রবীন্দ্রস্মৃতি বিজড়িত বলধা গার্ডেনে

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: বুধ, ২৯/১০/২০১৪ - ২:৫৪অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

আজি হতে কত বর্ষ আগে?
সার্ধশতবর্ষ তো অবশ্যই।
১৮৯৮ সালে বঙ্গীয় প্রাদেশিক সম্মেলনে যোগ দিতে এসেছিলেন তিনি। অবিভক্ত ভারতবর্ষের প্রেক্ষাপটে রচিত 'ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন' নাট্যের একটি অঙ্কের পার্শ্বচরিত্র হিসেবে এসেছিলেন প্রথমবার।

দ্বিতীয়বার ১৯২৬ সালে।
দ্বিতীয়বার যখন তিনি ঢাকায় এলেন, তখন বহুমাত্রিক কর্মকাণ্ডে সমৃদ্ধ, অতলান্ত অভিজ্ঞতায় ঋদ্ধ তাঁর জীবন। এবারের সফরে তিনিই সকল ঘটনার কেন্দ্রীয় চরিত্র। সাধারণের উম্মাদনা, সুধী সমাজের আগ্রহের সমস্তটাই তাঁকে ঘিরে।
কলকাতা থেকে গোয়ালন্দ হয়ে স্টিমারে নারায়নগঞ্জ। সেখান থেকে সুসজ্জিত মোটর শোভাযাত্রা সহকারে ৭ ফেব্রুয়ারির পড়ন্ত দুপুরে ঢাকা পৌঁছলেন তিনি। ব্যস্ত কর্মসূচীর ঠাসবুননে পরবর্তী দুটো দিন পার করে ১০ ফেব্রুয়ারি সকালে পাটুয়াটুলীর ব্রাহ্মসমাজে যোগদানের পর বাঙালির প্রাণের মানুষ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পা রাখলেন ওয়ারীর এককোণে ভাওয়াল পরগনার বলধার জমিদার নরেন্দ্র নারায়ণ রায়চৌধুরীর পরম যত্নে গড়ে তোলা বিচিত্র উদ্ভিদরাজ্য বলধা গার্ডেনে।

পড়ন্ত বিকেলের নরম আলো গায়ে মেখে ঐতিহাসিক সেই উদ্ভিদরাজ্যের সামনে এসে দাঁড়ালাম আমরা। উদ্ভিদরাজ্যটি দুটি অংশে বিভক্ত। এর মধ্যে অপেক্ষাকৃত ছোট এবং সাধারণের প্রবেশাধিকার সংরক্ষিত অংশটির নাম 'সাইকি'- বাংলায় যাকে ডাকা যায় 'মানস' নামে! আর মোটামুটি আয়তাকার বৃহত্তর অংশটির নাম 'সিবিলি'- ফ্রিজিয়ার পৌরাণিক কাহিনীতে বর্ণিত উর্বরতার দেবী সিবিলির নামানুসারে। উদ্ভিদরাজ্যের এই অংশে প্রবেশাধিকার অবাধ সকলের।

উদ্ভিদরাজ্যের ভেতরে ঢুকলাম আমরা। পা বাড়ালাম অসংখ্য বৃক্ষের ছায়াঘন পথে।
১৯০৯ সালে ৩.৩৮ একর জমির উপর জমিদার নরেন্দ্র নারায়ণ রায়চৌধুরী সূচনা করেন এই বৃক্ষসংগ্রহশালার।
তারপর ১৯৪০ সাল পর্যন্ত বাগানের শ্রীবৃদ্ধির যুগ। বৃক্ষপ্রেমী জমিদারের ঐকান্তিক প্রয়াসে বলধা গার্ডেনে সংগৃহীত হয় প্রায় ৮০০ প্রজাতির উদ্ভিদ।
দেশী, বিদেশী, শঙ্কর জাতের ফলজ বনজ ঔষধি বৃক্ষ-গুল্ম-লতার পাশাপাশি উদয়পদ্ম, নাগেশ্বর, রাজঅশোক, স্বর্ণঅশোকসহ নানা ধরনের গাছে সমৃদ্ধ হয় বলধা গার্ডেন!

১৯৪০ সালে এই বাগানটিতে সংঘটিত একটি হত্যাকাণ্ড যতি টেনে দেয় শ্রীবৃদ্ধির ইতিহাসে। প্রতিষ্ঠাতা নরেন্দ্র নারায়ণ রায়চৌধুরীর একমাত্র পুত্র নৃপেন্দ্র নারায়ণ রায় চৌধুরীকে হত্যা করা হয় বলধা কালচার হাউজের শয়নকক্ষে।
স্বাভাবিকভাবেই পুত্রশোকে ভেঙ্গে পড়েন বৃক্ষপ্রেমী জমিদার। সেই সাথে ব্যাধি-বার্ধক্যও আঘাত হানে তাঁর শোকসন্তপ্ততায়। ১৯৪৩ সালের ১৩ অগাস্ট নরেন্দ্র নারায়ণ রায়চৌধুরী পতিত হন মৃত্যুমুখে।

জমিদারের মৃত্যুর পর বলধা গার্ডেনের দায়িত্ব অর্পিত হয় অমৃতলাল আচার্যের উপর। বৃক্ষপ্রেমী ছিলেন তিনিও। তাই হয়তোবা বাগানের ক্ষয়িষ্ণুতার গতি থমকে যায় কিছু সময়ের জন্য!
কিন্তু অমৃতলাল আচার্যের মৃত্যুর পর বলধা গার্ডেনের করুণ পরিণতি নিশ্চিত হয়ে যায়। ১৯৪৭ সালের দেশভাগের সময় প্রায় পরিত্যক্ত উদ্যানে পরিণত হয় এটি। ১৯৫১ সালে পূর্ববঙ্গের পরিস্থিতি খানিকটা স্থিতাবস্থায় এলে বাগানটিকে ন্যস্ত করা হয় কোর্ট অব ওয়ার্ডসের অধীনে। ১৯৬২ সালে বলধা গার্ডেনের দায়ভার গ্রহণ করে বন বিভাগ।

ঐতিহাসিক এই বাগানের ছায়াঘন পথ ধরে হাঁটতে হাঁটতে শঙ্খনদের কাছে পৌঁছাই আমরা। 'শঙ্খনদ' সত্যিকার অর্থে নদ নয়। চারদিক বাঁধানো একটা ছোট্ট পুকুর। অপরূপ সেই পুকুরের দুপাশে নানা রকম নকশা আঁকা দুটো ঘাট। ঘাটদুটোর সিড়ি নেমে গেছে বহুদূর- জল অবধি- যে জলে ভেসে আছে দেশী প্রজাতির শাপলা, আফ্রিকার দানবাকৃতি পদ্মপাতা।

শঙ্খনদের একপাড়ে 'আনন্দভবন'। দ্বিতল এই ভবন থেকে বাগানের শোভা ভালোভাবে অবলোকন করা যায়। আনন্দভবনের সামনে দাঁড়িয়ে কথা হলো বনবিভাগের একজন কর্মচারীর সাথে। তিনি জানালেন, কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এখানে বসেই লিখেছিলেন তার ক্যামেলিয়া কবিতাটি।
সত্যি? সংশয় প্রকাশ করলাম আমরা।
আমাদের সংশয় প্রকাশে তিনি অসন্তুষ্ট হলেন। অনেকটা জোর করেই আমাদের নিয়ে চললেন বাগানের পেছন দিকে। মোটা তারের জাল দিয়ে ঘেরা একটা ঘর সেখানে। ঘরটির নাম ক্যামেলিয়া হাউজ। ক্যামেলিয়া হাউজের ভেতর ঘন সবুজ রংয়ের শক্ত পাতাযুক্ত কিছু গাছ। গাছগুলোর প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করে তিনি বললেন, এই হচ্ছে সেই ক্যামেলিয়া গাছ, যার ফুল দেখে মুগ্ধ হয়ে কবি লিখেছিলেন কবিতাটি!

ক্যামেলিয়া হাউজের চারপাশ জুড়ে শাপলা হাউজ। নানা প্রজাতির শাপলার বীজ জলপূর্ণ প্রতিটি হাউজে। একটি হাউজে আমাজন লিলি। বিস্মিত হওয়ার মতো বিশাল বৃত্তাকার অবয়ব তার! তবে বিস্ময় উপকরণের যেন শেষ নেই উদ্যানটিতে! আমাদের বিস্ময়ের মাত্রাকে আরো বাড়িয়ে দিল লাল রংয়ের একটি সূর্যঘড়ি!

বিপুল বিস্ময় নিয়ে উদ্যান ঘুরে দেখলাম আমরা। শুধু বিস্ময়ই নয়, পাশাপাশি উদ্যানের অনাকাঙ্ক্ষিত অবনমনচিত্রও চোখে পড়ল আমাদের! চোখে পড়ল উদ্যান ব্যবস্থাপনায় বিভিন্ন বিশৃঙ্খলা!
ক্রমবর্ধমান অবনমন, বিশৃঙ্খলা সত্ত্বেও বাগানের বিচিত্র প্রজাতির সবুজ বৃক্ষ নিবিড় স্নেহের ছায়ায় আপন করে নিতে উদ্যত অবুঝ নগরবাসীকে!
বৃক্ষ কি এমনই হয়! স্নেহময়, মমতাশীল!
জীবনের অপরিহার্য প্রপঞ্চ সেই বৃক্ষের প্রতি ভালোবাসা তৈরি হওয়া তো অবশ্যই উচিত আমাদের!

দীপংকর চন্দ

ছবি: 
24/08/2007 - 2:03পূর্বাহ্ন

মন্তব্য

অতিথি লেখক এর ছবি

বলধা গার্ডেনে রবীন্দ্রনাথের পদধূলি পড়েছিল জেনে রীতিমত শিহরিত হচ্ছি। এই বলধা গার্ডেন যেখানে অনেকবার গেছি, সেখানে কবিও এসেছিলেন, আমি যে পথ ধরে হেটেছি, সে জায়গা দিয়ে কবিও হেটেছিলেন! সত্যি অন্যরকম একটা অনুভূতির জন্ম দিল লেখাটা, অথচ কবি সংক্রান্ত বর্ননাটা অল্পতেই শেষ হয়ে গেল। কবি কি কিছু বলেছিলেন? লিখেছিলেন কোন কবিতা? বা, গান? কবিতার বিশাল কাব্যসিন্ধুর কোথাও স্থান পেয়েছে এই বলধা গার্ডেন বা এর কোন বৃক্ষ, ফুল, পাতা?

পাশাপাশি উদ্যানের অনাকাঙ্ক্ষিত অবনমনচিত্রও চোখে পড়ল আমাদের! চোখে পড়ল উদ্যান ব্যবস্থাপনায় বিভিন্ন বিশৃঙ্খলা!

ক্রমবর্ধমান অশ্লীলতা নিভৃতচারী নিসর্গপ্রেমীদের দীর্ঘদিন ধরে বলধা গার্ডেন থেকে দূরে সরিয়ে রাখছে!

লোক-লোকান্তর

অতিথি লেখক এর ছবি

শুভকামনা জানবেন লোক-লোকান্তর।

উত্তরের বিলম্বের জন্য ক্ষমাপ্রার্থণা করছি।

বলধা গার্ডেনে কবিগুরুর যাপিত সংক্ষিপ্ত সময় সম্পর্কে কিছু নির্ভরযোগ্য তথ্যসূত্র আমাদের আশ্বস্ত করলেও বলধা গার্ডেনের বিশেষ কোন স্মৃতি কিংবা বিচিত্র এই উদ্ভিদরাজ্যের বিশেষ কোন জীব বা জড় উপাদানের প্রভাব তাঁর সুবিশাল কাব্যসিন্ধুর কোন অংশকে প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষে সুনির্দিশ্টভাবে আলোকজ্জ্বল করেছে কিনা, সে সম্পর্কে প্রচলিত তথ্যসমূহ আমার জানার স্বল্প পরিধিতে বিশেষ স্বচ্ছ নয়।

বিচ্ছিন্নভাবে বলধা গার্ডেন সম্পর্কে কবি গুরুর উচ্ছসিত প্রশংসার কথা প্রাসঙ্গিকভাবে উঠে আসে কিছু সূত্রে, তবে নির্ভরযোগ্য সূত্র সমর্থিত না হওয়ায় বিষয়টি সম্পর্কে খানিকটা সংশয় রয়েই যায় চেতনে-অবচেতনে।

বলধা গার্ডেনে ক্যামেলিয়া হাউজে প্রস্ফুটিত ফুলের অপরূপ শোভা দর্শনে কবিগুরু তাঁর পাঠক নন্দিত ক্যামেলিয়া কবিতাটি রচনা করেছিলেন বিচিত্র এই উদ্ভিদরাজ্যের শঙ্খনদের পাড়ে অবস্থিত আনন্দভবনে বসে, এমন একটি তথ্য সুপ্রচলিত কবি অনুরাগীদের মধ্যে। এধরনের তথ্য-উৎকীর্ণ একটি ফলকের উপস্থিতিও লক্ষ্য করেছেন হয়তো বলধা গার্ডেন পরিদর্শনার্থীদের কেউ কেউ, কিন্তু নির্ভরযোগ্য সূত্রের মুখাপ্রেক্ষি হলে খানিকটা মুশকিলে পড়তে হয় সম্ভবত তাদের, যাদের বসবাস নয় পঠন প্রাচুর্যে।

সংশয়ের উল্টো পিঠেই সম্ভাবনার উপস্থিতি অফুরন্ত। কারণ, কোন নির্ভরযোগ্য সূত্র সমর্থন না করলেও কোন ঘটনা সংঘটিত হবার সম্ভাবনা উপেক্ষা করা যায় না কখনওই।

বলধা গার্ডেনে কবির পদার্পণের সময় উল্লেখ করা হয়েছে নিবন্ধে। ক্যামেলিয়া কবিতাটির পুনশ্চ-এ অন্তর্ভুক্তি লক্ষ্য করা যায় ১৯৩২ সালে।

ক্যামেলিয়া কবিতাটি কবির অনান্য কবিতার চেয়ে খানিকটা ভিন্ন আঙ্গিকের। কবিতার রূপ সম্পর্কে কবির এক ধরনের বিশেষ উপলব্ধির সময় এটি। পুনশ্চ-এর ভূমিকায় এই প্রসঙ্গে স্বল্প কিছু শব্দ যোজনও করেছেন কবিগুরু।

ভূমিকা

গীতাঞ্জলির গানগুলি ইংরেজি গদ্যে অনুবাদ করেছিলেম। এই অনুবাদ কাব্যশ্রেণীতে গণ্য হয়েছে। সেই অবধি আমার মনে এই প্রশ্ন ছিল যে, পদ্যছন্দের সুস্পষ্ট ঝংকার না রেখে ইংরেজিরই মতো বাংলা গদ্যে কবিতার রস দেওয়া যায় কি না। মনে আছে সত্যেন্দ্রনাথকে অনুরোধ করেছিলেম। তিনি স্বীকার করেছিলেন, কিন্তু চেষ্টা করেন নি। তখন আমি নিজেই পরীক্ষা করেছি, `লিপিকা'র অল্প কয়েকটি লেখায় সেগুলি আছে। ছাপবার সময় বাক্যগুলিকে পদ্যের মতো খণ্ডিত করা হয় নি, বোধ করি ভীরুতাই তার কারণ।

তার পরে আমার অনুরোধক্রমে একবার অবনীন্দ্রনাথ এই চেষ্টায় প্রবৃত্ত হয়েছিলেন। আমার মত এই যে, তাঁর লেখাগুলি কাব্যের সীমার মধ্যে এসেছিল, কেবল ভাষাবাহুল্যের জন্যে তাতে পরিমাণ রক্ষা হয় নি। আর-একবার আমি সেই চেষ্টায় প্রবৃত্ত হয়েছি।

এই উপলক্ষে একটা কথা বলবার আছে। গদ্যকাব্যে অতিনিরূপিত ছন্দের বন্ধন ভাঙাই যথেষ্ট নয়, পদ্যকাব্যে ভাষায় ও প্রকাশরীতিতে যে একটি সসজ্জ সলজ্জ অবগুণ্ঠনপ্রথা আছে তাও দূর করলে তবেই গদ্যের স্বাধীন ক্ষেত্রে তার সঞ্চরণ স্বাভাবিক হতে পারে। অসংকুচিত গদ্যরীতিতে কাব্যের অধিকারকে অনেক দূর বাড়িয়ে দেওয়া সম্ভব, এই আমার বিশ্বাস এবং সেই দিকে লক্ষ রেখে এই গ্রন্থে প্রকাশিত কবিতাগুলি লিখেছি। এর মধ্যে কয়েকটি কবিতা আছে তাতে মিল নেই, পদ্যছন্দ আছে, কিন্তু পদ্যের বিশেষ ভাষারীতি ত্যাগ করবার চেষ্টা করেছি। যেমন, তরে, সনে, মোর, প্রভৃতি যে-সকল শব্দ গদ্যে ব্যবহার হয় না সেগুলিকে এই-সকল কবিতায় স্থান দিই নি।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

ভালো লাগার এই বিশেষ কবিতাটি কী আরো একবার পড়েই ফেলবো আমরা! পঠনে উন্মোচিত হয় যদি নতুনভাবে বোঝার কোন ভিন্ন দিগন্ত!

ক্যামেলিয়া

নাম তার কমলা,
দেখেছি তার খাতার উপরে লেখা।
সে চলেছিল ট্রামে, তার ভাইকে নিয়ে কলেজের রাস্তায়।
আমি ছিলেম পিছনের বেঞ্চিতে।
মুখের এক পাশের নিটোল রেখাটি দেখা যায়,
আর ঘাড়ের উপর কোমল চুলগুলি খোঁপার নীচে।
কোলে তার ছিল বই আর খাতা।
যেখানে আমার নামবার সেখানে নামা হল না।

এখন থেকে সময়ের হিসাব করে বেরোই–
সে হিসাব আমার কাজের সঙ্গে ঠিকটি মেলে না,
প্রায় ঠিক মেলে ওদের বেরোবার সময়ের সঙ্গে,
প্রায়ই হয় দেখা।
মনে মনে ভাবি, আর-কোনো সম্বন্ধ না থাক্,
ও তো আমার সহযাত্রিণী।
নির্মল বুদ্ধির চেহারা
ঝক্ঝক্ করছে যেন।
সুকুমার কপাল থেকে চুল উপরে তোলা,
উজ্জ্বল চোখের দৃষ্টি নিঃসংকোচ।
মনে ভাবি একটা কোনো সংকট দেখা দেয় না কেন,
উদ্ধার করে জন্ম সার্থক করি–
রাস্তার মধ্যে একটা কোনো উৎপাত,
কোনো-একজন গুণ্ডার স্পর্ধা।
এমন তো আজকাল ঘটেই থাকে।
কিন্তু আমার ভাগ্যটা যেন ঘোলা জলের ডোবা,
বড়ো রকম ইতিহাস ধরে না তার মধ্যে,
নিরীহ দিনগুলো ব্যাঙের মতো একঘেয়ে ডাকে–
না সেখানে হাঙর-কুমিরের নিমন্ত্রণ, না রাজহাঁসের।
একদিন ছিল ঠেলাঠেলি ভিড়।

কমলার পাশে বসেছে একজন আধা-ইংরেজ।
ইচ্ছে করছিল, অকারণে টুপিটা উড়িয়ে দিই তার মাথা থেকে,
ঘাড়ে ধরে তাকে রাস্তায় দিই নামিয়ে।
কোনো ছুতো পাই নে, হাত নিশ্পিশ্ করে।
এমন সময়ে সে এক মোটা চুরোট ধরিয়ে
টানতে করলে শুরু।
কাছে এসে বললুম, "ফেলো চুরোট।’
যেন পেলেই না শুনতে,
ধোঁওয়া ওড়াতে লাগল বেশ ঘোরালো করে।
মুখ থেকে টেনে ফেলে দিলেম চুরোট রাস্তায়।
হাতে মুঠো পাকিয়ে একবার তাকালো কট্মট্ ক’রে–
আর কিছু বললে না, এক লাফে নেমে গেল।
বোধ হয় আমাকে চেনে।
আমার নাম আছে ফুটবল খেলায়,
বেশ একটু চওড়া গোছের নাম।
লাল হয়ে উঠল মেয়েটির মুখ,
বই খুলে মাথা নিচু করে ভান করলে পড়বার।
হাত কাঁপতে লাগল,
কটাক্ষেও তাকালে না বীরপুরুষের দিকে।
আপিসের বাবুরা বললে, "বেশ করেছেন মশায়।’
একটু পরেই মেয়েটি নেমে পড়ল অজায়গায়,
একটা ট্যাক্সি নিয়ে গেল চলে।

পরদিন তাকে দেখলুম না,
তার পরদিনও না,
তৃতীয় দিনে দেখি
একটা ঠেলাগাড়িতে চলেছে কলেজে।
বুঝলুম, ভুল করেছি গোঁয়ারের মতো।
ও মেয়ে নিজের দায় নিজেই পারে নিতে,
আমাকে কোনো দরকারই ছিল না।
আবার বললুম মনে মনে,
ভাগ্যটা ঘোলা জলের ডোবা–
বীরত্বের স্মৃতি মনের মধ্যে কেবলই আজ আওয়াজ করছে
কোলাব্যাঙের ঠাট্টার মতো।
ঠিক করলুম ভুল শোধরাতে হবে।

খবর পেয়েছি গরমের ছুটিতে ওরা যায় দার্জিলিঙে।
সেবার আমারও হাওয়া বদলাবার জরুরি দরকার।
ওদের ছোট্ট বাসা, নাম দিয়েছে মতিয়া–
রাস্তা থেকে একটু নেমে এক কোণে
গাছের আড়ালে,
সামনে বরফের পাহাড়।
শোনা গেল আসবে না এবার।
ফিরব মনে করছি এমন সময়ে আমার এক ভক্তের সঙ্গে দেখা,
মোহনলাল–
রোগা মানুষটি, লম্বা, চোখে চশমা,
দুর্বল পাকযন্ত্র দার্জিলিঙের হাওয়ায় একটু উৎসাহ পায়।
সে বললে, "তনুকা আমার বোন,
কিছুতে ছাড়বে না তোমার সঙ্গে দেখা না করে।’
মেয়েটি ছায়ার মতো,
দেহ যতটুকু না হলে নয় ততটুকু–
যতটা পড়াশোনায় ঝোঁক, আহারে ততটা নয়।
ফুটবলের সর্দারের ’পরে তাই এত অদ্ভুত ভক্তি–
মনে করলে আলাপ করতে এসেছি সে আমার দুর্লভ দয়া।
হায় রে ভাগ্যের খেলা!

যেদিন নেমে আসব তার দু দিন আগে তনুকা বললে,
"একটি জিনিস দেব আপনাকে, যাতে মনে থাকবে আমাদের কথা–
একটি ফুলের গাছ।’
এ এক উৎপাত। চুপ করে রইলেম।
তনুকা বললে, "দামি দুর্লভ গাছ,
এ দেশের মাটিতে অনেক যত্নে বাঁচে।’
জিগেস করলেম, "নামটা কী?’
সে বললে "ক্যামেলিয়া’।
চমক লাগল–
আর-একটা নাম ঝলক দিয়ে উঠল মনের অন্ধকারে।
হেসে বললেম, "ক্যামেলিয়া,
সহজে বুঝি এর মন মেলে না।’
তনুকা কী বুঝলে জানি নে, হঠাৎ লজ্জা পেলে,
খুশিও হল।
চললেম টবসুদ্ধ গাছ নিয়ে।
দেখা গেল পার্শ্ববর্তিনী হিসাবে সহযাত্রিণীটি সহজ নয়।
একটা দো-কামরা গাড়িতে
টবটাকে লুকোলেম নাবার ঘরে।
থাক্ এই ভ্রমণবৃত্তান্ত,
বাদ দেওয়া যাক আরো মাস কয়েকের তুচ্ছতা।

পুজোর ছুটিতে প্রহসনের যবনিকা উঠল
সাঁওতাল পরগনায়।
জায়গাটা ছোটো। নাম বলতে চাই নে–
বায়ুবদলের বায়ু-গ্রস্তদল এ জায়গার খবর জানে না।
কমলার মামা ছিলেন রেলের এঞ্জিনিয়র।
এইখানে বাসা বেঁধেছেন
শালবনে ছায়ায়, কাঠবিড়ালিদের পাড়ায়।
সেখানে নীল পাহাড় দেখা যায় দিগন্তে,
অদূরে জলধারা চলেছে বালির মধ্যে দিয়ে,
পলাশবনে তসরের গুটি ধরেছে,
মহিষ চরছে হর্তকি গাছের তলায়–
উলঙ্গ সাঁওতালের ছেলে পিঠের উপরে।
বাসাবাড়ি কোথাও নেই,
তাই তাঁবু পাতলেম নদীর ধারে।
সঙ্গী ছিল না কেউ,
কেবল ছিল টবে সেই ক্যামেলিয়া।

কমলা এসেছে মাকে নিয়ে।
রোদ ওঠবার আগে
হিমে-ছোঁওয়া স্নিগ্ধ হাওয়ায়
শাল-বাগানের ভিতর দিয়ে বেড়াতে যায় ছাতি হাতে।
মেঠো ফুলগুলো পায়ে এসে মাথা কোটে,
কিন্তু সে কি চেয়ে দেখে।
অল্পজল নদী পায়ে হেঁটে
পেরিয়ে যায় ও পারে,
সেখানে সিসুগাছের তলায় বই পড়ে।
আর আমাকে সে যে চিনেছে
তা জানলেম আমাকে লক্ষ্য করে না বলেই।

একদিন দেখি নদীর ধারে বালির উপর চড়িভাতি করছে এরা।
ইচ্ছে হল গিয়ে বলি, আমাকে দরকার কি নেই কিছুতেই।
আমি পারি জল তুলে আনতে নদী থেকে–
পারি বন থেকে কাঠ আনতে কেটে,
আর, তা ছাড়া কাছাকাছি জঙ্গলের মধ্যে
একটা ভদ্রগোছের ভালুকও কি মেলে না।

দেখলেম দলের মধ্যে একজন যুবক–
শট্-পরা, গায়ে রেশমের বিলিতি জামা,
কমলার পাশে পা ছড়িয়ে
হাভানা চুরোট খাচ্ছে।
আর, কমলা অন্যমনে টুকরো টুকরো করছে
একটা শ্বেতজবার পাপড়ি,
পাশে পড়ে আছে
বিলিতি মাসিক পত্র।

মুহূর্তে বুঝলেম এই সাঁওতাল পরগনার নির্জন কোণে
আমি অসহ্য অতিরিক্ত, ধরবে না কোথাও।
তখনি চলে যেতেম, কিন্তু বাকি আছে একটি কাজ।
আর দিন-কয়েকেই ক্যামেলিয়া ফুটবে,
পাঠিয়ে দিয়ে তবে ছুটি।
সমস্ত দিন বন্দুক ঘাড়ে শিকারে ফিরি বনে জঙ্গলে,
সন্ধ্যার আগে ফিরে এসে টবে দিই জল
আর দেখি কুঁড়ি এগোল কত দূর।

সময় হয়েছে আজ।
যে আনে আমার রান্নার কাঠ।
ডেকেছি সেই সাঁওতাল মেয়েটিকে।
তার হাত দিয়ে পাঠাব
শালপাতার পাত্রে।
তাঁবুর মধ্যে বসে তখন পড়ছি ডিটেকটিভ গল্প।
বাইরে থেকে মিষ্টিসুরে আওয়াজ এল, "বাবু, ডেকেছিস কেনে।’
বেরিয়ে এসে দেখি ক্যামেলিয়া
সাঁওতাল মেয়ের কানে,
কালো গালের উপর আলো করেছে।
সে আবার জিগেস করলে, "ডেকেছিস কেনে।’
আমি বললেম, "এইজন্যেই।’
তার পরে ফিরে এলেম কলকাতায়।

উল্লেখ্য নিবন্ধের অভিলক্ষ্য বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী স্থানের প্রতি আমাদের বিরাজিত ভালোবাসা পুনঃস্মরণের ক্ষীণ চেষ্টা, ক্ষীণ চেষ্টা বৃক্ষের প্রতি প্রকৃতির প্রতি আমাদের বিরাজিত মমত্ববোধের পুনঃস্মরণ।
এই চেষ্টা নিজেদের স্বার্থে। আত্মরক্ষার স্বার্থে।

ভালো থাকবেন। অনিঃশেষ। সবসময়।

দীপংকর চন্দ

সাক্ষী সত্যানন্দ এর ছবি

চলুক পপকর্ন লইয়া গ্যালারীতে বইলাম

____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?

অতিথি লেখক এর ছবি

কেমন আছেন ভাই?
আশাকরি ভালো অনেক।
অনেক ভালো লাগা আপনার উচ্ছল উপস্থিতিতে।
আমার শুভকামনা জানবেন। অনিঃশেষ। সবসময়।

দীপংকর চন্দ

সুলতানা সাদিয়া এর ছবি

ভাল লাগলো।

-----------------------------------
অন্ধ, আমি বৃষ্টি এলাম আলোয়
পথ হারালাম দূর্বাদলের পথে
পেরিয়ে এলাম স্মরণ-অতীত সেতু

আমি এখন রৌদ্র-ভবিষ্যতে

অতিথি লেখক এর ছবি

শুভকামনা সুলতানা সাদিয়া।
আমি এরমধ্যে কয়েকটি ভিন্নস্বাদের কাব্যিক লেখা পড়েছি, যেগুলোর রচয়িতার নামের সাথে আপনার নাম মিলে যাচ্ছে হুবহু।
জানিনা আপনিই সেই লেখাগুলোর রচয়িতা কিনা!

যাই হোক। ভালো থাকবেন। অনিঃশেষ। সবসময়।

দীপংকর চন্দ

খেকশিয়াল এর ছবি

যদ্দুর জানি খুনটা নাকি দ্বিতীয় পক্ষের স্ত্রী করায়। নরেন্দ্রনারায়ণ নাকি বুঝতে পেরেছিলেন, স্ত্রীকে বের করে দেন। মুনতাসীর মামুনের বইয়ে পেয়েছিলাম মনে পড়ে।

-----------------------------------------------
'..দ্রিমুই য্রখ্রন ত্রখ্রন স্রবট্রাত্রেই দ্রিমু!'

অতিথি লেখক এর ছবি

তথ্য নির্দেশের জন্য ধন্যবাদ ভাই।

ঢাকা গবেষক হিসেবে মুনতাসীর মামুন স্বনামধন্য। বলধা গার্ডেন অথবা ঢাকা সম্পর্কে আগ্রহীদের অন্যান্য তথ্যের পাশাপাশি অন্তত একবার দৃষ্টিপাত করা উচিত মুনতাসীর মামুনের গবেষণাকর্মে।

শুভকামনা জানবেন। অনিঃশেষ। সবসময়।

দীপংকর চন্দ

প্রকৃতিপ্রেমিক এর ছবি

এরকম একটা জায়গা উন্নত দেশে থাকলে সেটাকে তারা পর্যটন স্হানে পরিণত করতো এবং এর আয় দিয়েই স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে পারতো।

অতিথি লেখক এর ছবি

শুভকামনা প্রকৃতিপ্রেমিক।

এরকম একটা জায়গা উন্নত দেশে থাকলে সেটাকে তারা পর্যটন স্হানে পরিণত করতো এবং এর আয় দিয়েই স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে পারতো।

যথার্থ বলেছেন আপনি।
আমাদের দেশের কতো ঐতিহ্যবাহী স্থান কেবলমাত্র সচেতনতার অভাবে রিক্ত নিঃস্ব হয়ে রইলো!
বিদেশ ভালো, তবে শত প্রতিকূলতা সত্ত্বেও নিজের দেশ নিজের মাটি উত্তম সম্ভবত!

ভালো থাকবেন। অনিঃশেষ। সবসময়।

দীপংকর চন্দ

Sohel Lehos এর ছবি

আজ থেকে বহু বছর আগে নারায়ন গঞ্জ থেকে ঢাকায় কলেজে যেতাম। মাঝে মধ্যে ট্রাফিক জ্যামের কারণে হন্টন পথে রওয়ানা হতাম। লক্ষ্য সামনে কোথাও থেকে আবার গাড়ি ধরা। তখন বলধা গার্ডেনের পাশ দিয়ে যেতে হত। যত বার তার পাশ দিয়ে গিয়েছি একবার করে ঢুঁ মেরে গেছি। সম্ভবত ২টাকা করে প্রবেশ মূল্য ছিল। ভেতরে একা একা ঘুরে বেড়াতাম আর নানা রকম গাছ গাছালি দেখে মুগ্ধ হতাম। কত পুরানো স্মৃতি! বলধা গার্ডেন সম্পর্কে প্রায় কিছুই জানতাম না। আপনার লেখার কারণে জানলাম।

ধন্যবাদ! চলুক

সোহেল লেহস
-------------------------------------------------------
এইটা কি লেখলেন ভাই! গল্পের ট্যুইস্ট দেইখা পেটে কেমন জানি একটু মোচড় দিল হাসি

অতিথি লেখক এর ছবি

শুভকামনা সোহেল ভাই।

ভেতরে একা একা ঘুরে বেড়াতাম আর নানা রকম গাছ গাছালি দেখে মুগ্ধ হতাম।

এই মুগ্ধ হবার মনটুকুই মানুষের প্রধান শক্তি সম্ভবত!
তথ্য হয়তো মুগ্ধতার সাথে সামান্য ব্যঞ্জন যুক্ত করে!

আপনার মুগ্ধ মনের প্রতি শ্রদ্ধা রইলো।
ভালো থাকবেন। অনিঃশেষ। সবসময়।

দীপংকর চন্দ

অতিথি লেখক এর ছবি

আরো কিছু ছবি দিলে ভালো হতো...........................

শুভ কামনা সব সময়।
এহসান সাবির

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।