বিদায়বেলা ও বাস্তবতা

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: মঙ্গল, ০৬/১২/২০১১ - ১০:৪৪পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

জিয়া আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে যখন এক পা দু পা করে ধীরে ধীরে ইমিগ্রেশনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলাম, খুব ইচ্ছা করছিল একবার পেছনে ফিরে দেখি স্বচ্ছ কাচের ওপাশ থেকে যারা আমার গমনপথের দিকে তাকিয়ে আছে তারা কে কি করছে। মিনিট খানেক আগে হাসিমুখে সবাইকে বিদায় দিয়ে তখনো আমার মনে হচ্ছিল এ বছরের অস্কার বিজয়ী অভিনেতাও মনে হয় আমার মত ভাল অভিনয় করতে পারে নাই। আমি বুঝতে পারছিলাম যে প্রতিটা পদক্ষেপে আমি আমার জীবনের সবচেয়ে প্রিয় মানুষগুলোর থেকে এক ধাপ দূরে সরে যাচ্ছি। একটা পর্যায়ে ভাবতাম কি লাভ, পরিবার ছেড়ে, আত্মীয়-স্বজন ছেড়ে এতো দূরে থেকে আমি কি পাব। যদি বিদেশ না যাই কি হবে। আসলে হয়ত কিছুই হত না, কিন্তু এটাই নিয়তি। ব্যাপারটা এমন নয় যে এই প্রথম আমি ঘর ছেড়ে যাচ্ছি। এস এস সি র পর থেকেই আমি বাড়ি থেকে দূরে। কিন্তু তখন একটা সুযোগ ছিলো চাইলেই বাবা-মাকে দেখতে যেতে পারতাম। এখন তা নেই।
বিদায় জিনিসটা বরাবরি আমার অপছন্দের। বাবার সরকারি চাকরির সূত্রে ছোটবেলা থেকেই কোনো এক জায়গায় একটানা বেশি দিন থাকা হয়নি। যখনি কোথাও শিকড় গজাতে শুরু করেছে তখনি শেকড় শুদ্ধ গাছকে উপড়ে ফেলা হয়েছে। প্রতিটা সময় স্কুলের বন্ধুদেরকে বিদায় জানাতে গিয়ে মনটা প্রতিবাদ করে উঠতো। নতুন স্কুলে, নতুন পরিবেশে, নতুন মানুষগুলোর সাথে মানিয়ে নেয়ার সময় পুরানো বন্ধুদেরকে খুব মিস করতাম। ছোটবেলায় মাঝে মাঝে ভাবতাম যদি হঠাৎ করে আগের স্কুলের বন্ধুরা নতুন স্কুলে এসে যেত, কত মজাই না হত। তারপরও একটা সময় সব ঠিক হয়ে যেত। নতুন বন্ধু হত, তারা আস্তে আস্তে পুরানো হত, আবার তাদের ছেড়ে চলে যাওয়া, আবার নতুন বন্ধু নতুন পরিবেশ, নতুন করে শিকড় গজানো। এভাবেই চলতে লাগলো চক্রের মত।
বুয়েটের শেষ দিনগুলোতে সবার মন খারাপ ছিলো। আমার খারাপ লাগাটা ছিলো অন্যরকম। কারন এই অভিজ্ঞতা আমার ছোটবেলা থেকেই পর্যায়বৃত্তিকভাবে হয়ে আসছে। খুব খারাপ লেগেছিলো যখন শেষ ক্লাসের দিন হল থেকে বেরুলাম। মনে হচ্ছিল গত পাঁচ বছর ধরে চলা একটা রাস্তা যেন আজ থেকে শেষ হয়ে গেল। এই রাস্তায় আমার চলার দিন শেষ। এইভাবে সকালে ঘুম থেকে উঠে ব্যাগ কাঁধে নিয়ে আর বেরোতে হবে না। অনেকদিন ধরে নিয়মিত করে আসা একটা জিনিস যতই অপছন্দের হোক, তার প্রতি একধরনের মায়া জন্মে যায়। বুয়েটের বিরক্তিকর ক্লাসগুলোকেও তখন কত আপন মনে হচ্ছিল। একটা সময় বুয়েট, প্রিয় হল আর হলের মানুষদের বিদায় জানাতে হলো।
আমার চাকরি জীবন খুব সংক্ষিপ্ত। ততোদিন বিদায় জিনিসটা আমার জন্য অনেক স্বাভাবিক হয়ে গেছে। চাকরি ছেড়ে, দেশ ছেড়ে আমেরিকায় এলাম উচ্চশিক্ষার জন্য। অ্যাক্রন নামে আমেরিকার এই ছোট্ট শহরে এসে আবিস্কার করলাম অন্য এক পরিবারকে। এই পরিবারের সদস্যরা হলো আমার মতোই বাংলাদেশ থেকে আসা অন্যান্য স্টুডেন্টরা। এই পরিবারের প্রতিটা সদস্য আমাকে শুরু থেকে বুঝতেই দেয়নি আমার বাবা-মা ভাই-বোন এগারো হাজার মাইল দূরে থাকে। নিজেকে ভাগ্যবান মনে হতে লাগলো এরকম একটা জায়গায় আসতে পেরে। এখানকার বেশিরভাগ মানুষকেই আমি আগে থেকে চিনতাম না; কয়েকজনকে চিনতাম।তাদের মধ্যে কেউ কেউ বন্ধুস্থানীয়, কেউ কেউ শিক্ষকশ্রেণীর। কিন্তু যতই দিন যেতে থাকল মানুষগুলোর সাথে যেন আত্মার সম্পর্ক তৈরী হতে থাকল। একটা সময় আর মনে হত না এই পরের দেশে আমার কেউ নাই, আমি আত্মীয়-স্বজন থেকে দূরে আছি।
এভাবে দিন যেতে যেতে বিদায় জিনিসটা আমি ভুলতে বসেছিলাম। কিন্তু ভাগ্য একটু ব্যতিক্রমীভাবে মনে করিয়ে দিল শিকড় যত গভীরই হোক তা উপড়তে তার সময় লাগে না। এবার নিজের বিদায় না, অন্যকে বিদায় দিতে গিয়ে বুঝলাম বিদায়কালে যে চলে যায় তার কষ্টের চেয়ে যে থেকে যায় তার কষ্ট অনেক বেশি। সেদিনই প্রথম আবিষ্কার করলাম আমার ভিতর প্রচন্ড আবেগী যে সত্তা বাস করে সেই সত্তাকে। মাত্র দেড় বছরেই কিভাবে একজন মানুষ নিজের রক্তের ভাই এর মত আপন হয়ে যেতে পারে সেটা তখনি বুঝতে পারি। সেদিন উপলন্ধি করলাম আসলে বাস্তবতার কাছে আমরা কতো অসহায়। আমরা চাইলেই কাউকে ধরে রাখতে পারি না। আমরা বড়জোর মনে মনে চাইতে পারি কিন্তু শেষ পর্যন্ত বাস্তবতার কাছে হার স্বীকার করতেই হবে। বিদায় জিনিসটা কখনোই মন থেকে আসে না, সবসময় তা হয় ইচ্ছার বিরুদ্ধে। মন থেকে হওয়া বিদায়কে বিদায় বলে না, তাকে বলে নিস্তার পাওয়া। তারপরও ইচ্ছার বিরুদ্ধে এই বিদায়ের সময় হাসিমুখ করে রাখাটা পৃথিবীর সবচেয়ে কঠিন কাজগুলোর একটা।
এখন কেমন যেন বিদায়ের প্রতি একটা ভীতি জন্মাতে শুরু করেছে। আরো একটা বিদায়ের ঘন্টা বেজে গেছে, কিন্তু বরাবরের মতই মন চাইছে না চারপাশের আপন মানুষগুলোকে ছেড়ে যেতে। কিন্তু যথারীতি এবারো বাস্তবতার কাছে আত্মসমর্পণ করতে যাচ্ছি। মাঝে মাঝে খুব জানতে ইচ্ছা করে আমি চলে যাওয়ার পর কি কি হবে। হঠাৎ করে হয়ত মাঝেমাঝে কারো আমার কথা মনে হবে। হয়ত যে আড্ডায় আমি নিয়মিত ছিলাম সেখানে কেউ আমার কথা বলে উঠবে। কয়েক সেকেন্ড অথবা কয়েক মিনিট আমার কি অবস্থা এইটা নিয়ে সবাই কথা বলবে। তারপর অন্য কোনো প্রসঙ্গ নিয়ে আলোচনা শুরু হয়ে যাবে। স্মৃতি হলো বিদায়ের বাইপ্রোডাক্ট এবং তা সময়ের ব্যাস্তানুপাতিক। যতই দিন যেতে থাকবে স্মৃতি ততই ফিকে হতে থাকবে। হয়তো সমইয়ের গতির সঙ্গে নতুন জ়ীবনের সাথে বন্ধুত্ব শুরু করব এবং আরেকটা বিদায়ের দিকে এগিয়ে যাব। অনেক মানুষের স্মৃতি এবং অতি আপন কিছু মানুষ ও বিদায়বেলায় তাদের পরিবর্তন মনের মাঝে সবসময় গেঁথে থাকবে।


মন্তব্য

আশফিক অনিক এর ছবি

আপনার মত অভিজ্ঞতা আমারও কয়েকবার হয়েছে।

সুন্দর লেখা,ভালো লাগলো!

জাদুকর এর ছবি

ধন্যবাদ আশফিক......

ত্রিমাত্রিক কবি এর ছবি

শাফায়েত, নামটা অ্যাড করে দিতে পারতি ... আর প্যারাগুলার মাঝখানে আরেকটা করে লাইনগ্যাপ দিলে চোখের আরাম হইত। সচলে স্বাগতম।

_ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _
একজীবনের অপূর্ণ সাধ মেটাতে চাই
আরেক জীবন, চতুর্দিকের সর্বব্যাপী জীবন্ত সুখ
সবকিছুতে আমার একটা হিস্যা তো চাই

জাদুকর এর ছবি

প্রথম লেখা বলে কিছু জিনিস বুঝে উঠতে পারিনি। ব্যাপারগুলা আমিও বুঝতে পারছি। নেক্সট টাইম ঠিক থাকবে। তোকে আবার ধন্যবাদ......

অন্যকেউ এর ছবি

চলুক

_____________________________________________________________________

বরং দ্বিমত হও, আস্থা রাখো দ্বিতীয় বিদ্যায়।

নিটোল এর ছবি

চলুক

_________________
[খোমাখাতা]

রুমা এর ছবি

খুব সুন্দর লেখা, ভাল লাগলো ।

জাদুকর এর ছবি

ধন্যবাদ রুমা

Guest_Writer Neelkomolinee এর ছবি

আপনার লেখা পড়ে আমার নিজের বিদায় নেয়ার কথা মনে পরে গেল। আমেরিকায় এসে ছাত্র জীবন শেষে কাজের জন্য অন্য শহরে চলে যাওয়া খুব কষ্টের।পরে অনেকবার মুভ করে গাঁ সওয়া হয়ে গেছে।
নিজেরাও দুজন থেকে চারজন হয়ে গেছি।কিন্তু সম্প্রতি বিশ বছর পর এক অনেক বড় শহর থেকে ছোট শহরে স্বামীর কাজের জন্য মুভ করতে হল। আমি কাজ করি বাসা থেকে।এই বয়েসে বন্ধুদের ছেড়ে আসা অনেক বেশি কষ্টের।
সুন্দর লেখার জন্য ধন্যবাদ।

জাদুকর এর ছবি

আসলে আমাদের সবার জীবনেই এরকম অনেক ঘটনার মধ্যে দিয়ে যেতে হয় যেগুলো না চাইলেও মেনে নিতে হয়। মন্তব্যের জন্য অনেক ধন্যবাদ।

রাব্বানী এর ছবি

চলুক

তৃষা এর ছবি

খুব ভালো হয়েছে ভাইয়া!!

জাদুকর এর ছবি

ধন্যবাদ তৃষা

Samad Bhuiyan এর ছবি

অনেক সুন্দর লেখা হাসি

জাদুকর এর ছবি

ধন্যবাদ আব্দুস সামাদ। জার্মানীর দিনকাল কেমন চলছে?

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।