বিশ্বে ঘটে যাওয়া কিছু অজানা সুনামীর কথা -১ম পর্ব : সুনামী বোমা

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: শুক্র, ২৭/০৯/২০১৩ - ১:৩১পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

সুনামী কি সেটা আমরা সবাই কম বেশী জানি। সাগরে বা লেকে বিশাল আয়তনের পানি স্থানান্তর হওয়ার ফলে একের পর এক যে বড় বড় ঢেউ সৃষ্টি হয়, সেগুলোকে সুনামী বলা হয়। ভূমিকম্প, আগ্নেয়গিরির অগ্নুৎপাত, ভূমিধ্বস, পানির নীচে বিস্ফোরন (পানির নীচে আনবিক যন্ত্রের বিস্ফোরনসহ), হিমবাহের ভাঙ্গন, উল্কাপিন্ডের সংঘর্ষ, এবং পানির নীচে ও উপরে সংঘটিত আরো অনেক আলোড়নের জন্য সুনামী সৃষ্টি হতে পারে।

কয়েকদিন আগে, ২১ শে সেপ্টেম্বর ২০১৩, রাত ৮ টায় বিবিসি ৪ চ্যানেলে বিখ্যাত স্কটিশ ভূতাত্বিক প্রফেসর ইয়েন স্টুয়ার্ট (Professor Iain Stewart) এর উপস্থাপনাতে সুনামীর উপরে বানানো ডকুমেন্টারী '10 Things You don't know about Tsunami' প্রচার হচ্ছিল । সেই ডাইনোসারের যুগ থেকে শুরু করে মোজেস (হযরত মূসা) এর সাগর দুইভাগ করে ইসরায়েলীদের নিয়ে পার হয়ে যাওয়ার পরে ফারাও বাহিনীর সেই সাগরে ডুবে যাওয়ার কাহিনীও সেখানে বিশ্লেষন করা হয়েছে, সেই সাথে আছে সম্প্রতি ২০০৪ ও ২০১১ তে ঘটে যাওয়া সুনামীর কথা। এই ডকুমেন্টারীতে কয়েকটি সুনামীর ঘটনা বলা আছে, যে গুলো আমরা অনেকেই হয়তো জানতাম না। সেই অজানা একটা সুনামীর ঘটনা বলবো, যেটার প্রেক্ষাপট ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন সময় ।

একটি ব্যার্থ সুনামীঃ
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ১৯৪৫ সালের আগস্ট মাসে জাপানের হিরোসিমা ও নাগাসাকিতে আনবিক বোমা ফেলা হয়, সেটা আমরা সবাই জানি। কিন্তু আমরা সবাই কি জানি সেই সময়ে বোমা বিস্ফোরন করে সুনামী বানানোর চেষ্টা করা হয়েছিল?

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন সময়ে জাপান ছিল শক্তিশালী একটা দেশ, তাদের আধিপত্ত ছিল প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল জুড়ে। পুরো প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল হয়ে উঠেছিল যুদ্ধ ক্ষেত্র। সেই অঞ্চল জুড়ে আছে হাজার হাজার দ্বীপ, সেই দ্বীপগুলোর বেশীর ভাগ ছিল জাপানীদের শক্ত ঘাটি। সেই দ্বীপগুলোর দখল নেয়ার জন্য মিত্র বাহিনী মরিয়া হয়ে উঠেছিল। কিন্তু কোন ভাবেই সুবিধা করতে পারছিল না, সেই দ্বীপগুলোতে যুদ্ধ করতে যেয়ে মিত্র বাহিনীর হতা হতের পরিমান বেড়েই যাচ্ছিল। তাদের সব জেনারেলরা মিলে অন্য এক বুদ্ধি বের করতে থাকলো, কিভাবে ঐ সব দ্বীপ থেকে জাপানীদের নিশ্চিন্ন করে দেয়া যায়। এমন কোন উপায় বের করতে হবে যাতে নিজেদের সৈন্য বাহিনী বাদ দিয়েই জাপানীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা যাবে।

১৯৪৪ সালে মিত্র বাহিনীর জেনারেলরা মিলে চিন্তা করলো, এমন কোন সহজ উপায় বের করতে হবে যাতে করে বাইরে থেকে কিছু করে ঐ সব দ্বীপ থেকে জাপানীদের বিতাড়ন করা যায়। তারা একটা উপায়ের কথা ভাবলো, সাগরে যদি বিরাট বিস্ফোরন ঘটানো হয়, তাহলে কৃত্রিম সুনামী তৈরী হতে পারে, আর সুনামী হলে দ্বীপ থেকে জাপানীরা এমনিতেই ভেসে যাবে! তারা এই কাজ করার সিদ্ধান্ত নিলো কৃত্রিম সুনামী সৃষ্টি করা হবে যেটা জাপানী অধিকৃত দ্বীপ গুলোর দিকে তেড়ে যাবে, আর জাপানীদের সহজেই ভাসিয়ে দিবে। নিজেদের সৈন্যও মরবে না, আবার শত্রুও ধ্বংস হবে! এটা অনেকটা লাঠি নে ভেঙ্গে সাপ মেরে ফেলা! যে চিন্তা সেই কাজ, জেনারেলদের চিন্তা বলে কথা, শুরু হলো তাদের গোপনীয় প্রজেক্ট।

শুরু হলো 'প্রজেক্ট সীল' ( Project Seal)। এই প্রজেক্টকে 'সর্বোচ্চ গোপনীয়' হিসাবে রাখা হলো (১৯৯৯ সালে সেই প্রজেক্টের কথা উন্মোচনের আগ পর্যন্ত এত দিন বিষয়টা গোপন রাখা হয়েছিল)। প্রজেক্টের মূল পরিকল্পনাকারী ছিল অকল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অস্ট্রেলীয় প্রফেসর থমাস লীচ (Thomas Leech)। প্রফেসর লীচের বদ্ধমূল ধারনা ছিল সে সুনামী সৃষ্টি করার জন্য বোমা বানাতে সক্ষম হবে, যে সুনামী ৪০ ফুট উঁচু হবে এবং শত্রু দখলকৃত দ্বীপগুলোর সৈকতসমুহ ভাসিয়ে দিয়ে ভূখন্ডের ৩ মাইল ভিতর পর্যন্ত আঘাত এনে শত্রুদের ডুবিয়ে দিতে সক্ষম হবে । প্রফেসর লীচ তার দলবল নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা শুরু করে দিলো। তারা শুধু সাগরেই বিস্ফোরন ঘটিয়ে পরীক্ষা করলো না, তারা বোমা পরীক্ষা করার জন্য সাগরের পাশে বিশেষ পুকুর তৈরী করলো।
প্রফেসর লীচ চিন্তা করেছিল যে সাগরের একটা নির্দিষ্ট গভীরে বোমা পেতে বিস্ফোরন ঘটাতে পারলে সাগরের উপরের স্তরে সাধারন ঢেউ এর চেয়ে বড় ঢেঊ সৃষ্টি হবে। এই চিন্তা করে সাগরের নীচে বোমা পেতে বিস্ফোরন ঘটনো হলো। কিন্তু পরীক্ষার প্রথম দিনেই তার ধারনা ভুল প্রমানিত হলো। সাগরের পানি শুধু একটু উপরের দিকে উঠে যে ঢেউ তৈরী করলো সেটা ছিল খুবই হতাশাজনক।

মন খারাপ করলে তো আর চলে না। একবার না পারলে দেখো শতবার। প্রফেসর লীচ এবার নতুন ধারনা আর তত্ব নিয়ে এলো। সে ঘোষনা দিলো, সাগরের উপরে ভাসিয়ে রেখে বোমা ফাটালে সবচেয়ে ভাল ফল পাওয়া যাবে। তারা যখন এই তত্ব নিয়ে বোমা ফাটালো, কিছু উৎসাহজনক ঢেউ সৃষ্টি হলো। তারপর এই ঘটনাতে উৎসাহী হয়ে বিস্ফোরকের পরিমান অনেক বাড়িয়ে পরীক্ষা করলো, কিন্তু যে ঢেউ সৃষ্টি হলো সেগুলোর আকার খুব বেশী বড় হলোনা, যা খুবই হতাশাজনক। তারপর থেকে পরীক্ষাগুলো একের পর এক ব্যর্থ হতে থাকলো। প্রফেসর লীচের সব তথ্য আর পরীক্ষা নিয়ে জেনারেলদের মাঝে সন্দেহ দেখা দিলো। ৭ মাস ধরে প্রফেসর লীচ ৪০০০ টি বিস্ফোরন ঘটিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা করেছে, কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে প্রত্যেকটি পরীক্ষা নিরীক্ষা শুধু ব্যর্থই হয়েছে। প্রত্যেকটি বিস্ফোরন পরীক্ষাগার পুকুরের উপরের স্তরের পানিকে আলোড়িত করার বেশী আর কিছুই করতে পারে নাই।

সব প্রচেষ্টাই যখন একের পর এক ব্যর্থ হয়ে যাচ্ছে, তখন প্রফেসর সাহেব শেষ চেষ্টা হিসাবে সবচেয়ে বড় একটা পরীক্ষা করার সিদ্ধান্ত নিলো। ২০০০ টন বিস্ফোরক দিয়ে বিশাল একটা পরীক্ষা চালানোর সিন্ধান্ত নিলো। পরীক্ষাগার পুকুর বাদ দিয়ে একটা বড় লেগুনে বিস্ফোরন ঘটানোর চিন্তা করলো।
কিন্তু এই পরীক্ষা নিরীক্ষা চালানো আর কখনো সম্ভব হয় নাই। মিলিটারীর উচ্চ পর্যায়ের উপদেষ্টারা এতদিনে নড়ে চড়ে বসলো, একের পর এক পরীক্ষা নিরীক্ষা ব্যর্থ হওয়াতে তারা এমনিতেই চিন্তিত হয়ে পড়েছিল। প্রফেসর সাহেবের তত্বের গ্রহন যোগ্যতা নিয়ে তাদের ভিতর বড় সন্দেহ তৈরী হলো। প্রফেসর সাহেবের তত্বের সব হিসাব নিকাশ আর তথ্য উপাত্ত নিয়ে তারা বিশ্লেষনে বসলো, এবং সেই হিসাব নিকাশে উপদেষ্টারা কিছু গোজামিল খুঁজে পেলো। প্রফেসর সাহেবের গুরুত্বপূর্ণ কিছু হিসাব নিকাশে মারাত্মক ত্রুটি ছিল। সেসব হিসাব নিকাশ দেখে একজন উপদেষ্টা স্বীকার করলো যে, সুনামী তৈরী করতে যে পরিমান বিস্ফোরকের দরকার পড়বে, তার পরিমান এত ব্যাপক যে এটা চিন্তা করাই অকল্পনীয় বিষয়, এবং এটা তৈরী কখনোই সম্ভব হবে না।
প্রজেক্ট সীলকে ( Project Seal) বিলুপ্তী ঘোষনা করা হলো। ঐ প্রজেক্টের ব্যর্থতা সবার কাছেই গোপন রাখা হল। গোপন নথীপত্র প্রথমে প্রকাশ করা হলো ১৯৯৯ এ। কৃত্রিম সুনামী সৃষ্টি করার মানুষের ইচ্ছার এভাবেই ইতি ঘটলো।

তবে বোমা বিস্ফোরন ঘটিয়ে সুনামী বানিয়ে জাপানী সৈন্যদের ধ্বংস করতে না পারলেও, তার প্রায় ১ বছর পরেই মার্কিনীরা আনবিক বোমা তৈরী করে জাপানের দুইটা দ্বীপে বিস্ফোরন ঘটিয়ে অনেক সাধারন নাগরিকদের ধ্বংস করতে পেরেছিল। সুনামী সৃষ্টি করতে না পারার ক্ষোভ থেকেই মার্কিনীরা আনবিক বোমা তৈরী করে জাপানে নিক্ষেপ করেছিল কিনা কে জানে! হয়তো এই রহস্য পরে কোন এক সময়ে জানা যাবে।

desh_bondhu


মন্তব্য

 মেঘলা মানুষ এর ছবি

লেখাটির জন্য ধনয়বাদ আপনাকে দেশবন্ধু।
প্রসাঙ্গিক রেফারেন্স যুক্ত করলে আরও চমৎকার লাগত লেখাটা।

গুগল করে দেখলাম, একটা ১১ মিনিটের ডকুমেন্টারিও তৈরি করা হচ্ছে, এখনও রিলিজ হয় নি তা।

শুভেচ্ছা

অতিথি লেখক এর ছবি

ধন্যবাদ আপনাকে। লেখার শুরুতেই আমি রেফারেন্স এর কথা বলেছি। ২১ শে সেপ্টেম্বর ২০১৩, রাত ৮ টায় BBC 4 চ্যানেলে প্রচারিত Professor Iain Stewart এর ডকুমেন্টারী '10 Things You don't know about Tsunami' হতেই আমার এই লেখাটি।

অতিথি লেখক এর ছবি

প্রাসঙ্গিক রেফারেন্স লেখার শুরুতেই বলেছি, মনে হয় খেয়াল করেন নি। Professor Iain Stewart এর ডকুমেন্টারী '10 Things You don't know about Tsunami' , যেটা BBC 4 এ প্রচার হয়েছিল, ২১ সেপ্টেম্বর ২০১৩ তে। সেখানে এটার বিস্তারিত ভিডিও আছে। গুগল এ এখন পর্যন্ত এটার বিস্তারিত তেমন নাই। (desh_bondhu)

অতিথি লেখক এর ছবি

ভালো লাগলো আপনার সহজ ভাষায় জটিল লেখা পড়ে। ব্যাপারটি জানা ছিলো না। অসংখ্য ধন্যবাদ আপনাকে।

-এস এম নিয়াজ মাওলা

অতিথি লেখক এর ছবি

আমি খুব ভয়ে ছিলাম, আগে এত বড় করে কিছু লিখি নাই, আমার দৌড় ছিল ফেইসবুকে কয়েক লাইনের স্টেটাস দেওইয়া। ভাল লেগেছে জানতে পেরে খুশী হলাম। জানার কি আর শেষ আছে রে ভাই? জন্মের পর থেকে তো শুধু জেনেই চলেছি।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।