স্বপ্নডানায় দীর্ঘশ্বাস

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: বিষ্যুদ, ১৯/০১/২০১২ - ১:০৩পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

(উৎসর্গ: জয়শ্রী সেন জয়া, আমার বৌদি।)

পথের দু’ধার ঘেষে শিমুল গাছের সারি। হালকা বাতাসে শিমুল তুলো উড়ে বেড়াচ্ছে এপাশ থেকে ওপাশ। যেন দোল খাচ্ছে। মেঠোপথে পড়ে থাকা তুলোগুলো পায়ের স্পর্শে সরে যাচ্ছে এধার ওধার। যেন পথ করে দিচ্ছে। পায়ে চলার পথ। শিমুল গাছের ছায়ায় অযত্নে বেড়ে ওঠা রক্ত জবার গাছগুলোতে প্রজাপতির মেলা। মনটা কেমন যেন হালকা হয়ে যায় অলোকের।

প্রায় এক যুগ পার করে গ্রামে ফিরল অলোক। বলার মত তেমন কোন আত্মীয় স্বজন নেই ওর এখানে। তবুও মাটির টানে আসা। কিন্তু আজকের গ্রামটাকে ও মনের ছবির সাথে মেলাতে পারে না কিছুতেই। অনেক কিছু বদলে গেছে। গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া নদীটা শুকিয়ে মৃতপ্রায়। গ্রামের লোকের কাছে খবর নিয়ে জেনেছে বর্ষার ভরা যৌবনে যাওবা একটু ভরে উঠে, বর্ষা না যেতেই যেন বসুমতির প্রচন্ড তৃষ্ঞার কাছে হার মেনে নিজেকে সপে দেয় তার কাছে। আদিগন্ত মাঠ যেন কল্পনা মাত্র। চোখ মেলে তাকালে যেন হোচট খেতে হয়, নতুন গজিয়ে ওঠা টিনের চালে নয়তো বেড়ায়। এতকিছুর পরও শান্ত স্নিগ্ধ সমীরন, পাখির কিচির মিচির, আর যন্ত্রের শব্দহীনতা ওকে কিছুটা হলেও স্বস্তি দেয়।

এসব নিয়ে ওর বন্ধুরা ওকে প্রায়ই ক্ষ্যাপায়। বলে, এই একুশ শতকে বসেও তুই এখনও সেই গেঁয়োই রয়ে গেলি। নতুন সভ্যতার এই অভিবাদন তুই গ্রহন করতে পারলি না। এখনও সেই অতীতেই পড়ে রইলি। কিন্তু অলোক জানে ওরা বুঝেও বুঝতে চায়না অতীতকে বাদ দিয়ে বর্তমান বা ভবিষ্যত কোনটাই গড়ে উঠতে পারে না। ওরা জানে, একদিন এই অতীত এসেই গলা টিপে ধরবে বর্তমানের, অতীতকে অস্বীকার করার স্পর্ধায়। সেদিন ফিরে যেতে হবে আবার সেই মাটির কাছেই।

শেষবার অলোক গ্রামে এসেছিল রুহানাকে নিয়ে। সেদিন লাল রঙ্গের শাড়িতে রুহানাকে অগ্নিশিখার মত লাগছিলো। দূর থেকে হল গেটে রুহানাকে দেখে চমকে উঠেছিল অলোক। কি করে এই মেয়েটা ওকে ভালোবেসেছিল অলোক আজও বুঝে পায়না। ওর মত রাগী, নিতান্ত স্বার্থপর আর দু:খবিলাসীকে যে রুহানার মত মেয়ে ভালোবাসতে পারে সেটা ওর কল্পনারও অতীত ছিলো।

দিনটা ছিলো পৌষ সংক্রান্তি। পৌষের শীতে কুয়াশা ঘেরা চারপাশটা যেন মায়াবী পরিবেশ তৈরি করেছিলো। রুহানার মুখ দেখে অলোক বুঝতে পেরেছিলো ভীষণ খুশি হয়েছে ও। অলোকের মুখের দিকে তাকিয়ে মিষ্টি করে শুধু একটু হেসেছিলো রুহানা।

অলোক ভেবেছিলো ওর বাবামায়ের কাছে রুহানার সত্যকার পরিটয়টাই দেবে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আর পারেনি। তাই বন্ধু বলেই পরিচয় করিয়ে দেয়। অলোকের এই অসহায়ত্ব সেদিন রুহানাও বুঝতে পেরেছিলো । তাই কোন অভিযোগ করেনি। ফিরে এসে বরং সাত্ত্বনাই দিয়েছিলো। এই ঘটনার প্রায় তিন বছরের মাথায় অলোকের বাবা মা দু’জনেই মারা যান। ভাই বোন থাকা সত্ত্বেও অলোক কেমন যেন একটু শেকড় ছেড়া হয়ে যায় । ভাই বোনেরা অনেক আগেই নিজেদের মত করে সংসার পেতে নিয়েছিলো। ভাইয়ের সংসারে উৎপাত হতে পারে ভেবে অলোক সবার সাথেই একটা মুখ রক্ষার সম্পর্কই রেখেছিলো।

সমস্ত বাঁধনগুলোই যখন একে একে আলগা হয়ে যাচ্ছিলো তখন একদিন অলোকের সেই যুক্তিহীন ক্রোধ রুহানাকেও ছুড়ে ফেলে দূরে। সবকিছুর পরও ফিরে এসেছিলো রুহানা। কিন্তু এবারও আঘাত করে নিষ্ঠুরের মত। সব অপমান সয়ে নিয়ে রুহানা সরে দাঁড়ায় ওর জীবন থেকে। সেদিন ঘুনাক্ষরেও বুঝতে পারেনি জীবনের শেষ বন্ধনটাও ও হারালো। আর এখন জীবনটা ওর কাছে এক বন্ধনহীন গ্রন্থি।
এসব ভাবতে ভাবতে হঠাৎ খেয়াল হয়, পথ ফুরিয়ে এলো। এবার ফেরার পালা।

কিন্তু কোথায় ফিরবে অলোক, কার কাছে!!

অর্ক রায় চৌধুরী


মন্তব্য

প্রদীপ্তময় সাহা এর ছবি

আমরা যারা অতীতকে ভালবাসি তারা বারবার অতীতেই ফিরতে চাই । কিন্তু জানিনা অতীত আমাদের চায় কিনা । এবারে তবে অতীতকে ভালবেসে বলি 'তুমি ভাল থাক ।' আর ভালবাসি এই বর্তমানকে, এটা ভেবে অন্তত যে, এ অতীতের দিকেই যাত্রা শুরু করছে এইমাত্র । যদি এই বর্তাতমানে ভালবাসার মত কিছু সত্যিই কিছু না থাকে তবু না হয় তাকে যত্ন করে ভালবাসি । অতীতের কাছে বার্তা পাঠাই 'আমি বদলে গেছি, আমি অনুতপ্ত ।' হতেও পারে আমার অতীত অভিমান ভুলে কোনদিন আমার সামনে এসে দাঁড়াল ভবিষ্যতের নতুন রূপ নিয়ে ।

লেখা চালিয়ে যান । ভাল লাগল ।

অর্ক রায় চৌধুরী এর ছবি

ভবিষ্যতের নতুন রুপের জন্য যে সেই সোনালী অতীতটাই আমাদের দরকার!!!
ধন্যবাদ....

প্রৌঢ় ভাবনা এর ছবি

ভাল লেগেছে। চলুক

অর্ক রায় চৌধুরী এর ছবি

ধন্যবাদ....আপনাকে...

নক্ষত্র-নীরবতা এর ছবি

ভাল লাগল, চালিয়ে যান চলুক

অর্ক রায় চৌধুরী এর ছবি

আপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা-

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।