কথা বলছি, একজন তৃতীয় বিশ্ববাসী!

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: বিষ্যুদ, ২৫/১২/২০১৪ - ৯:৪৪অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

চিন্তা গুলো মাথার ভিতর ঘুরপাক খাচ্ছিল, তাই ভাবলাম লিখেই ফেলি। কথাগুলো নতুন না, শুধু উপলব্ধিটা নতুন হতে পারে। ছোটবেলা থেকে শুনে এসেছি চাচারা লন্ডনে থেকে গেছেন, আমার বাবা থাকতে না পেরে ফিরে এসেছিলেন নিজের দেশে। সেই থেকে আমার বাবাকে কেউ কেউ "বঙ্গবন্ধু" ডাকা শুরু করেছিল!

পৈত্রিকসূত্রে ভারতীয়, দেশ বিভাগের সময় ভারত থেকে বাংলাদেশে চলে আসা, এরপর একটু উদবাস্তু জীবন ছিল আমার বাবার দিকের পরিবারের। তারপর সবসময়ই দেশে অস্থিরতা, নিজেদের সুনিশ্চিত ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে দাদা দাদী চেয়েছিলেন ছেলেদের বাকি জীবনটা যুক্তরাজ্যের মাটিতেই কেটে যাক। কিন্তু সব ভাবনা সত্যি হয় না, যেমন হয় নি আমার বাবার ক্ষেত্রেও। অতএব আমাদের বেড়ে ওঠা এই ছোট্ট অনেক অসুবিধার এই দেশটাতে। আমার মা, সহজ সরল বাংলাদেশী মহিলা, দেশ ছেড়ে উন্নত জীবনের আশা কখনোই করেননি। কাজেই বাংলাদেশ ছাড়ার চিন্তাটা আসলে অনেকদিন পর্যন্ত মাথাতেই আসে নি।

পরিবারে প্রথম পড়ালেখার জন্য বাইরে যায় আমার ভাই। সেও পড়া শেষ্ করে তখন আর দেরী করেনি। তার কাছে শুনেছিলাম, বছর দশেক আগে যোগাযোগ তখনও যখন ততটা উন্নত ছিল না। একদিন আম্মুর সাথে কথা বলতে গিয়ে ১০ পাউন্ডের একটা ফোনকার্ড কিনতে হয়েছিল, মিনিট পার হয়ে শুধু কেমন আছ জিজ্ঞেস করতে না করতেই লাইন কেটে গিয়েছিল! নিজের মার সাথে যোগাযোগটা যেখানে এত কঠিন আর ব্যয়বহুল সেখানে অন্তত বছর চারেক কাটানোটার কথা ভাবতেও চোখ দিয়ে পানি গড়িয়েছিল। মোটামোটি সচ্ছ্বল পরিবারের হলেও অঢেল ছিল না কোনদিন আমাদের, আম্মুকে তখন অনেক চিন্তা করতে দেখেছি কিভাবে সব হবে তা নিয়ে। তবে যে ইচ্ছা থাকলে উপায় হবার কথা ছিল, সেই ইচ্ছাটা ছিল পুরোমাত্রায়, তাই দিন শেষে সব ঠিকঠাকই হয়েছিল। আম্মুও হাফ ছেড়ে বেঁচেছিল ভাইয়া সব শেষ করে ফিরত আসার পর।

কিন্তু দিনে দিনে অরাজকতা আর অস্থিরতা দেশে বাড়ছেই। যত বেশি অস্থিরতা তত বেশি টক শোর কাটতি। টক শো চলছে না, মানে দেশে আলোড়ণ তোলার মত বোধহয় কিছু হচ্ছে না! চিন্তা নাই, তখনই কেউ খুন, নইলে জবাই! আবার কিঞ্চিত লাফালাফি, এই দেশের আর কি ভবিষ্যত! ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস ছেড়ে পরবর্তী কাজ একটা বাইরের ডিগ্রী লাগবে, সবাই যায় আমরা কেন না! অতএব এবার সময় একটু পৃথিবী ঘুরে দেখার, নতুন মানুষ চেনার। তখন ইউনিভার্সিটির টিচাররা বলেছিলেন, একবার গেলে আর ফিরে আসার কোন মানে হয় না, আগামী দশ বছরে এই দেশই থাকে কিনা কে জানে! ভবিষ্যত বলা কঠিন, অতএব কোন মন্তব্য করি নি তখন।

কানাডাতে কিছুদিন পর প্রাথমিক উচ্ছাসটা কেটে যাবার পর বুঝতে পারলাম এই দেশে যারা থাকে একটা শূণ্যতা নিয়েই থাকে। মাঝে মাঝেই নিজের ছোট্ট স্টুডিওটাতে এসাইনমেন্ট করতে করতে খাবার হোম ডেলিভারির অর্ডার করতাম, বাইরে হাটু সমান বরফ, বের হতে খুব আলসেমী হত। তখন এই বরফের পাহাড় ঠেলে খাবারটা পৌছে দিয়ে যেত সাধারণত কোন দক্ষিণ এশীয় ভদ্রলোক। মট্রিয়ালে টিপস দেয়াটা একটা অলিখিত নিয়ম, কিন্তু বাঙ্গালীরা বাঙ্গালী টের পেলে সাধারণত কোন টিপস নিতে চাইতেন না। একদিন এক সিলেটি ভদ্র্লোক বলেছিলেন, দেশে গিয়ে করার মত তো কিছু নাই, এখানে একবার চলে এসেছি তাই আর যাব না। আপনারা হয়ত পড়া শেষ হয়ে গেলে কোন বড় চাকরি করতে পারবেন, আমাদের তো সেই সুযোগ হবে না, তাই আর যাব না। সেদিন খুব হতাশ মনে হয়েছিল তাকে। অবশ্য সবাই যে হতাশ থাকে তা না, কেউ কেউ আবার খুব সুন্দর করেই জীবনটাকে গুছিয়ে নিয়েছে বিদেশের মাটিতে। ডিগ্রী যখন শেষের দিকে, সিদ্ধান্তটা একটু কঠিন ছিল, থাকতে চাইলে তখন থাকার বেশ কিছু উপায় ছিল। কিন্তু তখনই অনিবার্য কারণে দেশে ফিরে আসতেই হয়। ফিরলাম দেশে, ছেড়ে আসার সময় একটু কষ্ট হয়েছিল প্লেনের টেক অফের পর পুরো আলোকিত মন্ট্রিয়াল শহরটা দেখে। তখনকার জন্য ফেরার আর কোন সম্ভাবনা ছিল না এই সুন্দর শহরটায়!

দেশ সম্পর্কে বাজে কথা বলে বেড়ানোর মধ্যে কখনোই আভিজাত্যের ছোঁয়া পেতাম না। কিন্তু মাঝে মাঝে অনেক বেশি অস্থিরতা, রাস্তায় ঘন্টাব্যাপী যানজট, গাড়িতে চড়ে অভ্যাস, মানুষজনের অন্ধের মত রাস্তা পাড় হতে গিয়ে গাড়িটার ঠিক সামনে চলে আসা! যেখানে থাকি, উড়ালসড়ক বানানোর কাজ চলছে। বাসার সামনে বের হলে হাটার রাস্তা নাই, একটু বৃষ্টি হলেই গোড়ালী সমান কাদাপানি! আর কোনদিনই হয়ত খুব ভাল কোন অবস্থায় যাবে না এই রাস্তাটা! খুব ছোট ছোট সমস্যা, কিন্তু প্রতিদিন একই ভাবে সামলাতে হচ্ছে! সব সময় ভাল লাগে না আসলে। তখন মনে হয়, দেশের বাইরেই কি তাহলে নিঃসন্দেহে ভাল?

শূণ্যতা আর সমস্যা, অনেক অনেক প্র্যাকটিকাল প্রবলেম। চিন্তাটার কোন শেষ হয় না আসলে! আকাশ পাতাল পুরো চিন্তাটাই আসছিল ঘন্টাব্যাপী জ্যামে কানে হেডফোনে গান শুনতে শুনতে! হঠাত প্রতিদিনের মত হাতির ঝিলের ড্রাইভ ওয়েটা চিন্তায় ছেদ ফেলে দিল! বিশাল বড় আকাশ, সন্ধ্যার একটু একটু অন্ধকারে আলোকিত ঝিলটাকেও খুব খারাপ মনে হয় না। একটু নাহয় দেরীই হয়, কিন্তু বাড়িতে তো ফিরি, চিন্তা করার জন্য কিছু মানুষের কাছে, এটাই বা খুব কম কি!

আনীকা
ঢাকা, বাংলাদেশ

ছবি: 
24/08/2007 - 2:03পূর্বাহ্ন

মন্তব্য

সুলতানা সাদিয়া এর ছবি

প্রবাস জীবনের তৃপ্তি-অতৃপ্তি দুটোই অাছে বোধহয়। শুধু মোহ না থাকলেই দেশের গন্ধ, রূপ, কষ্টও অাপনার লাগে। অামি পারিনি দেশ ছাড়তে। দেশ নিয়ে অনুভূতি খুব ভাল লাগলো। মনে এমন কোনো ভাবনা অাসলেই লিখে ফেলবেন।

-----------------------------------
অন্ধ, আমি বৃষ্টি এলাম আলোয়
পথ হারালাম দূর্বাদলের পথে
পেরিয়ে এলাম স্মরণ-অতীত সেতু

আমি এখন রৌদ্র-ভবিষ্যতে

এস এম মাহবুব মুর্শেদ এর ছবি

লেখা ভাল্লাগলো। আমি প্রবাসী বাংলাদেশী। দেশে বেড়াতে এসে একই ধরণের উপলব্ধির সম্মুখীন। আমার অভিজ্ঞতার কথা লিখব শিঘ্রী।

তিথীডোর এর ছবি

আমি নব্য বৈরাগী মানে সদ্য দেশত্যাগী, এক বছর হয়নি এখনো। হাসি
ফেরার পর কেমন লাগবে কে জানে! কিন্তু বাইরে আসলে আসতে চাইনি কখনো, থেকে যেতে চাইনি। এখনো চাই না...যত দ্রুত সম্ভব, শেষ করে ফিরতে চাই।
'It's so stupid because all I wanted was space and now that I have it, there's this part of me.. that's achingly lonely I could die.'
সারাদিনের খাটাখাটনির পর গ্রোসারির প্যাকেট আর ব্যাকপ্যাক টেনে অ্যাপার্টমেন্টে ফিরে শূন্য ঘরের দরজা খুলে আলো জ্বালানোর সময় মাঝেমাঝে গলা ছেড়ে কাঁদতে ইচ্ছে করে।

যারা সব পেয়েছির দেশগুলোতে সেটেল হবার লোভ সামলে নিজের গরিব দেশে ফিরে আসার সাহস দেখাতে পারে, তাদের পছন্দ করি। চলুক
লিখুন নিয়মিত।

________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"

আনীকা এর ছবি

অনেক ধন্যবাদ লেখাটি পড়ার জন্য। দেশ নিয়ে আসলে আশা হতাশা কোনটাই কম না। দিন শেষে নিজের মত আরও অনেককে যখন ভাবতে দেখি ভাল লাগে। আপনাদের লেখার অপেক্ষায় থাকলাম। হাসি

অতিথি লেখক এর ছবি

আমিও এক সদ্য দেশত্যাগী, নব্য বৈরাগী। ঢাকার বঙ্গবাজার থেকে কেনা জোব্বা টাইপের জ্যাকেটটা গায়ে জড়িয়ে সাস্পেনশন রেলে করে বাসায় ফিরি প্রতিদিন,চারপাশে ভিনদেশী মানুষের কলকাকলি শুনি, বাইরে তুষার ঢাকা গাছপালার দিকে তাকিয়ে কিছুটা আনমনা হয়ে পড়ি। স্মৃতিতে দেশের কত তুচ্ছ বিষয়ও মনে পড়ে, ভোরের শিশির ধোয়া ঘাস- ছেড়া শার্ট পড়ে স্কুলে যাওয়া গায়ের ছেলে থেকে প্রিয় সিলেট শহরের ব্যাস্ত চৌহাট্টা পয়েন্টের ফুলের দোকান পর্যন্ত! এমনকি সদ্য ইঞ্জিনিয়ারিং শেষ করে জয়েন করা ঘিঞ্জি নারায়নগঞ্জের চৌদ্দ হাজার পাঁচশো টাকা বেতনের চাকুরীটার কথাও মনে পড়ে! পাশ করে দেশে ফিরব কি ফিরব না, সেটা নিয়েও কত কিছু ভাবি। বিদেশে ক্যারিয়ার গড়ে পরিবারকে অর্থনৈতিক শান্তি দিয়ে এক আচ্ছন্ন স্মৃতিকাতরতা বুকে নিয়ে ভিনদেশে থেকে যাবো নাকি, দেশে অজস্র প্রিয় মানুষদের কাছেই আবার ফিরে যাবো সেটা হয়ত সময়ই বলে দেবে। আপাতত একটা ক্ষণিক স্বপ্নের কথা বলি। আমি চাই আরো-আরো, অনেক ছেলে মেয়ে বিদেশ আসুক। শুধু মধ্যপ্রাচ্যের শ্রমিক হয়ে নয়, বরং কিছুটা সচ্ছলতা নিয়ে, ভারতীয়-চাইনিজদের মতো বিদেশে প্রচুর প্রতিষ্ঠা পাক। বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক, ব্যাবসায়িক ক্ষেত্রে নিখাদ বাংলাদেশি বিশেষজ্ঞ তৈরি হোক। অনেকেই দেশে ফিরে যাক, অনেকে বিদেশে থেকে যাক। দেশে গিয়ে ভারতের আই আই টি অথবা আই এস আর ও এর মত প্রতিষ্ঠান তৈরির নেতৃত্ব দিক। দেশে নতুন ইন্ডাস্ট্রি হোক, অর্থনীতি উন্নয়নে নতুন আইডিয়া আসুক।
কে জানে এমন কখনো হবে কিনা !

রাজর্ষি

Sohel Lehos এর ছবি

আমি দৈবক্রমে বিদেশে এসেছিলাম। তারপর এত কিছু ঘটনা ঘটে গেছে আমার জীবনের উপর দিয়ে যে বুঝতেই পারিনি কোনদিক দিয়ে ১৮টি বছর পেড়িয়ে গেl। প্রতিনিয়ত দেশকে নিয়ে ভাবি আমি। ভেবে উদাস হই। মাঝেমধ্যে মনে হয় এখানে কেন আছি? কি আছে এখানে? স্বচ্ছলতা? নিরবিচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ? ট্র্যাফিক জ্যামহীন রাস্তা? জীবনের নিরাপত্তা? হ্যাঁ, এগুলো আছে বৈকি। কিন্তু আজ থেকে আঠার বসন্ত আগে নিজের 'সত্তা" টাকে 'নারায়ণগণজ' বলে একটা জায়গায় ফেলে এসেছিলাম। সত্তাহীন প্রবাস জীবন ভাল লাগে না।

মজার ব্যাপার হল এখন যখন দেশে বেড়াতে যাই তখন মাস খানেক পর ম্যাকডোনাল্ডের একটা বিগ ম্যাক স্যান্ডুইচের জন্য মনটা যেন কেমন আকুলি বিকুলি করতে থাকে। এর আরও দুই সপ্তাহ পর মনে হয় বালের এই দেশে মানুষ থাকে!

যারা জীবনের আধা আধি দেশে এবং বিদেশে কাটিয়েছেন তাদের কি এমন হয়?

সোহেল লেহস
-------------------------------------------------------
এইটা কি লেখলেন ভাই! গল্পের ট্যুইস্ট দেইখা পেটে কেমন জানি একটু মোচড় দিল হাসি

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।