বুড়ো বন্ধু এবং সাহিত্যপ্রেম

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: বুধ, ২৭/০২/২০১৩ - ১০:৪৮অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

আমাদের প্রি-ক্যাডেট স্কুলের পূব পাশে আকাশী রঙের যে বিল্ডিংটা দুপাশের অন্যান্য হেঁজিপেঁজি দোকানপাটের মাঝখানে একলা একা দাঁড়িয়ে আছে, যাতে সারাটা সকাল বোরিং ক্লাশের পর ভীষণ ক্লান্ত হয়ে সারি সারি বইয়ের আলমারীর মাঝে মুখ লুকাতাম,- দ্বিতীয় শ্রেণীর বার্ষিক পরীক্ষার পর ১০ টাকা ফি দিয়ে ঐ পাঠাগারে ভর্তি হবার পর থেকেই যে সাহিত্যের প্রতি আমার ভালোবাসা জন্ম নিয়েছে তা কিন্ত নয়। কিংবা, কবে কখন কীভাবে সাহিত্যের প্রেম পড়ে গিয়েছিলাম আজ এতকাল ভালোবাসাবাসির পর আর ঠিক মনে পড়ছে না। বড়জোর, এই শীতরাতে লেপের আদরে চোখ বন্ধ হয়ে আসলে ছোটো ছোটো স্মৃতিরা এসে ভীড় জমায়; প্রথম প্রেমের মতই যে স্মৃতি মনে দাগ কেটে আছে- যাকে সারাজীবনেও ভোলা যায় না। সাহিত্য আমার প্রথম প্রেম। যখন আমি চারপাশের বাস্তবতা এবং ভাবনার সাথে খাপ খাওয়াতে পারছি না, জোর করে মিশে যেতে বলা হচ্ছে সেই জীবনের সাথে, আমি বিপন্ন থেকে বিপন্নতর হচ্ছিলাম ধীরে ধীরে, নিজেকে একলা একা লাগছিল- তখন ১০ টাকা বার্ষিক চাঁদার বিনিময়ে ঐ নিঃসঙ্গ বুড়ো ঘরটার সাথে বন্ধত্ব পাতা হয়ে গেল। আমার মতো অনেকেই বন্ধু ছিল তার, নিভৃতচারী কবিরা যেমন অনেক বন্ধু আর জনতার মাঝে একা হয়ে থাকেন নিজেদের ভেতরে তেমনি ঐ বুড়ো পাঠাগারটিকেও অনেক বন্ধু আর জনতার ভিড়ে আমার কাছে নিঃসঙ্গ কবির মত মনে হত। আমার নীরস আর একাকিত্বে হাবুডুবু খাওয়া অজস্র মুহূর্ত সেইসব বই প্রেমে অপ্রেমে আনন্দ বিষাদে ভরিয়ে রেখেছে। আমাদের প্রেমটা ছিল আজকালকার লিভিং টুগেদারের মত!

সিমোন দ্য বোভোয়ার আর সার্ত্রের মাঝে যে ধরণের প্রেম ছিল, আঙ্গিকগত দিক থেকে, আমাদের প্রেম তাদেরটার সাথে মিল আছে। শোনা যায়, তাঁরা পরস্পর পরস্পরের প্রতি যেমন প্রবল ভালোবাসায় মোহগ্রস্থ ছিলেন, তেমনি আবার তাদের প্রত্যেকের একাধিক প্রেমিক/প্রেমিকা ছিল। তবুও, শেষদিন পর্যন্ত তারা কি পরস্পর পরস্পরের প্রতি তীব্র প্রেম ভালোবাসা অনুভব করেন নি? আমি সাহিত্যের প্রেম মাথায় নিয়ে একেক সময় প্রেমে পড়েছি আরো বিভিন্ন কিছুর প্রতিও; তারা দেহের চাকচিক্য নিয়ে হঠাত্‍ করে এসেছে আবার ক্ষণিক ভালোবাসা দিয়ে চোখ ধাঁধিয়ে চলে গেছে, কখনো কখনো আমিই ছেড়ে দিয়েছি; কিন্তু সাহিত্যের প্রতি প্রেম আজো আছে।

Epiphany কী জিনিস ঠিকমত জানি না। বিভিন্ন লেখা থেকে জেনেছি, জয়েস তাঁর গদ্যকে এপিফোনী বলতেন। আমি ব্যক্তিগতভাবে জয়েসের গদ্যশৈলীর অনুরাগী হওয়ায় তাঁর অনুকরণে 'Epiphany' এর চর্চা করতে চাইতাম। কথা ছিল, ফেসবুকে শুধু ছোটো ছোটো এই এপিফোনীর চর্চা করে যাব, আর কিছুই না। এসে, ক্ষুদ্র পরিসরে যে পরিচিতি পেলাম সমাজ আর ধর্ম আর দেশ নিয়ে গম্ভীর গম্ভীর কথা বলে গিয়ে, মুহূর্তেই ভুলে গেলাম আমার উদ্দেশ্যের কথা। বুঝলাম, জনপ্রিয়তা এমনই সৃষ্টিশীলতা বিনষ্টকারী বোমা। অনেকটা, সূর্যাস্তের নদীতে পড়ন্ত বিকেলে সাঁতার কাঁটতে এসে হঠাত্‍ লোভনীয় মাছের নাগাল পেয়ে গেছি যেন, আর ভুলে গেছি সোনালি জলের ঢেউ-এ ভেসে ভেসে অলসভঙ্গিতে আকাশ দেখার সাধের কথা।

জীবনের আরেকরকম গাঢ় ছায়ার আড়ালে পড়ে আজ সেই বুড়ো বন্ধুকে ভুলে গেছি, গায়ে মগজে মনে লেগে আছে শুধু তার ভালোবাসার ছোঁয়া। প্রেমিকাও ভুলতে বসেছি প্রায়। আজ নিজের ভেতরে তাকালে শূন্যতায় লটকে থাকা বেটোফোনের মিউজিক বেজে ওঠে; আবার নতুন করে প্রেমে পড়তে ইচ্ছে করে পুরাতন প্রেমিকার, যে প্রেমিকা শুধু তাকেই নয়- আমার নিজেকে খুঁজতে বুঝতে এবং ভালোবাসতে শিখিয়েছিল।

-কিঙ্কর আহসান


মন্তব্য

ব্যঙের ছাতা এর ছবি

বাহ!

কিঙ্কর আহসান এর ছবি

ধন্যবাদ হাসি

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।