হেমন্তের উত্তরবঙ্গ

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: শুক্র, ১০/০২/২০১২ - ৯:৫৬অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

চতুর্থ পর্বঃ কবি ও শিক্ষক ...............

শীতের আগমনীবার্তা নিয়ে ৬ নভেম্বরের কুয়াশাঘেরা ভোর হাজির হলো। ০৬:৩৭ মিনিটে আবার মহাসড়কে নেমে পড়লাম। যতই দিন যেতে লাগলো আমি ততই সকাল সকাল যাত্রা শুরু করতে পারছিলাম। ইচ্ছা করলে সময়টা আরও এগিয়ে নিয়ে আসতে পারতাম। কিন্তু ভাতকুড়া জামে মসজিদে বেশ সময় নিয়ে কিছু কাজ সারলাম। তার উপর মুয়াজ্জিন সাহেব মসজিদ প্রাঙ্গণে লাগানো পেঁপে গাছের বৃদ্ধি ও তার ফলন সম্পর্কে আমার বিশেষজ্ঞ মতামত চাইলেন। জিন প্রকৌশলের কিতাবে এ ব্যাপারে কি বলা আছে তা জানতে চাইলেন। আমিও বিশেষজ্ঞের (অর্থাৎ বিশেষভাবে অজ্ঞ যিনি) মত পেঁপের কৌলিতত্ত্ব নিয়ে বাঙালি জাতির অবদান আর তৎসংশ্লিষ্ট আরও কিছু পুঁথিগত বিদ্যা ঝাড়লাম। তবে একটা বিষয়ে আমার খটকা লাগলো। মাটিতে প্রচুর ইটের কণা ছিল। আমার মনে হলো এটাই পেঁপের ফলনের পথে অন্যতম অন্তরায়। তবে যে বিষয়ে যত কম জানি তার সম্পর্কে তত অল্প বলাই উত্তম। তাই আর কথা না বাড়িয়ে বের হয়ে আসলাম। ০৬:৫০ মিনিটে তারটিয়া বাজারে পৌঁছলাম। সেখানে বার মিনিটের মত ছিলাম। ০৭:০৪ মিনিটে দিনের প্রথম কিলোমিটার পোস্ট আমাকে অবহিত করলো যে আমার গুরুত্বহীন জীবনে একটা গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা আর মাত্র ২৮ কিলোমিটার দূরেই ঘটতে যাচ্ছে।

প্রকৃতির একটা অদ্ভুত বৈশিষ্ট্য আছে। জীবনের রঙ্গমঞ্চে সে যখন এক ঘটনা থেকে অন্য ঘটনার দৃশ্যায়ন করে তখন এক সূক্ষ্ম প্রভাবক পরিবর্তনের নিয়ন্তা হয়ে কাজ করে। আমি যখন ভাতকুড়ার ঐ মসজিদে ছিলাম তখন সারারাত ধরে ঘুমানোর চেষ্টা করছিলাম। রাত গভীর থেকে গভীরতর হলো, কিন্তু ঘুম হলো না। একসময় রাত শেষ হয়ে ভোর আসলো। এটা প্রকৃতির একটা ক্রান্তিলগ্ন। সময়ের কালান্তর। তারটিয়া বাজারে নাস্তা করে যখন আবার মহাসড়কে নামলাম তখন প্রকৃতির ভোর থেকে সকালে রূপান্তর আমার চোখে পড়লো। যা আগেও আমি দেখেছি। কিন্তু দেখিনি সেই প্রভাবককে যে এই রূপান্তরের নিয়ন্তা। এটা স্থান-কাল-পাত্র ও ব্যক্তিত্বভেদে পরিবর্তনশীল কিন্তু অস্তিত্বে ধ্রুব। আমি তাকে দেখলাম মহাসড়কের এক সূক্ষ্ম বাঁকের মাঝে। ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়ক থেকে একটা রাস্তা সোজা চলে গেছে। সেই রাস্তা ধরলে টাঙ্গাইল সদরে যাওয়া যেত। কিন্তু আমি ডানে বাঁক নেওয়া মহাসড়ককে বেছে নিলাম। আর এই বাঁক ঘুরতে ঘুরতেই আমার মনে হলো এই বুঝি ভোর শেষ হয়ে সকাল এলো। এরকম বোধ বোধ করি সবার হবার সৌভাগ্য হয় না। বাঁকের ধারে ডানদিকে ছিল রবি’র (সাবেক একটেল) একটা বড়সড় বিলবোর্ড। হেমন্তের উজ্জ্বল হলদে সূর্যের অবিরত কিরণচ্ছটা যেন সেই বিলবোর্ডে আছড়ে পড়ে চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ছিলো। রাস্তার বাঁদিকে টাঙ্গাইল টেকনিক্যাল ইন্সিটিউট (TTI) আর দূর পশ্চিমে মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় দেখলাম। সব মিলিয়ে আজকের পরিবেশটাও ছিল নিঃসঙ্গ পথিকের নিস্তরঙ্গ পথচলার এক অসাধারণ বন্ধু। কেউ যদি এই বিমূর্ত অভিজ্ঞতা লাভ করতে চান তাহলে তাকে কোনো এক হেমন্তের ভোরে টাঙ্গাইলের সন্তোষে যেতে হবে।

সকাল আটটার কিছু আগে রাস্তার উপর একটা কুকুর মরে পড়ে থাকতে দেখলাম। তাজা রক্তের ধারা আর উপড়ানো ডান চোখ দেখে বুঝতে পারলাম বেচারা হয়তো কিছুক্ষণ আগেও আমার মত প্রকৃতির ক্রান্তিলগ্নের সৌন্দর্য বোঝার চেষ্টায় ছিল। মনটা দুঃখে ছেয়ে গেলো। যেদিন থেকে আমি এরকম মহাসড়ক অভিযানে বের হয়েছি সেদিন থেকেই মৃত্যু আমার পিছে আঠার মতো লেগে আছে। হয়তো নিজে মরতে মরতে বেঁচে গেছি নয়তো অন্য কাউকে মরে পড়ে থাকতে দেখেছি। প্রথম প্রথম সেইসব দৃশ্য দেখে ভয় লাগতো। কিন্তু আজ দুঃখ ছাড়া আর কিছু অনুভূত হলো না। সকাল ০৮:২৬ মিনিটে দিনের ষষ্ঠ কিলোমিটার পোস্ট জানিয়ে দিয়ে গেলো যে ঐতিহাসিক যমুনা সেতু থেকে আমি আর ২২ কিলোমিটার দূরে আছি। এর মিনিট পাঁচেক পর টাঙ্গাইল-রাবনা বাইপাসে এসে পৌঁছলাম। এখান থেকে মহাসড়ক আবার ডানে বেঁকে গেছে। আর বাঁদিকে একটা রাস্তা বের হয়ে টাঙ্গাইল সদরে গিয়ে মিলেছে। আমার ইচ্ছা ছিল টাঙ্গাইল শহরটা একটু ঘুরে দেখবার। টাঙ্গাইল হলো বহুগুণে গুণান্বিত এক ঐতিহ্যবাহী জেলা। বাংলাদেশের অধিকাংশ জেলার সব কিছু সদর ও তার আশেপাশে কেন্দ্রীভূত থাকে। কিন্তু অল্প কিছু জেলার মতো টাঙ্গাইল এর ব্যতিক্রম। এর আগাগোড়া ঐতিহ্যমণ্ডিত। যাহোক আমি আমার পথেই হাঁটতে লাগলাম। টাঙ্গাইল শহর আর দেখা হলো না।

পৃথিবীতে সুখ কখনো দীর্ঘস্থায়ী হয় না। হলে তো আর বেহেশতের দরকার ছিল না। ০৮:৩৯ মিনিটে বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর রাবনাস্থ মাইক্রোওয়েভ স্টেশনকে (বাঁদিকে রেখে) পাশ কাটানোর সময়ও টের পাইনি সামনে আমার জন্য অপেক্ষা করছে সমগ্র উত্তরবঙ্গের জঘন্যতম (সম্ভবত) মহাসড়ক। কথাটা ঠিক ঐ সময়ের জন্য প্রযোজ্য। এখন অবশ্য মাননীয় সরকারের সৌজন্যে প্রায় সব সড়কই সমমানে উন্নীত হয়েছে। ওনারা এখন নদীর মাঝখান দিয়ে অত্যাধুনিক সড়ক নির্মাণে মহাব্যস্ত। যাহোক রাস্তাটা এমন বাজে ছিল যে কেবলই মনে হচ্ছিলো পাহাড় ট্রেকিংয়ের ট্রেনিং আমি এখনই নিচ্ছি। সাথে রাস্তার পাশে ছিল প্রাগৈতিহাসিক যুগের কিছু কিলোমিটার পোস্ট। এরই মধ্যে ০৯:০৯ মিনিটে কালিহাতী উপজেলায় প্রবেশ করলাম। মহাসড়কের এরকম উটকো যন্ত্রণায় সময়মত অনেক কিছুই ক্রনিকলে তুলতে পারিনি। এই যেমন রাস্তার ডানদিকে সমান্তরালে চলে যাওয়া রেলপথের ব্যাপারটা। একে আমি অনেক আগেই দেখেছিলাম। কিন্তু এরকম পাহাড় (!) বেয়ে একবার উঠলে আর নামলে লিখবো কি করে! ০৯:২২ মিনিটে পুংলি সেতু পার হলাম। অদ্ভুত সুন্দর নদীর নাম- পুংলি। এর মিনিট দশেক পর একটা ট্রেন দেখলাম যমুনা সেতু থেকে আসছিলো। এক সময় বুঝতে পারলাম এভাবে কৌশলতত্ত্ব অনুযায়ী বাঁদিক ধরে হাঁটতে থাকলে হয় বিরক্ত চালকের গাড়ির ধাক্কায় অকালে প্রাণটা যাবে নয়তো ঠ্যাং ভেঙে বসে থাকতে হবে। তাই বাধ্য হয়ে ০৯:৪৪ মিনিটে ট্র্যাক পরিবর্তন করলাম। তবে বেশিক্ষণ আমাকে ডানদিকে হাঁটতে হলো না। মিনিট ছয়েক পরেই আমি এলেঙ্গা হাইওয়ে রোড বাসস্ট্যান্ডে পৌঁছলাম। রাবনা বাইপাস আমার জন্য মহাবিরক্তির কারণ হলেও রাস্তাটা ছিল ছায়াঘেরা, সুশীতল ও মনোরম।

এলেঙ্গা বাসস্ট্যান্ডে এসে চলমান একটা বিশ্রাম নিলাম। অর্থাৎ বিশ্রামও করছিলাম আবার হেঁটে হেঁটে চারপাশটা ভালোভাবে দেখেও নিচ্ছিলাম। এখানে বেশ কয়েকটা ফিলিং স্টেশন চোখে পড়লো। লক্ষণীয় ছিল মহাসড়কের বাঁদিকে খানিকটা দূরে সারি সারি দোকান। সবাই যার যার ধান্দা নিয়ে ব্যস্ত। এইসব জায়গায় মানুষ এমনই হয়ে যায়। গ্রামের যে সহজ-সরল শ্মশ্রুমণ্ডিত বৃদ্ধ অপার্থিব চিন্তায় চিরসুখী, এই যান্ত্রিক নিরস পরিবেশে এসে সেই মানুষটিই বৈষয়িক ফিকিরের যাঁতাকলে পিষ্ট হয়ে নিষ্ঠুর আচরণে বাধ্য হয়। আমাকে অবশ্য সামনাসামনি এগুলো দেখতে হয়নি। পুরো একুশ মিনিটের পর্যবেক্ষণে এরকম ধারণা জন্মে। মানুষের পরিবর্তনশীল ব্যক্তিত্ব এক বৃদ্ধের আদলে দেখার চেষ্টা আর কি। এলেঙ্গা বাজার রাস্তা থেকে বাঁদিকে বেশ খানিকটা ভিতরে। আমি সেখানে যাইনি।

সকাল ১০:১৮ মিনিটে বঙ্গবন্ধু সেতু (পূর্বতন যমুনা সেতু)–র Extension area-তে প্রবেশ করলাম। একে ইংরেজিতে Approach road বলে। অল্প কিছুক্ষণ বাদে এলেঙ্গা রিসোর্ট চোখে পড়লো। এর ঠিক দুই মিনিট পর (১০:২২ মিনিটে) সড়ক দুভাগে ভাগ হয়ে গেলো। ডানদিকের রাস্তাটা কালিহাতী, মধুপুর, ঘাটাইল ক্যান্টনমেন্ট ও গলফ ক্লাব, জামালপুর এবং ময়মনসিংহে চলে গেছে। মোটামুটি এলাহিকাণ্ড। তিন তিনটা স্থান নির্দেশক বিলবোর্ড বসানো ছিল ঐ জায়গায়। আর আমি যমুনা অভিমুখে হাঁটতে লাগলাম। কিছুক্ষণ পরে বাঁদিক দিয়ে একটা রাস্তা এসে আবার ডানে চলে গেলো। এটি টাঙ্গাইলের ভূঞাপুরে চলে গেছে। সেতুর Approach road–টিকে এক কথায় Express highway বলা যায়। এই রোডে গাড়ি থামে না বললেই চলে। চালকরাও মনে হয় এখানটাতে গাড়ি চালিয়ে মজা পান। উল্কাবেগে একেকটা গাড়ি আমাকে পাশ কাটাচ্ছিল। আর যাবার সময় একগাদা ধুলাবালি উপহার দিয়ে যাচ্ছিলো। আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে বানানো এই সড়কের ভাবই আলাদা। ডানদিক ঘেঁষে ব্রডগেজ রেলওয়ে। এরকম প্রায় জনমানবহীন রাস্তায় হেঁটে যাওয়া যেখানে চালক ইচ্ছা করলেই যা খুশি তাই করতে পারে। কেউ কেউ আবার একফুট দূর দিয়েও গাড়ি নিয়ে যাচ্ছিলো। লিখতে গিয়ে আমার এখন অবাক লাগছে এই ভেবে যে একেকটা গাড়ি পাশ কাটিয়ে যখন চলে যাচ্ছিলো তখন কেন একবিন্দুও ভয় পাইনি! আমি তো নিজেকে এতো সাহসী ভাবি না। ভাবার অবশ্য কোনো কারণ নেই। কিন্তু কোন সেই শক্তি, কোথাকার সেই উদ্যম, কার সেই প্রেরণা যা আমাকে স্বভাববিরুদ্ধ কাজ করতে উদ্ভুদ্ধ করেছিলো। আমি জানি না। হয়তো এটাই জীবনের কোনো সূক্ষ্ম বাঁক, অদৃশ্য নিয়ন্তা।

এরকম রাস্তায় কেউ বিশ্রাম নেওয়ার জন্য থামে না। এখানে টানা হাঁটার মধ্যে এক রকম আনন্দ আছে। চট্টগ্রাম ট্যুরেও আমি এরকম এক পরিস্থিতিতে পড়েছিলাম। কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামে বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তের অপার সৌন্দর্য দেখে বাকরুদ্ধ হয়ে গিয়েছিলাম। পায়ের অসহ্য যন্ত্রণা জাদুর মতো উধাও হয়ে গিয়েছিলো। উল্কাবেগে অবিরাম হাঁটছিলাম। পরে এর জন্য বড়সড় একটা খেসারত দিতে হয়েছিলো। এর বিস্তারিত আমি আমার চট্টগ্রাম ট্যুরের কাহিনিতে লিখবো, ইনশাল্লাহ্। অতীতের ভুল থেকে যে শিক্ষা নেয় ভবিষ্যতে তার হোঁচট খাওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম। তাই আমি বিশ্রাম নেওয়ার জন্য ঘন ঘন থামলাম। প্রথমবার ধোলাটাঙ্গর নামক স্থানে। তখন বাজে বেলা ১১:০৫ মিনিট। এখানে নয় মিনিটের মতো বসে ছিলাম। জায়গাটা এতো সুন্দর আর নির্জন ছিল যে টানা নয় ঘণ্টা বসে থাকলেও খারাপ লাগার কথা না। পথে একটা কিলোমিটার পোস্ট দেখলাম। এক পিঠে পাবনা-১৩৭ আর অন্য পিঠে ঢাকা-১১০। সেতু এলাকার কিলোমিটার পোস্টগুলি বেশ নাদুসনুদুস, হৃষ্টপুষ্ট। ১১:৩২ মিনিটে ট্র্যাক থেকে নেমে পড়লাম। উদ্দেশ্য- একটা বিদ্যালয় পরিদর্শন ও বোতলে পানি ভর্তিকরণ। ট্র্যাক থেকে বাঁদিকে কিছুটা ভিতরে অবস্থিত এই বিদ্যালয়টির নাম আনালিয়া রেজিস্টার্ড প্রাথমিক বিদ্যালয়। ওখানকার ছেলে-মেয়েরা চিড়িয়া দেখার মতো করে আমাকে দেখছিলো। স্কুলের চাপকল থেকে পানি ভরে আমি গেলাম প্রধান শিক্ষকের অফিসে। অত্যন্ত সজ্জন মানুষ। ওনাকে এমনিই জিজ্ঞাসা করলাম যে আমি পায়ে হেঁটে যমুনা সেতু পার হতে পারবো কিনা। উনি বললেন, পায়ে হেঁটে যাবে কেন? সেতুর আগে একটা বাসে উঠে ওপারে চলে যাও, তাহলেই তো হয়। আমি বললাম যে স্যার, আমি সমস্ত পথ পায়ে হেঁটে এসেছি, বাকি পথও যাব পায়ে হেঁটে। তাই সেতুর উপরও আমাকে হাঁটতে হবে। এর অন্য কোনো বিকল্প নেই। উনি বললেন, কেন বিকল্প থাকবে না! তুমি বাসে উঠে চলে যাও। দশ টাকা ভাড়া নিবে। বেশি না। আমি আবারো ওনাকে বেশ শান্তভাবে হাসিমুখে বোঝানোর চেষ্টা করলাম। যখন বিদায় নিয়ে চলে আসবো তখন উনি আমাকে আশীর্বাদ করে বললেন, সেতুর আগে বাস পাওয়া যায়। দশ টাকা নেয়। একটা কৌতুক দিয়ে প্যারাটা শেষ করি। আমার খুব প্রিয় কৌতুক।
বাবাঃ সোনা, তুমি বড় হয়ে কি করবে?
ছেলেঃ বাবা, আমি বড় হয়ে দোকানে যাবো; তারপর দোকান থেকে গুলতি কিনে পাখি মারবো।
বাবাঃ না। তুমি তা করতে পারো না। তুমি বড় হয়ে লেখাপড়া করবে। এখন বলো তো তুমি বড় হয়ে কি করবে?
ছেলেঃ আমি বড় হয়ে লেখাপড়া করবো। তারপর দোকানে গিয়ে গুলতি কিনে পাখি মারবো।
বাবাঃ না। তুমি লেখাপড়া করে ভালো একটা চাকরি করবে, বিয়ে করে সংসার করবে। কি বুঝেছ?
ছেলেঃ হ্যাঁ, বুঝেছি। আমি লেখাপড়া করে ভালো একটা চাকরি করবো, বিয়ে করে সংসার করবো। তারপর আমি দোকানে যাবো। গুলতি কিনে পাখি মারবো।
বাবাঃ (রেগে গিয়ে) না। তুমি সারাজীবন ভালোভাবে চলবে। একসময় তুমি বৃদ্ধ হবে। তখন চাকরি থেকে অবসর নিয়ে সুখে-শান্তিতে বাকি জীবনটা কাটাবে। বেশি বেশি আল্লাহ্‌কে ডাকবে। কি বলেছি বুঝেছ?
ছেলেঃ বেশ বুঝেছি, বাবা। আমি সারাজীবন ভালোভাবে চলবো। একসময় বৃদ্ধ হবো। চাকরি থেকে অবসর নিয়ে বাকি জীবন সুখে-শান্তিতে কাটাবো। বেশি বেশি আল্লাহ্‌কে ডাকবো। তারপর আমি দোকানে যাবো ...............

আনালিয়ার মজার স্মৃতি নিয়ে আবার ট্র্যাকে ফিরলাম। সাথে সাথে একটা কিলোমিটার পোস্ট আমাকে জানিয়ে দিলো বগুড়া থেকে আমি আরও ৮৭ কিলোমিটার দূরে আছি। আমি তখন যমুনা সেতু আর কতদূরে তা জানার জন্য আঁকুপাঁকু করছি। সেই পৌনে এগারোটার দিকে জানতে পেরেছিলাম যে সেতু আর মাত্র ১৩ কিলোমিটার দূরে। কিছুক্ষণ পর একটা ট্রেনকে সেতুর দিকে যেতে দেখলাম। যা বাবা, তুই আগে যা। আমি তোর পিছে পিছে আসছি। দুপুর ১২:০৯ মিনিটে জানলাম সেতু আর ৮ কিলোমিটার সামনে। একটু পরে টহলরত চারজন পুলিসের সাথে দেখা হলো। ওনাদের আমি দূর থেকেই দেখেছিলাম। নিজে থেকেই কথা বললাম। পাশ কাটানোর কোনো উপায় ছিল না। আমি না থামলে ওনারাই আমাকে পিছনে ডেকে থামাতেন। পুলিস ভাইদের একজনের বাড়ি আবার আমার জেলা কুমিল্লায়। দেশি মানুষ হওয়াতে ওনার উচ্ছ্বাসটা একটু বেশিই ছিল। ওনাদের কাছ থেকে যা জানতে পারলাম তা হলো আমার হাঁটার উদ্দেশ্যের মহিমান্বিত গুরুত্ব (!) অনুধাবনপূর্বক সেতু কতৃপক্ষ খুশিমনেই সেতু পার হবার অনুমতি দেবেন। দুপুর ১২:৫৩ মিনিটে রাস্তার পাশের ঘাসের উপর বসে আট মিনিটের মতো জিরিয়ে নিলাম। একটা ট্রেন দেখলাম। সম্ভবত রাজশাহী থেকে আসছিলো- সিল্কসিটি এক্সপ্রেস। এমন সময় রাশেদুলের ফোন পেলাম। ও আমার ছোট ভাই। চট্টগ্রামে পড়াশোনা করে। জানতে পারলাম ঈদের ছুটিতে ঢাকায় এসেছে। আমার কথা শুনে ও খুশি হলো। ওর আর আমার খুব ইচ্ছা ছিল দুজনে মিলে একটা ট্যুরে যাবো। কিন্তু সময় সুযোগ আর হয়ে উঠেনি। আবার একাকী পথচলা শুরু হলো। একটা টোললিস্ট চোখে পড়লো। এরকম লিস্ট আমি এলেঙ্গা বাসস্ট্যান্ডের পরে সেতু এলাকায় ঢোকার মুখে একটা পেয়েছিলাম। এখন আমি লাম্পপোস্ট বসানো রাস্তা দিয়ে হাঁটছি।

বেলা দেড়টা নাগাদ সেতুর পূর্ব পার্শ্বের থানায় পৌঁছলাম। থানায় এসে সেই চারজন পুলিসের সাথে দেখা হলো। একটু আগেই তাদের গাড়িতে করে সামনে যেতে দেখেছিলাম। তবে এখানে আমার এমন একজনের সাথে পরিচয় হলো যিনি কিনা সমগ্র বাংলাদেশের পুলিস বিভাগের মধ্যে অনন্য। ওনার নাম কবি গোলাম মহিউদ্দিন! গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার থেকে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতিপ্রাপ্ত প্রথম (এবং সম্ভবত একমাত্র) কবি পুলিস তিনি। দীর্ঘ দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে ওনার কবিতা লিখার অভ্যাস। এই সুদীর্ঘ সময়ে উনি ত্রিশটার মত কাব্যগ্রন্থ লিখেছেন। কবিতার সংখ্যা তিনি নির্দিষ্ট করতে পারেননি। অথচ বড়ই আফসোসের বিষয় যে কেবল পুলিসে চাকরি করার কারণে তার দুটির বেশি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়নি। কাব্যগ্রন্থ দুটি হলো- “সভ্যতার রঙ” ও “শহর ফেরা মানুষ”। কবিতা ছাড়াও তিনি উপন্যাস (প্রায় ১২টি), প্রবন্ধ (১৫-১৬টি) ও গান (বিক্ষিপ্তভাবে ১০০ এর মতো) রচনা করেছেন। এটিএন বাংলায় ওনাকে নিয়ে একটা ডকুমেন্টারি হয়েছিলো। প্রায় দশ মিনিটের ঐ ডকুমেন্টারিটি ওনার মুঠোফোনে আমাকে দেখালেন। শেষে পকেট থেকে একটা কাগজ বের করে বললেন, আমার একটা কবিতা আপনাকে পড়ে শোনাই। অত্যন্ত চমৎকার একটা কবিতা। যমুনাকে নিয়ে লিখা। কবিতাটি শুনে আমি বুঝতে পারলাম উনি “পথে যেতে যেতে দেখলাম গাছে একটি ব্যাঙ ঝুলিতেছে” জাতীয় কবিতা লিখেন না। ওনার সাথে আমার প্রায়ই ফোনে কথা হয়। শেষ কথা হয় ২০১১ সালের ৩০ ডিসেম্বর। উনি তখন ওনার গ্রামের বাড়ি ছিলেন। নাটোরের লালপুর উপজেলার ময়না গ্রামে। আমাকে জানালেন পুলিসের চাকরি আর করবেন না। এটা তার আর ভালো লাগে না। ইতোমধ্যেই তিনি অবসরের জন্য দরখাস্ত করেছেন এবং তা গৃহীতও হয়েছে। ২০১২ সালের প্রথম দিন থেকে তার পেনশন জীবন শুরু হবে। চাকরির ১৩ বছর বাকি থাকতেই স্বেচ্ছায় অবসর নেওয়া এই মহিউদ্দিন ভাই সত্যিকারের একজন সাহিত্য অন্তঃপ্রান মানুষ। নিবেদিতপ্রাণ কবি।

মহিউদ্দিন ভাইয়ের সাথে আমি প্রায় ৩০ মিনিটের মত ছিলাম। বিদায়বেলায় উনি আমাকে এখানকার খাঁটি গোরুর দুধ খাওয়াতে চাইলেন। কিন্তু অনুরোধটি আমার প্রটোকলবহির্ভূত ছিল বিধায় রাখতে পারলাম না। দুপুর ০২:২৫ মিনিটে আবার যখন রাস্তায় নামলাম সেতুর টোলপ্লাজা থেকে আমি আর মাত্র দুই কিলোমিটার দূরে। সারা শরীর জুড়ে একটা শিহরণ বয়ে যাচ্ছিলো। ঠিক চৌদ্দ মিনিট পরে একটা গোলচত্বরে এসে পৌঁছলাম। এখানে রাস্তাটা ভাগ হয়ে জালের মতো তিনদিকে এঁকেবেঁকে চলে গেছে। বাঁদিকে অর্থাৎ দক্ষিণে অবস্থিত সেনাবাহিনীর কিছু স্থাপনা ও তাদের বাসভবন। উত্তর দিকের রাস্তা চলে গেছে ভূঞাপুরের দিকে। চত্বরের ওখানে এক লোক ঝালমুড়ি বিক্রি করছিলো। লোভ সামলাতে পারলাম না। দশ টাকার অর্ডার দিলাম। বানানো শেষে পরিমাণ দেখে আমার আক্কেলগুড়ুম। এই ঝালমুড়ি তো আশেপাশের সবাইকে দেওয়ার পরেও থেকে যাবে। পলিথিনে ভরে ভাতের মতো খেতে খেতে আবার রওয়ানা হলাম। ঝালমুড়িওয়ালাকেও এমনি জিজ্ঞাসা করেছিলাম যমুনা সেতু পায়ে হেঁটে পাড়ি দেওয়া যাবে কিনা। উনি এক কথায় বলে দিলেন- অসম্ভব। তার বক্তব্যের সারসংক্ষেপ মোটামুটি এই ছিল- আমি নাকি সেতুর ধারেকাছেও যেতে পারবো না। দুপুর ০২:৫৩ মিনিটে সেতুর পূর্বপ্রান্তের শেষ কিলোমিটার পোস্টটি পার হলাম। সেখানকার তথ্যমতে রাজশাহী যেতে হলে আমাকে আরও ২৩৬ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে হবে। আর ঢাকা সেই সুদূর ১২০ কিলোমিটার পিছনে। একটু পরে সেই কাঙ্ক্ষিত যমুনা সেতু আমার চোখের সামনে উদ্ভাসিত হলো।

বেলা তিনটা নাগাদ ওয়েট স্টেশন (Weigh station)–এ হাজির হলাম। যানবাহনের বিশেষ করে মালবাহী ট্রাকের অতিরিক্ত ওজন নির্ণয় করাই এই স্টেশনের কাজ। যাই হোক ওদের কাছে আমার আর্জি পেশ করলাম। এর ভার এত বেশি ছিল যে ওনারা তা মাপতে পারলেন না। তাই আমাকে ট্রাফিক কন্ট্রোল রুম (TCR) দেখিয়ে দিলেন। TCR-এ গিয়ে সরাসরি বললাম, আমি ঢাকা থেকে পায়ে হেঁটে বাংলাদেশের সর্বউত্তরে যাচ্ছি। তাই এই সেতু দিয়ে আমাকে হেঁটে যাবার অনুমতি দিন। ওখানকার ইন-চার্জ ছিলেন জনৈক আনিস সাহেব। উনি প্রথমে আমার কথা হজম করলেন; তারপর সেই ঝালমুড়িওয়ালার মতো বলে উঠলেন- অসম্ভব। আমি তাকে ঢাকা ইউনিভার্সিটি ট্যুরিস্ট সোসাইটি (DUTS)–র প্রেসিডেন্টের দেওয়া প্রত্যয়নপত্রটি দেখালাম। ঢাকা থেকেই আমি এই প্রত্যয়নপত্রটি নিয়ে গিয়েছিলাম। DUTS -এর আমি একজন নিবেদিতপ্রাণ অনিয়মিত সদস্য। তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ম্যাক ভাই নিজ হাতে আমাকে প্রত্যয়নপত্রটি লিখে দিলেন। সাথে বললেন ফিরে এসে যেন DUTS –এ নিয়মিত হই। এইসব কথা থাক। মূল প্রসঙ্গে ফিরি। কোথায় যেন ছিলাম? ওহ, আনিস সাহেব। তো তিনি আমার কথায় কিছুতেই রাজি হলেন না। ওনার সাথে অফিসে আরও কিছু মধ্যপদস্থ কর্মচারী ছিলেন। প্রত্যয়নপত্র ব্যর্থ হলে আমি ফোনপর্ব শুরু করি। প্রথমেই ফোন দেই ম্যাক ভাইকে। উনি আনিস সাহেবের সাথে কথা বললেন। কিন্তু তিনি তার সিদ্ধান্তে অটল, অবিচল। এরপর একে একে অনেককেই ফোন দেই। এমনকি ঢাকার এক প্রভাবশালী মন্ত্রীর পার্সোনাল অ্যাসিস্ট্যান্ট (অথবা ডানহাত) –এর পরিচয়েও কাজ হয়নি। ওনারা স্যার স্যার করলেন ঠিকই কিন্তু সিদ্ধান্ত পাল্টালেন না। এরকম পরিস্থিতির জন্য আমি তৈরি ছিলাম না। তাই প্রথমে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গিয়েছিলাম। ধীরে ধীরে পরিস্থিতি মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করলাম।

TCR থেকে আমি চলে গেলাম ওখানকার সেনাবাহিনীর চেকপোস্টে। ওনাদের কাছে সব বিস্তারিতভাবে খুলে বললাম। সব শুনে তারা তড়িৎ গতিতে কয়েক জায়গায় ফোন দিলেন। কিন্তু বিধিবাম। কিছুতেই কিছু হলো না। আমার ধারণা ছিল সেতুর সার্বিক তত্ত্বাবধান বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর হাতে। একসময় ছিল। কিন্তু পহেলা নভেম্বর, ২০১০ থেকে এর নির্বাহী ক্ষমতা এক বিদেশি কোম্পানির কাছে ন্যস্ত করা হয়। কিন্তু পদব্রজে সেতু ভ্রমণের অনুমতিদানের মতো অদ্ভুত ক্ষমতার হস্তান্তর হয়তো তখনো হয়নি। জায়গায় জায়গায় তখনো BBSO–র সাইনবোর্ড দেখছিলাম। BBSO মানে Bangabandhu Bridge Special Operation- তত্ত্বাবধানে Bangladesh Army। ফলে সদিচ্ছা থাকা সত্ত্বেও কেবল নির্বাহী ক্ষমতা না থাকায় সেনাবাহিনী আমাকে কোনো সাহায্য করতে পারলো না। অন্যদিকে নতুন এবং বিদেশি কোম্পানি হওয়াতে তারা (TCR) নিরাপত্তার খাতিরে পায়ে হেঁটে সেতু পার হতে দিচ্ছিলো না। সেনাবাহিনীর ওরা এখানকার মেইন অফিসে চেষ্টা করে দেখতে বললো। আমি কথামতো ওখানে গেলাম। কিন্তু শুক্র ও শনিবারে অফিস বন্ধ থাকে। সেনাসদস্যদের উপর কিছুটা রাগ হলো। বেটারা তো এখানেই থাকে। এই বিষয়টা কি জানতো না ওরা! আমি খুব হতাশ হয়ে পড়লাম; কিন্তু আশা ছাড়লাম না। বিষণ্ণ মনে আবার TCR অফিসে গেলাম। আবার অনুরোধ করলাম। কিন্তু ওনাদের সাফ কথা- পায়ে হেঁটে সেতু পার হওয়া যাবে না। এক পর্যায়ে ওনারা বললেন আমাকে অফিসের একটা গাড়িতে করে সেতু পার করে দেওয়া যেতো যদি আমি ঢাকাস্থ মহাখালীর সেতু ভবনের নির্বাহী পরিচালকের কাছ থেকে একটা প্রত্যয়নপত্র আনতে পারতাম। এটাই নাকি অন্য অভিযাত্রিকদের জন্য করা হয়। কিছুদিন আগেও চারজন বিদেশি সাইক্লিস্টকে এভাবেই গাড়িতে করে সেতু পার করে দেওয়া হয়েছিলো। সেখানে পায়ে হেঁটে...... উহু, কিছুতেই না।

চোখজুড়ে রাজ্যময় হতাশা। পৃথিবীর যেকোনো মানুষের একটা ক্ষমতা কমবেশি আছে। আর তা হলো- অন্যের চোখের ভাষা বোঝার ক্ষমতা। ওখানকার খাকি পোশাকের গার্ডরা আমার কষ্টটা উপলব্ধি করতে পারছিলেন। ওদের একজন আমাকে বললেন, আপনি খামোখা TCR –এ যেতে গেলেন কেন। লুকিয়ে লুকিয়ে সেতু পার হলেই তো পারতেন। যাই হোক আমি বুঝে গেলাম আজ আর আমার যমুনার ওপারে যাওয়া হচ্ছে না। ঠিক করলাম এখানকার কোনো মসজিদে রাতটা কাটিয়ে দেবো। এ ব্যাপারে একজন গার্ড আমাকে সাহায্য করলেন। উনি আমাকে যমুনা তীরবর্তী পটলকান্দির এক বাজারে নিয়ে গেলেন। পটলকান্দির এ বাজারের নাম যমুনা বাজার। পথে ওনাকে জিজ্ঞাসা করলাম আসলেই লুকিয়ে লুকিয়ে সেতু পার হওয়া যেতো কিনা। উনি বললেন যেতো না। আর যদি আমি কোনোভাবে সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে উঠেও যেতাম, সেতুর পর্যবেক্ষণ ক্যামেরায় ঠিকই ধরা পড়তাম। ব্যস, খেল খতম। আজ রাতটা তখন মহিউদ্দিন ভাইয়ের ওখানে গরাদের ভিতর কাটাতে হতো। সারারাত কবিতা শুনে পরদিন ঢাকায় চালান।

বিকাল ০৪:৪২ মিনিটে মৈত্রী এক্সপ্রেসকে দেখতে পেলাম। ঢাকা-কলকাতার মধ্যে যাতায়াতকারী এই ট্রেনটি তখন সেতু পার হয়ে ঢাকা যাচ্ছিলো। পরদিন আবার কলকাতার উদ্দেশ্যে যাত্রা করবে। সাথে আসা সেই গার্ড ভাই স্থানীয় এক মসজিদে আমার রাতে থাকার ব্যবস্থা করে দিলেন। আমি খুবই দুঃখিত যে তার নাম আমার মনে নেই। ক্রনিকলেও লিখতে পারিনি। তবে উনি যদি এখনও সেখানে চাকরি করেন তাহলে নাম না জানা থাকলেও যে কেউ ওনাকে খুঁজে বের করতে পারবেন কেবল একটা বৈশিষ্ট্যের কারণে। আর তা হলো ওনার অসাধারণ সুন্দর চেহারা। ছেলেরা এমন চোখ ধাঁধানো সুন্দর হয় আমার জানা ছিল না। যাই হোক উনি আমাকে একা রেখে বাসায় চলে গেলেন। আর আমি ঘুরে ঘুরে বাজারটা দেখতে লাগলাম। জমজমাট বাজার। সন্ধ্যার সময় ঘন গোরুর দুধ দিয়ে বানানো এক কাপ চা খেলাম। গোধূলির রক্তিম পশ্চিমাকাশ যেন বৃষ্টির ফোঁটার মতো বিষণ্ণটা ছড়িয়ে দিচ্ছিলো। দুইদিন আগেও এই গোধূলিলগ্নে আমি কি না করেছিলাম! আর আজ......। সময় সত্যিই এক পরিবর্তনশীল মাত্রা (Dimension)।

পটলকান্দির যমুনা বাজারে রাত নেমে এলো। ব্যাটারির চার্জার কিনতে এক দোকানে ঢুকলাম। দাম শুনে মনে হলো জিনিসটা সোনা-রূপা কিছু দিয়ে বানানো। তবে দোকানদার মানুষটা খুব ভালো ছিলেন। উনি একটা চার্জার দিয়ে আমার মোবাইল চার্জ করে দিলেন। মোটামুটি কাজ চালানোর মতো চার্জ হলো। ধীরে ধীরে আলাপ জমে উঠলো। ওনার নাম নজরুল। দোকানদারী ওনার মূল পেশা না। উনি মূলত একজন শিক্ষক। মগড়া বহুমুখী কারিগরী দাখিল মাদ্রাসার তরুণ শিক্ষক। প্রতিষ্ঠানটি কালিহাতী উপজেলার মগড়া ইউনিয়নে অবস্থিত। মাদ্রাসাটি এমপিওভুক্ত না হওয়াতে উনি দুঃখ প্রকাশ করলেন। আমি বললাম ঢাকা গিয়ে এ ব্যাপারে সাহায্য করবো। কিন্তু আজ অবধি কিছুই করতে পারিনি। যেখানে নিজের জন্যই মন্ত্রি-মিনিস্টারদের রেফারেন্স পাই না, সেখানে অন্যেরটা কিভাবে পাবো। নজরুল ভাই আজকের রাতটা ওনার বাড়িতে কাটাতে বললেন। রাত নয়টা কি সাড়ে নয়টা; দোকান বন্ধ করে আমাকে নিয়ে উনি চললেন গৃহপানে। মাঠের আইল ধরে এঁকেবেঁকে এক সময় ওনার বাড়ি পৌঁছলাম। সেদিন মুরগী রান্না হয়েছিলো। আমাকে তাই দিয়ে আপ্যায়ন করলেন। খাওয়া-দাওয়া সেরে ঘুমাতে গেলাম। কিন্তু সহজে ঘুম আসলো না। দূরে শুনতে পাচ্ছিলাম গাড়ির ছুটে চলার শব্দ। কেউ হয়তো এপারে আসছে কেউবা ওপারে। আমি কি পারবো? দেখা যাক কি হয় কাল সকালে।

বিঃ দ্রঃ এখানে বর্ণিত প্রতিটি ঘটনা সম্পূর্ণ সত্য

--------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
নিঃসঙ্গ অভিযাত্রিক


মন্তব্য

মরুদ্যান এর ছবি

চলুক।

তদানিন্তন পাঁঠা এর ছবি

চাল্লু চলুক পপকর্ন লইয়া গ্যালারীতে বইলাম

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।