অচলায়তনের কথাঃ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়-এর নাট্যকলা ও সঙ্গীত বিভাগ; একটি রিপোর্ট আর সবার ভাবনা

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: শনি, ০৬/০৮/২০১১ - ৮:১৫পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যকলা ও সঙ্গীত বিভাগ
উপাচার্যের স্বেচ্ছাচারিতার শিকার শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের নিরঙ্কুশ ক্ষমতা ও বেনজির স্বেচ্ছাচারিতার শিকার হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়টির নাট্যকলা ও সঙ্গীত বিভাগ। গত ২৩শে জুলাই বিভাগের এ্যাডহক নিয়োগপ্রাপ্ত ৩ শিক্ষকের মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ার পর চাকরীর সময়সীমা নবায়ন না করা নিয়ে নাট্যকলা ও সঙ্গীত বিভাগে এই অচলাবস্থা তৈরি হয়েছে।

বিভাগের সভাপতি হিসাবে মলয় ভৌমিকের স্বেচ্ছাচারিতার বিরুদ্ধে আন্দোলনরত শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের ছবি। আর এখন এই আন্দোলনকারী শিক্ষকদের তিনজন শিকার হলেন উপাচার্যের নিরঙ্কুশ ক্ষমতা ও স্বেচ্ছাচারিতার।
ওই ৩ জন শিক্ষকের হাতে থাকা বিভিন্ন বর্ষের ২৭টি কোর্সের ভবিষ্যত নিয়ে বিভাগটির অন্যান্য শিক্ষকদের সাথে শিক্ষার্থীরাও শঙ্কিত বলে জানিয়েছেন। নাট্যকলা ও সঙ্গীত বিভাগের এ্যাডহক নিয়োগপ্রাপ্ত ৩ শিক্ষক মনোজ কুমার প্রামাণিক, আব্দুস সালাম জীবন এবং সলক হোসেনের চাকরির মেয়াদ না বাড়ানোর কারণ হিসাবে উপাচার্য বলেছেন, নৈতিক স্খলন এবং নৈরাজ্য সৃষ্টির দায়ে এই শিক্ষকদের চাকরির মেয়াদ আর বাড়ানো হবে না।
নাট্যকলা ও সঙ্গীত বিভাগের সহকারী অধ্যাপক কাজী শুসমিন আফসানা রাজনৈতিক প্রতিবেদককে বলেন, “কারণ তার মতে তারা ভিসির বিরুদ্ধে, সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করে অনৈতিক কাজ করেছেন।” শুসমিন আফসানা আরও বলেন, যে জরুরি অবস্থার ভিত্তিতে প্ল্যানিং কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী ভিসি স্যার এই ৩ জন এ্যাডহক শিক্ষকের নিয়োগ দিয়েছিলেন সে জরুরি অবস্থা এখনও আছে। কারণ এখনও বিজ্ঞপ্তির ভিত্তিতে কোন শিক্ষক নিয়োগ দেয়া হয়নি। এই শিক্ষকদের অভাবে নাট্যকলা ও সঙ্গীত বিভাগকে ভীষণ সমস্যার মুখোমুখি হতে হচ্ছে। আমাদের মনে হচ্ছে যে আমারা তাত্ত্বিক দিকগুলো শেষ করে নিতে পারব, কিন্তু তারা ছিলেন কোর্স শিক্ষক; তাদের ছাড়া ব্যবহারিক দিকগুলো নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভবই না।
বিভাগটির চতুর্থ বর্ষের এক শিক্ষার্থী জানালেন, এমনিতেই শিক্ষক সঙ্কটে সেশন জট বিদ্যমান । এর পরও শিক্ষক নিয়োগ দিয়ে আবার তাদের টেনে নেয়া এটা কোন ধরনের টালবাহানা? এক মাসে একজন সাধারণ শিক্ষার্থীর চলতে প্রায় ৪ হাজার টাকা লাগে । একবছর সেশন জট থাকলে তাহলে কত টাকা ক্ষতি হয়? মনে রাখা দরকার যে প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিরা বিলাসিতার মাঝে জীবন যাপন করতে পারে কিন্তু আমরা কিন্তু অনেক কষ্টের টাকায় পড়ালেখা করি ।
নাট্যকলা ও সঙ্গীত বিভাগে মনোজ কুমার প্রামাণিক ১ম বর্ষের ১ টা কোর্স, দ্বিতীয় বর্ষের ১ টা কোর্স, তৃতীয় বর্ষের ৪ টা কোর্স, চতুর্থ বর্ষের ৩ টা এবং মাষ্টার্সের ২ টা কোর্সের সাথে সাথে চতুর্থ বর্ষের বার্ষিক প্রযোজনার জন্য অতিরিক্ত আরো ৬ ঘন্টা সহ সপ্তাহে ৫৯ ঘন্টা ক্লাস নিয়ে আসছিলেন। আব্দুস সালাম জীবন নিচ্ছিলেন ১ম বর্ষের ২ টা কোর্স, দ্বিতীয় বর্ষের ৩ টা কোর্স, তৃতীয় বর্ষের ১ টা কোর্স, চতুর্থ বর্ষের ১ টা এবং মাষ্টার্সের ৩ টা কোর্সের সাথে সাথে দ্বিতীয় বর্ষের বার্ষিক প্রযোজনা এবং এম.এ বর্ষের অভিনয় গ্রুপের বার্ষিক প্রযোজনার জন্য অতিরিক্ত আরো ১৮ ঘন্টা সহ সপ্তাহে ৫৭ ঘন্টা ক্লাস । ওদিকে সঙ্গীতের সলোক হোসেন ১ম বর্ষের ২ টা কোর্স, দ্বিতীয় বর্ষের ২ টা কোর্স, তৃতীয় বর্ষের ১ টা কোর্স, চতুর্থ বর্ষের ১ টা এবং প্রতিটি কোর্সে ৩ ঘন্টা করে সপ্তাহে ১৮ ঘন্টা ক্লাস নিয়ে আসছিলেন। এর মাঝে মনোজ কুমার প্রামাণিকের ৭টা কোর্সের এবং আব্দুস সালাম জীবনের ৩টা কোর্সের পরীক্ষা চলছে। শিক্ষার্থীরা জানান, অন্য ডিপার্টমেন্টে যেমন ক্লাস সাসপেন্ড থাকে পরীক্ষার বেশ কিছুদিন আগে থেকে আমাদের ব্যাপারটা তো তেমন না। পরীক্ষার আগের রাতেও আমাদের রিহার্সেল করতে হয়। আমরা ভীষণ বিপন্ন বোধ করছি। অথচ গোটা বিভাগের এই বিপন্ন অবস্থা নিয়ে কোন মাথাব্যথা নেই বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ৭৩ এর আইন অনুযায়ি প্রণীত বিধি’র ভলিউম ২-এ ৫৫ নম্বর সেকশনের K ( some other conditions of the service of university employees) ধারার ৩ নম্বর উপধারায় বলা আছে, “ A teacher or officer of the university may be dismissed only on grounds of moral turpitude or inefficiency but no such teacher or officer shall be dismissed unless an inquiry into the charges of moral turpitude or inefficiency is held by an inquiry committee on which the teacher or the officer may be represented by a person nominated by him.” সে অনুযায়ি এই তিন শিক্ষককে নৈতিকতার অবক্ষয়ের দায়ে দোষী করা হয়েছে ।
এই ‘নৈতিক অবক্ষয়ে’র পেছনের কাহিনী এমন;
২০০৯ সালের ৮ নভেম্বর নাট্যকলা ও সঙ্গীত বিভাগে সভাপতি হিসেবে ব্যাবস্থাপনা বিভাগের শিক্ষক মলয় ভৌমিক প্রেষণে উপাচার্য কর্তৃক নিয়োগপ্রাপ্ত হন। বিভাগের সঙ্কট নিরসনে তাকে পাঠানো হয়। কিন্তু মলয় ভৌমিক বিভিন্ন ক্ষেত্রে স্বেচ্ছাচারি ভুমিকা নিতেন বলে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের অভিযোগ করেন। একপর্যায়ে তাঁর অপসারণের দাবিতে গত ৩১ মার্চ, ২০১১ দুপুরে বিভাগের ১৩ জন শিক্ষক মিলে সভাপতির কক্ষে তালা ঝুলিয়ে দেন। এই এ্যাডহক নিয়োগপ্রাপ্ত তিন শিক্ষক মৌন সম্মতি দিয়েছিলেন তাতে। পরবর্তীতে বিভাগের ১৮ জনের মাঝে ১৬ জন শিক্ষক এবং তৎকালীন রাজশাহীতে উপস্থিত ওই বিভাগের একজন ছাড়া সকল শিক্ষার্থীর স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলনের তীব্রতায় ৬ ই এপ্রিল মলয় ভৌমিক কিছু শর্তসাপেক্ষে পদত্যাগ করেন।
জনাব ভৌমিকের দেয়া চারটি শর্ত ছিলঃ ‘বিধি বহির্ভূতভাবে যেসব শিক্ষক আইন হাতে তুলে নিয়ে বিভাগে অচলাবস্থার সৃষ্টি করেছেন তাদের বিরুদ্ধে ও এর নেপথ্যে কোনো ইন্ধনদাতা থাকলে তাদের বিরুদ্ধে অবিলম্বে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া, ইতিপূর্বে বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট গঠিত তদন্ত কমিটি ওই বিভাগের শিক্ষক অসিত রায়সহ যাদের বিরুদ্ধে শাস্তির সুপারিশ করেছিল তা অবিলম্বে বাস্তবায়ন, তার বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগসহ নাট্যকলা ও সঙ্গীত বিভাগ প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকে এ পর্যন্ত ওই বিভাগে যেসব অনিয়ম ও দুর্নীতি হয়েছে তার তদন্ত করে দোষীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া এবং ওই বিভাগের সব দালিলিক নথিপত্রের সংরক্ষণ নিশ্চিত করা।’
এর পরে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন একটা তদন্ত কমিটি গঠন করে। সেই তদন্ত কমিটির রিপোর্ট পেশ করার শেষ দিন ছিল গত ৩১ জুলাই, ২০১১। কিন্তু তদন্ত কমিটির রিপোর্ট আলোর মুখ দেখবার আগেই প্রশাসন কর্তৃক এই এ্যাডহক নিয়োগপ্রাপ্ত ৩ শিক্ষকের বিরুদ্ধে এক রকম পরোক্ষ শাস্তির ব্যাবস্থা করা হল।
আন্দোলনকারী সব শিক্ষক- শিক্ষার্থীদের মাঝে শুধু এই তিন জন শিক্ষককে আলাদা করে নৈতিক স্খলনের দায়ে অভিযুক্ত করা হয়েছে। এ ব্যাপারে বিভাগের শিক্ষক এবং আন্দোলনকারীদের অন্যতম একজন আতাউর রহমান বলেন, “সেই আন্দোলনে বিভাগের ১৮ জন শিক্ষকের মাঝে ১৬ জন শিক্ষক এবং প্রায় সকল শিক্ষার্থীদের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহন ছিল। এটা কোন অন্যায় আন্দোলন ছিল না। বিশ্ববিদ্যালয় হল মুক্ত চিন্তার জায়গা। এইখানে প্রত্যেকের তাদের নিজস্ব মত প্রকাশের স্বাধীনতা আছে। সুতরাং এমন কোন কাজ তখন করা হয় নাই যা তাদের চাকরির ক্ষেত্রে প্রভাব ফেলার মত।” এ্যাডহক নিয়োগপ্রাপ্ত ৩ শিক্ষকদের একজন মনজ কুমার প্রামানিক বলেন, “বিশ্ববিদ্যালয় হল মুক্ত চিন্তার জায়গা। এখানে যদি একজন শিক্ষককে তার মত প্রকাশের জন্য শাস্তি পেতে হয়, যদি এমন হয় যে তার চাকরি চলে যাচ্ছে, তাহলে আসলে বিশ্ববিদ্যালয় কোন দিকে যাচ্ছে তা নিয়ে ভাবার বিষয় আছে বলে আমি মনে করি”। শিক্ষকরা জানান, আমাদের প্রশ্ন হল যে বিভাগের সভাপতি রুমে আমরা তালা লাগাই নাই কিন্তু আমরা তাহলে কেন এই দোষে দুষ্ট হব আর যদি আন্দোলন করা দোষ হয়, তাহলে আমাদের মত অনান্য শিক্ষক শিক্ষার্থীরাও দুষ্ট। তাহলে আমরা কেন এর শাস্তি একা একা ভোগ করব?
এডহক নিয়োগ নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে সমঝোতার রাজনীতি আছে। হলুদ-নীল মানে বিএনপি-জামায়াত এবং আওয়ামী-বাম শিক্ষকদের কেন্দ্র করে জারি থাকা উপাচার্যের স্বেচ্ছাচারি ক্ষমতার রাজনীতিতে ‘পরস্পরের দলীয়করণে পরস্পর বৈধতা দেয়া’র মধ্য দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় চলে। এ্যাডহক নিয়োগ অস্থায়ী নিয়োগ হলেও নিয়োগকৃত শিক্ষকের চাকরীর মেয়াদ নবায়ন করে করে একসময় স্থায়ী করা হয়। তাই চলতি ধারণাতে এ্যাডহক নিয়োগপ্রাপ্ত হওয়া মানেই বোঝায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হয়ে যাওয়া।
প্রতি ছয়মাস পরপর এই মেয়াদ নবায়ন করা হয়। এভাবে একসময় তিনি স্থায়ী হন। তবে এ্যাডহক নিয়োগপ্রাপ্ত কোন শিক্ষকের চাকরী নবায়ন করা হয়নি; এমন নজির বিশ্ববিদ্যালয়ে নেই বললেই চলে। কিন্তু ৭৩ এর অধ্যাদেশ ভিসিকে যে সর্বসময় ক্ষমতা দিয়েছে তার বলেই এভাবে কোন কিছুর তোয়াক্কা না এই শিক্ষকদের এবং একই সাথে বিভাগের শিক্ষার্থীদের জীবন অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দেয়া হয়েছে।
ইতিহাস বিভাগের শিক্ষক প্রফেসর ম. ফারুক-উজ্জামান বলেন; এমন নজির আমার চাকরীর ২৮ বছরে আমি দেখিনি। এ্যাডহক নিয়োগপ্রাপ্ত কতজন শিক্ষক এ পর্যন্ত চাকরী খুইয়েছেন এই তথ্য জানতে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ভবনের তথ্য সেলে গিয়ে কোন তথ্য পাওয়া যায়নি। তথ্য সেল থেকে রেজিস্ট্রার মারফত একটি আবেদন করবার পরামর্শ দেন। বেশ ক’জন সিনিয়র শিক্ষকের সাথে কথা বললে তারাও স্মৃতি হাতড়ে এমন ঘটনার নজির মনে করতে ব্যর্থ হন।
গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক সেলিম রেজা নিউটন বলেন, নাট্যকলার আন্দোলনে ১৮ জন শিক্ষকের মধ্যে ১৬ জন-ই ছিলেন । কিন্তু তাদের মধ্যে কেবল এই তিনজন কে শিকার বানানো হচ্ছে এটা একেবারেই অনৈতিক কাজ। প্রশাসন যে আইনের কথা বলছেন সেই ৭৩ এর আইনে যে স্বাধীনতা আর বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্ত্বশাসনের কথা বলা আছে তা ভিসির স্বায়ত্ত্বশাসন না। এই আইনের স্পিরিট এটা না। যখন নাট্যকলা বিভাগের শিক্ষকরা তাদের সভাপতিকে অপসারনের জন্য ভিসিকে চিঠি দিয়েছিলেন তখন আইন অনুযায়ী ভিসির উচিত ছিল তাদের দাবি মেনে নেয়া । কিন্তু তিনি প্রথম থেকেই পক্ষপাতিত্বমূলক মনোভাব প্রদর্শন করেন।
শিক্ষকরা অবাক হচ্ছেন যে, এমন কাণ্ড তো আইয়ুব খানের আমলেও হয়নি , এরশাদের আমলেও হয়নি, ১/১১ এর সময়েও এমন চেষ্টা করা হয়েছিল , শিক্ষকদের চাকরি খেতে চেয়েছিল, তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ এনেছিল যে তারা সরকারে বিরুদ্ধে মৌন মিছিল করেছিল, কিন্তু তারা তা পারেনি। এমন ঘটনা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা মেনে নিবেন না । তারা হয়তো এখন জানেন না বিষয়টা। কিন্তু আস্তে আস্তে সবাই এর বিরুদ্ধে দ্বারা হবেন এবং প্রশাসন তাদের এ কাজটা করতে পারবেন না শেষ পর্যন্ত।
শিক্ষক সমিতির সভাপতি এই প্রতিবেদককে জানালেন, এই ৩ শিক্ষকের চাকরি নবায়ন করবার ব্যাপারে কথা বলবার সুযোগ পাননি তারা। তাই নবায়ন করবার সুপারিশ করে উপাচার্য বরাবর তারা চিঠি প্রেরণ করবেন বলে জানান। তিনি বলেন, শিক্ষক সমিতি মনে করে, তাদের সুপারিশ উপাচার্য আমলে নেবেন।
যাকে কেন্দ্র করে ঘটনা এতদূর গড়াচ্ছে সেই মলয় ভৌমিককে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করলে তিনি এ বাপারে কোন প্রকার মন্তব্য করতে অস্বীকার করেন। তিনি বলেন, ‘এ বিষয় এখন তদন্তাধীন। তদন্তাধীন কোন ব্যাপারে তদন্ত রিপোর্ট প্রকাশিত না হওয়া পর্যন্ত আমি কোন প্রকার মন্তব্য করব না। আমার যা বলার তা রিপোর্ট প্রকাশিত হবার পর বলব। আমি যেহেতু তদন্তে এক পক্ষের লোক, তাই কোন ভাবেই আমি আগে থেকে মন্তব্য করে তদন্তকে প্রভাবিত করতে চাই না। যারা আইন ভেঙ্গে বিভাগের সভাপতির রুম-এ তালা লাগিয়ে দেন, তাদের মত আমি আইন বিরুদ্ধ নই!’ উল্লেখ্য এই মলয় ভৌমিক-ই সেনা কর্পোরেট কর্তত্বের ১/১১ সরকারের বিরুদ্ধে জরুরি আইন ভেঙ্গে মিছিল করেছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাধীনতার প্রশ্নে এবং জেল খেটেছিলেন।

রিপোর্টটি এই লিঙ্কে- আছেhttp://rajnoitik.com/2011/08/04/রাবিতে স্বেচ্ছাচারিতা/

ভাবনা-১

শেষের লাইনটি পড়লেই বোঝা যায়, 'বাতাস' একেক সময় একেক দিকে বয়!

পয়েন্ট আকারে কিছু কথা ও প্রশ্নঃ
১। ৩১ জুলাইয়ের কথা বলা হলেও তদন্ত কমিটী কেনো এখনো রিপোর্ট পেশ করেননি? তদন্ত রিপোর্টের আগেই যদি ভিসি নৈতিকতা স্খলনের অভিযোগে তাঁদের চাকরী নবায়ন না করেন, তাহলে তদন্ত'র দরকার কি? প্রহসন ছাড়া একে আর কি নামে ডাকা যায়?
২। আমরা কি ধরে নেব যে- তদন্তের রিপোর্ট-এ ঐ ৩ শিক্ষক নির্দোষ প্রমাণিত হতে যাচ্ছেন? তা নাহলে, ভিসি কেনো তদন্ত রিপোর্ট আসার আগেই তদন্ত কমিটিকে বাদ দিয়ে নিজে সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন? তিনি কি আগেই 'অহি' প্রাপ্ত হয়েছেন যে- " হে উপাচার্য, তুমি কি জানোনা যে, যা করার তা এখুনি করিতে হইবে? কেননা, রিপোর্ট আসার পর কিছুই করা যাইবেনা; কারন, 'ওঁরা' যে নির্দোষ!"
৩। জনাব মলয় ভৌমিক রিপোর্টারকে ফোনে জানিয়েছেন যে- "আমার যা বলার তা রিপোর্ট প্রকাশিত হবার পর বলব। আমি যেহেতু তদন্তে এক পক্ষের লোক, তাই কোন ভাবেই আমি আগে থেকে মন্তব্য করে তদন্তকে প্রভাবিত করতে চাই না। যারা আইন ভেঙ্গে বিভাগের সভাপতির রুম-এ তালা লাগিয়ে দেন, তাদের মত আমি আইন বিরুদ্ধ নই!"
তো, উনি রিপোর্ট প্রকাশিত হবার আগেই কীভাবে জানতে পারলেন যে- ওই ৩ শিক্ষক সহ বিভাগীয় শিক্ষকগণ আইন বিরুদ্ধ কাজ করেছিলেন?

আইনতো সময় ভেদে পরিবর্তনীয়! কেননা, ১/১১ -এর সময় যা ছিলো আইন পরিপন্থী, তা এখনকার সময় বীরত্ত্বগাঁথা।
৪। প্রশাসন, ভিসি, জনাব মলয় ভৌমিক 'প্রমূখ' যদি 'নাট্যকলা ও সঙ্গীত বিভাগ' -এর উন্নতিই কামনা করে থাকেন, তাহলে বিভাগের '২৭টি কোর্সের' ভবিষ্যত নিয়ে তাঁরা কেনো এখন ভাবছেননা? কেনো তাঁরা 'মনোজ কুমার প্রামাণিক', 'আব্দুস সালাম জীবন' এবং 'সলোক হোসেন' -এর যথাক্রমে সাপ্তাহিক ৫৯ ঘন্টা, ৫৭ ঘন্টা এবং ১৮ ঘন্টা ক্লাস, যা কিনা এখন 'বন্ধ' তা নিয়ে চিন্তিত নন? মনোজ কুমার প্রামাণিকের এবং আব্দুস সালাম জীবনের যথাক্রমে যে ৭টা ও ৩টা, মোট ১১টি কোর্সের পরীক্ষা চলছে, তার ভবিষ্যত কেনো এখন তাঁরা ভাবছেননা?
তাহলেতো এটাই প্রমাণিত হয় যে- তাঁরা আসলে 'নাট্যকলা ও সঙ্গীত বিভাগ' -এর কোনো উন্নতিই কামনা করেননা; বরং, ক্ষতিই কামনা করেন, নাকি? তাঁরা কি চান যে- 'নাট্যকলা ও সঙ্গীত বিভাগ' -এর সমার্থক শব্দ হোক 'সেশন জ্যাম' এবং 'ব্রয়লার মুরগি তৈরীর কারখানা'?
৫। যতদূর জানি, ৩টি কারনে এড্‌হক ভিত্তিতে নিয়োগ প্রাপ্তদের চাকুরী নাবায়ন করা যায়না- 'বিশ্ববিদ্যালয় দ্রোহীতা', 'পরীক্ষা ও রেজাল্ট জালিয়াতি' এবং 'নারী কেলেংকারী'। কিন্তু, ৩টির কোনোটিই তাঁদের দ্বারা সংঘটিত হয়েছে, এমন প্রমাণ পাওয়া যায়নি। বরং, ২য় টি (পরীক্ষা ও রেজাল্ট জালিয়াতি) জনাব মলয় ভৌমিকের বিরুদ্ধে বিভাগীয় শিক্ষকগণ এবং শিক্ষার্থীরা এনেছিলেন! তাহলে, জনাব মলয় ভৌমিকের ক্ষেত্রে ভিসি বা প্রশাসন কি বলবেন?
৬। মাননীয় ভিসি কি ইতিহাস গড়তে চাচ্ছেন? ইতিহাস বিভাগের শিক্ষক প্রফেসর ম. ফারুক-উজ্জামান এমন নজির (এড্‌হক নবায়ন না করা) তাঁর চাকরীর ২৮ বছরে দেখেননি এবং বেশ ক’জন সিনিয়র শিক্ষকও স্মৃতি হাতড়ে এমন ঘটনার নজির মনে করতে ব্যর্থ হয়েছেন! আসলেই রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ইতিহাস গড়তে যাচ্ছে! অবশ্য, বর্তমান ভিসি এর আগেও ইতিহাস গড়েছিলেন সেই ২০০৭ সালে; যখন কিনা মৌন মিছিল ও কোনো প্রকার আন্দলোন না করেই তিনি তত্‌কালীন প্রশাসনের কথামতো ছাত্রদের আন্দোলন থামাতে ব্যর্থ হয়ে জেলে গিয়েছিলেন এবং এর ফলশ্রুতিতে পরবর্তীতে এই পদ তিনি লাভ করেছিলেন! উল্লেখীত ইতিহাস অবশ্য আমার নিজের তৈরী করা নয়! বিশ্ববিদ্যালয়ের এক নামজাদা ও ট্যালেন্টেড শিক্ষক এই তথ্যগুলো জানিয়েছিলেন বর্তমান ভিসি'র বাসভবনের সামনে এপ্রিল মাসে 'নাট্যকলা ও সঙ্গীত বিভাগ' -এর আন্দলোনরত শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের প্রতি এক বক্তব্যে।
৭। "শিক্ষকরা অবাক হচ্ছেন যে, এমন কাণ্ড তো আইয়ুব খানের আমলেও হয়নি , এরশাদের আমলেও হয়নি, ১/১১ এর সময়েও এমন চেষ্টা করা হয়েছিল , শিক্ষকদের চাকরি খেতে চেয়েছিল, তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ এনেছিল যে তারা সরকারে বিরুদ্ধে মৌন মিছিল করেছিল, কিন্তু তারা তা পারেনি।"- এই অবাকটা আমি নিজেও হচ্ছি!

ভাবনা-২

বিশ্ববিদ্যালয় যখন পরিণত হয় ক্ষমতাচর্চা আর ক্ষমতা অপব্যাবহারের নাট্যমঞ্চে, তখন এর চেয়ে বেশি হতাশ ও ক্ষুব্ধ হওয়ার মত আর কিছু থাকে কি ? । দুর্দান্ত তিনজন শিক্ষকের চাকরি কেড়ে নেয়ার এই অন্যায় পদক্ষেপ কিন্তু খুব সহজেই বুঝিয়ে দেয় যে , পাওয়ার প্রাকটিসের যে পচন গোটা সমাজ বাবস্থাকে ক্রমশ নষ্ট করে ফেলছে বিশ্ববিদ্যালয়ও তার সীমানার বাইরে নয় । ফলে শঙ্কিত হতে হয় ।মুক্ত চিন্তার আরাধনার এই ক্ষেত্র থাকুক অসুস্থ বিকারগ্রস্থ প্রশাসকের থাবার সীমানার বাইরে । ভুলে যাওয়া উচিত নয় যে ন্যায়ের ন্যায্যতা সবারই আছে । যদি মুহূর্তে মুহূর্তে আমাদের নিজেদের প্রাপ্যটুকু বুঝে নিতে রাস্তায় যেতে হয়, যদি বার বার চিৎকার করে সহজ কথাটি বুঝাতে হয় ; তবে মনে রাখা দরকার দেবালয়েও কিন্তু আগুন জ্বলে …


মন্তব্য

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।