আপোষ

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: মঙ্গল, ১৮/০৩/২০১৪ - ৫:২২পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

রকমারীর সোহাগ/লিটন ভাইয়া,

আপনাদের সাথে পরিচয় অনেকদিনের । আমার মত অনেকের কাছেই আপনাদের প্রাথমিক পরিচয় অবশ্যই রকমারীর কর্ণধার হিসেবে নয় । আমাদের একটা বড় অংশের পড়ালেখার প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টে দেবার পেছনে আছেন আপনারা । দেশের সেরা প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েও আপনারাই এপর্যন্ত আমার দেখা সবসময়ের সেরা শিক্ষক । আপনারা প্রথম শিক্ষাগুরু যারা শিখিয়েছেন সবকিছুকে প্রশ্ন করতে । "মুখস্ত বিদ্যা প্রতিভাকে ধ্বংস করে" - এই বুলি এখন সবার মুখে, কিন্তু একমাত্র আপনাদেরই একে সত্যিকার অর্থে একটি সংস্কৃতি হিসেবে লালন করতে দেখেছি ।

শ্রমে-মননে-চিন্তায় আপনাদের অনুসরণ করার চেষ্টা করেছি সবসময় । দেশের আর দশটা বড়ো মানুষের চালিয়াতি-দূর্নীতি আর সাধারন মানুষকে ঠকানোর মানসিকতা দেখে যখন মনে হয়েছে আমাদের আর আশা নেই, আপনাদের দেখে শক্তি পেয়েছি... নিজেকে বলেছি, নীতির সাথে আপোষহীন মানুষ এখনো আছে আমাদের সাথে, সবকিছু নষ্টদের অধিকারে যেতে দিচ্ছি না এত সহজেই ।

কোথায় আপনারা, আর কোথায় প্রকাশ্যে মানুষ খুনের ঘোষনা দিয়ে হাজতবাস করা একটা তৃতীয় শ্রেণির কূপমন্ডুক । এমন একজনের কথায় কেন আপনারা রাতারাতি কিছু লেখকের বই সরিয়ে ফেললেন আর বই ফিল্টার করার মত একটা মধ্যযুগীয় নীতি প্রণয়ন করতে বসে গেলেন? নিরাপত্তার ভয়? না । যারা বলে আপনি ভয় পেয়েছেন তারা আপনাকে চেনে না । আপনি চাইলে খুব সহজেই আপনার অফিসে হামলা করতে যে আহবান জানিয়েছে তাকে আইনের আওতায় আনতে পারতেন । ফারাবী এপর্যন্ত অনেককেই অনেকরকম হুমকি ধামকী দিয়েছে আর অনেক মেয়েকে আজেবাজে প্রস্তাবও দিয়েছে। তাদের মধ্যে আপনার চেয়ে অনেক কম গুরুত্বপূর্ণ মানুষও আছে । এই হুমকিতে নড়ে যাবার মানুষ তো আপনি নন ।

খুব সম্ভবত ভাইয়া একটা “বাস্তবতা” মেনে নিয়েছেন । একবার নাস্তিক তকমা গায়ে লেগে গেলে এই মরার দেশে ব্যবসায় বড়সড় ক্ষতি হয়ে যাবে । তবে এই আপোষটা করতে গিয়ে অনেক বড় একটা মূল্য দিয়ে ফেলেছেন ভাইয়া । জ্ঞান-বিজ্ঞান তো মডারেট করার জিনিস না । যাকিছু ইচ্ছে জানার অধিকার আছে আমার । মানুষ কি পড়বে আর জানবে সেটা একটা রিভিউ কমিটির কন্ট্রোভার্সি ফিল্টার দিয়ে ছেকে আনার নীতি তো আপনারা আমাদের শেখাননি । অবশ্যই রকমারি আপনাদের প্রতিষ্ঠান, যেমন খুশি তেমন নীতিমালা অনুযায়ী একে চালানোর অধিকার তো আপনাদের অবশ্যই আছে । তবে রকমারিকে অন্য সাধারণ ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোর কাতারে ফেলতাম না বলেই কষ্ট পেয়েছি । রকমারি ছিল অনেকটা সারা বছর হাতের কাছে একটা ছোট বইমেলার মত। অনেক কিনেছি তা নয়, কিন্তু অবসর সময় প্রায়ই প্রিয় ক্যাটাগরিগুলোতে গিয়ে ঘাঁটতাম, নতুন কি এলো খুঁজতাম । এখন থেকে সেখানকার সব বই ফারাবীদের ভয়ে ভীত একটা কমিটি দিয়ে স্বীকৃত হয়ে আসবে- এটা মানতে পারছি না ।

কোন বইগুলোকে কন্ট্রোভার্সিয়াল হিসেবে বাদ দেয়া হবে সেটাই বা কিভাবে ঠিক করা হবে? যেকোন ধর্মীয় বই অন্য ধর্মের মানুষের কাছে কন্ট্রোভার্সিয়াল মনে হতে পারে । এক দর্শনের কাছে অন্য দর্শন কন্ট্রোভার্সিয়াল হতে পারে। স্ট্রিং থিওরির দশ এগারোটা মাত্রার কথা বেশিরভাগ সাধারণ মানুষের কাছে গাঁজাখুরি মনে হতে পারে। সৃষ্টিতত্ববাদীদের কাছে বিবর্তন তো মাতালের প্রলাপ । এসব কিছু যদি আপনাদের কন্ট্রোভার্সি ফিল্টারে যোগ করেন তাহলে তো শেষমেষ বাচ্চাদের রূপকথা, রান্নাবান্না আর ২১ দিনে মাইক্রোসফট ওয়ার্ড টাইপের বই ছাড়া আর কিছু থাকবে না । আর ফারাবিদের আজ প্রশ্রয় দিলে তারা কাল ধরবে বিবর্তনের বই, তারপর আহমদ শরীফ আর বারট্রান্ড রাসেলের বই। সবশেষে হয়তো চমক ভাইয়ের জেনেটিক্স বই কিংবা জাফর ইকবাল স্যারের বাচ্চাদের উপন্যাসেও তারা কন্ট্রোভার্সি খুঁজে পাবে । তখন কি করার থাকবে ভাইয়া?

আপনাদের জন্য অন্তরের ভেতর থেকে শ্রদ্ধা আছে আমার মত অনেকেরই । দুপক্ষেরই যারা না জেনে আপনাকে আজেবাজে বকেছে তাদেরকে আমার কলেজ জীবনের একটা ঘটনা বলি । তখন উদ্ভাসে পড়তাম । একদিন সোহাগ ভাইয়াকে বললাম আর্থিক সমস্যার কথা। ভাইয়া বললেন উদ্ভাসে টিউশন ফি এর ব্যাপারে আমাকে ছাড় দেয়া হবে; কিন্তু একটা শর্তে- আমি যদি কখনো কারো শিক্ষক হই তাহলে এই একই ফেভারটা আমার ছাত্রদেরকে দ্বিগুণ করে ফেরত দিতে হবে । সেদিন যতটা মুগ্ধ হয়েছিলাম আজ নীতির সাথে আপনাদের আপোষ করতে দেখে ততটাই স্তব্ধ হয়েছি । কোন দিক দিয়ে আপনাদের হাঁটুর সমান মুরোদ রাখে না এমন একজনের কথায় আর ব্যবসার স্বার্থে আদর্শ থেকে সরে আসতে দেখে আশা হারিয়ে ফেলছি ভাইয়া । একটা প্রজন্মের বড় অংশে বিজ্ঞানমনন তৈরি করে দিয়েছেন আপনারা । আর এজন্যে আমাদের ভেতর আপনাদের জন্য যে শ্রদ্ধার জায়গাটুকু আছে তাতে কেউ কখনো হাত দিতে পারবে না । কিন্তু কষ্ট পেয়েছি আজ ভাইয়া, অনেক কষ্ট পেয়েছি ।


মন্তব্য

অতিথি লেখক এর ছবি

তারা শুধু মাথা নতই করে নাই,নিজেদের এখন পাঁচ ওয়াক্তী নামাজী হিসেবে প্রমাণ করার চেষ্টা করছে।গতকাল তাদেরকে ফোন করেছিলাম,তাদের কথাটা এরকম,"ধর্মীয় বই কয়টা বিক্রি হয় বলুন অথচ দেখুন হুমায়ূন আহমেদ লাখ লাখ বিক্রি হচ্ছে,আমরা কেন তাই রিস্ক নিতে যাবো?ওরা আমাদের বোমা মারার হুমকী দেয় অথচ সোহাগ ভাই খুবই ধার্মিক মানুষ,তিনি পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়েন...যদি বইটা আপনার প্রয়োজন হয় তাহলে প্রকাশনী থেকে নিবেন,আমাদের কাছে ওটা নেই!"
--------
তূর্য রায়

অতিথি লেখক এর ছবি

এক কথাতেই বলা যায় পুরো বিষয়টাই অত্যান্ত মর্মাহত করার মত এবং দুঃখজনক। আবার বিপরীত দিক থেকে ভাবলে দেখবেন নিরাপত্তা কোথায়? কে দেবে নিরাপত্তা? কে দেবে আশ্বাস। আমি, আপনি বা আমরা যাই বলিনা কেনো জীবনের নিরাপত্তা যেখানে প্রতিনিয়ত হুমকির মুখে সেখানে এসব চর্চার পেছনের মানুষের সরে দাড়াবেনই।

Shah Waez (শাহ্‌ ওয়ায়েজ।)
Facebook

..............................................................................................
কোথাও নেই ঝুমঝুম অন্ধকার
তক্ষক ডাকা নিশুতিতে
রূপকথা শুনে শিউরে উঠে না গা
স্বপ্নে আমার শরীরে কেউ ছড়ায় না শিউলি ফুল
আলোর আকাশ নুয়ে এসে ছোঁয় না কপাল

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।