বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে নদী খনন -১

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: শনি, ৩১/০৩/২০১২ - ১০:৫১অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

নদী খনন বা ড্রেজিং হচ্ছে বছরের পর বছর ধরে প্রবাহের কারনে নদীর তলদেশে যে পলি জমা হয় তার অপসারন।বাংলাদেশের ভৌগলিক অবস্হান আর নদী অববাহিকার বৈশিষ্ট্যগত কারনে নদী খনন একটি অত্যন্ত গুরত্বপূর্ণ বিষয়।সেই সাথে নদী খননের সাথে অর্থনৈতিক বিষয়টিও ওতপ্রোত ভাবে জড়িত। এই ধারাবাহিকের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে বাংলাদেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে নদী খননের প্রয়োজনীয়তা, কয়েকটি চলমান নদী খনন প্রকল্প নিয়ে পর্যালোচনা এবং সেই সাথে এবিষয়ে ভবিষ্যতে করনীয় দিকগুলো নিয়ে আলোচনা করা। আই.ডাব্লিউ.এম এর নদী প্রকৌশল বিভাগে প্রায় আড়াই বছর কাজ করার সুবাধে দেশের চলমান বেশ কয়েকটি নদী খনন প্রকল্পে গভীরভাবে কাজ করার সু্যোগ হয়েছিল। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য প্রকল্পগুলো হচ্ছে "গড়াই নদী পুনরুদ্ধার প্রকল্প-২" এবং "পুরাতন মধুমতি নদী খনন প্রকল্প"। আমি মূলত এই দুটি অতি গুরুত্বপূর্ন প্রকল্পের খুটিনাটি দিকগুলোর উপর আলোকপাত করব। আশা করি আপনারা আমার সাথেই থাকবেন এবং আপনাদের মতামত দিবেন।

নদী খনন নিয়ে আলোচনা শুরুর আগে বাংলাদেশের নদীগুলোর ভৌগলিক অবস্হান আর তার সাথে আমাদের দেশে নদী খনন কেন এত গুরত্বপূর্ণ তা নিয়ে একটু আলোচনা করা যাক। ছোট, বড় মিলিয়ে বাংলাদেশের নদীর সংখ্যা প্রায় ৭০০। কিন্তু আমাদের প্রধান পলিবাহিত নদীগুলো হচ্ছে পদ্মা, যমুনা, তিস্তা, মেঘনা। এটা হয়তো আমরা অনেকেই জানি মূলতঃ বাংলদেশের নদীগুলোকে চারটি প্রধান অববাহিকায় ভাগ করা হয়েছে।
১. গঙ্গা অববাহিকা
২. যমুনা অববাহিকা।
৩. সুরমা-মেঘনা অববাহিকা
৪. চট্টগ্রাম এর পাহাড়ী নদী অববাহিকা।

মজার ব্যপার হচ্ছে এত নদী থাকা সত্বেও খুব কমই নদীই আছে যার উৎপত্তি বাংলাদেশে। বেশিরভাগ বড় নদীর উৎপত্তি হয়েছে হিমালয় থেকে। হিমালয় থেকে জন্ম নেয়া নদীগুলো অনেক পথ পাড়ি দিয়ে আমাদের দেশে প্রবেশ করে আর শেষ হয় বঙ্গোপসাগরে গিয়ে আর সাথে করে নিয়ে আসে প্রচুর পরিমানে পলি।শুনলে অবাক লাগে সারা বছরে প্রবাহিত এই পলির মোট পরিমান প্রায় ২.৪ বিলিয়ন টন। মনে প্রশ্ন জাগে এত এত পলি কোথায় যায়?

আমরা জানি, বাংলাদেশ মূলতঃ সমতল ভূমির দেশ। হিমায়লের খাড়া ঢাল বেয়ে তুমুল বেগে প্রবাহিত নদীগুলো সমতলে প্রবেশ করে ধীরে ধীরে তার গতি হারাতে থাকে আর সেই কারনেই নদীর সাথে আসা পলি জমা হতে থাকে নদীর তলদেশে। মেঘনার মোহনায় এই পলি জমার হার সবচেয়ে বেশি কেননা বঙ্গোপসাগরের পানির উচ্চতা আর মেঘনা মোহনার পানির উচ্চতা প্রায় সমান হবার কারনে মোহনায় সাগর অভিমূখী প্রবাহ খুবই কম। (ব-দ্বীপ সৃষ্টির এটি একটি কারন।)বছরের পর বছর ধরে নদীগুলোতে জমতে থাকা পলি নদীর পানি ধারন ক্ষমতা বিপুল ভাবে কমিয়ে দেয় যা পরবর্তীতে নদীকে একপ্রকার মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয় । তখন নদীকে জীবিত রাখতেই প্রয়োজন পড়ে খননের।

এতো গেলো নদীতে পলি জমার প্রাকৃতিক কারন। মানবসৃষ্ট কারনে এই পলি জমার হার প্রচুর পরিমানে বেড়ে যায়। বাঁধ, ব্যারেজ নির্মানের ফলে নদীর স্বাভাবিক পানি প্রবাহ এবং সেই সাথে পলি প্রবাহ বাধাগ্রস্হ হয়। ফারাক্কা ব্যারেজ নির্মানের কারনে পদ্মা নদীর প্রবাহ ভয়াবহ ভাবে কমে যায় যার প্রভাব পড়ে গড়াই নদীর উপর। এককালের খরস্রোতা রবীন্দ্রনাথের প্রিয় গড়াই আজ তাই মৃতপ্রায়।

এখন আসা যাক বাংলাদেশের প্রাকৃতিক আর আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে নদী খননের প্রয়োজনীয়তার দিকে।আমি খুব সংক্ষেপে কয়েকটি দিক তুলে ধরব।

১। পলি পড়ে যাওয়ায় নদী তার স্বাভাবিক গতিময়তা হারিয়ে ফেলে, ফলে পরিবেশ, বাস্তুতন্ত্র, খাদ্য শিকল ব্যপকভাবে হুমকীর সম্মুখীন হয়।
২। পানি প্রবাহ কমে যাওয়ায় সমুদ্রের নোনা পানি খুব সহজেই সমতল ভূমিতে উঠে আসে। আমদের গাছপালা এই নোনা পানিতে বেশি দিন টিকে থাকতে পারেনা। গড়াই নদীর প্রবাহ কমে যেয়ে লবনাক্ততা বৃদ্ধি পাওয়ার কারনে সুন্দরবনের অস্তিত্ব আজ হুমকীর মুখে।
৩. পলি জমে নদীর স্বাভাবিক পানি ধারন ক্ষমতা হ্রাস পায়। ফলে বর্ষা মৌসুমের অতিরিক্ত পানি নদী আর ধারন করতে পারেনা আর যার ফলাফল হচ্ছে বন্যা।
৪। নদীর নাব্যতা বিপুল পরিমানে কমে যাওয়ার কারনে নদীপথে যাত্রি ও মালামাল পরিবহন হুমকীর মুখে পড়ে।

বাংলাদেশের জন্য নদী খননের প্রয়োজনীয়তা আসলে বলে শেষ করা যায়না আমি শুধু প্রধান বিষয় গুলোর উপর আলোকপাত করলাম।

আগামী পর্বে থাকছে বাংলাদেশের চলমান নদী খনন প্রকল্পগুলো নিয়ে আলোচনা।

ইশতিয়াক


মন্তব্য

নামুস এর ছবি

এই নদীগুলো তো হাজার বছর ধরে চলছে ও পলি বয়ে আনছে। আর ড্রেজিং শুরু হয়েছে খুব বেশি হলে ৫০ বছর। তাহলে এই দীর্ঘ সময় নদীগুলো তো প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়মেই ড্রেজিং ছাড়াই টিকে ছিল। বরং এদের মৃত্যু ইদানিং তরান্বিত হচ্ছে। লেখক কি এই বিষয়ে একটু আলোকপাত করবেন?

-নামুস

ইশতিয়াক এর ছবি

ধন্যবাদ। অত্যন্ত ভালো প্রশ্ন।
প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়মে চললে পলি জমার হার ধীর হবে। আসলে প্রত্যেক নদীর কিছু নিজস্ব বৈশিষ্ট্য থাকে। আমাদের দেশের নদীগুলোর (পদ্মা, যমুনা) গতিপথ খুবই পরিবর্তনশীল। ১০০ বছর আগেই এরা অন্য যায়গা থেকে প্রবাহিত হতো। যেমন গড়াই নদী ছিলো পদ্মার পানি সমুদ্রে যাবার পথ। কালের বিবর্তনে তা আজ মৃতপ্রায় ।

মানবসৃষ্ট কারন পুরো প্রক্রিয়াকে তরান্বিত করেছে। মানুষ নিজের প্রয়োজনে গাছ পালা কেটে উজাড় করেছে। ফলে মাটি ধারন ক্ষমতা হ্রাস পায় আর মাটি ক্ষয় বেড়ে যেয়ে তা নদীর পলির পরিমান বাড়িয়ে দিয়েছে। নদীর একটি নিজস্ব পলিধারন ক্ষমতা আছে। আমরা তা নষ্ট করে দিয়েছি। নদীতে কাঠামো নির্মানের ব্যাপারটা মূল লেখায় এসেছে।

জলবায়ুর পরিবর্তন পলি জমার হার বেড়ে যাবার আরেকটি কারন। সমুদ্রের পানির উচ্চতা বেড়ে যাবার ফলে পানি আর আগের মত গতি নিয়ে নামতে পারছে না। আর তার কারনে পলি নদীর তলদেশে জমা হবার জন্য বেশি সময় পাচ্ছে।

সময়ের সাথে সব প্রাকৃতিক ভারসাম্যই তো আমরা নষ্ট করে ফেলছি। এই কারনে আগের চেয়ে এই সমস্যা এখন প্রকট আকার ধারন করেছে। আর আমরা তো সবসময় অনেক চিন্তা করে সময় নষ্ট না করে আশু সমাধান খুজি। আর সবচেয়ে সোজা সমাধান হচ্ছে ড্রেজিং। আমদের ঊচিত অনেক ভাবনা চিন্তা , গবেষনার মাধ্যমে পলিপড়ন সমস্যা সমাধান বের করা।

সৈয়দ নজরুল ইসলাম দেলগীর এর ছবি

চলুক

______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

কালো চিল এর ছবি

আমাদের দেশের কেবল গড়াই-ই নয়, মধুসুদনের সেই কপোতাক্ষও এখন প্রায় মৃত। বৃহত্তর খুলনা ও সাতক্ষীরা অঞ্চলের প্রায় সবগুলো নদীই এখন মৃত্যুর মুখোমুখি। পলি পড়ার কারণে এইসব এলাকার নদী ভিত্তিক যাতায়াত ব্যবস্থাতেও সমস্যা তৈরী হচ্ছে। ঢাকা-বরিশাল-পটুয়াখালী-ভোলা-হিজলা-মুলাদী-মেহেন্দিগঞ্জ-স্বরুপকাঠী-বানারিপাড়া রুটের বিভিন্ন স্থানে ডুবোচর দেখা দিয়েছে (সূত্রঃ বিডিনিউজ২৪ ১৯মার্চ, ২০১২)। সাধারণ মানুষ মাত্রই মনে করে ড্রেজিং করাই এর একমাত্র সমাধান। কিন্তু এটি যে কেবল সমস্যা থেকে আপাত উত্তরণের উপায়, তা অনেকেই বোঝেন না। সত্যি বলতে আমাদের দেশের ভৌগোলিক ও অর্থনৈতিক অবস্থা বিবেচনায় ড্রেজিং কখনোই পুর্ণাঙ্গ সমাধান হতে পারে না। আশা করি লেখকের লেখায় পলি সমস্যা সমাধানের ড্রেজিং ভিন্ন অন্যান্য উপায় গুলো উঠে আসবে।

-কালো চিল

ইশতিয়াক এর ছবি

কালো চিল ধন্যবাদ। আপনি ঠিকই বলেছেন। ড্রেজিং কোনোভাবেই একমাত্র উপায় নয় । পর্ব-১ আর উদ্দেশ্য ছিলো আমাদের দেশে এটা কেন গুরুতবপূর্ণ সে বিষয়ে আলোকপাত করা। প্রকল্প গুলো নিয়ে আলোচনায় ড্রেজিং ভিন্ন অন্য কি উপায় অবলম্বন করা যেতো তা উঠে আসবে। আমার এই ধারাবাহিকের উদ্দেশ্য হচ্ছে বাংলাদেশে ড্রেজিং নিয়ে হচ্ছে তা নিয়ে আলোচনা। পলি সমস্যার সমাধানের উপায় সবার আলোচনার মাধ্যমে উঠে আসবে আশা করি।

ব্যাঙের ছাতা এর ছবি

আগ্রহ নিয়ে পড়লাম। মন্তব্যগুলো সহ। পরের পর্বের অপেক্ষায়।

ইশতিয়াক এর ছবি

ধন্যবাদ আগ্রহ নিয়ে পড়ার জন্য। আশা করি বাকি পর্ব গুলোতেও আপনাকে সাথে পাবো।

হিমু এর ছবি

চমৎকার একটা সিরিজ হবে। আপনি "নদী খনন" ট্যাগটা যদি সবসময় ব্যবহার করেন, তাহলে আপনার সব লেখা এই ট্যাগের আন্ডারে এক ক্লিকে পাওয়া যাবে।

আপনি কি একটা পর্ব শেষ করে পরের পর্বের কনটেন্ট সম্পর্কে কিছুটা আভাস দিয়ে রাখবেন? তাহলে পাঠকও জিজ্ঞাসা, পরামর্শ, তথ্য বা রিসোর্স দিয়ে আপনার লেখাকে কমপ্লিমেন্ট করার সুযোগ পাবেন।

সিরিজ চলুক। সচলায়তনে নিবন্ধন করে ফেলুন।

ইশতিয়াক এর ছবি

মন্তব্যের ঘরে আপনার নাম দেখে ভালো লাগলো। আশা করি পরবর্তী পর্বগুলোতে আগে থেকেই কনটেন্ট সম্পর্কে আভাস দিতে পারবো। ধন্যবাদ।

সৈয়দ নজরুল ইসলাম দেলগীর এর ছবি

ড্রেজিংয়ের সময় মাটিতে যে প্রবল কম্পন হয়... তা কি নদীর দুপাশের ভূমিক্ষয়ের কারণ হতে পারে?
আমার জ্ঞান সীমিতর চেয়েও কম... স্রেফ আগ্রহ থেকে জানতে চাইলাম

চমৎকার সিরিজ। চলুক

______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

ইশতিয়াক এর ছবি

ধন্যবাদ। আপনাদের উৎসাহ আমাকে সাহস দিচ্ছে।

অপরিকল্পিত ড্রেজিং এর কারনে আসলে অনেক কিছুই হতে পারে। এ ব্যাপারে বিস্তারিত থাকবে সামনের পর্ব গুলোতে।

আপনার প্রশ্ন অত্যন্ত যৌক্তিক। ড্রেজিং এ নদীর তীরের ভারসাম্য রক্ষা অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ড্রেজ সেকশন এর ডিজাইন সঠিক ভাবে না হলে অথবা ড্রেজিং বিন্যাস (এলাইনমেণ্ট) ভুল হলে নদীর তীরের এর ঢালের ভারসাম্য নষ্ট হয়ে ভূমিক্ষয় হতে পারে (Bank Erosion)। ড্রেজিং এর সময় ড্রেজার এ আসলে যত কম্পন দেখা যায়, নদীতে প্রকৃতপক্ষে অতটা কম্পন হয়না।

সচল জাহিদ এর ছবি

চলুক চলুক চলুক

ইশতিয়াক চমৎকার সিরিজের সুচনা। গ্যালারীতে আছি। সচলায়তনে স্বাগতম।

এই সিরিজে শুধু কেইস স্টাডি না তুমি একটু মরফোলজিও নিয়ে আসতে পার। ড্রেজিং এর রিভার রেসপন্স নিয়ে আসলে আরো ভাল হয়।

সেই সাথে অপরিকল্পত ড্রেজিং ( বালু তোলার জন্য) রিভার রেসপন্স কি হয় সেটাও সিরিজে নিয়ে আসলে ভাল হয়।


এ বিশ্বকে এ শিশুর বাসযোগ্য করে যাব আমি, নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার।
ব্যক্তিগত ওয়েবসাইট
কৃতজ্ঞতা স্বীকারঃ অভ্র।

ইশতিয়াক এর ছবি

ধন্যবাদ স্যার। আপনার অনুপ্রেরনাতেই লেখা শুরু করতে পারলাম। আশা করি আপনার মূল্যবান মন্তব্য এবং উপদেশ সবসময় পাব। আসলে প্রযুক্তিগত টার্ম গুলো দূরে রেখে যতটা সম্ভব সবার বোধগম্য করে লেখার আপনার ভঙ্গি অনুকরন করার চেষ্টা করেছি এবং বুঝতে পেরেছি এটা কত কষ্টসাধ্য কাজ।

সরাসরি কেইস ষ্টাডি না করে ড্রেজিং বিষয়ক আলোচনায় উদাহরনের মাধ্যমে ব্যপারগুলো নিয়ে আসার কথা ভাবছি। আর ড্রেজিং যেহেতু, মরফোলজিকাল রেসপন্স তো আসবেই। চেষ্টা করব সীমিত জ্ঞান দিয়ে যথাসম্ভব তথ্যবহুল একটা সিরিজ করতে।

কালো চিল এর ছবি

আপনাদের দুইজনের লেখা দেখে সাহস সঞ্চয় করছি হাসি এতে করে যদি ভবিষ্যতে কিছু লিখা সম্ভব হয় !!

সৌরভ কবীর  এর ছবি

চলুক

ইশতিয়াক এর ছবি

ধন্যবাদ। আপনার মূল্যবান মতামতও চাই ।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।