বালক ভুল করে যায়

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: সোম, ১৫/১০/২০১২ - ১১:৪৩পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

পূবের পথ ধরে সন্ধ্যা নেমেছে বেশ আগেই। পূবের আকাশ ধরেই পাখিরা ফিরে গেছে ঘরে। কিংবা যারা অন্যদিকে থাকে- সেই বকের সারিরা, একলা শালিক- সবাই ফিরে গেছে। ডানাগুলো এখন হয়তো জুড়িয়ে নিচ্ছে সবুজের নিভে যাওয়া ছায়ায়। ভাসান বেলা এইতো শেষ হল বলে। বালকেরও ফেরার কথা ঘরে এসময়- সাথে করে আজন্ম উড়া উড়ির সাধ নিয়ে পোষা ঘুড়ি। অদ্ভুত আঁধার নেমে গলি-ঘুপচি খুঁজে নেয়ার আগেই খুঁজে নিতে হবে নিকনো উঠোন- কেরোসিন বাতি। তারপর কলপাড় থেকে বাঁশঝাড় নিঝুম হয়ে যাওয়ার শব্দ চোখে মেখে ফিরে এসে চোখ বুলানো “রূপসার ঘোলা জলে হয়তো কিশোর এক শাদা ছেঁড়া পালে”।

এতসব ভাবনা বালক গুছিয়ে ভাবতে পারে না এখনো। তাই বালক কাঠিতে সুতো গোটায়। ছোট ছোট হাতে সুতো গুটিয়ে চলে। ডানহাত দিয়ে আস্তে করে সুতো টান দিয়ে বামহাতের কসরতে। ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে চলে কাঠি দ্রুত। সুতোর কাঠি একটু ঢিলেঢালা হলেও আজ আর ঠিক করার সময় নেই। অনেক দ্রুত- তার থেকে দ্রুত আঁধার নামতে থাকে যে পৃথিবীজুড়ে আজ। নামতে থাকে ভয়েরা। খোলা বিরান মাঠ জুড়ে বাস করা অচেনা অনুভূতিরা আড়মোড়া ভেঙ্গে জেগে উঠতে থাকে। শুনশান- নিস্তেজ- ঘুমন্ত আঁধারে অনভ্যস্ততায়, কাঁপা কাঁপা হাতে বালকের দেরি হয়ে যায়- বালকের ভুল হয়ে যায়।

বালক সুতোর কাঠি ছুড়ে ফেলে দেয় মাটিতে। সুতো দু’হাত দিয়ে টানতে টানতে নামাতে থাকে ঘুড়ি। বাতাসের বিপরীতে ঢেউ তুলে নামতে থাকা ঘুড়ি বিদ্রোহ করে বসে। প্রতিটি টানে গম্ভীর থেকে হটাত উচ্চস্বরে চেঁচিয়ে উঠে মেঠো ঘুমে অনৈতিকভাবে প্রবেশ করতে থাকে ঘুড়িতে লাগানো বেত। এমনি কোনো এক হ্যাঁচকা টানে হটাত করে ছিঁড়ে যায় সুতো- উড়ে যেতে থাকে ঘুড়ি ঐ পশ্চিমে- ঐ দূর আঁধারে। বালক হকচকিয়ে যায়। একটু একটু ভয় করলেও বালকের গায়ে তার আঁচ লাগে না- টের পাই। কারণ ততক্ষণে খোলা মাঠ পেরিয়ে ছুটতে শুরু করছে সে।

ছুটতে ছুটতে একদম মাঝ নদী যেমন তেমনি শূন্য এক বাতাস খোলা প্রান্তরে গোত্তা খায় ঘুড়িটা। কোনো এক অস্পৃশ্য টানে বালকও ভাসতে ভাসতে চলে আসে- নাও ভেড়ায়। নাটাই সুতো ছিঁড়ে উড়ে যাওয়ার সাধ যখন হুহু বাতাসেও মেটাতে পারলি না তবে চল ফিরে, বালক দেখ তোর অদৃশ্য টানেই কতোটা ব্যাকুল। এই পথ একা পাড়ি দেয়নি কখনো যে এর আগে।

অতঃপর মৃদু তিরস্কারের পর অনুরাগে গলাগলি। বালকের কাঁধ ছুঁয়ে ছুঁয়ে বাতাসে ঢেউ কাটে ঘুড়ি। আঁধার সাঁতরে কেটে যায় সময়ের ফোঁড়। অনেকটা পথ যেতে হবে।

কিন্তু যেতে যেতে সে আর পুকুর পাড় খুঁজে পায় না, খড়ের গাদাও যেন নেই কোথাও। ফেলে যাওয়া সুতোর কাঠি- স্যান্ডেল শিশিরের ক্যানভাস হয়ে পড়ে থাকে। বরং ফিরতি পথে সেই বহুদূরের মাঠে কখনো সে দেখে স্কুল কখনো নদীর কিনার, কখনো তার পাড় ঘেঁষে মেলা বসে কখনো বা ভাঙ্গনের গ্রাস খুবলে খায় দুধেল ধান। বালক আবার ভয় পায়- মুখ লুকায়।

বালক ছুটতে থাকে। ঘোর সন্ধ্যার আকাশ- নিকষ অন্ধকার রাত্রির আকাশ সব পাড়ি দেয়। খোলা ধানের খেত, কালো দীঘির জল, কালো ধোঁয়ায় খেয়ে চলা শালবন, ছনে ছাওয়া দোচালা ঘরের উপর গজিয়ে উঠা ইমারত, বাড়িঘর ছেড়ে একটু দূরে জায়গা নেয়া কবরস্থান, নিশুতি পেঁচার ডাক সব পাড়ি দেয়। চেনা হাইওয়ে ভুলে বালক ভুল পথে নাগরিক শহরের আগন্তুক হয়ে যায়। ট্রাফিক পুলিশ- সার্জেন্ট ঘুমায়, রাস্তাগুলো- গাড়িগুলো ঘুমায়। লাল- নীল বাতির ফোয়ারা, হকার, কোনো রাস্তার ধারে উচ্ছিষ্টের ছেঁড়া পলিথিন বিছিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে পথ শিশু বা লম্বা উষ্কখুষ্ক চুলের নির্জীব চোখের লোকটা। সারাদিনের ক্লান্তি ভুলতে বা আগামী দিন আবার যুদ্ধে নামতে হবে এই তাড়নায় ঘুমিয়ে পড়েছে কতশত নাম। তাদের সাথে বাড়িঘরও ঘুমায়- খাঁচাগুলোও একটু হেলান দিয়ে নেয় আঁধারে। ওদের চোখে চোখে পর্দা উঠে নামে সারাদিনের রোদ- ধুলোমাখা ক্লান্তিতে।

সেই ভুল সময়ে বালকের ছোটা শেষ হয় যেন, আগন্তুক হয়ে আসে কোনো এক জানালায়। পর্দার ফাঁক গলে ভোর আসার আগে, আযানের সুর ভেসে আসার আগে, কিছু পাখির আবার জেগে উঠার আগে হটাত বালক নিজেই ঘুড়ি হয়ে যায় যেন। সেই কবেকার কোন গাঁয়ে এক বালকের অন্ধকার শিখে যাওয়া, নিভে যাওয়া সূর্যের পর পৃথিবীর ছায়া খুঁজে পাওয়া। হাঁটতে হাঁটতে- ছুটতে ছুটতে ঘুমের দেশের দরোজা খুঁজে বের হয়ে জাগতিক ক্লান্তির পাঠ নিয়ে ফেলা বালকের কোনো এক স্টেশনে থামার ইচ্ছে হয় যেন এতদিনে। নিতান্তই কৌতূহল হয়তো।

এবার সে নিজেই অদ্ভুত ঘুড়ি হয়ে সুতো নাটাই ছাড়াই কাউকে টেনে নিয়ে চলে জানালা গলিয়ে। না কেউ নিজেই মেঠো পথে উড়াল দিতে জানালার টুকরো আকাশে মেঠো ধুলো ছড়িয়ে দিয়েছিল মুঠোভরে! হয়তো কারো কখনো ঘুড়ি হতে মন চায়! কখনো বা সুতো ছিঁড়ে উড়ে যেতে মন চায়- গোত্তা খেতে মন চায়। তাই বোধহয় হটাত খেয়ালে ঘরের পথ ভুল করে ছুটতে ছুটতে বা ভাসতে ভাসতে অথবা অদ্ভুত কোনো ভাবে ঘোর সন্ধ্যা- নিগূঢ় ভোর হয়ে যায়, মানবিক গাঁ- নাগরিক শহর হয়ে যায়। আর একই অদ্ভুত খেয়ালেই বালক- ঘুড়ি হয়ে যায়। বারবার পথ ভুল করে যায়।

--------------------------------------------------------------------------------------------------------------------

কড়িকাঠুরে...
১১.১০.২০১২


মন্তব্য

ব্যাঙের ছাতা এর ছবি

বাহ! কী অদ্ভূত সুন্দর লেখা ! চলুক

কড়িকাঠুরে এর ছবি

অনেক ধন্যবাদ।

সাফিনাজ আরজু  এর ছবি

চলুক

কড়িকাঠুরে এর ছবি

আপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা- - হাসি

সবুজ পাহাড়ের রাজা এর ছবি

ভাল লাগল।
আরো লিখে যান।

কড়িকাঠুরে এর ছবি

মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ।

নিবিড় এর ছবি
কড়িকাঠুরে এর ছবি

হাসি - আপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা-

ধুসর জলছবি এর ছবি

ভাল লেগেছে। চলুক

কড়িকাঠুরে এর ছবি

ভাল লেগেছে জেনে আমারও ভাল লাগল- আপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা-

প্রৌঢ় ভাবনা এর ছবি

ভাল লেগেছে। চলুক

কড়িকাঠুরে এর ছবি

অনেক ধন্যবাদ আপনাকে। ভাল থাকুন- হাসি

সাফিনাজ আরজু  এর ছবি

চলুক

আলোকিতা এর ছবি

মনটা কেমন কেমন করে উঠল যেন!!.....

কড়িকাঠুরে এর ছবি

ভাল কিছু হোক।- আপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা-

তানভীর রাব্বানী এর ছবি

ভাল লাগল। চলুক

কড়িকাঠুরে এর ছবি

ধন্যবাদ... হাসি

অতিথি লেখক এর ছবি

কড়িকাঠুরে দা, অসম্ভব ভালো লাগা ছুঁয়ে গেল। উত্তম জাঝা!

অমি_বন্যা

কড়িকাঠুরে এর ছবি

ভাল থাকা হয় যেন- হাসি

সুলতানা পারভীন শিমুল এর ছবি

শেষের দুই প্যারা ছুঁয়ে গেলো বেশি করে...

...........................

একটি নিমেষ ধরতে চেয়ে আমার এমন কাঙালপনা

কড়িকাঠুরে এর ছবি

হাসি - আপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা- ...

মণিকা রশিদ এর ছবি

ভালো লিখেছেন! হাসি

----------------------------------------------
We all have reason
for moving
I move
to keep things whole.
-Mark Strand

কড়িকাঠুরে এর ছবি

অনেক ধন্যবাদ... হাসি

তারেক অণু এর ছবি
কড়িকাঠুরে এর ছবি

অনেক ধন্যবাদ আপনাকে... হাসি

মেঘা এর ছবি

মনে যেন ছন্দময় একটা কবিতা পড়ে গেলাম। চমৎকার লেগেছে। চলুক

--------------------------------------------------------
আমি আকাশ থেকে টুপটাপ ঝরে পরা
আলোর আধুলি কুড়াচ্ছি,
নুড়ি-পাথরের স্বপ্নে বিভোর নদীতে
পা-ডোবানো কিশোরের বিকেলকে সাক্ষী রেখে
একগুচ্ছ লাল কলাবতী ফুল নিয়ে দৌড়ে যাচ্ছি

কড়িকাঠুরে এর ছবি

আপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা- ... হাসি

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।