বিজ্ঞানে দৈবের বশে

কুমার এর ছবি
লিখেছেন কুমার [অতিথি] (তারিখ: শুক্র, ২৩/০৩/২০১২ - ৯:৪৫অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

ভায়াগ্রা

ঔষধ কোম্পানি ফাইজারের (Pfizer) গবেষণাগারে সায়মন ক্যাম্পবেল আর ডেভিড রবার্টস উচ্চ রক্তচাপ ও অ্যাঞ্জিনা/অ্যাঞ্জাইনা (angina) নামক
হার্টের অসুখ নিয়ন্ত্রণের জন্য একটি ঔষধ উদ্ভাবন করেন। গবেষণাগারে সফল পরীক্ষা-নিরীক্ষা পর ১৯৮০ সনের শেষের দিকে উদ্ভাবিত ঔষধটি
হিউম্যান ট্রায়ালের অনুমতি পায়। উচ্চ রক্তচাপ বা হার্টের অসুখ নিয়ন্ত্রণে কার্যকারী কোন ফলাফল না পেলেও, সেবনকারীরা পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হিসাবে তাঁদের হাম্বানটোটার উত্থিত দশা রিপোর্ট করেন। ফাইজার ঔষধটি হার্টের অসুখের চিকিৎসার পরিবর্তে অনুত্থিত মোগাদিশুর চিকিৎসার কাজে ব্যবহার করার পরিকল্পনা করে। পরবর্তীতে হিউম্যান ট্রায়ালে ঔষধটির কার্যক্ষমতা প্রমানিত হয়, ১৯৯৮ সনে আম্রিকান সরকার ঔষধটি ব্যবহারের ছাড়পত্র দেয়।

স্যকারিন

ঘটনাকাল ১৮৭৯ সন। কন্সশটান্টিন ফ্যলবার্গ জন্স হপকিন্স ইউনিভার্সিটির গবেষণাগারে অধ্যাপক আইরা রেমসেনের সহযোগীতায় আলকাতরা থেকে নতুন কোন রাসায়নিক যৌগ সংশ্লেষণের চেষ্টা করছিলেন। সারাদিন কাজ শেষে প্রচণ্ড ক্ষুধার্ত ফ্যলবার্গ বাসায় ফিরে হাত না ধুয়েই ময়লা হাতে খাওয়া শুরু করেন। ফ্যলবার্গের মনে হয় অন্যান্য দিনের তুলনায় আজকের খাবার স্বাদে অনেক মিষ্টি। বিবিকে ডেকে খাবার মিষ্টি হওয়ার কারণ জানতে চান। বিবি জানায় খাবারে কোন বাড়তি মিষ্টি দেয়া হয়নি। ফ্যলবার্গ দুয়ে দুয়ে চার মিলিয়ে ফেলেন, বুঝতে পারেন হাতে লেগে থাকা ময়লাই বাড়তি মিষ্টতার কারণ। এভাবেই ঘটনাচক্রে ফ্যলবার্গ স্যকারিন আবিষ্কার করেন। পরবর্তীতে ফ্যলবার্গ রেমসেনকে বাদ দিয়ে নিজের নামে স্যকারিনের পেটেন্ট করান। ফ্যলবার্গ-রেমসেনের দা-কুমড়া সম্পর্কের শুরুও তখন থেকে।

মাইক্রোওয়েভ ওভেন

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় উপুর্যপরি লাগাতার জার্মান যুদ্ধবিমানের আক্রমণে পর্যুদস্ত আম্রিকা তার রাডারযন্ত্রের খোল নলচে পালটানোর সিদ্ধান্ত নেয়। স্ব-শিক্ষিত প্রকৌশলী-বিজ্ঞানী পার্সি স্পেনসার আম্রিকার সবচেয়ে বড় মিসাইল নির্মাতা প্রতিষ্ঠান রেথিয়ন কোম্পানীর ল্যাবে রাডারযন্ত্র ও এতে শক্তি প্রদানকারী ম্যাগনেট্রন নাড়াচাড়া করার সময় তাঁর প্যান্টের মধ্যে অদ্ভুত এক অনুভূতি পান। পার্সি স্পেনসার পকেটে হাত দিয়ে দেখতে পান তাঁর পকেটে থাকা ক্যান্ডি চকলেট গলে শেষ। এরপর স্পেনসার ভুট্টা ও অন্যান্য খাদ্যদ্রব্য নিয়ে ম্যাগনেট্রনের সামনে নাড়াচাড়া করেন, ভুট্টা পপকর্ন হয়ে সারা ঘর জুড়ে ছড়িয়ে পড়ে, খাদ্যদ্রব্যও গরম হয়ে যায়। এভাবেই ১৯৪৬ সনে পার্সি স্পেনসার সামরিক গবেষণাগারে মাইক্রোওয়েভ ওভেন উদ্ভাবন করেন। স্পেনসারের ভাগ্য ভাল শুধুমাত্র চকলেটই গলে, অন্য কিছু নয়।

এক্সরে বা রঞ্জন রশ্মি

১৮৯৫ সনে উইলহেল্ম রেন্টগ্যান তাঁর নিজের গবেষণাগারে বন্ধুদের কাছ থেকে ধারকরা বায়ুশূন্য নলের মধ্যে দিয়ে ইলেকট্রিক ডিসচার্জ চালনা করার বাহ্যিক ফলাফল প্রত্যক্ষ করার চেষ্টা করেন। রেন্টগ্যান ক্যাথোড রশ্মির জন্য শক্তিশালী ইলেকট্রোস্টাটিক ফিল্ড তৈরী করেন সাথে সাথে কার্ডবোর্ড দিয়ে নল থেকে রশ্মি বের হওয়ার পথে ব্যবহৃত এলুমিনিয়ামের সুরক্ষারও বন্দোবস্ত করেন। ক্যাথোড রশ্মি অদৃশ্যমান, আবার কার্ডবোর্ড দিয়ে ঢাকা থাকার পরেও রেন্টগ্যান বেরিয়াম দিয়ে রঙ করা আরেকটি ছোট কার্ডবোর্ডের প্লেটের উপর ফ্লুরোসেন্টের মত আলোর নাচন দেখতে পান। গণিতের অজানা সবকিছুকে যেমন X দিয়ে চিহ্নিত করা হয়, রেন্টগ্যান তেমনি এই অজানা রশ্মির নাম দেন X-Ray। এক্সরে আবিষ্কারের পুরস্কারস্বরূপ রেন্টগ্যানকে পদার্থ বিজ্ঞানের প্রথম নোবেল পুরস্কারে ভূষিত করা হয় ১৯০১ সনে। রেন্টগ্যান নিসন্তান ছিলেন, তাঁর ক্যান্সারে মৃত্যুও মাত্রাতিরিক্ত রেডিয়েশনের কারণে ধারণা করা হয়। রেন্টগ্যানের ইচ্ছা অনুযায়ী মৃত্যুর পর তাঁর ব্যবহৃত সকল কিছু ধ্বংস করা হয়।

ভালকানাইজড রাবার

চার্লস ১২ বছর ধরে রাবারকে একটা টেকসই চেহারা দেওয়ার, শীত গ্রীষ্মে সকল তাপমাত্রায় ব্যবহার করার মত একটা রূপ দেয়ার প্রাণান্তকর চেষ্টা করেন। কিন্তু সাফল্য ধরা দেয় না কোনভাবেই। চার্লস ভুল করে একদিন রাবার জ্বাল দেয়ার সময় পাত্রের মধ্যে গন্ধক আর সীসা ফেলে দেন। পরে দেখা যায় রাবার কিছুটা শক্ত হলেও আগের চেয়ে অনেক বেশী ব্যবহারোপযোগী হয়েছে, বেড়েছে তাপমাত্রা প্রতিরোধক্ষমতা। উদ্ভাবন হলো ভালকানাইজড রাবারের। গাড়ীর টায়ার থেকে জুতার তলী কোথায় নাই এই ভালকানাইজড রাবার! চার্লস গুডইয়ারের সম্মানে গুডইয়ার টায়ার কোম্পানি তাঁদের কোম্পানির নামকরণ করেন।

কোক

আম্রিকার গৃহযুদ্ধে আহত সৈনিক জন পেম্বারটন ব্যথানাশক হিসাবে মরফিন সেবন করে মারাত্মকভাবে আসক্ত হয়ে পড়েন। পেশায় ফার্মাসিস্ট-কেমিস্ট পেম্বারটন এই আসক্তি থেকে মুক্তির, মাথাব্যথার উপশমকারী একটা ঔষধ তৈরীর চেষ্টা করছিলেন। পেম্বারটন আফ্রিকান কোকা (Coca) পাতা আর কোলা (Cola) বাদাম মিশিয়ে ঘুটে একটা কবিরাজি পানীয় তৈরী করেন ১৮৬৫ সনে। কোকা পাতা আর কোলা বাদাম দুইটিই প্রচণ্ড উদ্দীপক জড়িবুটি। পেম্বারটন তাঁর উদ্ভাবিত পানীয়টিকে ব্রেইন টনিক নাম দেন, মাথাব্যথার উপশমকারী, ক্লান্তি দূরকারী, পুরুষত্ব বৃদ্ধিকারী, নার্ভ শিথিলকারী সুস্বাদু পানীয় বলে উল্লেখ করেন। উদ্ভাবনের প্রথম আট বছর পানীয়টি শুধুমাত্র অল্প কিছু ড্রাগ স্টোরেই পাওয়া যেত। পেম্বারটন কোকাকোলার বাণিজ্যে বিশেষ সুবিধা করতে না পেরে ১৮৮৭ সনে ব্যবসা বিক্রি করে দেন। নতুন মালিক কোকাকোলার মধ্যে থেকে নারকোটিক উপাদান দূর করেন, পণ্যের বিজ্ঞাপনে বিশেষ মনোযোগ দেন, স্বাস্থ্য সংক্রান্ত গুনাগুণ কীর্ত্তন বন্ধ করেন, কোকাকোলা শুধু সতেজ ঝরঝরে চনমনে দিল ঠাণ্ডা করে বলে প্রচার করেন। ব্যাস। কোকাকোলার আসল রেসিপি-অনুপাত আজও অজানা, সিক্রেট ইনগ্রেডিয়েন্ট কোম্পানির কয়েকজন হোমরা চোমড়াই শুধু নাকি জানেন। প্রতিদ্ধন্দিরা নানা রকম কুৎসা রটায়, কেউ বলে সিক্রেট ইনগ্রেডিয়েন্ট না ছাই। কোকাকোলাই হয়ত একদিন বলবে, দেয়ার ইজ নো সিক্রেট ইনগ্রেডিয়েন্ট; টু মেক সামথিং স্পেশাল, ইউ জাস্ট হ্যাভ টু বিলিভ ইটজ স্পেশাল।

(চলতে পারে, নাও পারে)

কুমার


মন্তব্য

অনার্য সঙ্গীত এর ছবি

ভালো হচ্ছে। চলুক।

তবে লাইনগুলো কখনো কখনো অনেক লম্বা। একলাইনে ঠেসে অনেকখানি তথ্য গুঁজে লেখক পালাচ্ছে বলে মনে হয়! একটু কম তথ্যের ছোট অথচ বেশি লাইন পড়তে সুবিধে। মগজেও সহজে ঢোকে হাসি

______________________
নিজের ভেতর কোথায় সে তীব্র মানুষ!
অক্ষর যাপন

প্রদীপ্তময় সাহা এর ছবি

একদম মনের কথা বলেছেন ভাই ।
হাততালি

কুমার এর ছবি

আমারও মনে থাকবে লেখার সময়।

কুমার এর ছবি

পালাইনি অনার্যদা। পাঠকের সুবিধার ব্যাপারটি মাথায় রাখলাম।
ধন্যবাদ

প্রদীপ্তময় সাহা এর ছবি

বিষয়বস্তু খুবই আকর্ষণীয় । চালিয়ে যান ।
লাইন পিছু তথ্য একটু বেশি বলে অনেক সময় আবার পেছন ফিরে পড়ে তথ্য গুলো মাথায় ঢোকাতে হচ্ছে ।

কুমার এর ছবি

চলতে পারে বলছেন?
অনেক ধন্যবাদ প্রদীপ্তদা।

প্রদীপ্তময় সাহা এর ছবি

অবশ্যই ।
চলছে চলবে ।চলছে চলবে । হাসি

সৌরভ কবীর  এর ছবি

চলুক

কুমার এর ছবি

সৌরভ কবীরকে ধন্যবাদ পড়ার জন্য।

সবুজ পাহাড়ের রাজা এর ছবি

অনেক অজানা বিষয় জানলাম।
ভালো হচ্ছে। চলুক।
চলুক

কুমার এর ছবি

ধন্যবাদ রাজাভাই।

কাজি_মামুন এর ছবি

দৈবের বশে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো বিশেষ করে ভায়াগ্রা আর স্যকারিনের কাহিনী খুব ভাল লাগল। দৈবের বশে কিন্তু বিজ্ঞানের অনেক তাত্ত্বিক আবিষ্কারও হয়েছে! এই আকর্ষনীয় সিরিজটির দীর্ঘায়ু কামনা করছি।

কুমার এর ছবি

চলতে পারে যখন বলছেন চলবে হয়ত। আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।

সত্যপীর এর ছবি

স্পেনসারের ভাগ্য ভাল শুধুমাত্র চকলেটই গলে, অন্য কিছু নয়।

হো হো হো

দুর্দান্ত পোস্ট। পাঁচতারা।

..................................................................
#Banshibir.

প্রদীপ্তময় সাহা এর ছবি

পীর দাদা, আপনি তো মোক্ষম লাইন কোট করছেন ।
আবার ননস্টপ হাসি চালু করলাম ।
এইবারে আমারে লুকে পাগল কোবো । গড়াগড়ি দিয়া হাসি

কুমার এর ছবি

পীর পুংটা খুউব।

কুমার এর ছবি

ধন্যবাদ পীরব্রো।

ত্রিমাত্রিক কবি (লগিন করলাম না) এর ছবি

চলুক

কুমার এর ছবি

অনেক ধন্যবাদ কবি।

তারেক অণু এর ছবি
কুমার এর ছবি

অনেক ধন্যবাদ অণুদা।

আনোয়ার এর ছবি

চলুক

কুমার এর ছবি

ধন্যবাদ আনোয়ার ভাই।

shafi.m এর ছবি

বাহ! দারুন তথ্য তো। চলিয়ে যান। চলুক

কোলা বাদামের ইংরেজি হয়ত Kola nut। wikipedia তে তাই দেখেছিলাম মনে হচ্ছে।

শাফি।

কুমার এর ছবি

ধন্যবাদ শাফি ভাই। Kola nut ঠিকাছে। স্পেছিসঃ cola
coca-cola অরিজিন দেখানোর জন্য cola লিখেছি

কুমার এর ছবি

স্পেছিস genus: cola

Bunan এর ছবি

দৈবের বশে নিউটনের মাথায় আপেল পরার কথাটাও বলুন

কুমার এর ছবি

তাত্ত্বিক আবিষ্কার নিয়েও একটা সিরিজ হইতে পারে।
ধন্যবাদ বুনানকে।

ব্যঙের ছাতা এর ছবি

চলুক
চলুক চলুক। মাইক্রোওভেনেরটা জানা ছিল না। ভালো লেগেছে। তবে শেষের প্যারাতে শব্দটা হবে "প্রতিদ্বন্দ্বী" "প্রতিদ্ধন্দি" নয়। আর শেষের লাইনটা কোটেশনের মধ্যে দেখালে মনে হয় ভাল হত হাসি

পরের পর্বের অপেক্ষায় থাকলাম।

কুমার এর ছবি

ধন্যবাদ

আশালতা এর ছবি

ভালো হচ্ছে। চলুক।

----------------
স্বপ্ন হোক শক্তি

কুমার এর ছবি

ধন্যবাদ

নৈষাদ এর ছবি

চমৎকার। 'অণুগল্প' ট্যাগটা কিছুটা মিসলিডিং মনে হল।

কুমার এর ছবি

আপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা-

স্বাধীন এর ছবি

চলুক

কুমার এর ছবি

ধন্যবাদ

অতিথি লেখক এর ছবি

আমার মজা লেগেছে সেলাই মেশিন আবিষ্কারের কাহিনি। ইলিয়াস হাউস অনেকদিন থেকে চিন্তা করছিলেন সেলাই মেশিন বানানোর, কিন্তু সুঁইয়ের পেছনের সুতা ঢুকানোর ফুটোটাকে কিছুতেই মেশিনের মধ‌্যে আনতে পারছিলেন না। একদিন স্বপ্নে দেখেন তিনি আফ্রিকার এক স্থানীয় রাজার হাতে বন্দী, রাজা তাঁকে হুকুম দিলেন সেলাই মেশিন বানানোর। কিন্তু বিধি বাম, স্বপ্নে বানানো হলো না সেলাই মেশিন। রাজা হুকুম দিলেন "একে হত্যা করো"। যেই কথা সেই কাজ, একদল কাফ্রী বর্শা হাতে মারতে এলো হাউসকে। হাউস দেখেন তাদের বর্শার ফলকের মাথায় ফুটো করা। ঘুম ভেঙে গেলেও হাউসের মাথায় থেকে গেলো "বর্শার মাথায় ফুটো"। ব‌্যস, সেখান থেকেই সমাধান হয়ে গেলো তাঁর সমস্যার, আর তৈরী হয়ে গেলো সেলাই মেশিন।

-অয়ন

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।