প্রলাপ

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: শনি, ০১/১২/২০১২ - ৫:৪৭পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

কতকাল ধরিয়া মনের গুপ্ত কুঠুরিতে চিন্তাগুলা ফুটিতেছিল! দিনে দিনে ইহারা ফুটিয়া চাউলের মতন নরম হইয়াছে, দুঃখতাপে এবং চাপে আশা ভরসাকে মাড় বানাইয়া মনের আগুন নিভাইয়াছে। শাপে বর হইয়াছে , বিদ্রোহকে দানা বাঁধিয়া উঠিবার সুযোগ দেয় নাই । না হইলে কি আর লঙ্কা অক্ষত থাকিত!

এক্ষণে নিজের বিষয়ে বলি। আমি দুই হাত ভরিয়া খরচ করা উদাসী বাপের দুগ্ধপোষ্য সাবালক পুত্র ।সংসার শব্দের আভিধানিক অর্থে আমারে কেহ আটকাইতে না পারিলেও “তোমার গৃহে অন্নের সংস্থান হয় কোথায় হইতে?
এই প্রশ্নের উত্তরে –“ডাইনিং টেবল হইতে” বলিয়াছিলাম দেখিয়া পিতৃদেব এর ধারণা আমি নাকি সংসার বানান করাই কেবল শিখিয়াছি!
কিন্তু আমার সহচরেরা যে এই বিষয়ে বাপের পেশার প্রসঙ্গ টানিয়া অহেতুক জটিলতার সৃষ্টি করে, তাহাতে দেখিলাম তাঁহার আপত্তি নাই!

যৌবন বৃক্ষে মুকুল আসি আসি করিতেছে, এমন এক বসন্তদিনে এক কুটিল আনিল সেই সংবাদ। মায়াকানন। সেইখানে নাকি প্রাণের উৎসব চলিতেছে, তাহারই ধারাবাহিকতায় নূতন পুষ্পদিগের আহ্বান করা হইয়াছে! তবে মনিষীদিগের কঠিন প্রশ্নবাণের মধ্য দিয়া সেইখানে প্রবেশ করিতে হয়।

নগ্নকাল হইতে পার্শ্ববর্তী বাটীর যে মিত্র অদ্যাবধি আমার সঙ্গ লইয়াছে(বর্তমানে আমার কক্ষ সঙ্গী), আমাকে তাহার বুদ্ধি অনুসারে প্রায়শ চলিতে হয়।
জিজ্ঞাসিলাম, যাই?
সহচর কহে, কী প্রয়োজন? পাঠশালার ব্যাঘাত ঘটিবে।

তাহাকে না জানাইয়া মায়াকাননে গমন করিলাম। আমি স্বল্পজ্ঞানী মানুষ, উত্তর ত করিতে পারিবনা!
যাহাই হউক, কতিপয় জ্ঞানী ব্যাক্তির সম্মুখে বসিব, ইহাই যথেষ্ট!

প্রথম প্রশ্ন- “উঠান ঝাঁট দিতে হয় কি করিয়া জান ত?”

একী! আমি ত “শকুন্তলা” মুখস্থ করিয়া আসিয়াছিলাম!

এহেন বহু জটিল প্রশ্ন করা হইল। মায়াকাননে অতি কষ্টে ঢুকিলাম।
সহচর শুনিয়া কহিল- এইবার পড়ালেখা লাটে উঠিবে।
সর্বদা তাহার অভিভাবকত্ব বিরক্তিকর। বলিলাম-তোর মতন কি বইয়ের পৃষ্ঠা গুণিতে আসিয়াছি? শিল্পচর্চা করিবনা?

সে আমাকে বহুদিন ইহার বিরুদ্ধে যুক্তি দিয়াছে। আমি আবেগপ্রবণ বটে, তা বলিয়া শিল্পের সহিত আপোষ চলেনা।
ইহার জন্য ক্ষুদ্র ত্যাগের প্রয়োজন রহিয়াছে। সুতরাং এক কক্ষে বাস করিয়াও সহচরের সহিত আমার আর খুব একটা যোগাযোগ হয়না।

মায়াকানন যে কত বিচিত্র একটা স্থান, তাহা যদি বন্ধু বুঝিত!একেকজন ওস্তাদ ওস্তাদ লোক যেভাবে নূতন পুষ্পদিগেরে ফুটাইয়া তুলিল, আমি অভিভূত!
সোহাগে, শাসনে , নিয়ম নীতিতে, পরিপূর্ণ করিল।
আমি বেশ বুঝিয়াছি ঘি মাখন খাইয়া এতদিন কিছুই শিখি নাই। এইবার লইতেছি আসল শিক্ষা। এতদিন হাত পায়ে বড় হইতেছিলাম,
এখন বাড়িতেছি, পুষ্ট হইতেছি, জ্ঞানলাভ করিতেছি। তুচ্ছ একটা বিষয়ে প্রশ্ন করিলে বিশদ উত্তরের সহিত উচ্চারণ করিতে প্রাণ যায় এমন ফরাসি,জার্মান মহৎ লোকেদের নাম শুনিতেছি। কান-প্রান দুইই ধন্য।
আর এইখানে স্নেহের ঘাটতি নাই। যাহা চাইবে, পাইবে। মহীরুহ অগ্রজ আসিলে ত সেইদিন বিরাট ভোজ হইবে।
ইচ্ছামত ঘুরিয়া ফিরিয়া, গল্প করিয়া বেড়াও কেহই কিছু বলিবেনা।
শুধু অসময়ে তোমাকে জল আনিতে যাইতে হইবে, এই যা! জলকে চলিতে চলিতে কত জনার যে কত কাহিনী হইয়া গেল, দীর্ঘ ইতিহাস।

মায়াকানন আমার মনে ধরিল। আমি আমার বিরক্তিকর কক্ষ ছাড়িয়া দিবারাত্রি সেইখানে পড়িয়া থাকিতাম।
কতিপয় প্রাণের বন্ধু পাইলাম। ইহারা ভিন্ন আহার নিদ্রা হইতে গিয়াও হয়না, কেহ মনে দাগা পাইলে সেই দুঃখ অন্য সকলে বাটিয়া লই।

বালিকাদিগের সহিত খুব একটা মিশিতাম না।
একদিন মুড়ি খাইতেছি, পিঙ্গলকেশী আসিয়া কহিল- ভাই! মায়াকাননের লোকেদের ঠিক বুঝিতেছিনা।
তাহারা ছড়াইয়াছে অমুক তিন- তিন জনের সহিত আমার সম্পর্ক! আমি তাহাদের ভ্রাতার নজরে দেখি।”

দেখ কাণ্ড! পিঙ্গলকেশীরে “গণ-রাই” বানাইলে যে তাহার গনোরিয়া হইবে, এই সহজ তথ্য কি মায়াকাননের অধিবাসীরা জানেনা?
তাহারা সুরুচিসম্পন্ন ,তাহারা যে অনর্থক গুজব ছড়ায়না, তাহা কী আমার বুঝাইয়া দিতে হইবে!
বিরক্তি ঢাকিয়া কহিলাম- বাজে কথায় কান দাও কেন? তোমরা মেয়েরা সর্বদাই তিলকে তাল করিতে চাও!

অনতিকাল পর আদরযত্নে সামান্য ভাটা পড়িল। বুঝিলাম না কী কারণে যে শুধু পেটমোটা একটা বাধাই খাতা হইতে কাগজে লেখা নকল করা ভিন্ন শিল্পচর্চার আর কোন বালাই নাই। উঠিতে ধমক, বসিতে শাসন আর পান হইতে চুন খসিলে অনুজের সামনে অপমান।

সহচর কহিল- "শোন, এখানকার অনেককেই কপাল চাপড়াইতে দেখি। তুই চলিয়া আয়। খাটিতে খাটিতে উহাদের প্রাণান্ত। কিছুই পায় নাই।"
রাগিয়া বলিলাম- পাওয়ার আশা করিলে এমনি হয়। তাহারা শুধু খাটিতেই শিখিয়াছে, মাথা ব্যবহার করিলনা কেন? তাহারা কপাল চাপড়াইবেই।
-তুই কি করিবি?
-আমি? শিল্পচর্চা করিব! দেখিস নাই ভ্রাতা তথাগতের চশমার পাওয়ার? এমন জ্ঞানী হইব।

মুখে এই কথা বলিলেও সকলে অতিষ্ঠ হইয়াছিলাম। কিন্তু কতিপয় ঘটনা দ্রুত ঘটিল। একদিন এক জন কহিল- কি হে! তোমাদের রসিক অগ্রজ যে মধুকুঞ্জ খুলিয়াছে! কি হইতেছে এইসব?

রসিক অগ্রজকে আমার বিশেষ পছন্দ। তাহার উদ্দেশ্য ত সকলের প্রাণ জাগাইয়া তোলা। তাহাকে ঘিরিয়া কাহাকেও গান গাহিতে দেখিতাম, কেহবা পকেট খসাইয়া খাবার খাইত। মেজাজ অনুকুল থাকিলে নিজেই তিনি পয়সা দিয়া কহিতেন- যা না, জিলাপি খা...
তাহার মত মানুষের নামে অভিযোগ!
সে ব্যাক্তি কহিল- “আরে ভাই! যাহাদের উপকারে তিনি সিদ্ধহস্ত-তাহাদের হইতে একটাও বালকের নাম বল ত? কিছুই ত জাননা ছাই!”

আরেকজন আসিয়া কহিল-“ভাই, তোর খৎনা হইয়াছে না?”
আমি ঈষৎ অপ্রস্তুত হইয়া কহিলাম- “হাঁ ভাই। কিন্তু কেন?”
সে ব্যাক্তি যেন পাইয়া বসিল- “অনুজেরা সকলেই তোরে দাদা ডাকে কেন? “
অবাক হইলাম। দিদি ডাকিবে নাকি?
সে বলিল-“খেয়াল করিয়া দেখ, মালাউনে মালাউনে সয়লাব হইয়া গিয়াছে। ইহা একটা কারচুপি। সকলকেই নিজেদের মত মালাউন বানাইতে চাহে।”
উত্তমরূপে না ভাবিয়াই কহিলাম- ঠিক ত!
কিন্তু সহচর কহিল- “মায়াকাননে দিনভর বিশ্রী তালে সুরে বেসুরে লালন গীত হয়। সেইখানে মালাউন-মুসলমান এই জাতীয় শব্দ আসে কী করিয়া? ঢের হইয়াছে। তুমি ফিরিয়া আইস।”
কহিলাম- “খেলাটা না জমিলে কী করিয়া আসি?”
সহচর বিরক্ত হইয়া কহিল- “খেলিবে না ত একদান! হইবে কেবল গুটি। কী দরকার নির্বোধের মত খেলা দেখিবার?”

এক যুধিষ্ঠির আসিয়া সান্ত্বনা দিল- “পাঁচজনে পাঁচটা কথা বলিবে। দশজনে দশটা। তুমি স্থির থাকিও। মায়াকানন ত্যাগ করিও না।”

একদিন একটা অনর্থ বাঁধিয়া গেল। সহচরের বাক্য ফলিয়া গেল। দান দিতে পারিলাম না সেই সাথে খেলাও দেখিতে পারিলাম না।

কিন্তু সকলেই সকলের অনুকূল পরিবেশ পাইয়াছে বলিয়া দাবী করিল, মাঝখান হইতে কেহ কেহ কিছু না করিয়াও হইল কিঞ্চিৎ চক্ষুশূল।

যাহাই হউক, আমরা আত্মহারা হইয়া সকলের সহিত মিলাইয়া চলিতেছিলাম।
যখন কেহ ডাকিয়া কহেন যে “বর্তমানে পূর্বের চেয়ে অবস্থা উত্তম কি?” সকলেই নিজ- গৃহের নুন খাইয়া মানুষ, কাহারো গুণ গাইবার প্রশ্ন অবান্তর। সকলে বলি-“বিলক্ষণ”। নাম ধরিয়া হরিনাম সংকীর্তন করিলে তাহাতেও সায় ।

কিন্তু বিচিত্র কারণে চিত্র বদলাইতে লাগিল। স্থির প্রতিজ্ঞ লোকেরা সন্ধ্যা নামিতেই হারাইয়া যায়! যাহার প্রয়োজন নাই বলিয়া সে নিজ কর্মে প্রমান করিয়াছে, শুধু তাহাঁরই সন্ধান মিলে! একটা বিশাল অংশ বিষয়টার ভবিষ্যৎ বুঝিয়া নিজদিগকে গুটাইয়া লইল।

অর্জুন ডাকিয়া কহিল- ভাই দেখ, এইবার একটা উত্তম সূচনা হইয়াছে, অল্প সময় লাগিবে, দায়িত্ব বিশাল ত!

সক্রিয় পরচর্চা আর গুটিবাজির প্রথম অধ্যায় আরম্ভ করিয়াছি ,দৈবাৎ দেখি অগণন হিসাব নিকাশের মধ্য দিয়া শিল্পচর্চা হিসাবের বাহিরে অবস্থান করিতেছে! আর সহ্য হইলনা। অবস্থা বেগতিক দেখিয়া বিভীষণের নিকট যাইব স্থির করিলাম। সে বাটীতেই ছিল। কহিলাম- “খুব ত দেখাইয়াছিলে! কী হইল?”
সে দ্বিগুণ উত্তেজিত-“ মধ্যরাত্রে সকল সিদ্ধান্ত লইয়া প্রভাতে সেইসব চাপানো হয় আর অপরাহ্ণে দোষারোপ। সম্মান যাইবার ভয়ে কিছু বলিতে পারিনা। সম্মানহীন খাটিব কেন? আগে ত মায়াকাননে কেহ আসিলে বা বসিলে দুই চারিদিন আগে সংবাদ পাইতাম, এক্ষণে উপস্থিত অতিথির সামনে ডাকিয়া আনিয়া কহে উনি যে আসিবে, তাহার খেয়াল থাকিতে নাই?
আমি যোগ করিলাম-পূর্বে তো কাপড় ধরিয়া টানাটানি ছিল আর এক্ষনে যে শিল্প বানান লিখিতেছে “ষ” দিয়া? তাহার কি হইবে?
বিভীষণ কহিল- “সহমত। আলোচনা হইবে। সকলেই বলিবি। আমি নেতৃত্ব দান করিব।”

যথাসময়ে আলোচনায় অল্প অল্প কথাবার্তা হইল বটে, কিন্তু নেতা বিভীষণ নামকরণের সার্থকতা বজাইয়া রাখিল।
পরে নিভৃতে পাইয়া কহিল-“ অল্প ঝামেলা বিদ্যমান ছিল-আমি যে আবার ইহাদের স্নেহ লালিত-সেইদিন উত্তেজনার বশে তাহা ভুলিয়া গিয়াছিলাম।

তথাগতের অস্তিত্ব বিলোপ পাইয়াছে। এক রাত্রিতে যুধিষ্ঠির দীর্ঘশ্বাস ফেলিয়া কহিল- “আমার কোন মন্তব্য নাই”। অর্জুনের ভগ্নদশা- দুঃখের হাসি হাসিয়া কহে, “ভাবিয়াছিলাম এক, হইল আরেক।আগে জানিতাম না”!

সহচরকে বলিলাম- বইপত্র ত উঁইয়ে কাটিয়াছে। কী করি?

সে কহিল-“সোজা বাটী চলিয়া যাও। তোমার পিছনে সময় নষ্ট করার মতন সময় আর নাই।”

মায়াকানন কারাকানন হইয়া গিয়াছে। যাবজ্জীবনের সম্পুর্ন বন্দোবস্ত। এবং সশ্রম। দেখিতে দেখিতে সব বদলাইয়া গেল, ভাবিলে বোকা বনিয়া যাই, আগে ভ্রাতা হইতে গেলে কোলাকুলি করিতে হইত, রাখিবন্ধনের মত জটিল ব্যাপার বিদ্যমান ছিল। বর্তমানে সহজ, বিত্তবান ব্যাক্তির ঠিকুজি দেখাইয়া দিলে আজীবন ব্রাদারহুড নিশ্চিত।

আমি পলাতক। কিন্তু কোন কোন মধ্যরাত্রিতে অমোঘ টানে মায়াকাননের আশেপাশে ঘুরিয়া আসি। অবাক হইয়া দেখি, যেস্থানে নিশিযাপন না করিলে ভাত হজম হইত না, আজ তাহার প্রাঙ্গনে গেলেই বমি ছুটিয়া আইসে। এক্ষনে সংসার মানে বুঝিয়াছি-সেই যে –“সংসার মানে হইল আমড়া, আঁটি আর চামড়া, খাইলে হয় অম্লশুল!” পিতৃদেবকে জানাইতে হইবে।
কাহারো উদ্দেশ্যে কিছু বলিবার নাই, শুধু বলিতে ইচ্ছা করে-

"রাজনীতি,
ভুলেও পথে একাকী বাহির হইওনা
তোমারে ধর্ষিতে বড় সাধ হয়!"


মন্তব্য

অতিথি লেখক এর ছবি

লেখঅ ভালো লেগেছে। ভাষা হিসেবে সাধু কেন বেছে নেয়া হয়েছে? লেখকের পরিচয় নিয়ে সংশয়ে আছি। এটা কি ভুলে বাদ পড়ল? নাকি আমি চিনতে পারছি না?

স্বয়ম

কৌস্তুভ এর ছবি

হুমম, লেখকের নাম নেই কেন?

মুহূর্ত  এর ছবি

লেখকের নাম জানতে চাই।।।। ম্যাঁও

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।