হলমার্কের নেপথ্যে

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: রবি, ০৯/০৯/২০১২ - ৯:২৮অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

মাইনুল এইচ সিরাজী
-------------------
“শোনো ম্যানেজার, আমার একটু মোফাশশের সাহেবের ফেভার দরকার। শুনলাম ওনার সাথে নাকি তোমার দহরম-মহরম!”
“তা ঠিক স্যার। আপনি তো ভালোই জানেন, আজকাল শুধু সম্পর্ক দিয়ে কাজ হয় না। আমার প্রমোশন, পোস্টিং ইত্যাদির জন্য ওনাকে অন্যভাবে বশে আনতে হয়েছিল।”
“আরে বোকা এই অন্যভাবেটাতে আমার বিস্তর নলেজ আছে। তুমি লিংকটা করে দাও।”
ক'দিন পর ম্যানেজার এসে খোশ মেজাজে বলল, “স্যার, লিংকের ব্যবস্থা করেছি। আজ রাতে রেডিসনে দাওয়াত দিয়েছি। উনি আবার খেতে এবং পেতে ভালবাসেন।”

ভুরিভোজনের পর ম্যানেজার বলল, “মোফাশশের ভাই, আমার স্যার কোম্পানির এমডি হতে চান। কিন্তু উনার সিনিয়র আরো কয়েকজন ডিএমডি আছেন, যাদেরকে টেক্কা দিতে হবে। অবশ্য লং জাম্প দেয়ার কৌশল স্যার ভালোই জানেন। এর আগেও ডিএমডি হতে উনি কয়েকজনকে টপকাতে লম্বা জাম্প দিয়েছিলেন।”
মোফাশশের ভাই পান চিবুতে চিবুতে বললেন, “কাজটা বেশ কঠিন। বেশ কয়েক জায়গায় পানি ঢালতে হবে। ঠিক আছে, তুমি আমার সাথে কন্টাক্ট রাখো।”

ডিএমডি সাহেব টেনশনে আছেন। এমডির পদ দ্রুতই খালি হচ্ছে। ম্যানেজারকে ডেকে পরামর্শে বসলেন। ম্যানেজার বলল, “স্যার, ভাই তো কঠিন চিজ! কয়েক কোটি টাকা লাগবে বলেছেন।”
“ব্যবস্থা করো।” স্যার বললেন।
“কীভাবে?”
“বোটালো!”
“মানে স্যার?”
“মানে হচ্ছে তুমি তো আস্ত একটা ‌'বোকা টাইপের লোক'। তোমাকে এলসি শাখার ম্যানেজার কে বানিয়েছে?”
“ভাই বানিয়েছেন, স্যার।”
“তোমার শাখায় গার্মেন্টস পার্টি আছে?”
“হাতে গোনা স্যার”
“কয়েকটি থাকলেই হবে। তাদেরকে দু হাতে এলসি দাও এবং বিল কিনো।”
“কিন্তু স্যার, সেজন্য তো বিপুল টাকার এক্সপোর্ট এলসি এবং লোকাল এলসি প্রয়োজন!”
“হারা কোথাকার!”
“আবার কোন ভাষায় বকলেন স্যার?”
“হারা মানে হাদারাম!”
“এক্সপোর্ট এলসি পার্টি বানিয়ে দিবে। আর বিল কিনতে হেড অফিসের অনুমতি লাগে না, ম্যানেজারের ক্ষমতাই অসীম।”
“তা তো জানি। তবে ...”
“প্রভাবশালী কী একটা পার্টি আছে না তোমার ওখানে- যারা কোম্পানির নাম নিয়েও জালিয়াতি করেছে? ও হ্যাঁ, মনে পড়েছে। হলমার্ক। জানো হলমার্ক একটা ব্রিটিশ সাপ্লাই চেইনের নাম। সারা দুনিয়ায় নামটা পরিচিত।”
“জানি স্যার।”
“হলমার্কের এমডিকে এবার দাওয়াত দাও।”
“কিন্তু স্যার, ফাইভ স্টারের বিল তো আকাশ ছোঁয়া! তাছাড়া মদটদ আমি খাই না।”
“সে জন্যই তো মাথাটা খোলে না। এবার থেকে বিল হলমার্কই দেবে।”

কয়েকদিন পর আবার শেরাটন হোটেলে পার্টিকে নিয়ে খানা-পিনা হলো। পিতে পিতে কয়েক হাজার কোটি টাকা ব্যাংক থেকে বের করে নেয়ার কৌশল চূড়ান্ত হলো। কিন্তু ম্যানেজার ফর্মুলাটা বুঝছিল না। হলমার্কের অশিক্ষিত অথচ কুটবুদ্ধিসম্পন্ন এমডি ফাঁকিটা ধরতে পারল। লোভে তার চক্ষু চড়কগাছ! জিভ লকলকে। বলল, “স্যার আপনার মাথাটা তো অতি পরিষ্কার।”
স্যার বললেন, “এই ফলটা পাকানোর জন্য আমি ম্যানেজারের সহকারী হিসেবে এলসিতে অভিজ্ঞ অতি চতুর একজনকে নিয়োগ দেবো। আর আপনি একই কাজে অভিজ্ঞ দুষ্টু বুদ্ধিসম্পন্ন ব্যাংকের অবসরপ্রাপ্ত একজন ডিজিএমকে হলমার্কে নিয়োগ দেন, দাবার বাকি চাল তারাই দেবে। তবে দাওটা বড় হতে হবে। কারণ, এই খেলা চালাতে এবং কর্তৃপক্ষের মুখ বন্ধ রাখতে কয়েকজন ক্ষমতাধারীকে কিনে ফেলতে হবে। এমডি সাহেব তো ঘুষটুস খান না। উনার নাকের উপর চাকরি নবায়নের মিথ্যা মুলা ঝুলিয়ে রাখতে হবে। মোটুটা আপসে চুপসে যাবে।”

নীলনকশা অনুযায়ী দ্রুত কাজ চলছিল। কিন্তু বাধ সাধলেন নতুন দায়িত্ব পাওয়া হেড অফিসের জিএম। বকেয়া আদায়ের জন্য তিনি বারবার ম্যানেজারকে ফোনে তাগিদ দিতে লাগলেন। নির্দেশ না শোনায় জিএম সাহেব শাখা অডিটের উদ্যোগ নেন। আতংকিত হয়ে ম্যানেজার দৌড়ে এসে সবকিছু ডিএমডিকে জানালেন।
ডিএমডি বললেন, “আমাদের তো বাজেট আছে। জিএমকে কিনে ফেলো।”
“সেই জিএম স্যার তো বিক্রি হন না।”
“যত টাকা দিয়ে কেনা যায় চেষ্টা করো।”

কয়েকদিন পর --
“স্যার, জিএম স্যারকে কয়েকবার শেরাটনে দাওয়াত দিয়েছি, তিনি আসেননি। হলমার্কের অনুষ্ঠানে তো সবাইকে গিফট প্যাকেট দেয়া হয়েছে। হলমার্ক কৌশলে জিএম স্যারের প্যাকেটে একটি নতুন ফ্ল্যাটের দলিল আর চাবি রেখেছিলেন, সেখানেও তিনি যাননি। উল্টো শুনলাম অডিট করার জন্য নোট দিচ্ছেন তিনি। ভয়ে আছি স্যার!”
“বাদ দাও ভয়! আমি না ছাড়লে তো নোট এমডির কাছে যাবে না। কয়েকদিন আগে আরেক শাখায় এলসি দুর্নীতির দায়ে কয়েকজনকে বরখাস্ত করার জন্য এই স্টুপিড জিএম নোট দিয়েছিল। আমি বিস্তর কামাই করে সে নোট গুম করে দিয়েছি।”

দুদিন বাদে ম্যানেজার হন্তদন্ত হয়ে এসে বলল, “ স্যার আমার শাখায় স্পেশাল অডিটের নোট তো এমডি স্যার পাস করে দিয়েছেন।”
“কীভাবে?”
“আপনি গতকাল ছুটিতে ছিলেন, সে সুযোগে।”
“দাঁড়াও! এমডি- জিএম দুজনেরই চাকরি খাবো। আমাদের ভাগ থেকে কিছু টাকা খসে যাবে এই যা। হলমার্ককে বলো টাকার ব্যবস্থা করতে।”

এরপর জিএম এবং অডিটর দুজনই বদলি হয়ে গেলেন। এমডির চাকরিও নবায়ন হলো না। এমডি হবেন বলে ডিএমডি গোঁফে তা দিতে লাগলেন। সংশ্লিষ্টরা তাকে এমডির পদ দেয়ার নিশ্চয়তা দিলেন।

[ওই শাখায় যে পুকুর চুরি না হয়ে সাগর চুরি হচ্ছে সেটা প্রতিষ্ঠানের অনেকেই জানতেন, কিন্তু ভয়ে মুখ খুলছিলেন না কেউ। তবে মনে প্রাণে চাচ্ছিলেন জিএম দ্রুত অডিট শুরু করবেন। কিন্তু তাঁকে বদলি করায় সবাই ক্ষুদ্ধ হয়ে এ নিয়ে বলাবলি করতে লাগলেন। এক পর্যায়ে সাগর চুরির বিষয়টি মিডিয়ায় চলে আসে। ধরা পড়ে ইতিহাসে নজিরবিহীন চার হাজার কোটি টাকার ব্যাংক জালিয়াতি।]


মন্তব্য

কানা বাবা এর ছবি

চমৎকার লিখেছে। তবে চুরির পদ্ধতিটা ঠিক ভালো মত বুঝতে পারি নাই। যদি দয়া করে একটু বুঝিয়ে বলতেন তবে ভবিষ্যতে একটু কাজে লাগাতে পারতাম। হলমার্কের মালিকের মত আমিও একজন নগন্য গরীব আদমী।

/----------------------------------------------------
ওইখানে আমিও আছি, যেইখানে সূর্য উদয়
প্রিয়দেশ, পাল্টে দেবো, তুমি আর আমি বোধহয়
কমরেড, তৈরি থেকো,গায়ে মাখো আলতা বরণ
আমি তুমি, আমি তুমি, এভাবেই লক্ষ চরণ।।

ঈশান মাহমুদ এর ছবি

হলমার্কের অশিক্ষিত অথচ কূটবুদ্ধি সম্পন্ন এমডি....

এই দেশে টাকা কামাই করার জন্য আসলে বেশী শিক্ষিত হওয়ার কিংবা বেশী পরিশ্রম করার প্রয়োজন নেই । কিছু কূট-কৌশল জানলেই হলো। যে যতো বেশী পরিশ্রমী, সে তত বেশী গরীব। যেমন মাটি কাটা শ্রমিক কিংবা রিকশাঅলা।

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

একটা ব্যাপার আমার বোধগম্য নয়। এক্সপোর্ট এলসি কেউ হাতে করে ব্যাংকে নিয়ে আসে না। সেটা দেশের বাইরের কোন ব্যাংক থেকে সুইফ্‌ট বা এক্সপ্রেস মেইলে স্থানীয় ব্যাংকটিতে আসার কথা। এলসি শুধু আসলেই চলবে না, সেটা এলসি ওপেনারের ব্যাংকের সাথে বা ইন্টারমিডিয়ারী ব্যাংকের সাথে বেনেফিসিয়ারীর ব্যাংকের টেস্ট কী মিলতে হবে। এখন কেউ যদি নিজের বাসায় বা অফিসে বসে একটা এলসি বানিয়ে ব্যাংকে নিয়ে গিয়ে বলে, "এই যে আমার কোম্পানীর নামে এক্সপোর্ট এলসি এসেছে"; তাহলে তাকে পুলিশের হাতে সোপর্দ করার কথা বা সোজা হেমায়েতপুর/রাঁচী পাঠিয়ে দেবার কথা। সেটা যদি না করা হয়, আর ঐ বানানো এলসি'র বিপরীতে ব্যাক-টু-ব্যাক এলসি খোলা হয়ে থাকে বা কাজ চালানোর জন্য ঋণ দেয়া হয়ে থাকে তাহলে বুঝতে হবে মূল দুর্নীতিটা ব্যাংকের লোকজন করেছে। তাই এই দুর্নীতিতে হলমার্ক বা বাইরের লোকজনের চেয়ে ব্যাংকের লোকজনের দায় অনেক বেশি। ওএসডি করা, বদলি করা, সাময়িক বরখাস্ত করা বা চাকুরীচ্যুত করা আসলে কোন শাস্তি নয়। চুরি একটি ফৌজদারী অপরাধ। আমানতকারীদের অর্থ আত্মসাতের দায়ে সংশ্লিষ্ট সবার (ব্যাংকের লোকজনসহ) বিরুদ্ধে ফৌজদারী মামলা করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করা হোক।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

অতিথি লেখক এর ছবি

চলুক সহমত! ও,এস,ডি করা এই চোরদের শাস্তি হতে পারেনা। কমপক্ষে ১০ বছরের জেল ও যাবতীয় টাকা বাজেয়াপ্ত করা উচিত।

নির্ঝর অলয়

অতিথি লেখক এর ছবি

এই পর্যন্ত এ বিষয়ে নানা জায়গায় যা পড়লাম তাতে মনে হয়েছে এই স্ক্যামে সবচে প্রো-একটিভ কুলাঙ্গার এই ডিএমডিটি। এখানে তার কান্ডকীর্তি পড়ে মেজাজ ঠিক রাখাই দায়।বুঝতে পারছি আপনি সঙ্গত কারণেই তার নাম নেননি। তবে আমার ত আর সমস্যা নাই। আমি নিচ্ছি। একদলা থুথুর সাথে। তার নামটা দু শব্দের। তবে আমি আরেকটা শব্দ ব্যবহার করে দেখেছি, বেশ যায়।

বেজন্মা মাইনুল হক

বেজন্মাদের নিয়ে মাতামাতির মাঝে কিছু নাম অনেক কষ্টেসৃষ্টে এসেছে আমাদের কাছে। কিন্তু অনেক বেশি আলো তাদেরই প্রাপ্য ছিলো। বীরদের নামগুলোও আমি নিতে চাই। আভূমিনত শ্রদ্ধায়।

আ ন ম মাসরুরুল হুদা সিরাজী
এস এইচ এস আবু জাফর
শওকত আলী
এবং অন্য যাদের নাম আমি জানিনা।

কী সৌভাগ্য আপনার! এদের একজন আপনার সহোদর।

এ ইস্যুতে অনেক ইতং বিতং জপে মহাস্থবির মালাইলামা এখন সুর বদলাচ্ছেন। গতকাল প্রথমবারের মত বিস্ময়ের সঙ্গে তিনি বলেন, একটি শাখা থেকে এত টাকা চলে গেল! অবশ্য স্বভাববাচালটি নছিহত করতেও ভুলে নাই,

অনেক বিষয়ে তাৎক্ষণিক কোনো পদক্ষেপ নেওয়া যায় না। কারণ, সাক্ষী-সাবুদ পাওয়া যায় না। যেমন: ’৯৬-এর শেয়ার কেলেঙ্কারি মামলারই কোনো সাক্ষী পাওয়া যায়নি। তিনি বলেন, ‘দু-একটি ছাড়া আমাদের দেশে দুর্নীতি প্রমাণ করা গেছে এমন মামলা কম। এ জন্য আমার একটা প্রস্তাব আছে, সেটা হলো গণ-আদালত।

এ বর্ষিয়ান-ভুদাইরে কে বুঝাবে, ৯৬-এর শেয়ার কেলেঙ্কারির সাক্ষী পাওয়া যায় নাই, আইনিভাবে প্রমাণ করা যায় নাই ভাল কথা, কিন্তু কিছু লোকের জড়িত থাকার বিষয়টি ত অপেন সিক্রেট ছিল। তাদের একজনকে দলীয় উপদেষ্টা বানিয়ে বসাতে এই ঘটনার বিচারে তাদের দলীয় অবস্থানটা কি চিচিংফাক হয়ে পড়েনি? এ অবস্থায় ওই ঘটনা নিয়ে এমনতরো বুলি আবোল তাবোলের বেশি কিছু কি?

রব

ধ্রুব বর্ণন এর ছবি

আপনাকে অনেকদিন দেখি না বোধহয়? চিন্তিত

রব এর ছবি

জীবনবাবাজি ব্যাপক দৌড়ের উপর রাখছে, ভাই। তবে সচলে প্রতিদিনই আসা হয়। দৌড়ের উপর থাকায় ও আলস্যকারণে সবসময় মন্তব্য করা হয়না। মাঝেমধ্যে করি। তবে ক্যাপচায় প্রায়ই আটকে গিয়ে রেটটা পড়ে গেছে। এখন অবশ্য নতুন তরিকা পেয়ে গেছি।

আপনি ভাল আছেন, আশা করি।

স্যাম এর ছবি

চলুক

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।