থাকা উত্তরভাগ।আমি এসে দেখলাম আফ্রিকার প্যারিস আমার সেই মফঃস্বল শহর থেকে ৮০০ মাইল দূরে,আর বরাতে আমার পড়েছে বিদ্রোহীদের কব্জায় পড়ে ধুঁকতে থাকা দক্ষিনের শহর মঁ।যদিও মঁ শান্ত,পাহাড়ী,মেঘের আঁচলে লুকিয়ে থাকা সুন্দর একটা জায়গা; আমার মনপাখি বারবার উড়ে চলে যেতে চাইত আফ্রিকার প্যারিসের আকাশে।কে জানে কেমন ঐ শহরটা,তার মাঝখানে ও কি আইফেল টাওয়ারের মত কিছু আছে কিনা,কিংবা তার নদীর উপর যে সেতুগুলো আছে সেখানে শিল্পীর দল তুলি আর ক্যানভাস নিয়ে সারাদিন ছবি আঁকায় মগ্ন থাকে কিনা,এসব ভাবনা ভাবতে ভাবতে আমি অস্থির হয়ে পড়তাম।এভাবেই কেটে গেল চারটি উষ্ণ মাস।এই চার মাসে আবিদজানে মরেছে বিস্তর মানুষ,আন্তর্জাতিক মহলের খবরদারী আর চোখ রাঙ্গানিকে উপেক্ষা করে বুক চিতিয়ে আবিদজানে দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন উপনিবেশ-বিরোধী,স্বঘোষিত প্রেসিডেন্ট লরেন্ট বাগবো।এইখানে কিছুটা পরিপ্রেক্ষিত দিয়ে রাখা ভাল।দীর্ঘকাল ফ্রান্সের উপনিবেশ থাকার পর ১৯৬০ সালে আইভরী কোস্ট স্বাধীনতা লাভ করে কিন্তু আজ পর্যন্ত নেপথ্যে থেকে এই দেশের উপর খবরদারি চালিয়ে যাচ্ছে শিল্প-সাহিত্যের আবছায়ায় নিজেকে আড়াল করে রাখা সাম্রাজ্যবাদী ফ্রান্স।এই দেশের সমস্ত খনিজ সম্পদ তুলে নিয়ে যাচ্ছে ফ্রান্সের বিভিন্ন কোম্পানীগুলো কোন রকম রাজস্ব না দিয়েই।এই দেশের চিরহরিৎ বনগুলোকে উজাড় করে দিচ্ছে লেবানীজ আর ফরাসী বনদস্যুরা।প্রধান কৃষিজ দ্রব্য কোকো আর কফি এদেশ থেকে নামমাত্র মুল্যে কিনে নিয়ে বাজারজাত করছে ফ্রান্স-এ আর ফ্রান্স থেকেই চালান যাচ্ছে সারা বিশ্বে।এদেশের বিদ্যুত,পানি এবং টেলিযোগাযোগ ব্যাবস্থার মালিক হল ফ্রান্সের বিভিন্ন ক্ষমতাধর বেসরকারী প্রতিষ্ঠান। অবাক হলে ও সত্যি এদেশের ভেতরই বিশাল এক এলাকা জুড়ে রয়েছে ফ্রান্সের ক্যান্টনমেন্ট। রাজনৈতিক জীবনের শুরু থেকেই উপনিবেশ বিরোধী আন্দোলন চালিয়ে আসা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক লরেন্ট বাগবো নির্বাচনে জিতে ক্ষমতায় আসেন ২০০০ সালে,আর ঠিক তার দুই বছর পরই ক্যুর মাধ্যমে দেশটির উত্তর অংশ দখল করে নেয় সেনাবাহিনীর একটা অংশ।নিজেদের এরা রেবেল পরিচয় দিতেই ভালবাসে। প্রধানত মালি,বুরকিনা ফাসো,গিনি,ঘানা এসব দেশের অভিবাসীরাই বিদ্রোহীদের দল ভারী করে তোলে। এবং স্বাভাবিকভাবেই ফ্রান্স এই সুযোগটা লুফে নেয়,বাগবো সরকার সবসময় অভিযোগ করে এসেছে যে ফ্রান্স গোপনে বিদ্রোহীদের মদদ দিয়ে যাচ্ছে,অস্ত্র এবং অর্থের যোগান দিয়ে। দুবছর যেতে না যেতেই ২০০৪ সালে বাগবো সমর্থক এবং ফরাসী সৈন্যদের মধ্যে ভয়াবহ যুদ্ধ লেগে যায়,ফরাসী যুদ্ধ বিমান বোমা মেরে সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস করে দেয় আইভরী কোস্ট-এর বিমান বাহিনীকে,আবিদজানে শুরু হয় রক্তক্ষয়ী সংঘাত। কয়েকমাস পর সরকার এবং রেবেলদের মধ্যে একটা শান্তিচুক্তি সম্পাদিত হয় জাতিসংঘের পৌরহিত্যে যার ভিত্তিতে দেশটি দ্বিখন্ডিত হয়ে পড়ে সরকার নিয়ন্ত্রিত দক্ষিনভাগ আর বিদ্রোহীদের নিয়ন্ত্রিত উত্তরভাগে।সেই থেকে ২০১০ সাল অবধি সবুজ এই দেশটি শান্তই ছিল,অশান্তি মাথা-চাড়া দিয়ে উঠে অক্টোবরের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের পর থেকেই। জাতিসঙ্ঘের তত্ত্বাবধানে হওয়া এই নির্বাচনের ফলাফল মেনে নিতে অস্বীকৃতি জানান ক্ষমতাসীন প্রেসিডেন্ট বাগবো এবং অভিযোগ তোলেন নির্বাচনে ব্যাপক কারচুপির।উল্টো নিজেকেই তিনি বিজয়ী ঘোষনা করে বসে শপথ নিয়ে বসেন।একই সাথে আনর্জাতিক সম্প্রদায় এবং জাতিসঙ্ঘের রায়ে নির্বাচিত প্রার্থী আলাসান ওয়াতারা ও প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নিয়ে ফেলেন।আফ্রিকা-র প্যারিস আবিদজানে শুরু হয় আন্তর্জাতিক রাজনীতির পাশা খেলা এবং এরই মাঝে পড়ে খুন হয়ে যায় শত শত মানুষ।আবিদজানে যখন ভয়াবহ যুদ্ধ চলছে দুই প্রেসিডেন্ট এর সমর্থক এবং যোদ্ধাদের মধ্যে,তখন ৭০০ মাইল দূর থেকে বসে প্রতিদিন আমি উৎকন্ঠা নিয়ে ভাবতাম আমার আফ্রিকার প্যারিস দেখা বোধ হয় আর হবেনা।প্রতিদিন খবর পেতাম আবিদজানের রাস্তায় মানুষ পোড়ানো আর শপিং মল গুলোতে লুটপাটের খবর।আর আমি বিমর্ষ হতাম ভেতরে ভেতরে।আবিদজান এ যখন বিদ্রোহী বাহিনী ঢুকে পড়ে,আর জাতিসঙ্ঘ আর ফরাসী সৈন্যরা যৌথভাবে বিমান হামলা চালায়,বিশাল এ শহর তখন যেন একটা মৃত্যুপুরী।এখানে ওখানে লাশের পাহাড়,আর মানুষ পোড়ার গন্ধ,আর রক্তের দাগ,আর ভয়।ভয়।উত্তরে থেকে তখন আমরা দেখছি অমানবিক জাতিগত সহিংসতা,আবিদজান থেকে উৎখাত হওয়া মানুষের ঢল,আর মানুষের চোখে অবিশ্বাস আর ঘৃনা।দুয়েকুয়ে নামক একটা শহরে একদিনেই খুন হয়েছে হাজারো মানুষ।লাশের গন্ধ যে কী বিবমিষাকর তা এই প্রথমই আমার টের পাওয়া।শেষ পর্যন্ত সিংহপুরুষ বাগবোকে যখন গ্রেফতার করা হল তার প্রেসিডেন্সিয়াল প্রাসাদ থেকে,তখন উত্তরে খুশীর জোয়ার।রাস্তায় রাস্তায় বর্ণিল পোষাকে সজ্জিত নারীদের মিছিল। আবিদজানে ঢোকার পথে এখন আর কোন বাধা নেই।

বাগবো'র পতনে আমি যে খুশি হয়েছি এমন নয়,বরঞ্চ তার প্রতি সবসময় একটা সহানুভূতিই টের পেয়েছি ভেতরে ভেতরে।কিন্তু আমি আদার ব্যাপারী।আমার খুশি-অখুশিতে পৃথিবীর অন্যায় থেমে যাবেনা।আমি বরং আবিদজান দেখতে পাবো এজন্যই পুলকিত।এর মাস খানেক পরই এল সেই মাহেন্দ্রক্ষণ।বিমান থেকে আবিদজানের যে ছবি আমি দেখতে পেলাম তাতেই আমি মোহিত।এটা একটা লেগুনে ঘেরা বিশাল শহর।আবিদজানে পা রেখেই আমি অবাক হলাম নগরবাসীর কর্মচাঞ্চল্য দেখে।কে বলবে এ শহরেই মাত্র কদিন আগে হাজারো মানুষ গুলি খেয়ে মরেছে।আবিদজানে সড়কে গাড়ির ঢল দেখে ও অবাক হলাম।আসলে দীর্ঘ দশ বছর ধরে এ দেশটা একটা সংকটে আছে, মানুষ স্বাভাবিকভাবেই চাইবে এটার অবসান হোক।মানুষগুলোর চেহারায় ও তাই ক্লান্তির ছাপ।আবিদজান ফরাসীদের হাতে গড়া শহর।এর লেগুনগুলোর উপর পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছে দুটো সেতু অনেকটা সীন নদীর ওপরের সেতুগুলোর মতই।যুদ্ধের সময় এই লেগুনগুলোতে নাকি ভেসে যেত মানুষের লাশ।সারাটা শহরে দেখলাম ফ্লাই ওভারের ছড়াছড়ি,এ শহরে একবার রাস্তা হারালে নতুন ড্রাইভারের যে কি হাল হবে তা আর বলার অপেক্ষা রাখেনা।আবিদজানের সুউচ্চ দালানগুলো সব ব্যাবসা প্রতিষ্ঠান।মূলত ফরাসীরাই এসব ব্যাবসার মহারথী,মিডলম্যান হিসেবে আছে লেবানীজরা।আইভরীয়ানরা এসব অফিসে চাকরী করে।শহরের অফিস পাড়ার নাম প্লাতো,এখানেই রয়েছে ফ্রান্সের দূতাবাস,স্টেডিয়াম,ব্যাংক আর শপিং মলগুলো।সন্ধ্যায় আমরা কদিন পিজ্জা খেতে গেছি রেস্টুরেন্ট পাড়া জোন ফোর-এ।আবিদজানের একটা ব্যাপার দেখে খুব ভাল লাগল,তা হল এরা মোটামুটি আইন মেনে চলা পাবলিক।গাড়ীগুলো চলছে সারিবদ্ধভাবে।লালবাতি পড়লে থেমে যাচ্ছে।এখানে ওখানে ময়লার স্তুপ ও নেই।এ শহরের বনেদী পাড়া হল কোকোদী।এখানেই প্রেসিডেন্ট বাগবোর বাসা।এখানেই আবিদজানের সরকারী বিশ্ববিদ্যালয়।এখানেই সব অভিজাত লোকেদের বাস।কোকোদীতে আমরা প্রায়শঃ বেড়াতে যেতাম আবিদজানের সত্যিকারের চেহারা খুঁজে পেতে।শহরের উপকন্ঠে রয়েছে আবিদজানের সৈকতগুলো।আটলান্টিকের তীর ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকা গ্রান্ড বাসাম,বা আশ্বিনি সৈকতে এখন পর্যটকের কোন কোলাহল নেই।এখানে সৈকতগুলো মারাত্মক রকমের ঢালু,আর স্রোতের সে কি টান,আমাদের কক্সবাজার সে তুলনায় ঢের মনোরম।তবে গ্রান্ড বাসাম সৈকতের মূল আকর্ষন তার শিল্প বাজার।আইভরীয়ানদের কাঠের কাজ অতুলনীয়।মূলতঃ সেনুফু সম্প্রদায়ের লোকেরাই এই পেশার সাথে জড়িত।বাজার জুড়ে সারি সারি দোকানগুলো আমার কাছে এক অন্য পৃথিবীর রুপ তুলে ধরছিল যেন।প্রতিটি দোকানই আমার কাছে মনে হচ্ছিল এক একটা মিউজিয়াম যেখানে মূর্ত হয়েছে আফ্রিকানদের সৌন্দর্যবোধ,তাদের বীরত্মগাঁথা,তাদের দৈনন্দিন জীবনের সহজিয়া কথকথা।আবিদজানের আকাশচুম্বী দালান আর রাস্তাঘাট আমাকে একটা পরিকল্পিত শহরের ধারনা দিলেও সাগর পাড়ের শিল্পের এই দোকানগুলো-ই আমাকে এ শহরের খ্যাতির রহস্য বলে দেয়।প্যারিসে ও সীন নদীর ওপর শিল্পীরা বসে এঁকে চলে ঠিক যেভাবে সাগরের তীরে দাঁড়িয়ে সেনুফু তরুন ছেনি দিয়ে ইরোকো কাঠের ওপর ফুটিয়ে তোলে আফ্রিকার ছন্দগাঁথা।এখানেই আবিদজান আর প্যারিসের মধ্যে আমি দেখতে পাই এক অভূতপূর্ব মিল।


মন্তব্য

অপছন্দনীয় এর ছবি

বর্ণনা ভালো লাগলো।

যদি কিছু মনে না করেন তো একটা পরামর্শ দেই, প্যারাগ্রাফগুলো একটু ছোট ছোট হলে পড়তে সুবিধা হতো। হাসি

কৌশিক আহমেদ এর ছবি

শহরটা আসলেই বেশ সুন্দর। প্রায় দেড় বছর সময় কাটিয়েছি এই শহরে। যোন ফোর-এ থাকতাম আমরা। একন কি পরিস্থিতি কিছুটা শান্ত? সবকিছু স্বাভাবিক হলে আবার হয়ত যেতে হবে! হাসি

রাহিন হায়দার এর ছবি

আপনারে চেনা চেনা লাগে! দেঁতো হাসি

কৌশিক আহমেদ এর ছবি

হাহা, রাহিন কেমন আছো? এখনও আবিজানে?

রাহিন হায়দার এর ছবি

সচলে স্বাগতম সুমাদ্রি ভাই। লেখা ভালো লেগেছে। আরো আসুক। প্যারাগ্রাফ বানিয়ে দিয়েন এরপর থেকে।

দালোয়া গেছিলাম গত সোমবার, আজ ফিরলাম। ফেসবুকে কথা হবে।

অস্পৃশ্যা এর ছবি

লেখাটা ভাল লাগল, সহজ ভাষায় সুন্দর বর্ননা। তবে প্যারা করে দিলে পড়তে আরাম হত।

পাগল মন এর ছবি

বেশ সাবলীল বর্ণনা। তবে শহরের বর্ণনার সাথে কিছু ছবি দিলে মনে হয় পরিপূর্ণতা পেত লেখাটা।

------------------------------------------
হায়রে মানুষ, রঙিন ফানুস, দম ফুরাইলে ঠুস
তবুও তো ভাই কারোরই নাই, একটুখানি হুঁশ।

আসমা খান, অটোয়া। এর ছবি

লেখাটার বর্নানা খুব সুন্দর, পরের পর্বের অপেক্ষায় আছি। অনেক ধন্যবাদ লেখককে।

ফাহিম হাসান এর ছবি

নতুন স্বাদের লেখা ভালো লাগছে খুব।

্কানিজ ফাতিমা এর ছবি

লেখাটা আরেকটু সংক্ষেপ হতে পারত।বাক্যগুলো আরেকটু ছোট হলে ভাল লাগত।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।