বাংলা শকুন, হারিয়ে যাওয়া চেনা মুখ

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: সোম, ১০/০৬/২০১৩ - ৮:১২অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:


রেমা'র জঙ্গলে পেয়ে গেলাম প্রায় হারিয়ে যেতে বসা বাংলা শকুন

আমাদের ছোটবেলায় শকুন নিয়ে অনেক স্মৃতি ছিল।
আমার ছেলে বেলা কেটেছিলো উত্তরবঙ্গের গেঁয়ো শহর, নীলফামারীতে। বাসার খানিক দূরে ছিল একটা বাজার এলাকা, আমরা বলতাম কাছারী বাজার। একদিকে জজকোর্ট আরেকদিকে ডিসি অফিস। জজকোর্টের উঠোনে ছিল বিশালকায় কিছু গাছ (এগুলো এখন নেই, রাস্তা বড় করার সময় কেটে ফেলেছে)। এই গাছগুলো ছিলো নীলফামারীর ট্রেডমার্ক। অনেক দূর দূর থেকে দেখা যেত। বাইরের কোন জায়গা থেকে শহরে ঢোকার সময় যেন স্বাগতম জানাতো। ছোটবেলায় রুপকথার পাড়ভক্ত ছিলাম, তাই সবকিছুকে রুপকথার সাথে মিলিয়ে দেখার অভ্যাস ছিল। ভাবতাম এটা সেই শিম গাছ, যেটা বেয়ে রাখাল ছেলে আকাশে উঠে গিয়েছিল। গাছগুলোর নাম জানতাম না। কেউ কেউ বলতো কাঠবাদাম। আকাশছোয়া সেই গাছগুলো ভর্তি ছিল শকুনের বাসা।
একবার রাতের বেলা ঐ গাছের তলা দিয়ে ভাইএর সাথে ফিরছিলাম। সেখানেই শকুনের বাচ্চার কান্না শুনলাম। ভয়াবহ কান্না। শুনলে গায়ের সব রোম খাড়া হয়ে যায়। দির্ঘদিন ভেবে বসেছিলাম, শকুনের বাচ্চা নয়, ওটা শাকচুন্নীর কান্না।
বাসার খুব কাছে ঈদগাহ মাঠ। খুব ছোটবেলায় ভাবতাম এটাই সেই তেপান্তরের মাঠ, মাঠের ওপারে ব্যাঙ্গমা-ব্যাঙ্গমী থাকে। তাই প্রথম যেদিন ওপারে গিয়ে দেখি ওদিকে একটা কাঁচাবাজার, ভীষন অবাক হয়েছিলাম। বাসা থেকেই দেখতাম ঐমাঠের আকাশে চক্রাকারে শকুন উড়তো অনেক উচু দিয়ে। শকুনের উলটানো ডানা সামনের দিকে বেশ খানিকটা বাঁকা, চিলের মতো নয়। দুপুরবেলা মাঠে বসতো শকুনের দল। একটা মজার জিনিস খেয়াল করেছিলাম। অন্যপাখির থেকে সরাসরি শকুন আকাশে উড়ে যেতে পারেনা। অনেকটা প্লেনের মতো বেশখানিকটা পথ ডানা ঝাপটিয়ে দৌড়ে কিছুটা উপড়ে উঠে যেত। এরপরে চক্রাকারে ঘুরতে ঘুরতে আস্তে আস্তে উঠে যেত অসম্ভব রকমের উচ্চতায়। অনেকটা কমার্শিয়াল জেটের মতো।
শকুন সম্পর্কে একটা মজার কথা শুনতাম। মরা জন্তুর উপরে শকুনের পাল বসলেও তারা খাওয়া শুরু করতো না যতোক্ষন না রাজশকুন (দলের সর্দার) খাবারে মুখ দেয়না। পরে ব্যাপারটা সম্পর্কে ভালোভাবে জানলাম। শকুনের ঠোট মাংস ছেড়ার উপযোগী ছিদ্র করার জন্যে না। মরা গরু বা ছাগলের চামড়া ছিদ্র করা এই ঠোট দিয়ে সম্ভব না। শুধুমাত্র রাজশকুন বা দলের সর্দার (অনেকটা রানী মৌমাছি, দলের সবার চেয়ে আকৃতি ভিন্ন) এর ঠোঁট পারে চামড়া ছিদ্র করে মাংসের স্তরে যেতে। রাজশকুনের অভাবে যদি শেয়াল বা কুকুর মরার উপরে চড়াও হয়, তবেও বাকীরা কাজ চালিয়ে নিতে পারে।
আমরা নীলফামারী ছেড়ে ঢাকায় বসত গাড়লাম। শকুনের দলের সাথে প্রতিদিনকার দেখা স্বাক্ষাতও বন্ধ হয়ে গেল। শকুন এখন অতিবিপন্ন প্রজাতী। বাংলা শকুন বা White-rumped Vulture এখন শুধু বাংলাদেশেই না সারা পৃথিবীতেই বিলুপ্তির কাছাকাছি, মাত্র কয়েকদশকের অসেচতনাতেই কাক চিলের মতো চিরচেনা পাখিটাকে আজ আর দেখাই যায় না। শকুন বিলুপ্তির কারন অনেক, লিখতে গেলে বিশাল অধ্যায় হয়ে যাবে।
একসময়ের অতি চেনা পাখিটাকে অনেক দিনের পর দেখেছিলাম সুন্দরবনে, অনেক উচুতে উড়ছে, ছবি তোলা সম্ভব হয় নাই। মাসখানেক আগে রেমার জঙ্গলে চুপচাপ ওঁত পেতে বসেছিলাম আমার অতিপছন্দের একটা প্রাণী চশমা বানরের জন্যে, পাতার ফাঁক দিয়ে তার বেকহাম কাটিং হেয়ারকাটই খালি দেখা যাচ্ছিলো। হঠাত মাথার উপর দিয়ে বিশাল একটা ছায়া যেতেই ঝট করে উপরে তাকালাম। ছায়ার পিছে পিছে উড়ে আসছে একটা বিশাল সাদা বাংলা শকুন। মাথার উপরে আসতেই দুইবার মাত্র শাটার টেপার সুযোগ পেলাম। দ্রুত চলে গেল জঙ্গলের গাছপালার আড়ালে। দ্বিতীয়বার আর সুযোগ দিলনা।

মাত্র ২বার শাটার চাপার সুযোগ মিললো।
-
আমার আগের পোস্টঃ কসাই পাখির ভোজন পর্ব

সদস্য নামঃ সৌম্য
ইমেইল-


মন্তব্য

অতিথি লেখক এর ছবি

চলুক

--------------------
সুবোধ অবোধ
--------------------
শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি কেন এত বোকা হয়?!!

তারেক অণু এর ছবি

চমৎকার, গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে লিখেছেন। গেল বার সিলেটে আমি মাত্র একটি দেখেছিলাম।

মরা জন্তুর উপরে শকুনের পাল বসলেও তারা খাওয়া শুরু করতো না যতোক্ষন না রাজশকুন (দলের সর্দার) খাবারে মুখ দেয়না। পরে ব্যাপারটা সম্পর্কে ভালোভাবে জানলাম। শকুনের ঠোট মাংস ছেড়ার উপযোগী ছিদ্র করার জন্যে না। মরা গরু বা ছাগলের চামড়া ছিদ্র করা এই ঠোট দিয়ে সম্ভব না। শুধুমাত্র রাজশকুন বা দলের সর্দার (অনেকটা রানী মৌমাছি, দলের সবার চেয়ে আকৃতি ভিন্ন) এর ঠোঁট পারে চামড়া ছিদ্র করে মাংসের স্তরে যেতে। রাজশকুনের অভাবে যদি শেয়াল বা কুকুর মরার উপরে চড়াও হয়, তবেও বাকীরা কাজ চালিয়ে নিতে পারে।

--- সর্দার না, সেটা অন্য প্রজাতির শকুন, যার মাথার রঙ লাল, যে কারণে মানুষ মনে করত এটা রাজা শকুন। কিন্তু না। সে না এসে চামড়া ছেঁড়া পর্যন্ত অন্যরা খাওয়া শুরু করতে পারত না, তাই এমন ভ্রান্ত ধারণার তৈরি হয়েছে যে রাজার জন্য অপেক্ষা করছে।

কৌস্তুভ এর ছবি

দারুণ। আমাদের দেশ থেকে তো শকুন বিলুপ্ত হয়ে যেতে বসেছে।

আব্দুল্লাহ এ.এম. এর ছবি

ছোটবেলায় উকিলপাড়া থেকে হেঁটে হেঁটে কাচারীর পাশ দিয়ে পিটিআই স্কুলে যেতাম। রাস্তা তখনো পাকা হয় নি, ধুলি ধুসর পথের ধারে বিশাল কাঠবাদাম গাছগুলো মনে হতো অনন্ত আকাশে গিয়ে মিশেছে। গাছে বসে থাকা শকুনের পালকে মনে হতো যেন অনন্তের পথের যাত্রী। সেই কাঠবাদাম গাছগুলো এবং তাদের বাসিন্দা শকুনেরা এখন আর নেই জেনে মনটা খারাপ হয়ে গেল।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।