সাম্প্রতিকের শাশ্বত রূপায়ন : মোহাম্মদ রফিকের কালের মান্দাস

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: শুক্র, ১৬/০৫/২০১৪ - ২:০৭অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

একজন কবির দায় কতটা নিখাদ শিল্পের প্রতি আর কতটা তাঁর সময়ের প্রতি― এই নিয়ে বহু জটিল-কূটিল তর্ক-বিতর্ক হয়েছে, হচ্ছে, হবেও। তবে শিল্প ও সম-সময় ― এই দুইয়ের দায়কে নিজের কলমে সর্বাত্মকভাবে একীভূত করে বাংলা ভাষার খুব অল্প ক’জন কবিই কেবল চিরন্তনের শিখরস্পর্শী কবিতা লিখতে পেরেছেন। এবং বলতে একটুও দ্বিধা নেই আমার, সেই স্বল্প ক’জনের মধ্যে অবশ্যই মোহাম্মদ রফিক তাঁর কাব্যশক্তির দ্বারা এক বিশিষ্ট ও স্বতন্ত্র স্থান অধিকার করে আছেন। সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে একক ব্যক্তি ও বৃহৎ সমষ্টির অস্থির টানাপড়েন ধরা পড়েছিল তাঁর ধুলোর সংসারে এই মাটি গ্রন্থে; তারপর কপিলা, কীর্তিনাশা ও গাওদিয়া― ক্লাসিকের মর্যাদা পাবার যোগ্য এই কাব্যত্রয়ীতে উঠে এসেছিল পূর্ববঙ্গের গ্রামীণ জনপদের সৃষ্টি থেকে ধ্বংসের সজীব কিন্তু নির্মম চিত্রমালা; আর খোলা কবিতা তো রীতিমতো সপাটে আঘাত হেনেছিল বাংলাকে ছিঁড়েখুঁড়ে নিঃশেষ করা স্বৈরশাসকের ফাঁপা ভাবমূর্তির ওপর। পরবর্তীকালে তথাকথিত “গণতান্ত্রিক” আমলেও বাংলাদেশ যে চরম স্বৈরকালের খিন্ন হতাশা মুছে এগোতে পারেনি, সেই রুক্ষ বাস্তবতা পাওয়া যায় তাঁর মাতি কিসকু, বিষখালী সন্ধ্যা, নোনাঝাউ প্রভৃতি কাব্যগ্রন্থে।

মাসখানেক আগে প্রকাশিত হয়েছে মোহাম্মদ রফিকের নতুন কবিতার বই কালের মান্দাস। যথারীতি, তাঁর এই নবতম কাব্যগ্রন্থেও রয়েছে স্বদেশের সাম্প্রতিক সময়ের ঘটনাপুঞ্জের বহুমুখী ও সর্বোত্তম শৈল্পিক উপস্থাপন। তাঁর আগের কয়েকটি কাব্যগ্রন্থে আমরা পেয়েছিলাম বাংলাদেশের মানুষের স্বপ্নের পতন ও দুঃসহ দিনযাপনের কথকতা। কিন্তু কালের মান্দাস-এর অবয়ব খানিকটা ভিন্ন প্রকৃতির। বইটির রচনাকালের দিকে তাকানো যাক, ২০১৩-র ফেব্রুয়ারি থেকে জুন― এই পাঁচ মাসে লেখা ৫৬টি কবিতা সংকলিত হয়েছে এখানে। স্বভাবতই, গত বছরের ফেব্রুয়ারি মাসের গোড়াতেই শাহবাগের প্রজন্ম চত্বরে তারুণ্যের যে বিদ্রোহের অগ্নিস্ফূলিঙ্গ জ্বলে উঠেছিল, তার উত্তাপ এই কাব্যগ্রন্থের অনেকটা জুড়েই রয়েছে। উদাহরণস্বরূপ পড়ি, “প্রতিধ্বনি” কবিতাটি পুরোটাই, হৃদয়ে রক্ত দোলা দেয় যেন :

মূক ও বধির তারা কথা বলতে জানে;
খোঁড়া ভাঙা-হাত ন্যুব্জ, ডাক এলে হাঁটতে পারে
বদ্ধস্রোত হঠাত্ প্লাবণে বাঁধ ভাঙে
শুরু হয় সৃষ্টির উল্লাস মাঠে ঘাটে তেপান্তরে;

ইতিহাসে নড়ে বসে সমুদ্রের বিপুল গর্জনে
সম্মিলিত পদধ্বনি ভাঙে সময়ের ব্যবধান
কিশোর বালক সেও শোনে উজ্জীবন মন্ত্র
কণ্ঠে-কণ্ঠে লক্ষ লক্ষ মুষ্টিবদ্ধ হাতে হাতে

নবজন্ম ঘটে যায় একটি দেশের জনমানুষের
এবং তখন কেউ নয় বিচ্ছিন্ন বদ্বীপ বুকে-বুকে
জ্বলে ওঠে প্রদীপের শিখা চোখে চোখে
অগ্নিবাণ সম্প্রীতির বিশ্বাসের দৃঢ় অঙ্গীকার
জয় হবে, হবে জয় শোনো ওই কালের নিনাদ,
জাগো, ঢেউ উঠছে তেঁতুলিয়া থেকে টেকনাফ!

বলতেই হয়, এই কবিতা সময়ের বেড়া ভেঙে দেয়। শাহবাগের গণজাগরণের বিপ্লব-মুহূর্তের লেখনেও তাই মোহাম্মদ রফিক দেখতে পান একাত্তরের একতার দৃঢ়তা। “দেখো আজ” কবিতাতেও সেই একতা ও বিপ্লবের প্রতিজ্ঞার চিত্রলেখা অসামান্য আকারে মুদ্রিত :

...এটা তো মিছিল নয়, জনসমুদ্রের তীর্থযাত্রা
কবে থেকে শুরু তার, কে তার উত্তর দেবে আজ;
তরঙ্গ গর্জনে ভাঙে জলরাশি বিমুগ্ধ প্রহরে/
জেগে ওঠে আপন অস্তিত্বে অমলিন কলস্বরে...।

তবে, পরম প্রার্থিত বিপ্লবের আশার সাথে নৈরাজ্যের-ধ্বংসের চরম পরিস্থিতিও আসে কৃষ্ণ-বাস্তবতায় ভর করে― কবিও তা থেকে নিজেকে সরিয়ে রাখতে পারেন না। তাই ফের পড়ি “আগমুহূর্তে” শিরোনামের কবিতায় :

...দু-চোখ ধাঁধিয়ে দিচ্ছে কালো ধোঁয়া
ঘুমের কপাট জুড়ে ছায়া ফেলে মন্বন্তর
ত্রিকালবিনাশী হাওয়া ছুটে আসছে উড়িয়ে প্রান্তর
চৈত্রের নিদাঘ দেয় জ্বালিয়ে পুড়িয়ে হাড়গোড়...।

বিধ্বংসী আগুনের হলকায় যখন চতুর্দিক ছারখার, যেন তখনও বিপ্লবের পথে দাঁড়ানো নাছোড়বান্দা তরুণ প্রজন্মকে উদ্দেশ্য করেই লেখা “জয়গান” কবিতাটি :

মৃত্যু সঙ্গে করে নাও
পায়ে-পায়ে হাঁটো
তুমি নও লখিন্দর
নেই কোনো বেহুলাও
তুমি নও যুধিষ্ঠির
খোলা নেই স্বর্গের দুয়ার;

তুমি নইদ্যারচাঁদ
বুকে পিঠে বিষলক্ষ্যা ছুরি,
বিষ হরণের মন্ত্র জানা নেই
নিথর নিস্পন্দ মহুয়ার ধড়,
তুমি কাল, কাল-অধীশ্বর
তুমি মৃত্যু, মৃত্যু বিজয়ের পালাগান!

কবিতাটির দিকে মনোযোগ দিয়ে একটু তাকাই আবার। একইসাথে মৃত্যু, এবং মৃত্যুকে জয় করবার শক্ত সংকল্প এখানে যুগপৎ উপস্থিত। কালের মান্দাস তাই একইসাথে জাগরণের, জাগরণের স্বপ্নভঙ্গের ও স্বপ্নভঙ্গের কাল থেকে নতুন জাগরণে উত্তরণের অপূর্ব আশার কথাও বলে। “মা” এবং “প্রতিমূর্তি”― এই দুটি কবিতাকে পাশপাশি রেখে পড়া যেতে পারে। প্রথমটিতে রয়েছে যেন কবির নিজের মায়ের স্নেহ মমতা ও তাঁর দৈনন্দিনের চলন-কথনের বর্ণনাই :

...ভোরে উঠে জল দেয় গাছে
রোদ তার একান্ত আপন
সখা যেন, কাল-কালান্তর
হাওয়া দেয়, মোহমুক্ত ধন;

নিদ্রাহীন আমৃত্যু অমর
চক্ষু দুটি মশালের আলো
খোঁজ নেয় প্রতি সন্তানের
যারা খাটে মাঠে-তেপান্তরে...

আবার দ্বিতীয় কবিতাটিতে পাই মাতৃমূর্তির এক ভিন্নতর প্রতিমার সন্ধান :

মাতৃমূর্তি কালের প্রহরা
চক্ষু দুটি জ্বলছে অনির্বাণ
তোমার পৌত্রেরা মাঠে-পথে
তুলছে মুষ্টি অগ্নিশপথের,

পাথরে খোদিত শুধু নয়
তুমি চেতনার অগ্নিবাণ
ঘরে-ঘরে পাটের খড়ির
চোখে-মুখে বজ্র বিদ্যুতের,

কে বলেছে নিথর নিশ্চল
মুক্তি স্রোতে তোমার স্বাক্ষর
চির-বহমান জলস্রোত
হাঁক দেয় পদ্মা-মেঘনায়

কালের বেদিতে সমর্পিতা
তুমি বাংলা মাটি তেপান্তর
কাল নয় স্থবির নিঃশেষ
তুমি জাগরণ, মহাকাল।

দুটি কবিতা মিলে যেন মাতৃরূপ তথা স্বদেশের একইসাথে মমতাময়ী ও সংগ্রামী হয়ে উঠবার অমর প্রবণতাকেই চিহ্নিত করতে চায়। মাতৃরূপের মধ্যেই এই ঝঞ্ঝাময় স্বদেশের প্রকৃত রূপ নিহিত। অন্যদিকে “ডাক” কবিতাটির মধ্যে পাওয়া যায় সেই মাতৃরূপের অমরত্ব ও তাঁর কাছ থেকে পরিত্রাণের নিদান পাবার আকাঙ্খার প্রতিচ্ছবি :

...খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলে পথ
শত-শত খুনিদের মুখে ছাই
সন্ত্রাসের আস্তাবল ভেঙেচুরে
আমার মা আজও বেঁচে আছে
অঙ্গীকারে ছুটে যাই তার কাছে
নতজানু হয়ে বলি, পরিত্রাণ-মন্ত্র দাও মাগো!

কালের মান্দাস-এর রচনাকালেই, বাংলাদেশকে আরেকটি ঘটনা হতবিহ্বল করে তুলেছিল। তা হলো রানা প্লাজার ভয়াবহ ধ্বস ও সেই দুর্ঘটনায় হাজারো মানুষের মৃত্যু। এই বইয়ের কয়েকটি কবিতায় ধরা আছে সেই মর্মান্তিক সময়ের কিছু বাক্সময় অথচ দুঃসহ চিত্রও। যে নিরীহ প্রাণগুলোকে নিতান্তই “লোভ-লালসার যূপকাষ্ঠে অন্ধ বলিদান” দেওয়া হলো, তারাই যেন কবিকে ঘিরে ধরে বারংবার :

কোথা থেকে আসে এরা
কথা বলে ত্রাহিস্বরে
দাপায়, শাসায়, প্রেতমূর্তি যেন
ভেঙে পড়ে কলমের ভার
শব্দগুলি ভয়ার্ত চিৎকারে ছোটে
আশ্রয়ের খোঁজে ছেঁড়া ছন্দে, ছিন্ন চিত্রকল্পে...
(“মুক্তি দাও মাগো”)

এ নিয়ে আরেকটি অসামান্য কবিতা “শাহীনা”, হয়তো স্মরণে আছে সংবাদপাঠকদের, শাহীনা নামে এক পোশাক-শ্রমিক ধ্বসে পড়া রানা প্লাজা থেকে উদ্ধার পেতে পেতে শেষ মুহূর্তে উদ্ধারকাজের জন্যই জ্বালানো আগুনে পুড়ে মৃত্যুপথে ধাবিত হন― তাঁকে নিয়েই এই আশ্চর্য সংবেদি কবিতাটি রচিত :

শাহীনা, তোমার সঙ্গে যেতে চাই
কবিতার শব্দ ছন্দ লয় প্রতি পঙ্‌ক্তির বিন্যাস
তোমার মৃত্যুর চেয়ে কোনো কিছু যন্ত্রণার নয়;

শেষ মুহূর্তের আর্তকণ্ঠ, ভাই ছেড়ে যেয়ো না আমারে,
ঢাকা পড়ে আগুনের লেলিহান জ্বলন্ত শিখায়,
তখনও-বা বুঝি বেঁচে ছিলে চোখে জীবনের ঘোর;

নেমে এলো অন্ধকার তুমি পড়ে রইলে অসহায়
অতঃপর মৃত্যু এসে কোলে তুলে নিলো ধীরে ধীরে
সেই মুহূর্তের ক্ষণ ধরা পড়বে না কল্পনায়

কোথায় নিবাস ছিল বাড়িঘর সন্তানের মুখ
কাফনের ধবধবে সাদা থানে আবৃত অনড়
এখন তোমার যাত্রা স্মৃতিহীন অনন্ত আকাশে,

পড়ে রই পাপবিদ্ধ আত্মঅনুশোচনায় ছিন্নভিন্ন
এই অপরাধবোধ হয়তো-বা কোনো এক দুর্জনের
তবু, ক্ষমা করে দিয়ো বোন এই অক্ষম আবেগ

শাহীনা, তোমার সঙ্গী হতে চাই, কিন্তু সেই পথ
রুদ্ধ আজ; কাল নিয়তির অভিশাপ বুকে
পাথরের চাঁই বেঁধে মুখ থুবড়ে পড়ে থাকি কবিতার

চুন, বালি, ইট-সুরকি ধ্বংসজজ্ঞ ভবনের
অন্তহীন নির্বিবেক বিকারের ঘোরে,
জানি, তুমি জেগে উঠবে বারবার কবরের মাটি ফুঁড়ে!

কবির নিজস্ব কালের মান্দাস এভাবেই ভাসতে ভাসতে বর্তমানের জয়-পরাজয় কিংবা সংগ্রাম-গ্লানিকে তুলে আনে চিরন্তনের আদলে।

এই নাতিদীর্ঘ আলোচনার শুরুতে যা বলছিলাম, সেই কথায় আবার ফিরে আসি। একজন কবি তখনই অমর হয়ে ওঠেন যখন কিনা তিনি শিল্পের দায় ও সমকালের দায় এ-ই দুটিকেই একইসাথে মেটাতে পারেন। আগেই বলেছি, মোহাম্মদ রফিক আমাদের কালের সেই বিরল ধারার এক মহান কবি। বর্তমান ও চিরকালকে যুগপৎ আকারে মেলাতে খুব কম কবিই পারেন তাঁর মতো, এ কথা মনোযোগী কাব্যপাঠকের নিকট নিশ্চয়ই অত্যুক্তি বলে গণ্য হবে না। কালের মান্দাস বইটিতেও উক্ত বৈশিষ্ট্যের ব্যতিক্রম ঘটেনি। এই কাব্যগ্রন্থ সমকালের সৌরভ অন্তরে ধারণ করে পৌঁছছে অমর মহাকালের ধ্রুপদী মঞ্চে। সাম্প্রতিক কালের ঘটনাবলীর শাশ্বত ও সার্থক রূপায়ন ঘটেছে এখানে। পরিশেষে বলি, কালের মান্দাস কাব্যগ্রন্থটি মোহাম্মদ রফিক উৎসর্গ করেছেন “তরুণ প্রজন্মকে”। তরুণ প্রজন্মের পাঠকেরা যদি বইটি পড়ে নিজেদের কলমেও স্বকাল ও স্বদেশের চিত্রাবলী ধরে রাখার ন্যূনতম প্রচেষ্টাও করেন তাহলে মোহাম্মদ রফিকের আজীবনের সাধনা এক ভিন্ন মাত্রায় সার্থকতা পাবে বলে মনে করি। গুরু দ্রোণাচার্যরূপী কবি মোহাম্মদ রফিকের দানকৃত জরুরি শিক্ষা যেন তারুণ্যের মনে গেঁথে যায় চিরতরে, এই দরকারি আশাটুকুও সাথে থাক সর্বদা।

----মুহিত হাসান

ছবি: 
24/08/2007 - 2:03পূর্বাহ্ন

মন্তব্য

তারেক অণু এর ছবি

পড়ার তালিকায় আছে, স্যার বলেছিলেন অনেক দিন পর শাহবাগ আন্দোলনের সময় তিনি এঁকের পর এক কবিতা লিখেছিলেন।

রিভিউ ভাল হয়েছে দিগন্ত, আরও লেখা আসুক

এক লহমা এর ছবি

বইটি পড়ার ইচ্ছে রইল।
রিভিউ ভাল লেগেছে।

--------------------------------------------------------

এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।

এক লহমার... টুকিটাকি

তাহসিন রেজা এর ছবি

স্যারের অনেক বইই পড়েছি, এই বইটাও পড়েছি, আমার খুব প্রিয় হাসি

------------------------------------------------------------------------------------------------------------
“We sit in the mud, my friend, and reach for the stars.”

অলীক জানালা _________

অতিথি লেখক এর ছবি

চলুক

-আনন্দময়ী মজুমদার

ঝিঝি পোঁকা এর ছবি

রিভিউ ভাল লাগল ৷

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।