প্রত্যার্পন

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: রবি, ০৯/০৩/২০১৪ - ১০:৩৬পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:


"এখনও বিবর্ণ স্বপ্ন আমার, নীরবে এঁকে যায় ধূসর রঙে আমায়। শূন্যতায়।
বাস্তবতার নিয়মে মন, সবই যেন শূন্যতা এখন। হঠাৎ আমি হারিয়ে আজ, সত্ত্বার বিপরীতে বসবাস। শূন্যতায়। "

মার্কার এর কালো আর বোর্ডের সাদার মিশেলে ডুবে যাচ্ছে, দীপ্তিহীন চোখদুটো। ব্ল্যাকবোর্ডের মাঝে স্যার এর হাত কি যেন লিখে চলছে। চোখের প্রতিবিম্বে সবকিছুই কেমন জানি উত্তাল আর সমান্তরাল। রিমঝিম মনটা হারিয়ে যাচ্ছে, কোথায় যেন? পাশে ক্লাসমেটরা মনোযোগের সাথে ক্লাস করছে। অমির উত্তাল মন টিকছেই না সেদিকে। কোথায় যেন ছুটে যেতে চাইছে। খোলা চোখে সে কোথায় যেন হারিয়ে যাচ্ছে! স্তব্ধ মগজে। একটু পরপর আবার সে ফিরে আসছে বর্তমানে। আবার হারিয়ে যাচ্ছে।
স্যার এর লিখা, সমীকরণের একেকটি লাইন খুবই দুর্বোধ্য। শরীরে বিরক্তির শিস তুলে। চিবুকে ঘুমের ছোঁয়া এনে দেয়। এসবে মন নেই অমির। নিজেকে ও খুঁজে পায়, সম্পূর্ণ অন্য এক পৃথিবীতে। যেখানে আকাশের রঙ ভীষণ লাল। বাতাসে শিস বাজায় শরীরবিহীন মেঘের দল। অন্ধকারে, বৃষ্টি হয় একটু একটু। এরই মাঝে হেঁটে যায়, কে যেন। বৃষ্টির কণাগুলি ছড়িয়ে দেয় মিষ্টি বাতাস। সরলরেখার পথ ধরে, একটু একটু করে এগিয়ে যায় লোকটা। চেহারাটা স্পষ্ট নয় অমির চোখে। চোখদুটি রক্তজবার মত লাল। হাতে জ্বলন্ত একটা সিগারেট। হাতঘড়ির বদলে একটা সোনালি রঙা ব্রেসলেট। অস্পষ্ট চেহারাটা এই বুঝি স্পষ্ট হল। জটিল এক মুহূর্ত। পিছন থেকে একটানা আওয়াজ শুনা যাচ্ছিল। যেন, কারও আর্তচিৎকার।

- অমি। SF6 এর কেমিক্যাল প্রপারটিস বলতে পারবে?
আকাশ থেকে পড়লো অমি। এটা আবার কি? সে সম্পূর্ণ অন্য এক জগতে ডুবে ছিল। যেখানে অস্পষ্ট কেউ কোন একটা রুমের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল। চেহারাটা স্পষ্ট হবার আগেই স্যার এর কণ্ঠ।
পারব না স্যার।
- ক্লাসে কি বলছি, শুনেছ তুমি? কোথায় যে থাকো ?? আমি আসলে বুঝি না।
কিছু বলে না অমি। সহপাঠীদের আড্ডায় আজকাল মন থাকে না ওর। সেই অস্পষ্ট চেহারাটাকে দেখতে চায় সে। কে সেই মানুষটা আর কোথায়ই বা যাচ্ছে সে? আর কেনই বা এসব ভেসে আসছে ওর দুচোখে?
বিস্ময়ের ঢেউ গায়ে মেখে অমির প্রহরগুলি কেটে যায়। কৌতূহলের পাখি অহেতুক ডানা ঝাপটায়। উত্তর মেলে না কোন। মনের আড়ালে থেকে যায়, শুধু কিছুটা বিষণ্ণতা আর অনুরাগ।

দীর্ঘ, শান্ত এক সন্ধার লগ্ন। ঝুলবারান্দা পেরিয়ে শীতল বাতাস এসে ছুঁয়ে যায় অমিকে। বিকেলের ঘুমকাল পেরিয়ে আলো মাখা হাতে, ফেসবুক খুলে বসে থাকে অমি। অজস্র হিজিবিজি স্ট্যাটাস দেখে, লাইক আর কমেন্ট করে। কিছু পোস্ট এলেই কিঞ্চিৎ বিরক্ত হয়ে, এড়িয়ে যায় অমি। চ্যাটের মাঝে যখন কেউ জিজ্ঞেস করে বিশেষ একটা প্রশ্ন। কোন উত্তর দিতে ইচ্ছে করে না অমির। বারবার কৌশল করে এড়িয়ে যায়। মনের এক কোণে বিবেক নামক বস্তুটি হয়তো আঁকড়ে ধরে ওকে। কিন্তু নিজের ভিতরের জমে থাকা দৃঢ়তা ছুড়ে ফেলে দেয় প্রশ্নগুলিকে। উত্তর খুঁজতে চাওয়া অনুভূতিগুলিকে।
দ্বিধা। মনের গহীনে কখনও কখন উকি দিতে চায় প্রশ্নেরা। তবে বারবার হেরে যায় বিবেক। কেউ বুঝতে পারে না, কি সেই প্রশ্নগুলি। চোখের কান্নার মাঝে কখনও ধরা দেয় না প্রশ্নগুলি। বেশ আড়ালে থাকে। ফেসবুক কিংবা মূর্খ মুঠোফোনে অনেকের সাথে কথোপকথন হয়। অমি চায় না কখন উঠে আসুক প্রশ্নগুলি।
রাতের চায়ের কাপের আড্ডায় হারিয়ে যায় মন। নিভু নিভু আলোতে স্বপ্নেরা পুনর্জন্ম নেয়। চায়ের দোকানে নেশায় ভেজা কিছু তরুণের চোখ দেখে অমি, প্রতিরাতে। কিছুটা বিরক্তি আর ঘৃণা তুলে রেখে আসে সেখানে। রিক্সা করে বাড়ি ফিরে আসার সময়, দু চোখের পরিসীমায় আবার সেই দৃশ্যপট ভাসতে থাকে। মাঝে মাঝে রিক্সার ট্রিং ট্রিং শব্দে ঘোর ভাঙে। আবার নিজেকে সে ফিরে পায় সেই দৃশ্যপটে। কিন্তু স্পষ্ট হয় না চেহারাটা। বাড়ি ফিরে নিজের সাথে একান্ত কিছু সময় কাটায় অমি। চোখের দৃষ্টিতে জ্বলে, নির্বাক অদৃশ্যতা।


রাতের শেষ প্রহরে এফ এম ৯০. ৪ শুনতে শুনতে শুনতে ঘুমোতে যায় অমি। ঘুমের মাঝে স্বপ্ন হয়ে ধরা দেয় ফেলে আসা, হিম মাখা সেই দৃশ্যপটটা। ছায়ার মুখোশ পড়ে থাকা সেই লোকটার চেহারা আস্তে আস্তে স্পষ্ট হয়ে উঠে। অবাক হয় অমি। লোকটা দেখতে অবিকল অমির মতন। জাগরণের রহস্য দুয়ার খুলে,আস্তে আস্তে হেঁটে যায় লোকটা। কোন একটা হাসপাতালের ভিতরে। মাতাল করা গন্ধের সাথে, কিছুটা দূরে কান্নার আওয়াজ শোনা যায়। মৃদুভাষী মেঘসন্ধায়, দুর্লভ একটা গ্রুপের রক্ত না পাবার কারণে একটা পথশিশুর মৃত্যু হয়েছে। শবাধারের অন্ধকারের মুখ লুকায় কারও ক্লান্ত চোখের গাঢ় ঘুম। চুপিসারে।
মৌন এই চিত্রপটে, শ্রাবণের কাব্য ইশারা করে। কৌশলে নিস্তব্ধতা ঢেকে নেয় অমিকে। অন্যরকম শিহরণ। অন্ধকার আর কুশ্রী। খুঁজে না পাওয়া সেই রক্তের গ্রুপটা যে অমির নিজেরই রক্তের গ্রুপ। ফেসবুকের চ্যাটে অবহেলা করা গোপনীয়তায় ঘেরা সেসব প্রখর প্রশ্ন, নিজের শরীরে সূচ ঢুকাতে না চাইবার স্বার্থপর সেই ভয়, কাপুরুষত্ব আর দাম্ভিকতাকে জয়যুক্ত করে হাসপাতাল ছেড়ে বেরিয়ে আসে অমি।
কাল সকালে, এই সংবাদটা পড়েই হয়তো ওর আকাশে মেঘ জমবে। দু ফোঁটা চোখের জল ঝরবে । ফেসবুকে অন্য সবার মতই শেয়ার দিবে পোস্টটা। আর ভিতরে ভিতরে পুষে যাবে কাপুরুষত্ব।
বিবেকের প্রশ্নগুলিকে দাবিয়ে রেখে দিব্যি বেঁচে আছে সে। বেঁচে আছে বলতে, ভালোই তো আছে সে। ফাগুনের বিকেলে নিজের সবচাইতে প্রিয় মুহূর্তে প্রিয়জনের সাথে কাটানো সময়ের বুকে বসে অহেতুক এসব ভাবতে ভাল লাগে না অমির। কি হবে এসব নিয়ে ভেবে? কল্পনার সেই দৃশ্যপটটা চোখের সামনে ভেসে উঠে না আর। অনেক রাতে ঘুম ভেঙে আর এখন ঘামতে থাকে না। দ্রুতগামী হয় না শ্বাসগুলি। তীব্রতর হয় না বিবেকের গোপন তরঙ্গ।

সমস্ত শহর জুড়ে রোদ। বাতাসে শিউলি ফুলের গন্ধের আদলে উড়ে বেড়ায় মুক্ত পাখিদের দল। আনমনা হয় কারও মন, এমন সকালবেলায়।
হাসপাতালের বেডে শুয়ে অমি। বিন্দু বিন্দু আলো এসে পড়ে না মুখে। বন্ধুরা সবাই পাশেই। অমির মাথা আর হাতে সাদা রঙের ব্যান্ডেজ। কি হয়েছে অমির? ভ্রমে নেই তো সে? ভ্রম আর বাস্তবতার মধ্যে পার্থক্য করতে করতে, রুমির কণ্ঠে ধ্যান ভাঙে অমির।
- দোস্ত তুই অনেক লাকি। তোদের গাড়ির সাথে মাইক্রোর মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়। সময়মত ৭ ব্যাগ এবি- না পেলে হয়তো বাঁচানো যেত না তোকে। যাই হোক, এই যাত্রায় বেঁচে গেলি তুই। আসলেই অনেক লাকি রে তুই।
স্তব্ধ হয়ে যায় অমি। দীর্ঘ, শান্ত এক জাগরণের শুরুতেই ছিন্নভিন্ন হয়ে যায় ও। চুপিচুপি।
বন্ধুরা চলে যায়। ওষুধের ভাজে, ঘুম ঘুম দিন কেটে যায়। নেমে আসে রাত। হাতপাতালের বেডে শুয়ে শুয়ে ভাবতে থাকে অমি। ওর দৃষ্টির পরিসীমা ঘিরে থাকে সেই দৃশ্যপট। সূচের ভয়ে জমিয়ে রাখা কাপুরুষত্ব, নাকি কাপুরুষত্বের নগ্ন কাঁচের দেয়াল ভেঙে এগিয়ে যাওয়া অমির রুদ্ধবাক বিবেক।
সেই পথশিশুটার মত আরও কত মানুষ দুর্লভ রক্তের অভাবে প্রাণ হারাচ্ছে, প্রতিনিয়ত। ভাবতে ভাবতেই, ঘুম আড়াল চোখের কোণে নির্বাক অশ্রুরা এসে ভর করে। শিশুদের মত হু হু করে কেঁদে উঠে অমি। নিজেকে খুব ছোট মনে হতে থাকে। দু চোখে সাজিয়ে রাখা মিথ্যে, আর সূচের ভয়ে রক্ত দিতে না চাইবার অনুভূতিগুলির গলা টিপে ধরতে ইচ্ছে করে। চেতনার স্তরে অন্তহীন বিষাদ এসে ভরে করে। পুনশ্চ।

“খুব সকালে, এই শহরে, হঠাৎ হঠাৎ বৃষ্টি নামে। সূর্য ঢাকে মেঘের ফাঁকে, বৃষ্টি স্নানে নগর মাতে। ঘুম ভেঙে যায় হঠাৎ করেই, নিদ্রাবিহীন আঁধার ঘরে। কোন এক শ্রাবণে। ”

- রেহান সানি


মন্তব্য

আয়নামতি এর ছবি

হেঁয়ালি একটু বেশি মনে হলো। সূঁচের ভয় জিতে গেল একটা শিশুর প্রাণের দৌড়ে ভাবতে রাগই হচ্ছে!
স্পষ্ট হলো না খুব একটা 'মূর্খ মুঠোফোন' কেন বলা হলো চিন্তিত
লিখতে থাকুন ভাই।

অতিথি লেখক এর ছবি

রেহান সানি, মনে অতৃপ্তি থাকতে থাকতেই শেষ হয়ে গেলো। তবুও ভাল লাগলো।

“খুব সকালে, এই শহরে, হঠাৎ হঠাৎ বৃষ্টি নামে। সূর্য ঢাকে মেঘের ফাঁকে, বৃষ্টি স্নানে নগর মাতে। ঘুম ভেঙে যায় হঠাৎ করেই, নিদ্রাবিহীন আঁধার ঘরে। কোন এক শ্রাবণে। ” শেষের এই দুই লাইনের জন্যে দশে আমার ঝুলি থেকে ১১ দিলাম। ১ মার্ক আমার খাতা থেকে দেঁতো হাসি আরও লেখা পাবো আশা করি হাসি

shah waez (শাহ্‌ ওয়ায়েজ।)
Facebook

..............................................................................................
কোথাও নেই ঝুমঝুম অন্ধকার
তক্ষক ডাকা নিশুতিতে
রূপকথা শুনে শিউরে উঠে না গা
স্বপ্নে আমার শরীরে কেউ ছড়ায় না শিউলি ফুল
আলোর আকাশ নুয়ে এসে ছোঁয় না কপাল

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।