আমার আর্টিস্ট না হওয়া এবং মানিক ভাই

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: সোম, ১৫/১২/২০১৪ - ৬:১৪অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

আমি একদম আঁকতে পারি না এখন, অথচ হয়তো আমার খ্যাতি এখন দেশজুড়েও হতে পারত !

ছেলেবেলা থেকেই অবশ্য আর্টের প্রতি তীব্র অনুরাগ ছিল। সবাই বলত, বাহ সামিনের তো খুব ভাল আঁকে! অন্য বাচ্চারা যখন কম্পিউটারে ভিডিও গেমস, বাইরে খেলাধুলা করত, আমি একমনে এঁকে যেতাম। আর্টের যে কোন কম্পিটিশনে আমি যে ফার্স্ট হব এটা যেন নিয়মই হয়ে গিয়েছিল। আমি গ্রামের দৃশ্য আঁকতাম, কলসি নিয়ে গ্রামের বঁধু যাচ্ছে এটা ছিল আমার প্রিয় সাবজেক্ট। এছাড়া মাঝি নৌকা চালাচ্ছে, কৃষক ক্ষেতে কাজ করছে, বাচ্চারা গাছে উঠছে এগুলো আমি অনায়াসে এঁকে ফেলতাম। পেন্সিল কালার, প্যাস্টেল কালারে আমি ভাল হলেও জলরংটা একেবারেই পারতাম না। একদম ছ্যাঁড়াবেড়া করে ফেলে আর্টের মুডটা উঠে যেত, আর বসতেই ইচ্ছে করত না।

আমি আর্ট শিখতাম আমাদের স্কুলের অনীল স্যারের কাছে, অনীল চক্রবর্তী- যিনি ছিলেন আমাদের শহরের সবচেয়ে ভাল আর্টের টিচার। আর্টিস্ট বললাম না এ কারণে কারণ আমি পরে বুঝেছিলাম আঁকতে জানলেই আর্টিস্ট হওয়া যায় না। সবাই আর্টিস্ট নয়, কেউ কেউ আর্টিস্ট। যা হোক এটা আমি যথাস্থানে বলবো। আপাতত অনীল স্যারের কথা বলি।

অনীল স্যার ছিলেন ছোটখাট কিন্তু বেশ মোটাসোটা একটা মানুষ। মুখে দাঁড়ি ছিল না, তবে ঝাড়ুর মত একটা গোঁফ ছিল। মাঝে মাঝে আঁকতে আঁকতে তিনি নাক দিয়ে ফোসফোস শব্দ করতেন, তখন তার গোঁফটা খুব নড়ত। বেশ মজার ছিল দৃশ্যটা। উনার আর্ট অ্যাকাডেমীর নাম ছিল “চিত্রলেখা আর্ট অ্যাকাডেমী।” সেখানে একদম ন্যাদনাদা বাচ্চা থেকে শুরু করে ক্লাস এইটের ছেলেমেয়েরা আর্ট শিখতো। কারণ ক্লাস এইট পর্যন্ত আমাদের সময় আর্ট ছিল। আমাদের শহরে উনিই প্রথম আর্ট অ্যাকাডেমী দিয়েছিলেন বলে তিনি পুরো আর্ট-ব্যবসাটাই করেছিলেন একচেটিয়াভাবে। পরে উনার দেখে আরও অনেকে এই আর্ট-ব্যবসা শুরু করে- তখন উনার ব্যবসা মার খেতে থাকে।

আমি আঁকতাম খুব দ্রুত। আমার আঁকা শেষ হলে চুপ করে বসে অন্যদের আঁকা দেখতাম। আমি মাঝে মাঝে রঙের সেটের দিকে তাকিয়ে থাকতাম। আমার মনে হত ওয়াটার কালারের ছবিগুলো খুব সুখী, আর সব চেয়ে দুঃখী মনে হত মোমের কালারের ছবিগুলো । ওগুলো আর ক্রেয়নগুলোকেও খুব দুঃখী মনে হত। খুব বেশি কেউ ওগুলো ব্যবহার করত না। যারা ওগুলো দিয়ে আঁকত তাদেরকেও কেমন যেন দুঃখী লাগত আমার। এই তত্ত্ব কোথায় পেয়েছিলাম কে জানে !

যাই হোক খুব বেশি বাজে বকে ফেললাম। আসলে ছোটবেলা থেকেই আঁকাআঁকি খুব ভালোবাসতাম তো- তাই একসাথে অনেক কথাই মনে পড়ে গেল। কিন্তু এখন যা লিখতে বসেছি এগুলোর সাথে উপরের কথাগুলোর কোন দরকারই নেই। আমি এসএসসি পর্যন্ত আর্টকে দেখেছি বাচ্চাদের দৃষ্টিতে, তারপরই গভীরভাবে ডুবতে চেষ্টা করেছি। চেষ্টার ফল যে কি বের হল সেটাই জানাবো।
ক্লাস এইটের ফাইনাল পরীক্ষার পর আম্মু আমাকে একটা সুন্দর বই দেয়। বইটা পাঠিয়েছে আমার বড়মামা লন্ডন থেকে। বিশাল মোটা আর রঙিন বই, সেখানে বিশ্বের প্রায় সকল আর্টিস্টদের জীবনী আর তাদের শিল্পকলা। একেকটা পাতা ছিল বেশ মোটা। এমনিতে আমি ইংরেজী বই পড়তে পারি না কিন্তু ঐ সুন্দর বইটা আমি শেষ করেছিলাম কয়েক মাস সময় নিয়ে,আব্বু আর ভাইয়ার সাহায্য নিয়ে। সেখান থেকেই আমি কিছুটা ধারণা পেয়েছিলাম আর্ট ও আর্টিস্ট সম্পর্কে।

বইটা পড়ে আমার ভিতরের কী একটা পরিবর্তন হয়ে গেল। আমিও মনে করতে থাকলাম আমি একজন আর্টিস্ট। গ্রামের দৃশ্য আঁকা বাদ দিয়ে কী কী সব আঁকতাম আর ভাবতাম খুব বড় কিছু এঁকে ফেলেছি। কিন্তু সেই ভূত নামল টাইটানিক দেখার পর, মেট্রিকের পর। নিজেকে ভাবতাম ঐ জ্যাক ছেলেটার মত, একটা জাহাজে বসে মানুষের স্কেচ করছি, সেখানেই খুঁজে পাবো আমার প্রেমিকা...

তখন আমার ধ্যান ধারণা একমাত্র স্কেচ । কালারিংয়ে একদম আগ্রহ হারিয়ে গেল। আমি মানুষের প্রোট্রেট করতেই আগ্রহ বোধ করলাম। ভাবলাম, স্কেচ করে হাত পাকা করে পরে কালারিং শিখবো। এর মধ্যে সত্যজিতের ইলাস্ট্রেশনও আমায় পেয়ে বসল। এগুলোই আসল, এগুলোই যদি শিখতে না পারি বড় বড় আর্ট কীভাবে করব? কিন্তু এগুলো আমাকে শেখাবে কে? অনীল স্যার? নাহ, ঐ ব্যাটার কাছে শিখব না, বইটা পড়ে আমি বুঝতে পেরেছি শিল্পকে বুকে ধারন করতে হয়, ওটাকে ব্যবসা বানালেই সেটা আর শিল্প থাকে না। তখন আমার অনীল স্যারসহ পৃথিবীর সব আর্টের টিচারকে শত্রু মনে হল। বুঝতে পারলাম, এরা আর্টিস্ট নয়। এরা আর্টকে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। যা করার আমাকেই করতে হবে।

বেশ কিছুদিন ঘোরাঘুরি করে এমন একজনকে খুঁজে পেলাম যার কাছে ঠিক করলাম আর্ট শিখবো। ভদ্রলোকের নাম... আসলে ভদ্রলোক শুনলে একটু বয়স্ক মনে হয়। উনার বয়স বেশি না, তবে ত্রিশের কাছাকাছি। নাম রাইসুল ইসলাম, তবে মানিক ভাই নামেই শিল্পজগতে পরিচিত! কাউকে শেখান না, তবে আর্টিস্ট, টাউনহলের বেশ কিছু প্রোগামে নাকি কাজ করেছে। থাকে তালতলায় একটা ঝুপড়ি বাসায়। আমি তাকে দেখে অভিভূত হয়ে গেলাম।

মানিক ভাইয়ের মুখভর্তি দাঁড়ি, ঝাঁকড়া ঝাঁকড়া চুল। চোখে কাল ফ্রেমের চশমা, বেশিরভাগ সময় পড়েন গেঞ্জি বা ঢিলেঢালা ফতুয়া আর হাঁটু ছেঁড়া জিনস। আমি মুগ্ধ হয়ে গেলাম। আমার কাছে আর্টিস্ট যা, উনি তাই। আমার সব কথা শুনলেন, তারপর হেসে বললেন- “আর্ট শিখতে এসেছো? আর্ট তো শেখা যায় না, এগুলো ফিল করতে হয়। তাহলেই চোখের সামনে সবকিছুতে আর্ট দেখতে পাবা।” একটা আমগাছ দেখিয়ে বলল, “এই যে আমগাছটা দেখছো, এ যে এভাবে ডালপালা ছড়িয়ে আছে এর মধ্য দিয়ে একটা নারী লুকিয়ে আছে? হাত দুটো ছড়িয়ে আকাশের কাছে কিছু চাইছে? এভাবে নিজের কল্পনাকে আর্টের মাঝে ছড়িয়ে দাও।”

আমারও কেন জানি মনে হল, আরে সত্যিই তো ! । আমি আবারো অভিভূত। এনার কাছেই শিখবো ঠিক করে ফেললাম। উনার ঝুপড়ি ঘরটার একদিকে ছবি আঁকার সরঞ্জাম, ওটাই স্টুডিও। ওখানেই আমাকে শেখাতে লাগলেন। উনি ছিলেন আড্ডাপ্রিয় মানুষ, উনার ওখানে যতটা না আঁকতাম তার থেকে বেশি গল্প করতাম। আমি উনার সাথে আস্তে আস্তে অনেক ফ্রি হয়ে গেলাম। আমি একটা মেয়েকে খুব পছন্দ করতাম, ওকে কিভাবে ভালোবাসানো যায় এটা নিয়েই আলোচনা করতাম। উনিও উনার প্রেমের কথা আমাকে বলেছিলেন। একটা দুটা না, বেশ কয়েকটি ! একদিন কী এক কথায় টাইটানিকের প্রসঙ্গ উঠল। আমি বেশ অস্বস্তি আর খানিকতা লজ্জা নিয়েই জিজ্ঞেস করলাম উনি ওরকম ছবি কারো এঁকেছিলেন কি না? উনি ঘর কাঁপিয়ে হা হা করে হেসে উঠলেন। বললেন, “ন্যুড স্টাডি? আরে ওটা তো আর্টেরই একটা বিষয়। ওটাই ফিগারের ডিটেইল বোঝা যায়। প্যারিসে তো অহরহই সবাই আঁকে। এতে লজ্জা পাওয়ার কি আছে? হ্যাঁ আমিও এঁকেছিলাম। আমার দুটা ঘনিষ্ট বান্ধবী ছিল চারুকলায়, ওদের বলতে ওরা একবার রাজী হয়েছিল- একসাথেই।”

আমার হাত কাঁপছিল এসব শুবে। কান গরম হয়ে গিয়েছিল। আরও কিছু জিজ্ঞেস করার ছিল কিন্তু লজ্জায় করতে পারি নি। উনি আমাকে প্রোটেটের বেশ কিছু কায়দা-কানুন শিখিয়েছিলেন। আস্তে আস্তে খেয়াল করলাম আমি কারও ছবি আঁকতে গেলে আবছা আবছা হলেও তার চেহারাটা নিয়ে আসতে পারি। আমি উচ্ছ্বসিত হয়ে মানিক ভাইকে বললাম। উনি অবশ্য সেরকম উচ্ছ্বাস দেখালেন না। বললেন, “তুমি তো দেখে দেখে করেছো, কয়েকবার প্রাকটিস করলে এটা সবাই পারবে। তুমি বরং মেমরী ওয়ার্ক কর দেখি।” আমি আঁকতে গেলাম। দেখি, ঠিকই তো- মন থেকে এখনও তেমন আঁকতে পারি না। তবে লাইভ প্রোট্রেট করতে পারি। এটি প্রথম দেখি একটা বইমেলায়। উনার সাথে গিয়েছিলাম- উনার মতই ঝোলা নিয়ে। উনি একজনের প্রোট্রেট করছিলেন সামনাসামনি। কি মনে হল, আমিও শুরু করলাম। ওমা! দেখি আমিও বেশ ভালো প্রোট্রেট করে ফেলেছি। যদিও মানিক ভাইয়ের মত ডিটেইল ওয়ার্ক হয়নি কিন্তু যার ছবি তাকে বেশ ভালোভাবেই চেনা যাচ্ছে। উনি সেদিন আমাকেও টাকা দিয়েছিলেন। সেদিন থেকে আমিও নিজেকে আর্টিস্ট ভাবতে শুরু করলাম। খানিকটা পরিচিতিও পেলাম। এরপর থেকে যেখানেই যাই, সাথে থাকে আজিজ মার্কেট থেকে কেনা স্কেচবুক আর পেন্সিল। মানিক ভাইয়ের ততদিনে আমি অন্ধভক্ত হয়ে গেছি বলা চলে। তবে এটাও বুঝেছি উনি টাকার কাঙাল। টাকার গন্ধ পেলেই সব ভুলে যান তিনি। আমি অবশ্য ব্যাপারটা এভাবে দেখলাম না। ভাবলাম, আমার সেরকম টাকার চাহিদা নেই জন্যে আমি ওরকম টাকা টাকা করি না। উনার কাছে আমি শুধু শিল্পটাই নেবো, উনার টাকাপ্রীতি কে নিতে বলেছে ! আমি লেগে থাকলাম। যেখানেই উনি সেখানেই আমি। তবে এই ভক্তিতে ছেদ পড়ল কলেজে উঠার পর।

কলেজে পড়াশোনার চাপ বেড়ে যাওয়ায় মানিক ভাইয়ের ওখানে আর যাওয়া হল না। তবে কলেজে খুব পরিচিতি পেলাম আর্টিস্ট হিসেবে। যদিও শুধু প্রোট্রেটটাই পারি, ল্যান্ডস্কেপ বাদ। রং করা একদম ভুলে গিয়েছি। বেশ কিছু ফ্রি লাইভ প্রোট্রেটের পর যখন স্বিদ্ধান্ত নিলাম এখন থেকে সামান্য চার্জ নেব । কিন্তু তখনই ঘটনাটা ঘটল। আমার আর্টিস্ট না হওয়ার কাহিনী।

একদিন নোটিশ এল বিজয় দিবস উপলক্ষে জেলা ভিত্তিক দেয়ালিকা প্রদর্শনী হবে পাবলিক লাইব্রেরী মাঠে। আমাদের কলেজ থেকে যাবে দুইটা। এই দুইটার একটার সম্পূর্ণ দায়িত্ব পড়ল আমার উপর। আমার সাথে আরও চারজন বন্ধু-বান্ধবী। ওরা আমার উপর কাজ ছেড়ে দিয়ে নিশ্চিন্ত থাকল। আর আমি নিশ্চিন্ত থাকলাম মানিক ভাইয়ের উপর ছেড়ে দিয়ে। উনি সামান্য ঢং করলেও টাকা পেলে ঠিকই করে দেবেন কাজ। আমি আমার বন্ধু আরাফাতকে নিয়ে গেলাম মানিকভাইয়ের কাছে। আরাফাত আঁকতে না পারলেও আর্টে ওর ঝোঁক আছে। আর্টিস্টরা কেমন এটা দেখার ওর খুব আগ্রহ। তাই মানিক ভাইয়ের কাছে ওকেই নিয়ে গেলাম। পুরো কলেজে মানিক ভাইকে আমি দেবতার আসনে নিয়ে গেছি। সবাই জেনে গেছে বাংলাদেশে রেনেসাঁর সূত্রপাত যদি ঘটে, রাইসুল ইসলাম মানিক ভাইয়ের হাত ধরেই ঘটবে।

আমি আরাফাতকে নিয়ে গেলাম এক দুপুরবেলায় মানিক ভাইয়ের ঝুপড়িতে। ঢুলুঢুলু চোখে মানিকভাই আসলেন। বললেন, কাল রাতে ছ’টা ওয়েল পেইন্টিং শেষ করেছেন। আরাফাতের চোখ ছানাবড়া হয়ে গেল। আমি অবশ্য জানি যে করাই ছিল উনি খালি ঘষামাজা করেছেন- একরাতেই সব করেন নি। যাই হোক আরাফাতের ভুল ভাঙ্গালাম না- আমার গুরু বলে কথা !

মানিকভাই শুরু করলেন। পরশু কম্পিটিশন। কাল জমা দিতে হবে। আমরা বক্সবোর্ড নিয়ে গিয়েছিলাম। উনি কিসব ঘষামাজা করলেন পেন্সিল দিয়ে হালকা ভাবে। কনসেপ্ট তো বলেই দিয়েছিলাম- বিজয় দিবস। একটা মা অপেক্ষা করছে, উপরে দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছে। কিছু মুক্তিযোদ্ধা, পাক সেনার চোখে লালসা ইত্যাদি। উনি বললেন, ফার্স্ট হওয়ার পর অবশ্যই উনাকে খাওয়াতে হবে। আমরা হাসতে হাসতে রাজি হলাম।

উনি আঁকতে থাকলেন। আমরা পাশে বসে থাকলাম। আরাফাত ঘুরে ঘুরে সব দেখতে লাগল। আমি একটু গর্ব অনুভব করলাম- এই মহান আর্টিস্ট যে আমার গুরু এই বা কম কি!

“হুম শেষ, এখন রং” আমরা সবিস্ময়ে দেখলাম বক্সবোর্ডে কয়েকটা দাগই শুধু বোঝা যাচ্ছে, আর কিছু নয়। আরাফাত তোতালাতে তোতলাতে বলল (ও অতিরিক্ত উত্তেজনায় তোতলায়), “শেষ?”

মানিকভাই মধুর হাসি হেসে বললেন, “হ্যাঁ”।

- “কই কিছুই তো সেরকম দেখছি না!”

- “আমি যা দেখছি তা তোমরা দেখতে পাচ্ছো না...”

- “কি দেখছেন?”

- “মানুষের শোক, শক্তি, জীবন।”

আরাফাত একটু ধাতস্থ হল। আমি অভয়ের হাসি দিলাম, “রিল্যাক্স ম্যান। বস ঠিকই মিরাকল ঘটাবে।” কিন্তু আমার হাসি মিলিয়ে গেল যখন দেখলাম আমার বস মানিক ভাই তার ছড়ানো ছিটানো বিভিন্ন জিনিসের ভেতর থেকে কালারের যে প্লেট থাকে ওটা থেকে রং করতে শুরু করলেন । ধুলাবালিতে ময়লা ঐ প্লেটে এক সময় বিভিন্ন রং ছিল বোঝা যাচ্ছে। আর্টিস্টরা ক্যানভাসে তুলি দিয়ে আঁকে আর এটা দিয়ে রং গুলোয় এটা তো সবাই জানে। মানিক ভাইও তাই করছে কিন্তু আমার মুখ শুকিয়ে গিয়েছে। কারণ সচরাচর সবাই ঐ প্লেটে রং নেয় কোন একটা কালারবক্স থেকে। মানিক ভাইয়ের তো সেটাও নেই। শুকিয়ে যাওয়া ঐ রং থেকে মানিকভাই পানি দিয়ে গুলাচ্ছেন আর তুলি দিয়ে আঁকছেন। মিরাকলের দূরের কথা রংই আসছে না। যেটা আসছে সেটা মরা মরা নয়তো ফ্যাঁকাশে। আমি মুখ শুকনো করে বললাম, “ভাই রংটা একটু বেশি ইয়ে হয়ে যাচ্ছে না?”

- “ইয়েটা কি?”

- “মানে একটু হালকা হচ্ছে না?”

- “আরে ধুর! দেয়ালিকা না? এটাই তো অনেক গাঢ় লাগছে আমার। ভাবছি আরও কমায় দিবো।”

আমাদের মুখ হা হয়ে গেল। আরাফাত ফিসফিস করে বলল, “আমার মনে হয় তোর বস খসড়া আঁকছে। উনাকে বল এসব না করে আসলটা শুরু করতে।” আমি কি একটা বলতে গিয়েও বললাম না। আঁকা শেষ হল। ছবিটা দেখে আমার হাউমাউ করে কাঁদতে ইচ্ছে হল। হালকা রঙে কে মুক্তিযোদ্ধা কে রাজাকার বোঝাই যাচ্ছে না। একজনের আবার পা কেমন করে যেন গাছ হয়ে গিয়েছে। দুঃখী মাকে লাগছে খারাপ মেয়ের মত। শরীরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলো বিশ্রীভাবে ফুটে উঠেছে। আমি অস্থির হয়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু মানিক ভাই যখন এটার চার্জ বললেন তখন একদম শান্ত হয়ে গেলাম, কেমন অনুভূতিহীন। মানিক ভাইয়ের প্রতি রাগ, কম্পিটিশনের টেনশন কিছুই আর স্পর্শ করল না। একেই বলে মনে হয় অল্প শোকে কাতর, অধিক শোকে পাথর। আমরা যে টাকা চাঁদা উঠিয়েছিলাম আর্টিস্টকে দেয়ার জন্য তার তিনগুণ টাকা চাচ্ছেন মানিক ভাই এই ফালতু আর্টের জন্য। আবার উনি আরাফাতকে বলছেন, “নেহাত সামিন আমার ভাইয়ের মত জন্য চার্জ নিলামই না। যেটা না নিলে নয় সেটাই নিয়েছি।” আমার হাত-পা অবশ হয়ে গেল, আরাফাত চুপ। আমি কলেজে যেভাবে মানিকভাইকে প্রচার করেছি আর উনি যে আঁকলেন এরপর কলেজে আমার শিল্পের কি হবে অনুমান করা শুরু করেছি।

আরাফাতসহ আর্ট নিয়ে বের হলাম। মানিক ভাইকে বললাম টাকা পরে দেব। আরাফাতের প্রায় উন্মাদের মত অবস্থা। পরশু কম্পিটিশন আর আজ এই অবস্থা ও কি করবে ভেবে পেল না। তখন আমার শিল্পীসত্ত্বা উঁকি দিল। কল্পনা করতে লাগলাম, এতদিন আমি যা এঁকেছি, যা করেছি সবগুলোর ছোঁয়া নিয়ে আজ আমি আঁকতে বসবো। আবার বক্সবোর্ড কেনা হল। অতি উৎসাহ নিয়ে রাতে আঁকতে শুরু করলাম। রং ছাড়া জিনিসটা খারাপ হয়নি কিন্তু রং লাগাতেই আবা জীবন সাদাকালো হয়ে গেল। বলা বাহুল্য, রং না করতে পেরে জিনিসটা ছ্যাঁড়াব্যাড়া করে ফেললাম। যখন ভোর হল তখন আমার উদ্ভ্রান্তের মত অবস্থা। সকালে আরাফাত আমার ঘুম ভাঙ্গালো। এসে দেখে আমি আর্টের পাশেই শুয়ে আছি। আমার আর্ট আর মানিকভাইয়ের আর্ট দেখে পাশাপাশি রেখে শুকনো মুখে বলল, “কোনটা বেশি খারাপ এটা নিয়ে কনফিউজড করে দিলি। তবে আমার ভোট মানিকভাইয়ের দিকে।” সে আর কখনও আর্টের নাম মুখে আনবে না এই অঙ্গীকারও করল।

এখন কলেজ যেতে হবে। আমি আর আরাফাত অনেক ভেবে ভেবে একটা প্লান করলাম। প্লান মোতাবেক আমি কলেজে গিয়ে রাগে ফুঁসে ওঠার অনবদ্য অভিনয় করলাম আর আরাফাত আমাকে শান্ত করার চেষ্টা করল। অন্যরা কী রাগবে আমার রাগ দেখে ওরাই ভয় পেয়ে গেল। আর্ট দেখে দুঃখী গলায় সান্তনা দিয়ে বলল, “কি হবে আর রাগ করে বল। চল ভাবি কি করা যায়...”

সে যাত্রায় বেঁচে গেলাম। কিন্তু মানিকভাইয়ের টাকা কেউ দিল না। সে টাকায় অন্য আর্টিস্টকে দিয়ে কাজ করানো হবে আজকের মধ্যে। পুরো টাকাটাই আমাকে দিতে হবে। নতুন আর্টিস্ট পাওয়া গেল। আমি মনের দুঃখে নতুন আর্টিস্টকে কনসেপ্ট বোঝাতে গেলাম না। কাজটা যে ভুল হল সেটা টের পেলাম কম্পিটিশনের দিন সকালে, এই আর্টিস্ট কার্টুন এঁকেছে। টকটকে লাল রঙের জায়গায় শোভা পাচ্ছে গোলাপী রং। দেয়ালিকায় সাহিত্য-টাহিত্য টাইপ কিছু লিখতে হয় সেখানে আমাদের দেয়ালিকায় দুটো ছড়া আর একটা প্রবন্ধ। কারণ জানতে চাইলে যে ফ্রেন্ড লিখেছে সে বলল প্রবন্ধ লিখেই সে ঘুমিয়ে পড়েছিল। সকালে দুটা ছড়া পেয়েছে ম্যাগাজিন থেকে, ওগুলো দিয়ে দিয়েছে। কম্পিটিশন পাবলিক লাইব্রেরী মাঠে। ডিসিসহ আরও কে কে যেন বিচারক। আমাদের প্রিন্সিপাল স্যারও আসলেন। তারপর আমাদের দেয়ালিকা দেখে মুখ অন্ধকার করে চলে গেলেন। তাকে আর পাওয়া গেল না।

সেই কম্পিটিশনে কি হয়েছিল আমি বলব না, পাঠক বুঝে নিন। শুধু এটুকু বলব, পরের দিন কলেজে অ্যাসেম্বলীতে আমাকে ও আমার টিমকে যে অপমান করা হয়েছিল সকলের সামনে। তারপর আমি আমার আর্টের সরঞ্জাম চিরদিনের জন্য তুলে রেখেছিলাম। আর কখনই বের করি নি।

এই হল আমার আর্টিস্ট না হওয়ার কাহিনী। পরের দিকে, মানে ভার্সিটি লাইফে অবশ্য আঁকার চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু সেই বিভীষিকাময় দিনগুলো আর মানিকভাইয়ের কথা মনে হলেই আর আঁকতে পারিনা। মেজাজ খারাপ হয়ে যায়।

আর হ্যাঁ, মানিক ভাইকে উনার টাকাটা দিয়েছিলাম, পুরোটাই নিজের পকেট থেকে। এরপর আর কখনই যোগাযোগ করি নি উনার সাথে। তবে অনেক পরে উনাকে নিয়ে একটা তথ্য পেয়েছিলাম । ঘটনাটা এরকম-

ভার্সিটিতে পড়ি। আমার ঘনিষ্ট বন্ধু আকাশ চারুকলায় পড়ে। ওর ওখানে গিয়ে একদিন পরিচয় হল ওর স্যারের সাথে। বেশি বয়স না উনার। খুব গল্প করলেন আমাদের সাথে। আমি উনাকে মানিক ভাইয়ের গল্প বললাম। উনি গম্ভীর গলায় বললেন, “পুরো নাম রাইসুল ইসলাম?”

- “হ্যাঁ?”

- “চুল দাঁড়ি বড়? চোখে চশমা?”

- “হ্যাঁ”

“দেখতো এ নাকি?” স্যার উনার ল্যাপটপে ভার্সিটি লাইফের ছবি দেখালেন একটা। অনেক আগের। সেখানে মানিক ভাইকে চেনা যাচ্ছে। উনি দাঁতে দাঁতে চেপে বললেন, “হারামজাদা তোমাদের ওখানে?” আমি আর আকাশ হতভম্ব। জানা গেল উনি কেবল সেকেন্ড ইয়ার পর্যন্ত এখানে ছিলেন। ছেলেমেয়েদের ড্রাগ সাপ্লাই করতেন । একটা এক্সিবিশনে বেশ কিছু ছবি চুরি করে পালিয়েছেন যার মধ্যে স্যারের আঁকা উনার মায়ের প্রোট্রেট ছিল। এরপর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উনাকে বহিস্কার করা হয়।

আমি আমার এক বন্ধুকে ফোন করলাম। সে জানাল, “মানিক ভাই শিল্পকলা অ্যাকাডেমী থেকে বেশ বড় অ্যামাউন্টের টাকা নিয়ে পালিয়েছে। তার কোন খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না।”

রাসিক রেজা নাহিয়েন


মন্তব্য

তিথীডোর এর ছবি

ইন্টারেস্টিং গল্প। চলুক
আর্টিস্ট হবার শখ ছিল একজীবনে। ইন ফ্যাক্ট এইচএসসি পর্যন্ত আমার গোঁ ছিল চারুকলায় পড়ার। মায়ে পরীক্ষাই দিতে দেয়নি!

প্রোট্রেট নয়, শব্দটা পোট্রেট হবে।

________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"

অতিথি লেখক এর ছবি

অনেক ধন্যবাদ আপনাকে ভুলটি দেখিয়ে দেবার জন্য।

রাসিক রেজা নাহিয়েন

মন মাঝি এর ছবি

নাকি - 'পোর্ট্রেট'? (Portrait: ) দেঁতো হাসি

****************************************

অতিথি লেখক এর ছবি

চলুক

রাসিক রেজা নাহিয়েন

তিথীডোর এর ছবি

হ্যাঁ। আপনি ঠিক। পোর্ট্রেট' সহীহ। ধন্যবাদ।

________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"

মরুদ্যান এর ছবি

খাইসে দেঁতো হাসি

-----------------------------------------------------------------------------------------------------------------
যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চল রে

অতিথি লেখক এর ছবি

আর্ট জানলেই আর্টিস্ট হওয়া যায়না - খুব সত্য কথা!

অতিথি লেখক এর ছবি

পড়লাম আর্টিস্ট না হওয়ার গল্প।

" সবাই বলত, বাহ সামিনের তো খুব ভাল আঁকে " --- এখানে সামিন তো খুব ভালো আঁকে হবে। আর পোট্রেট এখনো ঠিক হয় নি।
শুভেচ্ছা রইলো।
===
অপর্ণা মিতু

অতিথি লেখক এর ছবি

অতিথি লেখক হিসেবে পোস্ট এডিট করা যায় না। ধন্যবাদ আপনার মন্তব্যের জন্য।

রাসিক রেজা নাহিয়েন

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।