রস+আলোর “একটি ঘাষ ফড়িং এর গল্প” এর পূণর্পাঠ

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: বিষ্যুদ, ২১/০৭/২০১১ - ৯:০৫অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

সংবাদপত্রের সঙ্গে দেওয়া ফান ম্যাগাজিন আমার আগ্রহের বিষয় বহুদিনের। একটি সংবাদপত্র আধেয় প্রস্তুতকরণ, উৎপাদন (মূদ্রণ-আনুষঙ্গিক), বিপণন ইত্যাদি বাবদ যে বিশাল অঙ্কের খরচ হয় তা বাংলাদেশ পরিস্থিতিতে শুধু মাত্র বিজ্ঞাপন থেকে তুলে সংবাদপত্রকে লাভজনক ব্যবসায় পরিণত করা রীতিমত দুঃসাধ্য-- এ ব্যাপারে কোন ভিন্নমত আপাতত পাওয়া যায় না। সংবাদপত্রগুলো তাদের বার্ষিক নীরিক্ষা প্রতিবেদন প্রকাশ করে না বলে আমরা অদ্যাবধি নিশ্চিত নই এসব সংবাদপত্র লাভ না লোকসান করছে। লোকসান করলে কী পরিমাণ, পরিমাণটা বিপুল হলে -- সে টাকা কোত্থেকে আসে, ইত্যাদি প্রভৃতি।

যা হোক একটি সংবাদপত্র যখন কোন ফান ম্যাগাজিন বিনামূল্যে পাঠকের হাতে তুলে দেয় তখন সে যে শুধু রং তামাশা করার জন্যই এ ধরনের বিশাল ব্যয় বহন করে না সেটা বোঝাই যায়। বাজারে কাটতি বাড়ানো তো একটা উদ্দেশ্যই, সঙ্গে যুক্ত থাকে মানুষের মধ্যে একটি মবিলিটি তৈরি করার। এ বিষয় নিয়ে পূর্বেও বিস্তারিত আমি লিখেছি।

এখন যে আলাপটি আমি তুলতে চাই তা হল প্রথম আলো পত্রিকার সাপ্তাহিক ফান ম্যাগাজিন রস+আলো’র একটি গল্প। এটি গত ১১ জুলাই ২০১১ তে প্রকাশিত হয়েছে। এখানে গোলাম রসূল ফিরোজ নামের একজন লেখক “একটি ঘাষ ফড়িংয়ের গল্প” নামে একটি গল্প লিখেছেন। এটি “ওয়েবসাইট অবলম্বনে” লেখা। তবে কোন ওয়েবসাইট অবলম্বনে লেখা তা বলা হয় নি। (তথ্য প্রযুক্তির আরেকটি অসদ্ব্যবহার হচ্ছে এই নাম ঠিকানাবিহীন “ওয়েবসাইট অবলম্বনে” লেখা। )

যা হোক গল্পটার কাসিক বা পুরোন ভার্সন উল্লেখ করেছেন লেখক। এটি আসলে ঈসপের একটি নীতি গল্প। বেন এডউইন পেরির ইনডেক্সে এটি ৩৭৩ নং গল্প। (Ben Edwin Perry (1965). Babrius and Phaedrus. Loeb Classical Library. Cambridge, MA: Harvard University Press. pp. 487, no. 373. ISBN 0-674-99480-9.) এ গল্পটি কঠোর পরিশ্রম ও ভবিষ্যত চিন্তা বিষয়ক একটি উপদেশমূলক গল্প। এ গল্পটা একটি আপাত নীরিহ গল্পই বটে। চলুন লেখক তথা রস+আলোর জবানিতে এ গল্পের পুরোন ভার্সনটি দেখি:

পুরোনো গল্প
গ্রীষ্মকালজুড়ে পিঁপড়া ওর নিজের জন্য ঘর বানাল এবং শীতের জন্য খাদ্য সঞ্চয় করল। আর ঘাসফড়িং ভাবল, পিঁপড়া একটা বোকা। সুতরাং ঘাসফড়িং হেসেখেলে মনের আনন্দে গ্রীষ্মকালটা পার করে দিল। তারপর যথারীতি শীতকাল এল। পিঁপড়ার এখন খাদ্যের অভাব নেই। আর তার থাকার জায়গাটাও বেশ গরম। ওদিকে ঘাসফড়িংয়ের খাদ্যও নেই, ভালো আশ্রয়ও নেই। সুতরাং শীতে টিকতে না পেরে, না খেয়ে বেচারা মারাই গেল।

এ গল্পটি বহুভাবে পরবর্তীতে বিভিন্ন সাহিত্যে ব্যবহৃত হয়েছে। এ গল্পটি সঙ্গীত, চলচ্চিত্র, টেলিভিশন, চিত্রকলা ইত্যাদি ক্ষেত্রে পূণবিবৃত হয়েছে। তবে সম্প্রতি টক শো গুরু জিম কুইন নিউ লিবারাল ধারায় গল্পটি পূণঃবিবৃত করেন। [url=(http://www.davidstanleybell.com/wisdom/story-ant-grasshopper.htm)]এখানে দেখুন[/url] আর এটিই হচ্ছে রস+আলো উদ্ধৃত সেই “ওয়েবসাইট অবলম্বন”।

জিম কুইনের গল্পটার অংশ বিশেষ ধরে আমরা রস+আলোর লেখকের বাংলাদেশি সংস্করণ সামান্য মিলিয়ে দেখব আমাদের দ্বিধা দূর করার উদ্দেশ্যে:

The ant works hard in the withering heat all summer long, building his house and laying up supplies for the winter. The grasshopper thinks he's a fool and laughs and dances and plays the summer away.
Come winter, the shivering grasshopper calls a press conference and demands to know why the ant should be allowed to be warm and well fed while others are cold and starving. CBS, NBC and ABC show up to provide pictures of the shivering grasshopper next to video of the ant in his comfortable home with a table filled with food.

(জিম কুইন)

আর এ কথাগুলোই হুক্ষহু অনুবাদ করেছেন আমাদের আলোচ্য লেখক নিম্নোক্তভাবে:

গ্রীষ্মকালজুড়ে পিঁপড়া ওর নিজের জন্য ঘর বানাল এবং শীতের জন্য খাদ্য সঞ্চয় করল। আর ঘাসফড়িং ভাবল, পিঁপড়া ব্যাটা একটা গাধা। সুতরাং হেসেখেলে নেচেগেয়ে গ্রীষ্মকালটা পার করে দিল ঘাসফড়িং।

তারপর যথারীতি শীতকাল এল। ঠান্ডায় মরমর ঘাসফড়িং প্রেস কনফারেন্স ডাকল এবং সে জানতে চায়, পিঁপড়া কেন একা একা ভালো ভালো খাবে আর গরম জায়গায় থাকবে, যেখানে অন্যরা না খেয়ে এবং শীতে জমে মরে যাচ্ছে। বিটিভি, বিবিসি, সিএনএন—সব এল, ওরা শীতে কাঁপা ঘাসফড়িংয়ের ভিডিও প্রচার করল আর পাশাপাশি প্রচার করল আয়েশে থাকা পিঁপড়ার ভিডিও। পিঁপড়ার আরামদায়ক একখানা বাড়ি আর টেবিল ভর্তি খাবারদাবার।

(গোলাম রসূল ফিরোজ)

এভাবেই লেখক তথা রস+আলো যখন নিউলিবারাল ধারার গল্পটি আমাদের বাংলাদেশের সঙ্গে খাপ খাওয়ান তখন একে বিশ্লেষণ করে দেখা বেশ প্রয়োজনীয় হয় সত্যি। চলুন দেখি গল্পটিতে আমাদের এ শীর্ষস্থানীয় সংবাদপত্রের সাপ্লিমেন্টারিটি কী ধরনের ইমেজ তৈরির চেষ্টা করতে থাকে।

ঘাষফড়িং-- গল্পের শুরুতেই বলা হয়েছে অলস এবং অদূরদর্শী একটি চরিত্র, যে কি না সারা গ্রীষ্ম জুড়ে “হেসে খেলে নেচে গেয়ে” বেড়াল এবং নিজের এই কর্মবিমুখতার কারণেই সে আজ “ঠান্ডায় মরমর”। এই অলস-কুঁড়ে-অপরিণামদর্শী(???) কে বাঁচাতে

.....সুশীল সমাজ ঘাসফড়িংয়ের প্রতি ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে মানববন্ধন করল এবং বিবৃতি দিল, ‘সংখ্যালঘুদের ওপর এহেন অন্যায় মেনে নেওয়া যায় না...’ এবং সেই সঙ্গে আন্তর্জাতিক তদন্তের দাবি জানাল। ঘাসফড়িংয়ের সমর্থনে ইন্টারনেটে অনলাইন পিটিশনের বন্যা বয়ে গেল।

সুশীল সমাজের (যদিও সুশীল সমাজ বলতে কাদেরকে বোঝানো হয় তা সুস্পষ্ট নয়। মিডিয়াগুলো এ ধরনের একটি সমাজ গঠনে আগ্রহী হলেও কী কী যোগ্যতা থাকলে এ সমাজে সভ্য হওয়া যায় তা এখনও ঠিক করতে না পারায় মিডিয়াগুলো এ শব্দটি ব্যবহার করলেও ব্যখ্যা দেয় না ) বিবৃতি থেকে বোঝা গেল এ ঘাষফড়িংরা আর কেউ নয় এ দেশের “সংখ্যালঘু” সম্প্রদায়। সংখ্যালঘু বলতে কাদেরকে বোঝায়?

A minority is a sociological group that does not make up a politically dominant voting majority of the total population of a given society. A sociological minority is not necessarily a numerical minority — it may include any group that is subnormal with respect to a dominant group in terms of social status, education, employment, wealth and political power.

সোসিওইকোনোমিকসে “সংখ্যালঘু” শব্দটি চারটি ভাগে সাধারণত ব্যবহৃত হয়-- ধর্মীয় সংখ্যালঘু, জাতিগত সংখ্যালঘু, ভাষাগত সংখ্যালঘু এবং/ অথবা সাংস্কৃতিক সংখ্যালঘু। কিন্তু এখানে লেখক যে সংখ্যালঘু বিচার করেছেন সোসিওলজিক্যাল মাইনোরিটি হিসেবে তার প্রমাণ পাওয়া যায় কিছু পরেই। যখন দুর্নীতির দায়ে ঘাষফড়িং তথা সংখ্যালঘুর বিপরীত চরিত্র পিঁপড়াকে ধরপাকড় শুরু হয় তখন লেখক উল্লেখ করেন:

বিরোধী দল অভিযোগ করল, শুধু বিরোধী দলের পিঁপড়াকেই গ্রেপ্তার করা হয়েছে। সুতরাং তারা হরতালের মেয়াদ বাড়িয়ে দিল।

অর্থাৎ পিঁপড়াদের অতপ্রোত রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা রয়েছে। সেটা বিরোধী দল এবং সরকারি দল দুদিকেই। আর ঘাষফড়িং হচ্ছে এ পিঁপড়াদের তুলনায় রাজনৈতিক মতার দিক থেকে স্বাভাবিকের চেয়ে নিচে অবস্থানকারী-- এ হিসেবে সংখ্যালঘু।

এবং সেই সঙ্গে এতক্ষণে এটাও খোলাসা হল যে ঘাষফড়িংদের যে ঘর-বাড়ি নেই, টেবিল ভর্তি খাবার নেই -- এ দুর্দশার কারণ তারা নিজেই। এবং সেই কঠোর পরিশ্রমী পিঁপড়ার সেগুলো ছিল তার কারণও সেই পিঁপড়া স্বয়ং। এখানে অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে আমরা বললাম না এই ঘাষফড়িং এর কঠোর পরিশ্রম করার জায়গাগুলো এই পিঁপড়ারা মহোৎসবে দখল করে রাখল। সরকারি-বিরোধীদলের রাজনীতি, কূটনীতি, পরিশ্রমী পিঁপড়ার রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা ঘাষ ফড়িং কে কিছুই করতে দিল না।

এরপর লেখক নানা আলোচনার এক ফাঁকে তার অবস্থানটা আরও পরিস্কার করতে থাকলেন। গল্পকারের আফসোস ঝরতে থাকল এভাবে

... দুদক দুর্নীতির অভিযোগে পিঁপড়াদের গ্রেপ্তার করল এবং তাদের সব সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করল। এবং গ্রেপ্তারের পুরো দৃশ্য বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে দেখানো হলো।...বিরোধী দল অভিযোগ করল, শুধু বিরোধী দলের পিঁপড়াকেই গ্রেপ্তার করা হয়েছে। ... অনেক অনেক বছর পর এসব কঠোর পরিশ্রমী পিঁপড়া মাইগ্রেশন করে ইংল্যান্ড-আমেরিকায় চলে গেল। ওখানে গিয়ে ওরা বড় বড় হোটেল দিয়ে মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার কামাতে লাগল।

সুতরাং এটাও বোঝা গেল লেখক যে কঠোর পরিশ্রমী পিঁপড়াদের কথা বলেছিলেন তারা দুর্নীতির দায়ে এক সময় গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। হ্যা পাঠক এটাই হচ্ছে এ গল্পের মদ্দা কথা। এ কঠোর পরিশ্রমী পিঁপড়ারা আর কেউ নন --আমাদের দেশের সেই সব ব্যবসায়ী যারা কোটি টাকা দামের প্রাডো গাড়ি রাস্তায় ফেলে পালিয়েছেন, যারা ডাস্টবিনে অবৈধ টাকা ফেলে জীবন বাঁচিয়েছেন, ঘরের ভেতর হরিণ-ময়ূর রাখার অপরাধে গ্রেপ্তার হয়েছেন এবং দুর্নীতির দায়ে গ্রেপ্তার হওয়ার ভয়ে বিদেশে পাড়ি জমিয়েছেন। যেহেতু এ ব্যবসায়ী-দুর্নীতিবাজ ব্যবসায়ী --যারা কঠোর পরিশ্রম (!) করে দু হাতে কালো টাকা কামিয়েছেন তারা চলে গেছেন-- তাই আমরা কী ধরনের অপরিসীম তির মুখে পড়লাম তা ঈসপের মত করে আমাদেরকে রস+আলো শেখাল এভাবে:

আর এদিকে হাজার হাজার ঘাসফড়িং নানাবিধ রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতির ভারে এবং মাইক্রোক্রেডিটের সাপ্তাহিক কিস্তির চাপে না খেয়ে মারা যাচ্ছে ফলে যা হলো, এসব কঠোর পরিশ্রমী পিঁপড়াকে হারিয়ে এবং ওই সব ঘাসফড়িংকে বসিয়ে বসিয়ে খাইয়ে গত হাজার বছরের মতো বাংলাদেশ সেই চিরকালের উন্নয়নশীল দেশই রয়ে গেল...!

এ গল্পটিতে আমাদের মিডিয়া আরও যা বললো না তা হচ্ছে-- এই সব মাইগ্রেটেড কঠোর পরিশ্রমী পিঁপড়ারা দেশে সুযোগ বুঝে ফিরে আসল, তারা সেই বিটিভি বা ওই ধরনের আরও কিছু মিডিয়াকে কিনে নিল। দেশে যেখানে প্রায় অর্ধেক লোক দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করছে সেখানে তারা আরও নতুন নয়টি টিভি চ্যানেল করল, প্রেস ওয়ালাদেরকে ভাল বেতন দিল যাতে তারা আর ঘাষ ফড়িংদের প্রেস কনফারেন্সে না যায়, ঘাষ ফড়িংদেরকে টোকাই ফোকাই, ইতর অলস ইত্যাদি বলে সমাজে রটাতে থাকল। নিজের পদলেহী রাজনৈতিক দলগুলোকে দু চারটা ধমক ধামক দিল আর এতদিন বিদেশে থেকে এ কঠোর পরিশ্রমী পিঁপড়া যে নতুন ব্যবসায়ী সংযোগ গড়ে তুলল সেখান থেকে বিদেশী পণ্য এনে ঘাষ ফড়িংয়ের কাছে বাণিজ্য করতে থাকল। এবং আরও অনেকভাবে ঘাষ ফড়িংকে শোষণ করতে থাকল। কিন্তু মিডিয়াতে না আসায় আমরা জানতেও পারলাম না।


মন্তব্য

বইখাতা এর ছবি

চলুক রস+আলো সাধারণত পড়া হয়, কিন্তু এটা পড়িনি মনে হচ্ছে।

guest_writer এর ছবি

ওহ শিট!!! রস আলোর একটা গল্প থেইকা এতো কিছু বাইরাইলো!!!
আমার একটা প্রশ্ন - আপনের এই পোস্ট থেইকা আমরা কি শিখলাম, কি বুঝলাম?
আমি এতটুকু বুঝ্তে পারছি যে, রস আলোতে গল্পের লেখক কইছে একটা, আর সাবলিমিনালি বুঝানোর চেষ্টা করছে আরেকটা, কিন্তু তাতে কি? আপনে কি কইতে চান, যে গল্পের লেখক কারো কাছ থেইকা পয়সা গিল্লা তারপর এই গল্পের ভিতরে এইসব জিনিষ ভইরা দিছে?
-মেফিস্টো

হাসিব এর ছবি

ভালো বিশ্লেষণ। আরো লিখুন। সচল থাকুন। লেখকের নামটা জানতে পারলে ভালো হতো।

সজল এর ছবি

চলুক

---
মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড়

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।