ব্যবহারে বংশের পরিচয়

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: বিষ্যুদ, ২৬/০৭/২০১২ - ৮:৩১অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

১.
'ডোন্ট ওরি'- গিন্নীকে এই কথাটা হাজারখানেক বার বলার পর এখন আর নিজেরই বিশ্বাস হয়না বানরের। দিন আনি দিন খাই টাইপের দিন ভালই চলছিল - এর মধ্যে গিন্নী এলেন, বান্দরের বান্দর বাচ্চা দুটোও এল। কিভাবে যেন দিন ও পড়ে গেল। যা যোগাড় হয় তাতে চারটা পেট ভরেনা। সেভিংস নেই, সিকিউরিটি নেই, চুলায় আগুন জ্বলে না, গিন্নী কথা বলেনা। 'অমন বানরের মত মুখ বানিয়ে আছ কেন?'- জিজ্ঞাস করতেই হাজার চুলার আগুন বের হয় কিছু আগের বন্ধ মুখ থেকে।

এমন যাচ্ছেতাই কোন এক দিনে মনে মনে খিস্তিখেউর করতে করতে বনের পথে পথে ঘুরতে লাগল বানর। দুদিন কিছুই পেটে পড়েনি। গিন্নী কোথা থেকে কি যোগাড় করে বাচ্চাদের খাইয়েছে, নিজেও খেয়েছে, তাচ্ছিল্য ভরে তাকেও সেধেছিল। বানর খায়নি। মানুষের যোগ্য পূর্বসূরির মতই 'ইগো'র কাছে আকছারই ক্ষুধাকে পরাজিত হতে দেয় সে। ক্ষুধায় চক্কর দেয়া মাথা - চক্করের সাথে তাল রেখে চলতে চলতে হঠাৎ এক অভূতপূর্ব দৃশ্য চোখে পড়ে বানরের - এক টুকরা খালি জায়গায় মাটিতে পোঁতা এক লম্বা বাঁশের মাথায় এক কাঁদি কলা ঝুলছে। নিজের চোখকে বিশ্বাস হয় না বানরের। চোখ কচলে আবার তাকায় বানর - ঝকঝকে বাঁশের মাথায় ঝকঝকে কতগুলো কলা। আশেপাশে কেউ নেই, দ্রুত বাঁশের দিকে আগাল বানর - যা করার তাড়াতাড়ি করা দরকার...
অনেকদিন পর আজকে মাথা উঁচু করে ঘরে ঢুকবে বানর। কোন কথা না বলে কলাগুলো বউয়ের সামনে রেখে পায়ের উপর পা তুলে আকাশের দিকে চেয়ে শুয়ে থাকবে। কল্পনায় পেয়ে বসে বানরকে- অনেক দিন পর বউয়ের একটু সোহাগ ও কল্পনা করে ফেলে...
আর চিন্তার সময় নেই, বাঁশ বাওয়া শুরু করে বানর। কিন্তু উদ্ভট ব্যাপার ঘটল। পিছলে নেমে আসল সে। কেমন বাঁশ এটা? কে বা কারা পুরো বাঁশে আচ্ছাসে তেল মেখে রেখেছে। আবার উঠার চেষ্টা চালাল বানর। ফলাফল পূর্ববৎ। যতটুকু উঠা ততটুকুই নামা। রাগে দুঃখে চোখে জল চলে আসল, মাথায় হাত দিয়ে মাটিতে বসে পড়ে বানর...
মনের পর্দায় স্ত্রীর মুখ ভেসে উঠতেই সুড়সুড় করে উঠে দাঁড়ায় বানর। আবার উঠার চেষ্টা শুরু করে। আগের চেষ্টার অভিজ্ঞতা এখন তার ঝুলিতে। নিজেকে অবাক করে বানর দেখল সে ইম্প্রুভ করছে, মানে উপরে উঠার গতি এখন পিছলে পড়ার গতির চেয়ে বেশি। ক্ষুধার্ত শরীর মাঝেমাঝে ভাবালুতাকে প্রশ্রয় দেয়। অধোগতি বাড়তে থাকে। বানর সম্বিতে ফিরে। নতুন প্রতিজ্ঞায় গতি বাড়তে থাকে। বাঁশ সরু হয়ে আসে আগার দিকে। এত পথ পাড়ি দেবার পর শুধু বাঁশ না বানর ও তৈলাক্ত, উপরন্তু ঘর্মাক্ত। মনের জোরে চলতে থাকে বানর। শেষ পর্যন্ত শেষ হয় বাঁশ বাওয়া । বাঁশের সরু মাথায় কায়দা করে বসে সামনে তাকায় বানর; এত উপর থেকে পৃথিবীটা আগে কখনো দেখা হয়নি।
কলার দিকে মনোযোগ ফিরায় বানর। কাঁপা কাঁপা হাতে কলার কাঁদিটা খুলতে যাবে এমন সময় লাঠিসোটা হাতে হইহই করে ঝোপের আড়াল থেকে বেরিয়ে আসে কতগুলো লোক। শুরু করে ঢিল ছোড়া । কলার কাঁদি ফেলে কোনরকমে জান বাঁচিয়ে ফিরতে পারে বানর। খালি হাতে ফেরা আহত বানর সেদিন ভাব নিয়েই ঘরে ফিরেছিল, কারণ বংশ-চূড়ায় বসে সে এমন কিছু দেখেছিল যা তাকে নতুন জীবনের সন্ধান দেয়।
২.
না চাইতেই বানরের প্রতিশোধ নেয়া হয়েছিল। বানর শুনেছে তার জীবনের গল্প এক অংকের ভিতর ঢুকে যাওয়া গল্প হয়ে প্রচুর মানব-শিক্ষার্থীকে নাকানি চুবানি খাওয়াচ্ছে। কিন্তু বানরের উপকার হয় অন্যভাবে। বাঁশে চড়ে দূরে, অনেক দূরে প্রচুর কলাগাছ দেখে বানর। আর তাই পরদিনই বউ বাচ্চা নিয়ে বাঁশে না, ঢাকার বাসে চড়ে বসে বানর।
৩.
বানরের নতুন কর্মক্ষেত্র ঢাকার কলাবাগান। বানরের প্রতিষ্ঠানের অবস্থা রমরমা; আমি কাজ পাই সে প্রতিষ্ঠানের লোগো তৈরির। কাজের লোক বানর। একটা কাগজে কিছু আঁকাআঁকি করলেন। আঁকাআঁকি দেখে কিছু বুঝলাম না - বানর বুঝিয়ে দিলেন।
'দেখ, আমার আজকের অবস্থানে আসতে পেরেছি সেদিন বাঁশে চড়েছিলাম বলে (বানরের ধারণা তাঁর জীবনের গল্পটা ওপেন সিক্রেট)। তাই লোগোতে বাঁশ বেয়ে উঠতে থাকা বানরের ছবি চাই, সাথে প্রতিষ্ঠানের নাম; আর লাস্ট বাট নট লিস্ট, প্রতিষ্ঠানের স্লোগান থাকবে লোগোর অংশ হিসেবে।'
স্লোগানটা হল- 'ব্যবহারে বংশের পরিচয়'।
কথা চালিয়ে গেলেন বানর। 'দেখ, অনেকে বলে আমি কলা খাওয়ার জন্য বাঁশে চড়ছিলাম। ঘটনা তো আসলে তা না। আমি চড়সি কারণ দূরে কোথায় কি আছে তা আমার জানতে হত। ঝোপঝাড় কেটে সামনে চলা হল ম্যানেজমেন্ট, আর বাঁশে চড়ে দিক ঠিক করাটা হল লিডারশীপ। লিডারশীপ ছাড়া ম্যানেজমেন্ট অচল। বাঁশ ব্যবহার যে করতে জানে সেই সফল হয়; সেই জন্যই আমি কোম্পানির স্লোগান দিলাম- 'ব্যবহারে বংশের পরিচয়'।'
কয়েকদিন পর লোগোর ড্রাফট নিয়ে গেলাম। লোগো দেখে আর্তনাদ করে উঠে রক্ত পানি করা ভয়ংকর দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকালেন বানর।
'এটা কি? ছবিতে বানরের বদলে হনুমান কেন?' আমি লোগোর প্রিন্টটার দিকে তাকালাম। তাঁর দিকে তাকানোর সাহস পেলামনা, তাঁর পেছনে দেয়ালে ঝুলতে থাকা তাঁর বিশাল পোরট্রেটের দিকে তাকালাম। আমার কাঁচুমাচু অবস্থা দেখে বানর নরম হলেন। বুঝলেন, আনাড়ির পাল্লায় পড়েছেন। তবে ব্যাটা হনূমান যখন আঁকতে পেরেছে কাজটা শেষ পর্যন্ত নিশ্চয়ই করিয়ে নেয়া যাবে। তিনি বাঁশের ব্যাবহার জানেন আর কঞ্চি ব্যাবহার করতে পারবেন না? বানর ল্যাপটপ খুলে বিভিন্ন বানরের ছবি দেখাতে লাগলেন আর বানরের অ্যানাটমি শেখাতে লাগলেন। আমি ভাবছি, এক জীবনে আর কত ধরনের অভিজ্ঞতা হবে। শেষে বানরের কাছ থেকে বানরের অ্যানাটমি শিখতে হচ্ছে। অনেক ছবির পর পারিবারিক ছবিও বের হল। 'এটা থাইল্যান্ডে তোলা। এইটা আমি আর এইটা তোমার ভাবী (বানরীর কথা বলছেন), এইটা পোলা বড়টা আর এইটা ছোটটা। দুটাই বান্দরের বান্দর।' আরও কিছু ছবি দেখালেন। হঠাৎ একটা ছবি আসতেই বিড়বিড় করে উঠলেন, 'এইটা আবার কোত্থেকে আসল'- বলেই তাড়াতাড়ি ডিলিট বাটন চেপে রিসাইকেল বিনে পাঠালেন। দুষ্টু ছবি বোধ হয়, আমি ভাবলাম। কিন্তু আমার কাছে লজ্জা পাবার কিছু ছিলনা; বানরের দুষ্টু ছবি আমি বুঝব কিভাবে।
কয়েক দিনের মধ্যে লোগোর কাজ শেষ হয়। বানর লোগো দেখে শব্দ করে পড়েন, 'ব্যবহারে বংশের পরিচয়।' 'আচ্ছা, ব্যবহারে বংশের আসল পরিচয় দিলে কেমন হয়?' 'ভালো হয় স্যার, স্লোগানটা আরো জোরালো হয়'। 'না যা আছে তাই থাক'। 'যা আছে তাও খারাপ না স্যার, সিমপ্লিসিটির আলাদা একটা ব্যাপার থাকে।' তৈলাভিজ্ঞ বানর আনাড়ির তেল ধরে ফেলে মুচকি হাসলেন। আমি ভাবলাম, বানরের মুচকি হাসি দেখার সৌভাগ্য কজনের হয়।
বিলের টাকা পাব এমন আশা করিনি (বানরের পিঠা ভাগের গল্পতো জানি)। সমস্যা হল বিল পাব না জেনেও অফিসে অফিসে ধরনা দেয়াটা অভ্যাস হয়ে গেছে। রোদে হেঁটে এসে ওয়েটিং রুমে বসে এসির হাওয়া খেতে খেতে জীবনের অর্থ খুজতে ভালো লাগে। ভেতরে ডাক পড়লে বোকার মত আশা নিয়ে ঢুকি, ডাক না পড়লেও খারাপ লাগেনা। বানর অবশ্য প্রতিবারই নিজের কক্ষে ডেকে নেন। নিজের নানা স্বপ্ন, পরিকল্পনার কথা বলেন, নানা ধরনের জ্ঞান দেন। বেশিরভাগই অবশ্য কিভাবে বাঁশ বেয়ে উঠতে হয় সেই বিষয়ক জ্ঞান, এই জ্ঞান কিভাবে কাজে লাগাবো বুঝে পাইনা। মিশন, ভিসন, ইনভেস্টমেন্ট, ব্রান্ডিং নানা কথার ভিড়ে বিলের কথা আর উঠেনা। মাঝে মাঝে একান্ত বাক্তিগত কথা বলেন, 'বুঝলা, তোমার ভাবী শুধু বলে, চল ফিরা যাই। এইখানে মন টিকে না। পোলা দুইটাও বাঁদরামি তো কিছুই শিখলনা।' দীর্ঘশ্বাস ফেলে বানর- 'এত কিছু করার পর ও সুখের খোঁজ পাইনা। তোমরাই ভালো আছো।'
আমি চুপচাপ বানরের কথা শুনি। আমার জন্য সবসময় দুইটা কলা আর এক গ্লাস পানি বরাদ্দ থাকে। একটা ক্ষুধার তাড়নায় খাই আর অন্যটা বানরের জোরাজুরিতে। এর মধ্যে বানর এক হালি কলা সাবাড় করেন। বানরের অফিস থেকে যখন বের হই তখন খালি পেটে কলা খাবার ধাক্কাটা টের পাই, গ্যাস্ট্রিক ঊর্ধ্বমুখী হয়ে মাথায় চড়ে বসে। ঝাপসা চোখে লিডারশীপ, ম্যানেজমেন্ট, ব্রান্ডিং নানা শব্দ বাঁশ থেকে ঝুলতে থাকে...

-এ ইউসুফ


মন্তব্য

সুলতানা পারভীন শিমুল এর ছবি

"না চাইতেই বানরের প্রতিশোধ নেয়া হয়েছিল। বানর শুনেছে তার জীবনের গল্প এক অংকের ভিতর ঢুকে যাওয়া গল্প হয়ে প্রচুর মানব-শিক্ষার্থীকে নাকানি চুবানি খাওয়াচ্ছে।"
হ।
কথা সইত্য। মন খারাপ

...........................

একটি নিমেষ ধরতে চেয়ে আমার এমন কাঙালপনা

অতিথি লেখক এর ছবি

যাহা বইলেছি সইত্যই বইলেছি, সইত্য বই মিথ্যা বলি নাই...

-এ ইউসুফ

সুমাদ্রী এর ছবি

চলুক

অন্ধকার এসে বিশ্বচরাচর ঢেকে দেওয়ার পরেই
আমি দেখতে পাই একটি দুটি তিনটি তারা জ্বলছে আকাশে।।

অতিথি লেখক এর ছবি

আপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা-

-এ ইউসুফ

উতপাখির হৃদয় এর ছবি

ছোট বেলায় বানরের এই তৈলাক্ত বাঁশের অংক অনেক ভুগিয়েছেরে ভাই। এখন আবার কর্পোরেট দুনিয়ায় ও বানর ? খাইছে

আশরাফুল কবীর এর ছবি

#সুন্দর লিখেছেন, এগিয়ে চলুন। বাঘের বাচ্চা

অতিথি লেখক এর ছবি

হাসি আপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা-

রিয়েল ডেমোন এর ছবি

ব্যাবহারেই বানরের পরিচয় বাঘের বাচ্চা

কল্যাণ এর ছবি

চলুক

_______________
আমার নামের মধ্যে ১৩

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।