মা সম্পর্কিত প্রলাপ...

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: রবি, ১৪/১০/২০১২ - ১২:২৮অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

রাগের মাথায় অথবা অবজ্ঞা অবহেলা করে অতি তুচ্ছ কারণেই মা'কে আঁতে ঘা দিয়ে কথা বলি, মনের ঝাল মিটিয়ে শান্তি পাই মনে; মা শুধু নির্বাক হয়ে তাকিয়ে থাকে, কিংবা বড়জোর মা অভিমান করে একদিন খাবার টেবিলে কথা না বলে চুপচাপ শুধু খাবার দিয়ে যায়;- মায়ের ঐসব ছেলেমানুষি আবেগে ভারাক্রান্ত হয়ে মান ভাঙাগড়ার সময় আছে? আগামি কালকের ইন্টার-কলেজ ফাইনালে কাপটা আমাদের হাতছাড়া হয়ে যায় কিনা- এই চিন্তায় বাঁচি না! সকালে ঘুম থেকে ওঠে টের পাই গায়ের উপর চাদরটি কখন এসে টেনে দিয়ে গেছে! এআর নতুন কী? বরং, পাশের বাসার আন্টি এইকাজ করলে না কৃতজ্ঞতায় মাথা নুয়ে আনতাম! টাকা চাইলে বলে, "এখন টাকা নাই পরে নিস।" পরক্ষণে আঁচলের খুঁট থেকে টাকা বের করে দেয়। তখন বলে উঠি, "তোর টাকা তুই রাখ!" বলেই ছুড়ে দিয়ে দেই ছুট... এই আকাট মুর্খ মহিলার সাথে কথা বাড়িয়ে সময় নষ্ট করব নাকি?

পরদিন কলেজে যাওয়ার পথে অভিমানী সুরে মা বলে ওঠে, "তোর বাবা এই টাকা কটা দিছে, তোকে রাখতে বলছে, পকেট খরচ।" কিন্তু জানি এটা বাবা দেন নি, মা'রই টাকা।

আমার মা'টি কী মূর্খ, একদম ছেলেমানুষ। কী লজ্জা! অন্যের মায়েরা কী স্মার্ট!...

প্রতিদিন এই রুটিন করে সকাল সাত থেকে রাত দশটা পর্যন্ত জব ক্লাস- কত্ত কাজ! আয়েশ করে দম ফেলবার সময়পর্যন্ত নেই। রাতে গিয়ে নিজে রান্না করে খেতে হবে। কাপড় চোপড় গুলো দুই সপ্তাহ অন্তর অন্তর ধুয়ে দিতে হয়, ভালো লাগে না আর! রান্না শেষে খেয়ে দেয়ে বিছানায় গড়ান দিতেই ঘুম- মরার মতন। ভোর ছটায় আবার জাগতে হবে যে!

স্টেশনের শত শত ব্যস্ত মানুষের ভিড়ে এক বৃদ্ধাকে দেখে থমকে দাঁড়াই। দুইপাশে দুটো ছেলে কোমর জড়িয়ে ধরে আলতো পায়ে ধীরে ধীরে সামনে এগুচ্ছে। দামী সুতোর কাপড়, গলায় মুক্তোর মালা। তারপাশ থেকে কয়েকটা ছেঁড়া ছেঁড়া কন্ঠস্বর ভেসে আসছেঃ
: এত লোকজনের মাঝে হাঁটতে কষ্ট হচ্ছে না তো মা? আরেকটু আসছে হাঁটো মা।
: তোকে বলেছিলাম না হুইল চেয়ারটা আনাতে?
: তাড়াহুড়ো করে আসাতে মনে ছিল না ভাইয়া।

বেঁচে থাকলে আমার মা'টাও নিশ্চয় এমন বৃদ্ধ হতো... তারপর? মা ঘরে পড়ে গিয়েছিলেন বেশ আগেই। সকালে না খেয়ে কলেজে আসতে চাইলে কিডনির প্রচন্ড ব্যথায় কঁকাতে কঁকাতে ক্ষীণ দুর্বল স্বরে ঠিকমত খাওয়া দাওয়া করে চলাফেরা করার আকুতি জানাত। মার অসুখ আর সারলই না। দেখাশুনার জন্য দুর সম্পর্কিত এক খালা এসে থাকতেন। সারারাত ব্যথায় কুঁকাতো। ঠিকমত ঘুমাতে না পারার জন্য রেগে গিয়ে আমি....

মা, তুমি হয়তো জানো না, রাতে ক্লান্ত শরীরটা বিছানায় ছুঁড়ে ফেলার সময় এখন খুব তোমার হাতের স্পর্শ পেতে চায়। পায় না। ঘুম না এলে এখন কেউ আর মাথায় বুলিয়ে দেয় না। ভোর কাপড়গুলো চেয়ারে দলা পাকিয়ে রেখে যাই, ফিরে এসে দেখি ওমনি পায়। হন্তদন্ত হয়ে না খেয়ে কাজে ছুটলেও এখন কেউ আর খেয়ে যাবার জন্য চিল্লাচিল্লি করে না। হাত কেটে ফেটে গেলেও এখন আর কারোর ভয়ার্ত চিত্‍কার করে ওঠে না, অথচ, তোমার চিল্লাচিল্লিতে তোমার উপর কতবার বিরক্ত হয়েছি, বকাবকি করেছি! মাঝে মাঝেই অনেক দূরে যেতে হয়- কাজে। যাওয়ার আগে কাছে ডেকে মাথায় হাত বুলিয়ে আজ আর কেউ বলে নাঃ "গাড়ি-ঘোড়া দেইখা যাইস! ভালা মুতন খাওয়া দাওয়া করিস! এই টাকা কয়ডা রাখ। পথে কিছু কিন্যা খাইস।" তোমার হাতে ধরে রাখা পুরোনো খুচরার দিকে তাকিয়ে থাকতাম।

মা, তোমাকে একটা অনুরোধ করি, প্লিজ রাখো। তুমি আবার ফিরে আসো।আমি আর কোনোদিন ভাতের থালা তোমার দিকে ছুঁড়ে মারব না। দেইখো তুমি। আর দূরে দূরে থাকব না তোমার। এতে যে যাই ভাবুক। তোমার দেওয়া ছেঁড়া টাকাগুলো আলতো করে নেব হাসিমুখে। মাঝরাতে কাঁচা ঘুম ভাঙিয়ে ভাত খেতে জোরাজুরি করলে আর অসভ্য গালি দিয়ে তোমার মন খারাপ করিয়ে দেব না, চুপচাপ খেয়ে ওঠব ঠিকঠিক। তোমার অসুস্থ অবস্থায় আমাকে যে একের পর এক ফরমাইশ দিতে আর আমি মুখ ঝামটা দিয়ে ফিরিয়ে দিতাম- বিশ্বাস করো, ওমনটি আর হবে না।

মা, আমি অনেক একা হয়ে গেছি। প্রতিদিন কান্নাভেজা চোখে তোমাকে মনে মনে খুঁজে ফিরি। তোমার সুশিক্ষিত অভিজাত ছেলে ঠান্ডায় জমে জমে মরা কাক হয়ে কাজে যায় আবার মরা কাক হয়ে রাতে বাড়ি ফেরে। চারপাশের প্রচন্ড ঠান্ডা নিয়ে তোমার গায়ের উঞ্চতা পাবার আশায় বিছানায় গা এলিয়ে দেয়- আঁতিপাতি করে তোমার হাত কাঁধ খুঁজে;- খুঁজে পায় না। প্রতিদিন স্মার্ট আর অভিজাত শিক্ষিত মা'দের ভিড়ে ছেলেটি তার মুর্খ আনস্মাট মায়ের মুখ খুঁজে বেড়ায়- ছায়ারও দেখা মেলে না। খুব একলা রাতে অন্ধকারে তোমার হাতটি ধরার জন্য হাত বাড়ায়,- নাগাল পায় না।

অন্ধকার বিষন্ন আকাশের দিকে তাকিয়ে মনে মনে ছেলেটি বলে ওঠেঃ অধম এই ছেলে অন্তত ক্ষমা করে দিও, মা।

কিঙ্কর আহসান

ahsan.kingkor@gmail.com


মন্তব্য

অতিথি লেখক এর ছবি

চোখ ভিজে এলো অচেনা কান্নায় - দাঁত থাকতে দাঁতের মর্যাদা না বলে মা থাকতে মায়ের মর্যাদা বলা উচিৎ?

সাফিনাজ আরজু  এর ছবি

আমি শুধু প্রবাদটা উল্লেখ করেছি, প্রবাদটা দাঁত থাকতে -- হাসি
আসল বিষয়টা হল- সঠিক সময়ে আমরা কোন কিছুর ঠিক ঠিক মূল্যায়ন করতে পারিনা।
স্কুল লাইফ শেষ হলে কলেজে গিয়ে স্কুল নিয়ে হা হুতাশ করি, ভার্সিটি উঠলে কলেজ নিয়ে অ্যান্ড সো অন।
কোন কিছু জীবন থেকে একেবারে হারিয়ে গেলে আমরা সেটা গুরুত্ব দিতে শুরু করি

আর মা তো সবার জন্য ,সব সময়ে সবচেয়ে মূল্যবান, যদিও আমরা কখনো সেটা সঠিক বয়সে এবং সঠিক সময়ে বুঝিনা

অতিথি লেখক এর ছবি

মন খারাপ খাঁটি কথা বলেছেন ভাইয়া। কিন্তু আপনার নামটি তো জানা হলো না...

-কিঙ্কর আহমেদ

সাফিনাজ আরজু  এর ছবি

মন খারাপ
এটাই সত্যি, দাঁত থাকতে দাঁতের মর্যাদা কেউ বুঝেনা। এমনিতেই তো আর প্রবাদটা হয়নি!!!

মন খারাপ করে দিলেন।
মায়ের কাছে যেতে মন চাইছে , কিন্তু উপায় তো নাই। ওঁয়া ওঁয়া

অতিথি লেখক এর ছবি

:'( ভাইয়া আমারও মন ভীষণ খারাপ। আমিও মায়ের কাছে যেতে চাই কিন্তু যেতে পারছি না। মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ...

-কিঙ্কর আহসান

অতিথি লেখক এর ছবি

:'( ভাইয়া আমারও মন ভীষণ খারাপ। আমিও মায়ের কাছে যেতে চাই কিন্তু যেতে পারছি না। মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ...

-কিঙ্কর আহসান

অতিথি লেখক এর ছবি

:'( ভাইয়া আমারও মন ভীষণ খারাপ। আমিও মায়ের কাছে যেতে চাই কিন্তু যেতে পারছি না। মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ...

-কিঙ্কর আহসান

সবুজ পাহাড়ের রাজা এর ছবি

মনটা খারাপ হয়ে গেলো।

অতিথি লেখক এর ছবি

মন খারাপ আমারো মন খারাপ ভাইয়া। মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ।

কিঙ্কর

এক জোনাকি এর ছবি

আপনার মা যেখানেই থাকুন, দোয়া করছি আপনার ভালবাসা, মনের আকুতি ঠিক পোঁছে যাচ্ছে ওনার কাছে।
মন খারাপ করেন না, মায়েরা সবসময় সন্তানদের সব দোষ ক্ষমা করে দেন, আপনার মা ও নিশ্চয় এক বুক ভালবাসা
নিয়ে ওপার থেকে তাকিয়ে আছেন আপনার দিকে, আপনি ভাল থাকলে উনি শান্তি পাবেন। অনেক ভাল থাকুন, শুভকামনা রইল।

কিঙ্কর আহসান এর ছবি

এক জোনাকি, আপনাকে অনেক ধন্যবাদ হাসি

-কিঙ্কর

প্রৌঢ় ভাবনা এর ছবি

শুভ কামনা।

অতিথি লেখক এর ছবি

দুঃখিত, আপনার প্রতি সহমর্মিতা দেখাতে পারছি না। আমরা অনেকেই হয়তো দুনিয়ার ঝাল মায়ের উপর ঝাড়ি, কিন্তু থালা ছুড়ে মারা, অসভ্য গালি দেওয়া একেবারেই মেনে নিতে পারলাম না। -রু

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।