"লোডশেডিং অবশ্যই দরকার" - একটি গবেষণাধর্মী রচনা

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: শনি, ৩১/০৩/২০১২ - ১১:২৪অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

[justify]কিছুদিন পূর্বে সংসদে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বলেছেন,

“লোডশেডিংয়ের দরকারও আছে, মানুষ যাতে ভুলে না যায়, লোডশেডিং নামে কিছু একটা ছিল”

আপাত দৃষ্টিতে কথাটি হাস্যরসাত্মক হলেও গভীর পর্যবেক্ষণে দেখা যায় এটি কিন্তু মোটেও কোন লুলীয় বাণী নয়, বরং বাঙালি জীবনে লোডশেডিং যে কি বিশাল বিপ্লব নিয়ে এসেছে তা নিচের কারণগুলো না পড়লে সহজে অনুমেয় নয়!!

কিছুদিন পূর্বে সংসদে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বলেছেন,

“লোডশেডিংয়ের দরকারও আছে, মানুষ যাতে ভুলে না যায়, লোডশেডিং নামে কিছু একটা ছিল”

আপাত দৃষ্টিতে কথাটি হাস্যরসাত্মক হলেও গভীর পর্যবেক্ষণে দেখা যায় এটি কিন্তু মোটেও কোন লুলীয় বাণী নয়, বরং বাঙালি জীবনে লোডশেডিং যে কি বিশাল বিপ্লব নিয়ে এসেছে তা নিচের কারণগুলো না পড়লে সহজে অনুমেয় নয়!!

আসুন, প্রথমেই আলোচনা করি লোডশেডিং কি সেটা নিয়ে।

লোডশেডিং , বাঙালি জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসা ও লোডশেডিং এই ৬ টি বাঙালি জীবনের মৌলিক অধিকার। প্রতিবছর প্রথম ৫ টা অধিকার সরকার নিশ্চিত করতে পারুক আর না পারুক, লোডশেডিং অধিকারটি পূরণে সরকার শতভাগ সফল হয়ে আসছে যুগযুগান্তর থেকে।

বহুকাল আগে অটো ভন্ গ্যারিক, বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিন, মাইকেল ফ্যারাডে নামক বিজ্ঞানীরা বিভিন্ন আবিষ্কার দ্বারা ইলেক্ট্রিসিটি বা বিদ্যুৎপ্রবাহ ব্যবহারে মানবজাতিকে অভ্যস্ত করে তুলে। কিন্তু আমরা বাঙালিরা সেই ইলেক্ট্রিসিটি ব্যবহারে থোড়াই কেয়ার করি। আমরা ব্যবহার করি লোডশেডিং। বিজ্ঞানের ভাষায়, ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র dt পরিমাণ সময় পর্যন্ত বিদ্যুতের অবস্থান ও টেন্ডস টু জিরো সেকেন্ড সময়ের মাঝে এর প্রস্থান হতে এর পুনরায় আগমনের মাঝের যে ইনফিনিটি সময়, তাকেই বলা হয় লোডশেডিং।

লোডশেডিং এর গুরুত্ব সমূহঃ

এবার আসল প্রসঙ্গে আসা যাক। কিভাবে লোডশেডিং বাঙালি সমাজ উন্নয়ন, দেশ সমৃদ্ধকরণ সহ নানা ক্ষেত্রে নিরবে নিভৃতে পালন করে চলেছে যুগান্তকারী ভূমিকা, তা দেখি। নিম্নে লোডশেডিংয়ের গুণাগুণ ও এর প্রয়োজনীয়তা বর্ণনা করে কিছু পয়েন্ট উল্লেখ করা হল-

১) এখনকার সময়ের পত্রিকাগুলোতে চোখ বুলালেই দেখা যায়, প্রতিদিন বিভিন্ন জায়গায় অনেক মানুষ দুর্ঘটনাবশত হাই ভোল্টেজ এর ইলেকট্রিক শক খেয়ে বা তড়িতাহিত হয়ে মৃত্যুবরণ করছে। অনাকাঙ্খিত এইসব দুর্ঘটনায় ঝরে যাচ্ছে অনেক মূল্যবান ও মেধাবী প্রাণ। কিন্তু বর্তমানে লোডশেডিং থাকার ফলে এই ঝুঁকি বলতে গেলে একদমই নেই। কেউ এখন ইচ্ছা করলেও ইলেকট্রিক শক খেয়ে মরতে পারবে না। এতে করে দেশে কমছে বার্ষিক মৃত্যুহার। দেশ হচ্ছে জনসমৃদ্ধ ও শক্তিশালী।

২) এখনকার সময়ে ঘরে ঘরে দেখা যায়, যে যার ইচ্ছামত ইলেকট্রিক মেশিন কিনে ঘর ভরিয়ে তুলছে। অনেক ধনকুবেরের ঘরে দেখা যায় ৩ টা রেফ্রিজারেটর, ২ টা এলসিডি টিভি, ওয়াশিং মেশিন, মাইক্রোওভেন, ইলেকট্রিক কুকার, ড্রাইয়ারসহ ইত্যাদি ইত্যাদি হাবিজাবী যন্ত্রপাতি। এইসব বেদরকারী যন্ত্রপাতি ব্যবহারে তারা নষ্ট করছে হাজার হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎশক্তি। কিন্তু বর্তমানে লোডশেডিং থাকায় এইসব যন্ত্রপাতি আর কোন কামে লাগতেসে না, আর এইভাবেই লোডশেডিং রক্ষা করতেসে হাজার মেগাওয়াটের মূল্যবান তড়িৎ শক্তি। দেশ হচ্ছে সমৃদ্ধ।

৩) এখনকার “কলাভেড়ী জেনারেশন” ইয়ং পোলাপাইন বড়ই বদখত। মায়ের পেঠ হতে বের হয়ে মস্তিষ্কে বুদ্ধি গজানো শুরু হওয়া মাত্রই তারা নিজেদের ল্যাপটপ/ডেস্কটপ কম্পিউটারে শুরু করে দেয় তাদের রঙ্গলীলা। এক একজনের আছে ন্যুনতম ৫ ৬ টা করে ফেসবুক, টুইটার, জি মেইল, ইয়াহু সহ নাম না জানা আরো হাজারো ওয়েবসাইট অ্যাকাউন্ট। এইগুলাতে তারা দিন রাত ২৪ ঘন্টা গেজাইতো। এভাবে পড়ালেখার ১২ টা বাজিয়ে তারা ধ্বংস করছিল মূল্যবান সময়। কিন্তু বর্তমানে লোডশেডিং রক্ষা করছে তাদের সেই মূল্যবান সময়। লোডশেডিং এর ফলে তারা কম্পিউটার টেবিলে বসে কম্পিউটার চালাইতে না পেরে বুকভরা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বাধ্য হয়ে বসছে পড়ার টেবিলে। এভাবেই দেশ ও জাতি হচ্ছে শিক্ষিত।

৪) একদা ঘরে ঘরে ইলেক্ট্রিসিটি থাকার ফলে দেশের মোমবাতি প্রস্তুতকারক শিল্পপ্রতিষ্ঠান গুলোর লালবাতি জ্বলে যাচ্ছিলো। অনেক মোমবাতি ফ্যাক্টরি কোটি টাকার লোকশান সইতে না পেরে বন্ধ হয়ে গিয়েছিল, ফলে বেকার হয়ে পরেছিল হাজারো মোমবাতি শ্রমিক। কিন্তু না, অবশেষে যখন হতেই লোডশেডিং এর আগমন ঠিক সেই মুহূর্ত হতে বাঙালি পুনরায় নির্ভরশীল হয়ে উঠতে থাকে মোমবাতির উপর। পুনরায় মোমবাতি শিল্প ফিরে পেতে থাকে প্রাণ, কর্মসংস্থান হয় হাজারো বেকার শ্রমিকের। আর এভাবেই দেশে শুরু হয় এক নতুন শিল্পযুগের। হ্রাস পেতে থাকে বেকারসংখ্যা, আর দেশ হয় বেকারমুক্ত।

৫) বাংলার ঘরে ঘরে মা, বোন, ফুফু, খালা, পাশের বাড়ির আন্টি সহ কোটি রমণী স্টার প্লাস, স্টার জলসা, জি বাংলা সহ আরো নানা ভারতীয় চ্যানেলে প্রচারিত হিন্দি সিরিয়ালের আগ্রাসনের তোপের মুখে হারিয়ে ফেলছিলো তাদের নিজ সংস্কৃতিপনা। বাংলার সুতির শাড়ির জায়গা দখল করে নিয়েছিল ইন্ডিয়ান স্টার প্লাস শাড়ি, সাত পাঁকে বাধা শাড়ি, তিন বৌ রাণীয়া শাড়ি। এইসব চ্যানেলে প্রচারিত সিরিয়াল দেখে দেখে তাদের মুখে খইয়ের মত ফুটতো হিন্দি ডাইয়ালগ, হিন্দি গানের বুলি। যা জাতিকে করে তুলছিল দেশীয় সংস্কৃতি বিমুখ। সৌভাগ্যের বিষয় যে এই অবস্থার পরিত্রান মিলেছে লোডশেডিং এর আগমনের সাথে। লোডশেডিং আছে, তো টিভি বন্ধ অতএব সিরিয়াল দেখাও বন্ধ। বাহ!! লোডশেডিং এর কি চমৎকার সময়োপযোগী অবদান।

৬) মূলত লোডশেডিং আছে বলেই এখন ঢাকার রাত হয় নির্মল আঁধারে পূর্ণ। দেখা মিলে নাম না জানা কোটি তারার, যাদের মাঝে পূর্ণ আলোয় উদ্ভাসিত হয় পূর্ণিমা চাঁদ। এইরকম পরিবেশে বাংলার ইয়ং জেনারেশানের কাঁচা মন হয়ে পরে কাব্যভাবে পূর্ণ। যার ফলে তাদের লেখনীতে জন্ম নেয় অমর কবিতা, গান, কাব্য এমনকি সুবিশাল উপন্যাস!! আর এভাবেই লোডশেডিং গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে বাংলা সাহিত্য সমৃদ্ধায়নে।

৭) গুলশান, বনানী এলাকাসহ দেশের ধনী পাড়াগুলোতে গভীর রাতের ডিজে ড্যান্সিং পার্টিগুলো বরাবরই ক্ষতিকর বাঙালি সমাজে। ইয়ং ছোকরা-ছোকরি গুলা পুরাই বরবাদ হয়ে যাচ্ছিলো এই পার্টিগুলাতে। কিন্তু এখন সবসময় আছে লোডশেডিং, বিদ্যুতের অভাবে আর ডিজে মিক্সার সাউন্ডবক্স চালাইতে পারেনা পোলাপাইন। আর তাই পার্টিও নাই। এভাবেই ডিজে পার্টির ১২ টা বাজিয়ে বিপথগামী যুবসমাজকে রক্ষা করে চলেছে লোডশেডিং।

৮) দেশের জনসাধারণের কাছে তেল, পেট্রোল, গ্যাস বিক্রি করে বাংলাদেশ সরকার চলে। কিন্তু ইলেকট্রিক মোটর গাড়ি আমদানীর ফলে এইসব জ্বালানীর প্রয়োজন কিছুটা কমতে বসেছিল। সরকার হারাতে বসেছিল কোটি টাকার রাজস্ব আয়। আর অবধারিত এই ক্ষতির হাত হতে পরিত্রান মিলেছে লোডশেডিং এর আগমনে। ইলেকট্রিক মোটর গাড়ি চার্জ করাতে লাগতো ইলেক্ট্রিসিটি, কিন্তু এখন লোডশেডিং এর যুগ তাই এসব গাড়িও অচল। ফলে সরকার জ্বালানী তেলের দামও ইচ্ছামত বাড়িয়ে কামিয়ে নিতে পারছে মোটা অঙ্কের রাজস্ব। আর এতেই দেশ হচ্ছে অর্থনৈতিকভাবে লাভবান।

৯) মানবসভ্যতার ইতিহাস ঘাটলেই দেখা যায়, সকল বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের মূলে রয়েছে বিরুপ পরিবেশের ফলে সৃষ্ট ঐ সকল আবিষ্কারের প্রতি মানুষের তীব্র চাহিদা। অনুরুপভাবে, লোডশেডিং আমাদের দিচ্ছে যথাপযুক্ত সেই বিরুপ পরিবেশ। ফলে ন্যাচারিলি বাঙালিরা হয়ে উঠছে আবিষ্কারপ্রবণ!!

১০) আর যেটা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সেটা হল, লোডশেডিং আছে বলেই শত শত ব্লগার লিখতে পারছে উপন্যাস টাইপের এক একটি লোডশেডিং বিরোধী ব্লগ পোস্ট। আর এর মাধ্যমেই বাংলা ব্লগ হচ্ছে আরো সমৃদ্ধ, আরো প্রাণোচ্ছল।

পরিশিষ্টঃ

এতো এতো উপকার সাধনের পরেও লোডশেডিংয়ের অবদান ও এর দরকারীতা আমরা বাঙালিরা কেউ না বুঝলেও, ঠিকই বুঝেছেন আমাদের প্রধানমন্ত্রী। তাইতো তিনি সংসদে করেছেন সেই দিকবিজয়ী উক্তিটি। কি পরিমাণ দূরদর্শী, যুক্তিবান ও সময়োপযোগী হলে এইরকম বাণী নিঃসরণ করা যায় আপনারাই বলুন??? অতএব ভাইরা আমার, আসুন আমরা প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যকে ঠেরা চোখে না দেখে, যুক্তি দিয়ে দেখি। ইলেক্ট্রিসিটি নাই তো কি হয়েছে, লোডশেডিংতো আছেই। লোডশেডিংয়ের শক্তিকে কাজে লাগিয়ে আমরা গড়ে তুলবো স্বপ্নের ডিজিটাল বাংলাদেশ। লোডশেডিংময় বাংলাদেশেই হোক আগামীর পথচলা!!!

সদস্যনাম: সেভেরাস স্নেইপ


মন্তব্য

ধুসর জলছবি এর ছবি

হ্যারি পটারের কথা মনে পড়ে গেল নামটা দেখে। হাসি

ভালো মানুষ এর ছবি

উত্তম জাঝা!

ব্যাঙের ছাতা এর ছবি

সবাই হয়ত আমার সাথে একমত হবেননা, কিন্তু শুক্লপক্ষের শেষের কয়েকটি দিন (আমার ক্ষমতা থাকলে খাইছে ) হাস্পাতাল এবং অন্যান্য জরুরী জায়গাগুলো ছাড়া পুরোটাই লোদশেডিং করে দিতাম।

অতি উত্তম লেখা। এই রচনা থেকে বুঝতে পারলাম লোডশেডিং গরুর চেয়েও ও উপকারী আমাদের জন্য দেঁতো হাসি

নিটোল এর ছবি

ভাই, সচলায়তনের নিয়ম হলো লেখা পোস্ট করার পর ৭২ ঘন্টার মধ্যে ব্যক্তিগত ব্লগ ছাড়া অন্য কোনো কমিউনিটি ব্লগে লেখা দেয়া যায় না। আমি আজকেই দেখি অন্যত্র পোস্ট করে দিলেন। মনে হয় ব্যাপারটা না জেনেই করেছেন। নিয়মকানুনগুলো আগে থেকে পড়ে নিলে আপনারই সুবিধে হবে।

ধন্যবাদ।

_________________
[খোমাখাতা]