বর্ধমান মহাবীর ও জৈনধর্ম

প্রৌঢ় ভাবনা এর ছবি
লিখেছেন প্রৌঢ় ভাবনা [অতিথি] (তারিখ: শনি, ২৬/১১/২০১১ - ১১:১৭পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

[b]ধর্মপ্রচার নয়, বিভিন্ন ধর্মমত সম্পর্কে যৎসামান্য জানার প্রচেষ্টা মাত্র

ঐতিহাসিক কালে জৈন ধর্মকে প্রাচীনতম ধর্মমতগুলির অন্যতম বলা যেতে পারে। জৈনমতে চব্বিশ জন তীর্থঙ্কর পর্যায়ক্রমে এই ধর্মমত প্রচার করেছিলেন।

কোন কোন ঐতিহাসিকের মতে পাঁচ হাজার বছর পূর্বেও এই ধর্মমত প্রচলিত ছিল। জৈন ধর্মমতের প্রথম তীর্থঙ্কর 'ঋষভ' কে পাওয়া যায় হরপ্পা সভ্যতারও পূর্বে। হরপ্পা সভ্যতায় জৈন ধর্মের নিদর্শন পাওয়া যায়।

জৈন বিশ্বাস অনুসারে, ঋষভ বর্তমান যুগের প্রথম তীর্থঙ্কর। এই কারণে তাঁর অপর নাম আদিনাথ। তিনি আত্মার সকল কর্ম নাশ করে এক মুক্ত আত্মা সিদ্ধে পরিণত হয়েছিলেন। জৈন বিশ্বাস অনুযায়ী, ঋষভ সভ্যতার সূচনার পূর্বে বর্তমান ছিলেন। তিনিই মানবজাতিকে কৃষিকাজ, পশুপালন, রান্না ও অন্যান্য কাজ শেখান।

জৈনমতে ঋষভের জ্যৈষ্ঠ পুত্র ভরত একজন চক্রবর্তী (বিশ্ববিজয়ী সার্বভৌম) সম্রাট হয়েছিলেন। পরবর্তী জীবনে তিনি রাজকার্য পরিত্যাগ করে সন্ন্যাস গ্রহণ করেন এবং মোক্ষলাভ করেন। এরপর সিদ্ধে পরিণত হলে তিনি সর্বজনপূজ্য হন। জৈন বিশ্বাস অনুযায়ী, তাঁর নাম অনুসারেই ভারতবর্ষ নামটির উৎপত্তি।

হিন্দু ধর্মগ্রন্থ ভাগবত পুরাণে ঋষভকে বিষ্ণুর এক অবতার রূপে বর্ণনা করা হয়েছে।

ভাগবতে বর্ণিত উপাখ্যান অনুসারে, জগতকে মুক্তির পথ দর্শানোর উদ্দেশ্যেই ঋষভের জন্ম হয়। তিনি জাগতিক কামনাবাসনায় আত্মনিয়োগের পরিবর্তে মানুষকে ঈশ্বরের পথ অবলম্বনের উপদেশ দিতেন। তিনিই ছিলেন শ্রমণ সংস্কৃতিরপ্রবর্তক ও প্রচারক।

চতুর্বিংশ জৈন তীর্থঙ্কর
ঋষভ বা আদিনাথ • অজিতনাথ • সম্ভবনাথ • অভিনন্দননাথ • সুমতিনাথ • পদ্মপ্রভ • সুপার্শ্বনাথ • চন্দ্রপ্রভ • পুষ্পদন্ত • শীতলনাথ • শ্রেয়াংশনাথ • বসুপূজ্য • বিমলনাথ • অনন্তনাথ • ধর্মনাথ • শান্তিনাথ • কুণ্ঠুনাথ • অরনাথ • মল্লিনাথ • মুনিসুব্রত • নমিনাথ • নেমিনাথ • পার্শ্বনাথ • মহাবীর।

এক থেকে বাইশতম তীর্থংকরকে নিয়ে এত বেশি অতিরঞ্জন ও অলৌকিক ঘটনার ছড়াছড়ি যে, ঐতিহাসিকদের ধারণা এ'গুলো কল্পকাহিনী। এতে এমনটা হতে মনে হতেই পারে যে, এইসব তীর্থংকরদের অস্তিত্ব ছিল। কিন্তু ভক্তির প্রাবল্যে এদের চরিত্রগুলোকে ভক্তরা বেশি রকম বড় করতে গিয়ে অবাস্তব করে তুলেছেন।

তীর্থংকর হিসেবে পার্শ্বনাথের অস্তিত্ব বিষয়ে ঐতিহাসিকদের কোন সন্দেহ নেই। পার্শ্বনাথ ছিলেন মহাবীরের অব্যবহিত পূর্ব ত্রয়োবিংশতিতম জৈন তীর্থঙ্কর। জৈন বিবরণ অনুযায়ী পার্শ্বনাথ আনুমানিক ৮১৭ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে জন্ম গ্রহন করেন। তাঁর পিতা অশ্বসেন সম্ভবত একজন গোষ্ঠীপতি ছিলেন। তাঁর মাতার নাম ছিল বামা, পত্নী প্রভাবতী অযোধ্যা অঞ্চলের কোন এক গোষ্ঠীপতির কন্যা ছিলেন। তিরিশ বছর বয়েসে পার্শ্বনাথ সংসার ত্যাগ করে সন্ন্যাসী হন।

জৈন ধর্মের সর্বশেষ তীর্থঙ্কর অর্থাৎ চব্বিশতম তীর্থঙ্কর বর্ধমান মহাবীরের জন্ম বৈশালী নগরীর কুন্দলপুরের (বর্তমান বিহার মতান্তরে পাটনা) একটি ক্ষত্রিয় পরিবারে। তাঁর পিতা: রাজা সিদ্ধার্থ, মাতা: রানী ত্রিশলা এবং পত্নী: যশোদা। এঁরা মহাবীরের পূর্ববর্তী তীর্থঙ্কর, পার্শ্বনাথের অনুসারী ছিলেন। মহাবীরের সময়কাল ৫৯৯ খ্রীষ্ট পূর্বাব্দ থেকে ৫২৭ খ্রীষ্ট পূর্বাব্দ মতান্তরে ৫৪৯ খ্রীষ্ট পূর্বাব্দ থেকে ৪৭৭ খ্রীষ্ট পূর্বাব্দ।

জৈন শ্রুতি মতে বর্ধমান মহাবীর হিসাবে জন্মলাভের পূর্বে ছাব্বিশ জন্মান্তর পার হয়ে সাতাশতম বারে তিনি বর্ধমান মহাবীর হিসাবে জন্মগ্রহন করেন। তিরিশ বৎসর বয়সে তিনি সংসার ত্যাগ করে সন্যাস গ্রহন করেন। এসময়ে তিনি সর্বস্ব এমনকি তাঁর পরিধেয় বস্ত্রও ত্যাগ করেছিলেন। সন্যাস গ্রহনের পরে বারো বছরের তপস্যায় তিনি 'কেবল'জ্ঞান লাভ করেন। দিগম্বর অবস্থাতেই তিনি বিভিন্ন লোকালয়ে তাঁর মত প্রচার করতেন।

ধারণামতে মহাবীরের পরিবার পার্শ্বনাথের অনুসারী ছিলেন। সেই মতে মহাবীরও পার্শ্বনাথের নীতি-দর্শন অনুসরন করেই ধর্মমত প্রচার শুরু করেছিলেন। পার্শ্বনাথের মূল চারটি বিধান, ১)অহিংসা, ২) অনৃত ৩) অস্তেয় এবং ৪) অপরিগ্রহ এগুলিকে চতুর্যাম ব্রত বলা হয়। এগুলির সঙ্গে মহাবীর আরও একটি ব্রত যোগ করেছিলেন যা হচ্ছে ব্রহ্মচর্য। এই বিধানের নতুন নামকরণ করা হয় পঞ্চ মহাব্রত।

তাঁর মৃত্যুর বেশ কিছুকাল পর জৈনদের মধ্যে বিভাজন হয় এবং দুটি মতের সৃষ্টি হয়। (১) 'দিগম্বর' যাঁরা সম্পূর্ণ নিরাভরন থাকায় বিশ্বাসী, (২) 'স্বেতাম্বর' তাঁরা সল্প স্বেতবস্ত্র পরিধানে বিশ্বাসী।

জৈন ধর্মে বিভাজন :
৹ দিগম্বর :
দিগম্বরপন্থীরা মহাবীরের সময়ের আগে লেখা কোনও জৈন-গ্রন্থকেই প্রামাণ্য বলে স্বীকার করে না। দিগম্বরপন্থীদের কিছু ধর্মীয় গ্রন্থ আছে যেগুলো চারটি শ্রেণীতে বিভক্ত। সেসব গ্রন্থ মহাবীরের সময়ে ও পরবর্তীকালে লেখা। দিগম্বররা মানেন মহাবীরের পঞ্চব্রত।

দিগম্বর সম্প্রদায়ের বিশ্বাসমতে নারীরা কখনও মোক্ষ লাভে সমর্থ নয়। তাঁদের মুক্তি বা মোক্ষ লাভের জন্য যে কোন জনমে পুরুষ হিসাবে জন্মগ্রহণ করেই তা অর্জন করতে হবে। কারন হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে যে নারীরা যথার্থরূপে একজন যোগীর জীবন যাপন করতে অসমর্থ কেননা সামাজীক কারনেই তাঁদেরকে বস্ত্র পরিধান করতে হয়, একজন নারীর নগ্ন অথবা বস্ত্রহীন থাকাটা সামাজীক কারনেই একটি অবাস্তব ধারনা। তাছাড়া বলা হয়ে থাকে, নারীরা স্বভাবজাত কারনেই অনিষ্টকর।

দিগম্বর সম্প্রদায়ের বিশ্বাসমতে একজন ভিক্ষু সর্বদাই নগ্ন অবস্থায় থাকেন। একজন প্রকৃত ভিক্ষু কখনই পার্থিব কোন বিষয়-সম্পত্তির অধিকারী হবেন না। তিঁনি জাগতিক কোন প্রকার আবেগ-অনুভূতি, যেমন লজ্জা ইত্যাদি, প্রদর্শন করবেন না। এমন কি একটি ভিক্ষাপাত্রও তাঁর অধিকারে রাখতে পারবেন না। তাঁরা, তাঁদের গণ্ডূষ ভরেই ভিক্ষাদ্রব্য, খাদ্য ইত্যাদি গ্রহণ করে থাকেন।

৹ স্বেতাম্বর :
পার্শ্বনাথের চতুর্যাম শ্বেতাম্বররা শ্রদ্ধার সঙ্গে স্বীকার করেন। শ্বেতাম্বররা মনে করেন জৈন ধর্মের বারটি প্রাচীন 'অঙ্গ' গ্রন্থ আছে। এই বারটি অঙ্গ নামের গ্রন্থ ছাড়াও 'উপাঙ্গ' নামে আরো বারটি ধর্মগ্রন্থ আছে। অঙ্গ ও উপাঙ্গ ছাড়াও আরও কিছু গ্রন্থকে শ্বেতাম্বররা জৈন ধর্মের অন্তর্গত বলে মনে করেন।
সেতাম্বর জৈনেরা সামান্য স্বেতবস্ত্র পরিধান করেন। তাঁরা একটি ভিক্ষাপাত্রও সংরক্ষণ করেন। তাঁদের হাঁটার পথ থেকে পোকামাকড় সরাবার জন্য একটি ঝাড়ুও ধারণ করেন। বইপত্র এবং লেখার সামগ্রীও তাঁরা তাঁদের অধিকারে রাখতে পারেন।

সেতাম্বর সম্প্রদায়ের ধারণামতে জৈন তীর্থঙ্কর মল্লিনাথ ছিলেন একজন নারী। দিগম্বর সম্প্রদায় এ ধারণার বিরোধী। এই সম্প্রদায়ের মতে কোন নারী মোক্ষলাভে সমর্থ নয়।

কতগুলি বিষয়ে এই দুই সম্প্রদায়ের ভিতর মতভেদ আছে। যেমন, বর্ধমান মহাবীরের জীবনের সবিস্তার বিবরণ নিয়ে। এই ধর্মমতে নারীদের আধ্যাত্মিক মর্যাদা ও প্রতিষ্ঠার অবস্থান নির্ণয় বিষয়ে। ভিক্ষুগণর বস্ত্র পরিধাণের বিষয় বিবেচনায়। ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান পালনে। কোন শাস্ত্রগ্রন্থটি জৈনদের মূল ধর্মগ্রন্থ হিসাবে বিবেচিত হবে সেটা নির্ণয়ের বিষয়ে।

তবে উভয় সম্প্রদায়ই জৈন দর্শনের মূল বিষয়ে একমত পোষণ করে এবং পাঁচটি মহান ব্রত (১) অহিংসা, (২) সুনৃত, (৩) অ-চৌর্য(অস্তেয়) (৪) ব্রহ্মচর্য এবং (৫) অপরিগ্রহ এগুলিকেও বিশ্বাসে ধারণ করেন।

জৈন ধর্মে সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্ব নেই। জৈনরা কোন সৃষ্টিকর্তা, রক্ষাকর্তা বা বিনাশকর্তায় বিশ্বাস করেনা। জৈন ধর্ম মতে মানুষের আত্মা দেহের উপর ভর করে মুক্তির পথে পরিভ্রমণরত। পুন পুন জন্মগ্রহন করে কর্মক্ষয়ের মাধ্যমে সমস্ত বন্ধন মুক্ত হয়ে নির্বাণ প্রাপ্তির মাধ্যমে মোক্ষ লাভ। এই মোক্ষ লাভ করলেই দেহ থেকে আত্মার মুক্তি, আর জন্মগ্রহন করতে হবেনা। দেহধারণ মানেই হচ্ছে, রোগ, শোক, যন্ত্রনা, মৃত্যু ইত্যাকার বিবিধ বিষয়ের সম্মুখীন হওয়া।

এই মুক্তির পরিক্রমায় পাঁচটি স্তর বিদ্যমান। একে বলে 'পঞ্চস্থিতি', (১) 'অরহত', (২) 'সিদ্ধ', (৩) 'আচার্য', (৪) 'উপাধ্যায়' ও (৫) 'সাধু'

তপস্যা ও কর্মক্ষয়ের মাধ্যমে এই স্তরগুলো অতিক্রম করে পরম আত্মিক উৎকর্ষের মাধ্যমে পুণ্যাত্যা হয়ে পরম মুক্তি।

জৈন ধর্মে 'জীব', 'অজীব', 'আস্রব', 'বন্ধ', 'সংভর', 'নির্জরা' ও 'মোক্ষ' এই সাতটি তত্ব আছে। 'পূণ্য' ও 'পাপ' এই দুটি তত্ব সংভর ও আস্রবের অন্তর্ভুক্ত।

'জীব' বা আত্মার অস্তিত্ব এই ধর্মের প্রথম তত্ব। যার চেতনা বা জ্ঞানশক্তি নেই তা 'অজীব'। ধর্ম, অধর্ম, আকাশ ও পুদগণও 'অজীব'। অনেকের মতে কালও 'অজীব'। কায়বাঙ মনকর্মকে 'আস্রব' বলে। এ হল সেই যোগ যাতে জীবে কর্ম প্রবেশ করে। আর জীবের সংগে পুদগণ বা দেহের মিশ্রন হল 'বন্ধ'। কষায়, মিথ্যাত্ব, অবিরতি, প্রমাদ ও যোগ, এই সব বন্ধহেতু। আস্রব নিরোধকে 'সংভর' বলে এবং 'নির্জরা' কর্মবন্ধনের আংশিক ক্ষয়ের নাম। 'মোক্ষ' হচ্ছে পূর্ণ কর্মক্ষয়।

মোক্ষর তিনটি মার্গ আছে, 'সম্যক দর্শন', 'সম্যক জ্ঞান' ও 'সম্যক চারিত্র'।

সত্য প্রতিতিকে 'সম্যক দর্শন' বলে।

জীব, অজীব, আস্রব, বন্ধ, সংভর, নির্জরা ও মোক্ষ, এই সপ্ত তত্বের জ্ঞানকে বলে 'সম্যক জ্ঞান'।

রাগ, দ্বেষ, হিংসা প্রভৃতি রিপু ত্যাগের নাম 'সম্যক চারিত্র'।

বর্ধমান মহাবীর যে পাঁচটি মহাব্রত উদযাপনের কথা বলেছেন সেগুলি হল,

(১) অহিংসা: জৈন ধর্মের মূল মন্ত্রই হল অহিংসা। নিজের কথায় কাজে বা মননে যাতে কোন জীব ক্ষতিগ্রস্থ না হয় সেটা বিশেষভাবে মেনে চলতে হবে। অহিংসাই পরম ধর্ম।

(২) সুনৃত (সত্য): সুনৃত শব্দটি খুবই তাৎপর্যপূর্ণ, যে কথা শুনলে অপরের আনন্দ হয়, যে কথায় লোকের মঙ্গল হয় ও তার পরিনাম সুন্দর হয়, তাকেই সুনৃত বলে।

(৩) অস্তেয় (অ-চৌর্য): মানুষ তার নিজস্ব অর্জনে তৃপ্ত থাকবে। অপরের প্রাপ্য সঠিকভাবে পরিশোধ করবে। অপরের সম্পদে লোভ করবেনা।

(৪) ব্রহ্মচর্য: সকল প্রকার বিলাসিতা, ইন্দ্রিয়সেবা, অসংযম থেকে নিজেকে নিবৃত্ত করতে হবে। গৃহীগণ আপন বৈধ সঙ্গী ব্যতিত কারও সাথে ইন্দ্রিয়সুখ উপভোগ করবেনা, সন্ত ও নানেরা চিত্ত নিবৃত্ত করে ইন্দ্রিয়, সঙ্গসুখে বিরত থাকবে।
p>(৫) অপরিগ্রহ: জীবন সতত অগ্রসরমান। বর্তমানের জনের সম্পদ আগামীর হাতে সমর্পিত হবে। তাই সম্পদে বা সম্পর্কে কারও কোন অধিকার জন্মাবেনা। বর্তমান হচ্ছে সম্পদের রক্ষক, ভবিষৎ এর হাতে সমর্পনের জন্য। সন্ত ও নানদের জন্য সব ধরনের সম্পদ ও সম্পর্ক পরিত্যাজ্য।

জৈন ধর্মমতে অহিংসাকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনা করা হয়েছে। বলা যেতে পারে অহিংসা হচ্ছে জৈন ধর্মের মূলমন্ত্র। মহাবীর বলেছেন, "অহিংসার চেয়ে মহৎ কোন গুণ নেই এবং জীবের প্রতি প্রেমের চেয়ে বড় কোন পুণ্য নেই।" আধুনিক কালে জৈনদের ধারণায় অহিংসা অর্থে শুধুমাত্র সহিংসতা বা অপরের অনিষ্ট করা থেকে বিরত থাকাই যথেষ্ট নয়। বরং মানুষের জন্য ন্যায়, শান্তি, মুক্তি ইত্যাদি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ইতিবাচক মানসিকতা নিয়ে কাজ করা।

কোন প্রাণী বা জীবিত স্বত্তাকে আঘাত করা, গালাগাল করা, অপমান করা, পরাভূত করা, উৎপীড়ন করা, হয়রানি করা বা হত্যা করা, জঘন্য অপরাধ। অহিংসা যে শিক্ষা দেয়, তা হলো, দয়ালু ও ক্ষমাশীল হতে, সহিষ্ণুতা বৃদ্ধি করতে, অপরের প্রতি সদয় ও সহানুভূতি সম্পন্ন হতে, শান্তির জন্য কাজ করতে, পরিবেশ রক্ষার জন্য কাজ করতে, জীবজন্তুর প্রতি দয়ালু ও উদার হতে, সঠিক পন্থায় সততার সাথে প্রাত্যহিক কর্ম সম্পাদন করতে।

জৈনমতে সহিংসতার রূপ : ৹ দৈহিক উৎপীড়ন, ৹ মানসিক উৎপীড়ন, ৹ বাচনিক উৎপীড়ন।

জৈন ধর্মমতে প্রার্থনা :

পঞ্চ মনস্কার সূত্র, ঊষা লগ্নের পূর্বে করণীয়।

(১) আলোকিত আত্মা (আধ্যাত্মিক ব্যক্তিত্ব)র উদ্দেশ্যে অবনত চিত্তে শ্রদ্ধা নিবেদন করা।
(২) মুক্ত আত্মা (আধ্যাত্মিক ব্যক্তিত্ব)র উদ্দেশ্যে অবনত চিত্তে শ্রদ্ধা নিবেদন করা।
(৩) ধর্মীয় জ্ঞান সম্পন্ন আধ্যাত্মিক নেতার উদ্দেশ্যে অবনত চিত্তে শ্রদ্ধা নিবেদন করা।
(৪) ধরমীয় শিক্ষক বা আচার্যের উদ্দেশ্যে অবনত চিত্তে শ্রদ্ধা নিবেদন করা।
(৫) পৃথিবীর সমস্ত ভিক্ষুগণের উদ্দেশ্যে অবনত চিত্তে শ্রদ্ধা নিবেদন করা।

প্ররিক্রমণ : বিগত রাতে নিজ আত্মার যে ক্ষতি সাধন হয়েছে, তার জন্য অনুতাপ করা।

জৈন ধর্মে তীর্থঙ্করের উদ্দেশ্যে অষ্ট প্রকারী পূজা করা হয়। (১) জলপূজা, (২) চন্দনপূজা, (৩) পুষ্পপূজা, (৪) ধুপপূজা, (৫) দীপকপূজা, (৬) অক্ষতপূজা, (৭) নৈবেদ্যপূজা ও (৮) ফলপূজা।

জৈন ধর্মের মূল গ্রন্থ হল 'অাগম'। অপেক্ষাকৃত অপ্রধান গ্রন্থ হচ্ছে, আচারঙ্গ সূত্র, উত্তর অধ্যয়ন সূত্র, সূত্র কৃতঙ্গ।

বর্ধমান মহাবীর তপস্যায় জ্ঞান লাভের মাধ্যমে ইন্দ্রিয়কে জয় করেছেন বলে তাঁকে জিন বলা হয়। এই জিন থেকেই জৈন শব্দের উৎপত্তি।

চলবে

আগের পর্বসমূহ:
ধর্মসার- (১) লাও-ৎসু ও 'তাও'
ধর্মসার- (১) লাও-ৎসু ও 'তাও' এর বাকি অংশ
ধর্মসার- (২) কনফুসিয়াস ও তাঁর ধর্ম
p>'ঝাঁপি খুলে বহু পুরাতন একটি নোটবই পেলুম। তখনকারদিনে আমাদের দেশে ইন্টারনেটের সুবিধা ছিলনা। বই-পুস্তক ঘেঁটেই যা কিছু পাওয়া। কখন, কোথায়, কিভাবে এসব পেয়েছিলাম তা আর এখন মনে করতে পারিনা তাই সূত্র জানাতে পারবোনা। ক্ষমা করবেন।'

প্রৌঢ়ভাবনা


মন্তব্য

তারেক অণু এর ছবি

রাজশাহি একটি জৈন মন্দির আছে, শুনেছি পুরো বাংলাদেশের অক্ষত ২টি মন্দিরের সেটি একটি।
জৈন ধর্মমত খুবই আকর্ষণীয় ও পরিবেশবাদী, সম্রাট অশোক বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণ না করে জৈন মতগ্রহ্ন করলে হয়ত তা আজ বিশ্ব নন্দিত হত। তবে ৫০০০ বছর অনেক বেশী বলে ফেলেছে, কিছু কিছু গবেষক বয়স বাড়িয়ে মজা পায়, সুযোগ পেলেই রামায়ণ- মহাভারতের বয়স ৬০০০ বছর বলে ফেলে!

কল্যাণF এর ছবি

চলুক

প্রৌঢ় ভাবনা এর ছবি

অনেক অনেক ধন্যবাদ, সাথে থাকার জন্য।

প্রৌঢ় ভাবনা এর ছবি

খুব শীঘ্রই রাজশাহী যাবার কথা আছে। অবশ্যই খুজে বার করার চেষ্টা করব, সেই সাথে কিছু ছবিও তুলবো,হাঃ হাঃ হাঃ।
হ্যাঁ, ঠিকই বলেছেন, বাড়িয়ে বলার একটা প্রবণতা আছে। আমার পর্যবেক্ষণেও এটা উঠে এসেছে।
তবে জৈন ধর্মমতের প্রথম তীর্থঙ্কর 'ঋষভ' বা 'আদিনাথ' এর দর্শন যে হরপ্পা সভ্যতার কালে প্রচলিত ছিল তা অনেক ঐতিহাসিকই মত প্রকাশ করেছেন। হরপ্পা সভ্যতার ন্যুড মূর্তিগুলো 'ঋষভ' এর দর্শন এরই সাকার প্রকাশ।
ধন্যবাদ আপনাকে, মূল্যবান মন্তব্যের জন্য।

স্বাধীন এর ছবি

সিরিজ চলতে থাকুক। এই পর্বটা অন্তত আগের পর্বগুলোর তুলনায় আকারে একটু বেড়েছে হাসি

একটি পরামর্শ- আপনার লেখার লিঙ্কগুলো একদম শুরুতে না দিয়ে শেষে দিন। শুরুতে লেখার মূল অংশ কিংবা ভূমিকাটি দিলে আমার মনে হয় অনেকে ভেতরে এসে লেখাটা পড়তে আগ্রহী হবে।

আরেকটি বিষয় লেখাগুলো শুধু কিছু তথ্যের মধ্যে নির্দিষ্ট না রেখে সেগুলো সম্পর্কে নিজস্ব কিছু বিশ্লেষণ, মতামত, নিদেনপক্ষে অন্য ধর্মগুলোর সাথে পার্থক্য কিংবা মিলগুলো কোথায় সে সম্পর্কে কিছু লিখতে পারেন। এভাবেই লেখার আকার বেড়ে যাবে।

প্রৌঢ় ভাবনা এর ছবি

ধন্যবাদ আপনার পরামর্শের জন্য। উপকৃত হলাম।
ধর্ম বড়ই স্পর্সকাতর একটি বিষয়। ধর্ম সম্পর্কে লিখতে হলে বৃহৎ পরিসর আবশ্যক। আমার স্বল্প জ্ঞানে আমি শুধু বিভিন্ন ধর্মমতের সারটাই তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। হ্যাঁ, অন্যান্য ধর্মমতগুলোর সাথে মিল ও পার্থক্য নিয়ে আলোচনা করা যায় বইকি।
উৎসাহ যোগাবার জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ।

রণদীপম বসু এর ছবি

স্বাধীন, একটা পোস্টের মধ্যে একটা ধর্ম ও দর্শন নিয়ে বিস্তারিত লিখা কি আদৌ সম্ভব ? ধরে নেন এটা স্রেফ খুবই সংক্ষিপ্ত প্রাথমিক পরিচয়। বিস্তারিত জানতে আগ্রহী হলে এই পেজে দেখুন। হাইপারলিংক করা আছে।

-------------------------------------------
‘চিন্তারাজিকে লুকিয়ে রাখার মধ্যে কোন মাহাত্ম্য নেই।’

স্বাধীন এর ছবি

অনেক ধন্যবাদ রণ'দা লিঙ্কটার জন্যে। আমি পড়বো।

প্রৌঢ় ভাবনা এর ছবি

লিঙ্কটার জন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ। অনেক কিছুই জানা হল।

পথিক পরাণ এর ছবি

বিভিন্ন ধর্মমত বিষয়ে আপনার লেখাগুলো বেশ মূল্যবান। ভালো লেগেছে।

একটু সংযোজন -- ''জিন'' বিষয়ে উইকিপিডিয়া বলছে--

'' জৈনধর্মের মূল বক্তব্য হল সকল জীবের প্রতি শান্তি ও অহিংসার পথ গ্রহণ। জৈন দর্শন ও ধর্মানুশীলনের মূল কথা হল দৈব চৈতন্যের আধ্যাত্মিক সোপানে স্বচেষ্টায় আত্মার উন্নতি। যে ব্যক্তি বা আত্মা অন্তরের শত্রুকে জয় করে সর্বোচ্চ অবস্থা প্রাপ্ত হন তাঁকে জিন (জিতেন্দ্রিয়) আখ্যা দেওয়া হয়।''

--------------------
পথেই আমার পথ হারিয়ে
চালচুলোহীন ছন্নছাড়া ঘুরছি কেবল...

প্রৌঢ় ভাবনা এর ছবি

ধন্যবাদ আপনাকে, সংযোজনের জন্য। হ্যাঁ, আপনি সঠিক ভাবেই বিষয়টিকে তুলে ধরেছেন।

দ্যা রিডার এর ছবি

চলুক... একবার পড়েছি... আবারো পড়ব ।। লিখতে থাকুন ... হাসি

প্রৌঢ় ভাবনা এর ছবি

ধন্যবাদ, পড়বার জন্য।

রোমেল চৌধুরী এর ছবি

লেখা চলুক। পড়ছি। সবকটি লেখা শেষ হলে আবারো পড়বো।

------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
আমি এক গভীরভাবে অচল মানুষ
হয়তো এই নবীন শতাব্দীতে
নক্ষত্রের নিচে।

প্রৌঢ় ভাবনা এর ছবি

ধন্যবাদ, যথেষ্ট ভরসা পেলুম।

তাপস শর্মা এর ছবি

অনবদ্য চলুক

প্রৌঢ় ভাবনা এর ছবি

ধন্যবাদ।

রেশাদ শাহবাজ এর ছবি

এগুলিতো কুসংস্কার! সত্যিকারের রিলিজিন নিয়ে লেখেন।

প্রৌঢ় ভাবনা এর ছবি

মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ।
আসলে আমি সংস্কার অথবা কুসংস্কার নিয়ে লিখছিনা। শুধুমাত্র প্রচলিত ধর্মমতের সার টুকুই লেখার চেষ্টা করছি।

নিয়াজ মোর্শেদ চৌধুরী এর ছবি

এগুলিতো কুসংস্কার! সত্যিকারের রিলিজিন নিয়ে লেখেন।

ভাই সত্যিকারের ধর্ম কোনটা? ধর্ম মানেই তো কুসংস্কার। আজ পর্যন্ত তো কোন ধর্মকে সত্য কথা বলতে শুনলাম না চোখ টিপি

উচ্ছলা এর ছবি

ভীষন নান্দনিক এই সিরিজটির সর্বাঙ্গীন মঙ্গল কামনা করছি। আমি এটির একজন একনিষ্ঠ পাঠিকা।

প্রৌঢ় ভাবনা এর ছবি

আপনার এই মন্তব্যটি আমার লেখার স্পৃহাকে অনেকগুন বাড়িয়ে দিয়েছে।
অনেক ধন্যবাদ, এমন উৎসাহব্যঞ্জক মন্তব্যের জন্য।

মন মাঝি এর ছবি

চমৎকার লেখা!

আপনার এই সিরিজটার জন্য নেট থেকে ধর্মের একটা বিবর্তনশীল ভৌগলিক মানচিত্র দিলাম। ৯০ সেকেন্ডে ৫০০০ বছরের ধর্মের ইতিহাস দেখুনঃ

****************************************

স্বাধীন এর ছবি

চলুক

প্রৌঢ় ভাবনা এর ছবি

আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।
আপনার এই মূল্যবান সংযোজনটি লেখাটির উৎকর্ষ বৃদ্ধি করেছে। আশা করছি সময়ে সময়ে প্রাসঙ্গিক সংযোজন করলে পাঠকগণ উপকৃত হবেন।

নিয়াজ মোর্শেদ চৌধুরী এর ছবি

অসাধারণ। চলুক

রণদীপম বসু এর ছবি

এটা কি ইসকনের তৈরি ? নইলে শুরুতেই কৃষ্ণের জন্ম দিয়ে শুরু করলো কেন বুঝলাম না। বাকীগুলো কিন্তু ইতিহাস, কেবল কৃষ্ণের জন্মের গাঁজাটুকু ছাড়া ! হা হা হা !!

-------------------------------------------
‘চিন্তারাজিকে লুকিয়ে রাখার মধ্যে কোন মাহাত্ম্য নেই।’

বন্দনা এর ছবি

এই পর্বটা বেশ জমজমাট হয়েছে। হাসি

প্রৌঢ় ভাবনা এর ছবি

ধন্যবাদ, উৎসাহব্যঞ্জক মন্তব্যের জন্য।

নিয়াজ মোর্শেদ চৌধুরী এর ছবি

এ পর্বটা চমৎকার লাগলো।

প্রৌঢ় ভাবনা এর ছবি

আপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা- মন্তব্যের জন্য।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।