কেমন বাজেট চাই?

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: বুধ, ০৪/০৬/২০১৪ - ২:৩৯পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

গত বেশ কয়েকটি অর্থবছরে বাংলাদেশ হাজারকোটি টাকার বিশাল ঘাটতি বাজেট প্রণয়ন করে আসছে। আমাদের দেশের দূর্বল এবং দুর্নীতিগ্রস্থ প্রশাসনিক ব্যবস্থায় এত বিশালাকার বাজেট বাস্তবায়নই হলো প্রকৃত চ্যালেঞ্জ। কারণ প্রায় প্রতিটি সরকারের আমলেই অর্থবছর শেষ হওয়ার আগে তাড়াহুড়ো করে এডিপি বাস্তবায়নের জন্য অর্থ ছাড় করানোর প্রবণতা লক্ষনীয়। এর ফলে প্রকল্পের ব্যয় বৃদ্ধির পাশাপাশি প্রকল্পের গুণগত মান যেমন ক্ষতিগ্রস্থ হয় তেমনি দুর্নীতির সুযোগও বৃদ্ধি পায়। দেশের একজন সচেতন নাগরিক হিসেবে বাজেটে নিম্নোক্ত বিষয়াদির প্রতি গুরুত্ব আশা করছি----
• বাংলাদেশের বিশাল জনসংখ্যাকে বরাবরই বোঝা হিসেবে দেখা হয়ে আসছে। কিন্ত যথাযথ কর্মমূখী শিক্ষা ও প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ পেলে এই বিশাল জনসংখ্যাকে আমরা জনসম্পদে পরিণত করতে পারি এবং দক্ষ জনশক্তি রপ্তানির মাধ্যমে প্রবাসে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের পাশাপাশি আমাদের ভাবমূর্তিও উজ্জ্বল করে তুলতে পারি। তাই আগামী বাজেটে এই ব্যাপারে যথাযথ কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন এবং এর সঠিক বাস্তবায়ন আশা করি।
• শিক্ষা ক্ষেত্রে বরাদ্দ বৃদ্ধি করে উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে পর্যাপ্ত পরিমাণ অর্থায়নের মাধ্যমে গবেষণাকে উৎসাহিত করতে হবে।
• কৃষি বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রধান চালিকা শক্তি। শুধু তাই-ই নয় এটি সবচেয়ে বড় কর্মসংস্থান সৃষ্টিকারী খাতও। কিন্তু কৃষক সর্বদা বঞ্চিত উৎপাদিত ফসলের উপযুক্ত মূল্যপ্রাপ্তি থেকে। তাই কৃষিজাত পণ্যের বাজার সৃষ্টির মাধমে উৎপাদিত ফসলের উপযুক্ত মূল্যপ্রাপ্তির এবং মধ্যস্বত্তঃভোগীদের দৌরাত্ম কমানোর প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা ও দিকনির্দেশনা বাজেটে প্রদান করতে হবে।
• ব্যাংক সুদের হার কমিয়ে বেসরকারি বিনিয়োগ ও ব্যক্তি উদ্যোক্তাদের বিনিয়োগে উৎসাহী করতে হবে। দেশের বিশাল তরুণ জনগোষ্ঠীর সম্ভাবনা, উদ্যম, সৃষ্টিশীলতা ও মেধাকে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের চালিকাশক্তি বানানোর জন্য বিনিয়োগের কোন বিকল্প নেই।
• শুধু প্রবৃদ্ধি অর্জনের মরীচিকার পিছনে না ছুটে প্রকৃত উন্নয়ন ঘটানোর লক্ষ্যে প্রাতিষ্ঠানিক পরিবর্তনের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা বাজেটে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। এই জন্য দেশের সকল নাগরিক মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করার জন্য সামাজিক নিরাপত্তার আকারকে আরো বিস্তৃত করতে হবে।
• দেশের রুগ্ন স্বাস্থ্য সেবার মানকে উন্নত ও আধুনিক করার লক্ষ্য সরকারি মেডিকেলগুলোর আসন সংখ্যা বৃদ্ধি ও অবকাঠামোকে শক্তিশালী করতে প্রয়োজনীয় বরাদ্দ দিতে হবে।
• বাংলাদেশের অন্যতম সম্ভাবনাময় খাত হলো পর্যটন। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের বিষয় কোন সরকারই এই খাতের সঠিক গুরত্ব অনাধাবন করতে পারেনি। কিন্তু পর্যটন শিল্পের বিকাশ ও এর যুগোপোযোগী ব্যবহারের মাধ্যমে মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড ইত্যাদি দেশ অভূতপূর্ব উন্নয়ন ঘটিয়েছে। তাই আসছে বাজেটে এই খাতের উপর বিশেষ গুরুত্ব আশা করছি।

বাজেটে যে খাতে সবচেয়ে বেশি বরাদ্দ চাই

একটি দেশের সামগ্রিক উন্নয়নের জন্য যে খাতটি অগ্রাধিকার ভিত্তিতে সবচেয়ে বেশি বরাদ্দ পাওয়ার কথা সেই শিক্ষা খাতটি-ই আমাদের বাজেট বরাদ্দের দিক থেকে সর্বদা অবহেলিত থাকে। অথচ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষার মানের করুণ দশা, উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ে গত দশ বছরেও নুতন কোন কলেজ স্থাপিত হয়নি। বিশ্ববিদ্যালয় ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো চলছে ধুঁকে ধুঁকে। এ পরিস্থিতিতে শিক্ষায় সর্বোচ্চ বরাদ্দ এবং গুরুত্বারোপ করতে হবে। সর্বোপরি নতুন স্কুল-কলেজ প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি বিদ্যমান প্রতিষ্ঠানগুলোর অবকাঠামো উন্নয়ন ও আসন সংখ্যা বৃদ্ধি করতে হবে এবং শিক্ষকদের মর্্যা দার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ বেতন স্কেল প্রণয়ন করতে হবে।

কোন বিশেষ খাতে বরাদ্দ বৃদ্ধি করা প্রয়োজন মনে করি এবং কেন

তথ্যপ্রযুক্তি খাতে বিনিয়োগ বৃদ্ধি করে এটিকে আরো সহজলভ্য ও সাশ্রয়ী করতে হবে। বর্তমানে এদেশের তরুণদের একটা বিশাল অংশ আউটসোর্সিং খাতে জড়িত আছে এবং স্বাধীন পেশা হিসাবে তরুণদের কাছে এর জনপ্রিয়তাও দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। বর্তমানে আউটসোর্সিং এবং ফ্রিল্যান্সিং জগতে বাংলাদেশের অবস্থান ৩য় এবং এদেশের ফ্রিল্যান্সারদের মান ও প্রশ্নাতীত। তবে এক্ষেত্রে সবচে বড় বাধা হচ্ছে উচ্চগতিসম্পন্ন ইন্টারনেট সংযোগ এর দুষ্প্রাপ্যতা এবং প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ ও দিকনির্দেশনার অভাব। তাই এই খাতে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বরাদ্ধ বৃদ্ধির মাধ্যমে প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ ইন্সটিটিউট প্রতিষ্ঠা এবং উচ্চগতিসম্পন্ন ইন্টারনেট এর সহজলভ্যতা একদিকে যেমন দেশের বেকার সমস্যাকে সমাধান করবে অন্যদিকে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের আরেকটি বড় ক্ষেত্র হিসাবে গড়ে উঠবে।

কোন খাতে প্রচলিত বরাদ্দকে অতিরিক্ত মনে করি এবং কেন

অবশ্যই সামরিক খাত এবং মাথাভারী প্রশাসনের বেতন-ভাতার পেছনে প্রচলিত বরাদ্দ। প্রতিবছরই দেখা যায় আমাদের বাজেটের সিংহভাগই ব্যয় হয় এই দুই খাতে। তার মধ্যে সামরিক খাতে বরাদ্দের অংকটি সবসময়ই সাধারণ জনগণের অজানা। সামরিক বাহিনীর কেনাকাটার ক্ষেত্রে সরকারি ক্রয় সংক্রান্ত নীতিমালারও কোন তোয়াক্কা করা হয়না এবং এই খাতেই জনগণের করের টাকার অপচয় হয় সবচেয়ে বেশি। তার উপর স্বচ্ছতার প্রশ্ন তো আছেই। তাছাড়া সরকার বদলের সাথে সাথে এক বিশাল সংখ্যক আমলাকে ওএসডি করণ এবং প্রয়োজনের অতিরিক্ত নিয়োগ (৩৩তম বিসিএস পরীক্ষার মাধ্যমে ৪২০৬টি শুন্য পদের বিপরীতে ৮৫২৯ জন অর্থাৎ দিগুণেরও বেশি নিয়োগ দেয়া হয়) এদেশের প্রশাসনিক ব্যয়কে গরীবের হাতি পোষার সাথে তুলনীয় করে তুলেছে।

বাজেটে তরুণদের চাওয়া

তরুণ সমাজ ইদানীং চাকরির পেছনে ছোটার চাইতে নতুন উদ্যোক্তা হবার স্বপ্নটাই বেশি দেখছে। তবে এক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় সমস্যা সরকারের বিভিন্ন দপ্তরের আমলাতান্ত্রিক জটিলতা এবং পুঁজির অভাব। তাই আগামী বাজেটে তরুণদের প্রত্যাশা হল-আমলাতান্ত্রিক জটিলতা নিরসনে ওয়ান স্টপ সার্ভিস প্রতিষ্ঠার জন্য বাজেটে বিশেষ বরাদ্দ রাখা এবং ব্যাংকের সুদের হারকে সহনীয় অবস্থায় এনে প্রয়োজনীয় পুঁজির ব্যবস্থা করা।

দীপাবলি ও নির্ঝরা শ্রাবণ


মন্তব্য

মেঘলা মানুষ এর ছবি

সুদের হার কমানো বাণিজ্যে গতি সঞ্চার করতে পারে। কিন্তু দুর্ভাগ্য হল, বাংলাদেশের ব্যাংকিং ব্যবস্থা সেরকম শক্ত অবস্থায় আছে বলে মনে হয় না। সুদের হার কমলে খেলাপি গ্রাহিতার সংখ্যা কমবে না, অপরদিকে ব্যাংকগুলো তাদের লাভজনক খাতে কম মুনাফা পাবে। ব্যাংকগুলো সংকটের মুখে পড়তে পারে। আমার কাছে নিশ্চিত তথ্য নেই, তবে সাধারণত সেভিংস অ্যাকাউন্টে থাকা টাকার উপর মুনাফার হার এবং ব্যাংকের বিতরণকৃত ঋণের সুদের হারের মাঝে বাংলাদেশে প্রায় ৭-১০% পার্থক্য আছে।

বাংলাদেশে মানুষের বিনিয়েগের খাত হিসেবে সঞ্চয়পত্রের আকর্ষণ আকাশচুম্বী। যারা অবসরে যান, তারা এটাকে একটা নিরাপদ বিনিয়োগ ধরে নেন। কিছু কিছু দেশে সুদের হার কম এবং সেখানে শেয়ার বাজারে বিনিয়োগ বেশি লাভজনক। ঐসব ব্যবস্থায় নিজে মাথা খাটিয়ে শেয়ার নাড়াচাড়া না করতে চাইলে, প্রাতিষ্ঠানিক পোর্টফোলিও ম্যানেজার পাওয়া সম্ভব; আমাদের দেশে এই ব্যবস্থা এখনও সুপ্রতিষ্ঠিত ও জনপ্রিয় না।

সামাজিক নিরাপত্তার কথাও উল্লেখ করেছেন -এটা ভালো লেগেছে।বাংলাদেশে বয়স্কভাতা (যেটা অপ্রতুল) ছাড়া আর কি কি সমাজিক নিরাপত্তায় সরকার অংশগ্রহণ করে জানা নেই। কেউ শারীরিক/মানসিকভাবে অক্ষম হয়ে গেলে তার দায়িত্ব রাষ্ট্র নেয় না।

তরুণ সমাজ ইদানীং চাকরির পেছনে ছোটার চাইতে নতুন উদ্যোক্তা হবার স্বপ্নটাই বেশি দেখছে। তবে এক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় সমস্যা সরকারের বিভিন্ন দপ্তরের আমলাতান্ত্রিক জটিলতা এবং পুঁজির অভাব।

-কথাটা সত্য। তবে এর সাথে নিরাপত্তার অভাব ও অযাচিত রাজনৈতিক প্রভাবের সমস্যাও প্রকট। আজ কেউ এখজন ব্যবসা শুরু করলে, কাল একজন এসে চাঁদা চাইবে -না পেলে হুমকি শুনতে হবে; পরশু দেখা যাবে যে ব্যবসার সুযোগটা এই তরুণ উদ্যোগতার পাওয়ার কথা -সেটা কেউ একজন রাজনৈতিক পেশির জোরে কেড়ে নিয়েছে। নতুন ব্যবসা করতে গিয়ে আশাহত হতে দেখেছি অনেককে -এসব কারণে।

লেখার জন্য শুভেচ্ছা, ভালো থাকুন হাসি

অতিথি লেখক এর ছবি

মেঘলা মানুষ,

মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ। হাসি

আসলে বাংলাদেশ ব্যাংকের পরামর্শ অনুসারে সঞ্চয় ও ঋণের সুদের হারের পার্থক্য ৫% এর মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকা উচিৎ। তা মানা হলে সুদের হার বর্তমান অবস্থা থেকে কমবে। আর সুদের হার বাড়ানো থাকলেও তাতে ঋণখেলাপীদের কোন সমস্যা হয়না। কারণ বড় বড় ঋণখেলাপীরা এমনিতেই বিশেষ ব্যবস্থায় স্বল্পসুদে ঋণ পেয়ে থাকেন। কিন্তু সুদের হার বাড়লে সমস্যায় পড়েন নতুন উদ্যোক্তা ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা। আর ব্যাংকিং জগতে গুটিকয়েক ব্যবসায়ীকে সব ব্যাংক বড় অংকের ঋণ দিয়ে তিজেরাই নিজেদের বিপদ ডেকে এনেছে। এক্ষেত্রে যদি স্বল্প সুদে ছোট আকারের ঋণ দিয়ে বেশি সংখ্যক নতুন উদ্যোক্তা ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের অর্থায়ন করা যায় তাহলে ঝুঁকিটা কমবে,বরং সুদের হার কম হলেও খেলাপী ঋণ কম হওয়ায় এর বিপরীতে নিরাপত্তা সঞ্চিতি কম রাখতে হবে বিধায় মুনাফা বাড়ার সুযোগ থাকবে।

তরুণ উদ্যোক্তারা অনেক বিপদের ঝুঁকি নিয়েই ব্যবসায় নামে কোন সন্দেহ নেই। তার উপর চাঁদাবাজি তো আছেই। তারপরও প্রতিনিয়ত তরুণ্রা এগিয়ে আসছে নতুন ধারার ব্যাবসা ভাবনা নিয়ে। তাই এগিয়ে আসার ক্ষেত্রে যে বাধাগুলো প্রধান সেগুলোর উপরই প্রধানত জোর দেয়া উচিৎ বলে মনে করছি।

ভালো থাকবেন।

দীপাবলি ও নির্ঝরা শ্রাবণ

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।