এ্যাকাডেমিক পাবলিশিং-১

কুমার এর ছবি
লিখেছেন কুমার [অতিথি] (তারিখ: মঙ্গল, ১৪/০২/২০১২ - ৪:০৮পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

দিনকাল ভালই কাটছিল। ঘুমথেকে উঠে মাঝেমধ্যে ইউনিভার্সিটি যাই, দোকানের ঝাঁপি খুলি, কফি-বিড়ি খাই, দুই-চার জন বন্ধুবান্ধবের সাথে গালগল্প মারি, সন্ধেবেলা বাসায় ফিরে টিভি দেখি – লুপটা এই রকমই চলছিল। দেশে থাকতে ভালই ছিলাম, ভালমন্ধ খাইতে পারতাম, এদিক-সেদিক যাইতে পারতাম, আড্ডাবাজির রমরমা দিন আছিলো সেইগুলান। হঠাৎ করে বলা নাই কওয়া নাই, যাদের সাথে গুলতানি মারতাম তাদের সিংহভাগই মেধাপাচারের শিকার হল। কিন্তু আমি বাংলার বাঘ হয়ে বীরদ‌‌‌‌পে নিজের মেধা বাঁচিয়ে রাখছিলাম। কিন্তু কয়েকদিন যাইতে না যাইতেই আর ভাল্লাগেনা, গায়ের মধ্যে কেমন কেমন লাগে। বন্ধুবান্ধবেরা খালি কয় আয়া পড়। আমি ও বাক্স-পেটরা নিয়ে আয়া পড়লাম। প্রথমদিকে অবশ্য ভালই ছিলাম, পরে পড়লাম জীবন চোষে অবস্হায়।

আমার সুপারভাইজার শুধান ওহে বৎস্য অনেককাল তো অতিবাহিত হল, তোমার গবেষণালদ্ধ ফলাফল কোথায়? তুমি কি চাহ আমি থানাদার ডাকি? আমিও প্রত্যেক সপ্তাহে ভুগিছুগি বুঝানো ছেড়ে দিয়ে কাজে মনোনিবেশ করলাম। কিন্তু রিসার্চ আমার কম্ম নহে। পুলাপানে দেখি হাতঝাড়া মারে আর পাবলিশ করে। কিছুদিনের মধ্যে বুঝলাম ঐগুলান আমার কাম না, ইবলিশ এর কাম! আন্ডারগ্রাড থাকাকালীন ক্লাসের উচ্চ জিপিএধারীদের বলতাম তোদের বিদেশযাত্রা ছাড়া গতি নাই, দেশে তোদের চাকরী নাই। আর এখন গ্র্যাজুয়েট লেভেলে এসে দলিল লেখকদের বলি তোদের বিদেশেও চাকরী নাই। বদলোকের একটু সান্ত্বনা হয় এতে। এইখানে এক চীনা ছাত্রকে জানি, যার ছয় বছরের গ্র্যাজুয়েট “লাইফ” শেষে পাবলিশড আর্টিকেল ছিল মাত্র পয়ত্রিশখানি (বেশীরভাগই প্রথম লেখক হিসাবে, বেশীরভাগই আই.ট্রিপল.ই তে), পেটেন্ট মাত্র সাতখানি, সাথে শখানেক কনফারেঞ্চ প্রসিডংস তো ছিলই। এরা ভাই বিখ্যাত লোক, ফি বছর মেডেল টেডেল পায়।

যাইহোক, কিছু কুখ্যাত লোককে নিয়ে লিখবো ভাবছিলাম, তেমনই একজন ডাঃ অনিল পট্টি। ভারতীয় এই ভদ্রলোক ভেলোর থেকে এমবিবিএস নিয়ে ইউনিভার্সিটি অফ নর্থ ডাকোটার মেডিসিন এবং হেল্‌থ সায়েন্স বিভাগে রেসিডেন্সী করেন। পরে ডিউক ইউনিভার্সিটির অনকোলজী বিভাগের একজন ফেলো হন। তিনি ডিউকে থাকাকালীন ক্যান্সার টিউমর এবং কিমোথেরাপীর রিসার্চ নিয়ে যুগান্তকারী কিছু দিকনির্দেশনা দেন। কিমোথেরাপী শুধুমাত্র টার্গেট টিউমর ছেল কেই নষ্ট করে না, ভাল কোষের ও ক্ষতি করে। কিন্ত পট্টির গবেষণালদ্ধ ফলাফল ছিল এইরকম, প্রত্যেক মানুষের ডি.এন.এ. যেমন মৌলিক, তেমনি কিমোথেরাপীও জেনটিক কোডিং অনুযায়ী ম্যাপ করা হবে। তাহলে ভাল কোষের ক্ষতি হবে না, শুধুমাত্র টার্গেট টিউমর নষ্ট হবে। পট্টির দাবী তারা সফল এবং এই পদ্ধতি ক্যান্সারের অ্যাডভাঞ্চড পরযায়ে ও সমান ফল দিবে। ডিউক ইউনিভার্সিটি ফলাও করে প্রচার করে এই সাফল্য সেইসাথে পট্টিও রাতারাতি বিখ্যাত হয়ে যান। পট্টির গবেষণালদ্ধ ফলাফল নামকরা সাময়িকীতে প্রকাশ পায়। অনেক মরণাপন্ন ক্যান্সার রোগী ডিউক ইউনিভার্সিটিতে যোগাযোগ করেন তাদের শেষ ভরসা হিসাবে। কিন্তু সায়েন্টিফিক কম্মুনিটি হল বিশ্বনিন্দুক। তারা হিউম্যান ট্রায়ালের পূর্বে পট্টির গবেষণালদ্ধ ফলাফল ভেরিফাই করার চেষ্টা করেন এবং মারাত্মক রকমের ভুল দেখতে পান। সায়েন্টিস্টরা সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে পট্টি বড়মাপের ফলাফল কারচুপি করেছেন, ফলস্বরূপ তাকে তিরস্কার করা হয় এবং ডিউক থেকে বের করে দেওয়া হয় ২০১০ সালে। পট্টির আর্টিকেল গুলো নামিয়ে নেওয়া (রিট্রাকটেড) হয়। শুধু তাই নয়, পট্টির যাবতীয় রিসার্চ, জীবনবৃত্তান্ত পুনরায় যাচাই করা হয়। এখানেও পাওয়া যায় পুকুরচুরি। ব্যাটা জীবনবৃত্তান্তে লিখেছে রোডে স্কলার, কিন্তু তিনি তা নন। আর এই রোডে স্কলার লিখে তিনি বিশাল অঙ্কের একটা গ্রান্টও হাতিয়ে নিয়েছেন। পট্টির এই ঘটনাকে সায়েন্টিফিক কম্মুনিটি আখ্যায়িত করেছে এ যাবৎ কালের সবচেয়ে বড় মেডিকেল রিসার্চ জালিয়াতি হিসাবে। সি.বি.এস সম্প্রতি ৬০ মিনিটস এ ডাঃ অনিল পট্টির রিসার্চ নিয়ে একটা ফিচার করেছে। পট্টি এখন কই? বর্তমানে পট্টি তার অনলাইন ইমেজ পুনরুদ্ধারের কাজে নিয়োজিত, তার কিছু নমুনা পাবেন এইখানে।

যাইহোক, দুই একটা আর্টিকেল যে লিখবো, কিন্তু লিখে কি হবে? ছাপাবে কে? সবজায়গাতেই খালি পিয়ার রিভিউ। কষ্ট করে লিখলাম, কিছুদিন পর মেইল পাব-রিগ্রেট এবং ফিউচার এনডেভার। এইখানেও বদলোকের সান্ত্বনা আছে। আইন্সটাইনের কোনো আর্টিকেলই পিয়ার রিভিউড ছিল না। আইন্সটাইন সাহস করে একবার একটা পিয়ার রিভিউতে জমা দিয়েছিলেন, সাথে সাথে গদাম করে রিজেক্টেড। সবকথার শেষ কথা, আগে একটা চাকরী বাগাই, পরে বলবো আমার ফিল্ডে পাবলিকেশন সোজা না, খুব খুব কঠিন। আর না হয় আমার প্রফ অনেক সিনিওর, পাবলিকেশনের ধার ধারে না।

চলবে. . . . . . . .

কুমার


মন্তব্য

প্রদীপ্তময় সাহা এর ছবি

পপকর্ন লইয়া গ্যালারীতে বইলাম

চালিয়ে যান ।
অপেক্ষায় থাকলাম ।

ভালো মানুষ এর ছবি

উত্তম জাঝা!
খুবি ভাল লিখছেনঃ)

কুমার এর ছবি

প্রদীপ্তময় এবং ভালো মানুষ: মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ।

শেহাব- এর ছবি

আমি এইবার ভেবে ছিলাম পি.এইচ.ডি. র ফাঁকতালে রিসার্চ বেইজড মাস্টার্স নিয়ে রাখব এই সেমিস্টারে। প্রফ কয় মাস্টার্স থিসিস রেফারিড জার্নালে পাবলিশড হতে হবে। আমি ঠান্ডা মেরে গেলাম।

স্বপ্নাদিষ্ট এর ছবি

কস্কি মমিন!

-স্বপ্নাদিষ্ট
=======================
যে জাতি নিজের ভাগ্য নিজে পরিবর্তন করে না, আল্লাহ তার ভাগ্য পরিবর্তন করেন না।

কুমার এর ছবি

শেহাব, মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ।
মাস্টার্স একটা নিয়েই ফেলুন। ঘরে একটা ডিগ্রী আসুক। ধৈর্য্য নিয়ে লিখে দেখুন না কি হয়।

কিম্ভূত এর ছবি

পপকর্ন লইয়া গ্যালারীতে বইলাম
চলুক।

স্বপ্নাদিষ্ট এর ছবি

পরের পর্বের অপেক্ষায় থাকলাম। লেখায় চলুক পট্টিরে ইটা রাইখ্যা গেলাম...

-স্বপ্নাদিষ্ট
=======================
যে জাতি নিজের ভাগ্য নিজে পরিবর্তন করে না, আল্লাহ তার ভাগ্য পরিবর্তন করেন না।

সৃষ্টিছাড়া এর ছবি

চলুক পপকর্ন লইয়া গ্যালারীতে বইলাম

কুমার এর ছবি

কিম্ভূত, স্বপ্নাদিষ্ট, সৃষ্টিছাড়া: অনেক ধন্যবাদ।

দ্যা রিডার এর ছবি

চালান , পড়ছি । হাসি

কুমার এর ছবি

ধন্যবাদ রিডারকে।

যাযাবর এর ছবি

গুল্লি

জয়ন্ত এর ছবি

নাম যার পট্টি সে তো পট্টি দেবেই। কিন্তু পট্টি দিয়েও সে নিজের মেডিকেল লাইসেন্স বজায় রাখতে পেরেছে এটা খুব কম কথা নয়।

কুমার এর ছবি

লাইছেন্সের কেসের নিস্পত্তি হয়েছে কিনা জানিনা। পড়ার জন্য ধন্যবাদ।

নিটোল এর ছবি

চলুক

_________________
[খোমাখাতা]

কুমার এর ছবি

ধন্যবাদ নিটোল ভাই।

ফাহিম হাসান এর ছবি

কুমার ভাই, লেখাটা একদম ঝরঝরে, মুচমুচে, সুস্বাদু হয়েছে।

কুমার এর ছবি

অনেক ধন্যবাদ ফাহিম ভাই। আপনের লেখা ভালু পাই।

অচল  এর ছবি

ভাল পা‌ইলাম লেখাটা (গুড়)

ত্রিমাত্রিক কবি এর ছবি

লেখায় উত্তম জাঝা!

_ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _
একজীবনের অপূর্ণ সাধ মেটাতে চাই
আরেক জীবন, চতুর্দিকের সর্বব্যাপী জীবন্ত সুখ
সবকিছুতে আমার একটা হিস্যা তো চাই

কুমার এর ছবি

ধন্যবাদ কবি ভাই।

ব্যাঙের ছাতা এর ছবি

আপনার লেখাটি পড়ে ভাল লেগেছে। প্রথম প্যারার শেষ লাইনে "লাইফ চোষে" পর্যন্ত পড়ে যেমনটা মনে হয়েছিল, তেমনই এখারা গড়নের লেখা। আমার পরিধি খুব ছোট, তারপরও বলছি, যতটুকুই পড়ার চেষ্টা করেছি, করছি; সেইজায়গা থেকেই বলছি, আপনার লেখার হাত ভাল। আরো লিখুন। আরো কিছু জানান আমাদের। চলুক
লেখায় (গুড়)

কুমার এর ছবি

খাইছে

অনার্য সঙ্গীত এর ছবি

পপকর্ন লইয়া গ্যালারীতে বইলাম
দারুণ। খালি আরেকটু টেনে লম্বা করেন লেখা। এই লেখাটা চোখ এড়িয়ে গিয়েছিল। এসে পড়ে গেলাম। হাসি

______________________
নিজের ভেতর কোথায় সে তীব্র মানুষ!
অক্ষর যাপন

কুমার এর ছবি

ধন্যবাদ

সবুজ পাহাড়ের রাজা এর ছবি
কুমার এর ছবি

ধন্যবাদ

শাব্দিক এর ছবি

চলুক

অতিথি লেখক এর ছবি

তবুও গো যোগে এষণা এগিয়ে যায়, যেতে থাকে

তুষার রায়

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।