কয়েকটি লাশের আত্মকাহিনী

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: মঙ্গল, ১৩/০১/২০১৫ - ১:৫১পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

'এভাবে আর ভালো লাগে না'- এমনটাই মনে হল নুরুল সাহেবের, ঘড়িতে তখন সকাল সাড়ে ন'টা, ঠিক করে বললে দু'তিন মিনিট এদিক-ওদিক হবে হয়তো। শরতের স্বচ্ছ আকাশ, নরম উজ্জ্বল আলোয় চারপাশ। ঝরঝরে বাতাসে চারতলার বারান্দায় চুপচাপ বসে থাকতে খুব একটা খারাপ লাগে না, অন্তত ঢাকা শহরে। এটা কি দখিনে বারান্দা? নুরুল সাহেব ঠিক মনে করতে পারেন না কিংবা মনে করতে চান না। অর্থহীন দৃষ্টি প্রসারিত করে বসে থাকেন। কোনো চাঞ্চল্য নেই, দৃঢ়তা নেই, নির্লিপ্ত আর জবজবে ভেজা দৃষ্টি। তিনি সমস্ত ঘটে যাওয়া দেখে যান শুধু। সময় এসে স্থির হয়ে থাকে পলেস্তারা খসে পড়তে থাকা চার তলার এই মলিন বারান্দায়।

ঢাকায় চারপাশটা এখন ঠেসে যাচ্ছে আকাশচুম্বী উঁচু ভবনে। রাস্তায় হাঁটতে ভালো লাগে না, কোনোদিকে তাকাতে ভালো লাগে না; শহরের প্রাণটাই মরে গেছে। সে হিসেবে নুরুল সাহেবের চারতলার এই বিল্ডিংটাকে ভাগ্যবানই বলতে হয়।এর দুই দিকে মোটামুটি দুইশ ভেতরে কোন উঁচু ভবন নেই, ভাবা যায়! নুরুল সাহেব যেদিকে মুখ করে বসে আছেন সেখানে একটা ছোট পচা ডোবা। কোনোকালে হয়তো দীঘি ছিল। আর অন্যদিকে বস্তি; সচরাচর দেখা বস্তিগুলোর মত না, বেশ অবস্থাসম্পন্ন বস্তি। এক চালের নিচে পাশাপাশি তিরিশ-চল্লিশ ঘর। বেশিদিন নাই এসবের চিহ্নটাও থাকবে না। দুই পাশ ঢেকে যাবে উঁচু দালানে। ভেজা স্যাঁতস্যাঁতে ভাব ছড়িয়ে পড়বে চার তলার এই বারান্দায়। ডোবার জায়গাটা নিয়ে একটা ঝামেলা হচ্ছে শোনা যায়; একজন খুন হয়েছে কদিন আগে। এর পেছনে নুরুল সাহেবের ছোট ছেলের নাম এসেছে বেশ কয়েকবার। হয়তো কোনোভাবে জড়িত সে।

একটু নড়ে চড়ে বসতে গিয়ে বাম হাঁটুর ব্যথাটা চড়িয়ে দেন আর চেয়ারের পেছনের পায়ে মট করে একটা শব্দ হয়। হাঁটু থেকে কোমর বেয়ে লতিয়ে উঠতে থাকে ব্যথা। নুরুল সাহেব ব্যথায় কুঁকড়ে যান- দুহাতে হাঁটু চেপে ধরেন আর ঠিক তখনই মাংস পচা উৎকট গন্ধ তার নাকে এসে লাগে। বেশ কিছুটা সময় লাগে ব্যথার রেশ মিলিয়ে যেতে। নুরুল ইসলাম আবার অর্থহীন দৃষ্টি মেলে ধরেন। হাঁটুর এই ব্যথা বেশ পুরনো, নুরুল সাহেবের স্ত্রী রাহেলা বানু যে বছর মারা যান তারও প্রায় সাত বছর আগের। রাহেলারও হাঁটুতে ব্যথা ছিল। তিনি অবশ্য ছিলেন অসুখ-বিসুখের কারখানা, কি ছিল না তার! ডায়াবেটিস, হাই ব্লাড-প্রেসার, এজমা, রক্তশূন্যতা; শেষ বয়সে চোখেও ভালো দেখতেন না। নুরুল ইসলামের সামনে সব ছবির মত ভাসতে থাকে। চোখ যেন একটু চঞ্চল হয়!

পরীর মত সুন্দরী ছিলেন রাহেলা বানু। বিয়ের আসরে রাহেলার মুখ দেখে তার মনটা ভরে গিয়েছিল। বার বার ভাবছিলেন -এ কি আমার জন্য! খোদা তো জোড়টা ঠিক করলেন না, অন্তত রাহেলার দিক থেকে। সংসার জীবনের প্রথম থেকেই তিনি কেমন যেন বউ পাগলা হতে থাকেন। রাহেলাও একটু পাগলী ছিলেন- নুরুল ইসলামের ভালোই লাগত। টোনাটুনির সংসার- রাগ, অভিমান আর দু'কূল ভাসানো ভালোবাসায় দিন কেটে যেতে থাকলো। নুরুল ইসলাম কোনোদিন খুব বড় চাকরির চেষ্টা করেন নি, ষাট-সত্তর দশকের গড়পড়তা বাঙালি মধ্যবিত্ত যে ধরনের চাকরির ঘেরাটোপে জীবন কাটাত, তিনি তা থেকে বেরুতে পারেন নি। তবে যা করেছেন সেটাই বা কম কিসে? ঢাকা শহরের এক নামিদামি উকিলের মুহরি ছিলেন তিনি। সেই উকিল সাহেবের নাম বলছি না, অনেকেই চিনে ফেলবেন। এতোটুকু জেনে রাখতে পারেন আশির দশকে বরিশালের বিখ্যাত ''পাঁচশালা হত্যা মামলায়'' আসামি পক্ষকে জিতিয়ে দিয়ে খুব নাম করেছিলেন। উকিল সাহেব ছিলেন নুরুল ইসলামের নিজের এলাকার লোক। এস.এস.সি. দিয়ে প্রথমে কিছুদিনের জন্য চেয়েছিলেন কাজটা করতে। পরে এক সময় কাজের নেশায় পড়াশোনাই ছেড়ে দেন। টাকা যা রোজগার করতেন, খুব একটা খারাপ ছিল না, অন্তত সেই সময়ে। প্রথম জীবনের কাঁচা পয়সা- গ্রামের বাড়িতে পাঠিয়েও নিজের জন্য অনেকখানি রয়ে যেত। নুরুল ইসলামেরও নতুন কিছু করার প্রতি দিন দিন আত্মবিশ্বাস কমতে থাকে। মনে হচ্ছিল এর চেয়ে ভালো কিছু বুঝি তার পক্ষে করা সম্ভব না। উকিল সাহেবেরও সেই সময় পসার হচ্ছে- টাকায় পেয়ে বসেছে তাকে। এক সময় নুরুল ইসলাম লক্ষ্য করলেন মাস শেষে তিনি টাকা জমাতে শুরু করেছেন।

নিচের ডোবার ডান কোণায় ভিড় লেগেছে। জনা পঞ্চাশেক মানুষ সেখানে জটলা করে দাঁড়িয়ে আছে। নুরুল সাহেব একটু উঁকি দিতে চেষ্টা করেন। পরে হাল ছেড়ে দেন। হাঁটুর ব্যথার কথা চিন্তা করে একটু ভয় পান যেন। লোকজনের কথা বার্তা একটু একটু কানে আসছে কিন্তু তিনি ধরতে পারছেন না। ভালোই জটলা লেগেছে। এমন সময় দশ বছরের কাজের ছেলে রুবেল দৌড়ে আসে, ''দাদাজান, নিচের ডোবায় একটা মরা মাইনসের লাশ ভাইসা উঠসে!'' কোন কথা বলেন না তিনি। কোন কথা বলার প্রয়োজনও বোধ করেন না। আর এই পিচ্চির সাথে কিই বা কথা বলবেন? যেমন হুস করে এসেছিল তেমনি হুস করে চলে যায় রুবেল। পচা মাংসের গন্ধ আবার নাকে এসে লাগে। নুরুল ইসলাম আবার কোন ভাবনায় ডুবে যান।

বিয়ের পর প্রায় তিন বছর ছিলেন ঝিগাতলায়। অনেক কষ্ট করতে হয়েছে তখন। দুই কামরার ছোট ঘর; রান্নাঘর আর বাথরুম আরেক পরিবারের সাথে ভাগ করতে হতো। সেই বাসা ছাড়ার দুই মাস আগে বড় ছেলে বদরুলের জন্ম হয়। তারপর আরামবাগ, খিলগাঁও, উত্তর শাহজানপুর হয়ে মুগদা পাড়া আসেন। মাসে তখন তেরশো টাকা ভাড়া দিতেন। ভালোই যাচ্ছিল সবকিছু। এক শীতের দুপুরে উকিল সাহেব নুরুল ইসলামকে ডাকলেন, ''নুরুল, তোমার সাথে কথা আছে, সন্ধ্যার পরে আমাকে মনে করিয়ে দিয়ো।'' সন্ধ্যার পর দেখা করতে গেলে উকিল সাহেব বলতে থাকেন- '' উত্তর মুগদার একটা জায়গার মামলা হাতে এসেছে, রব্বানি লড়বে। আমি কাগজপত্র দেখলাম- মালিকানায় জটিলতা আছে। এক বেচাতে কয়েক হাত ঘুরেছে। পার্টিও খুব ভালো না। মামলা চালাতে পারবে বলে মনে হয় না। আমি বলি তুমি জায়গাটা রেখে দাও''। নুরুল সাহেব বজ্রাহতের মত বসে থাকেন। তার মাথা ঝিমঝিম করতে থাকে। বলে কি বুড়ো! এতো টাকা কোথায় পাবেন তিনি? উকিল সাহেব বলে যান- '' ... প্রথমে বায়না করে ফেলো। গ্রামে যা কিছুজমি জমা আছে বিক্রি করে দাও, ধার-দেনা করে আরও কিছু জোগাড় করো, দেখো কিছু করতে পারো কিনা। আর শোনো ঢাকা শহরে এক টুকরা জমি- কিছু করতে পারলে বুড়ো বয়সে জমিদারের মত জীবন কাটাবে... '' এরপর কিভাবে যেন সব কিছু হয়ে গেলো। নুরুল সাহেব টেনে টুনে জোগাড় করলেন লাখ দুয়েক টাকা। বাকি সাড়ে তের লাখ টাকা উকিল সাহেব নিজেই কি মনে করে দিয়ে দিলেন। তিনি খুব অবাক হয়েছিলেন- এতোগুলো টাকা কেউ এভাবে দিয়ে দেয়! পঁয়ত্রিশ বছরের বিবাহিত যুবক- ঘরে ফুটফুটে বাচ্চা আর মন খারাপ করে দেয়া চোখে তাকানো স্ত্রী, ঢাকা শহরে উত্তর মুগদায় সাড়ে পাচ কাঠা জমির মালিক!

কেমন করে যেন বাড়িটা হয়ে গেলো। একতলা, দুতলা, তিনতলা, চারতলা। পরে শুনেছিলেন উকিল সাহেবের দেয়া টাকার পুরোটাই ছিল বেহাতে পাওয়া, হজম করতে না পেরে তাকে দিয়েছিলেন; না হয় জেলে পর্যন্ত যেতে হতো। এটা নিয়ে একটা খচখচানি অবশ্য নুরুল ইসলামের মনে অনেকদিন ছিল। পরে সময়ে ধীরে ধীরে সব সয়ে যায়। আরও দুই সন্তানের জন্ম হয়। মেয়ে হাসনা আর ছোট ছেলে রুহেল। ছোট ছেলের নাম রাহেলাই রেখেছিলেন। তারপর পদ্মায় পানি গড়িয়েছে অনেক। তাদের স্বামী-স্ত্রীর বয়স বাড়তে থাকে, ছেলে-মেয়ে বড় হতে থাকে। বাড়িটাও একতলা, দুতলা করে চারতলা হয়ে যায়।

শেষ জীবনে রাহেলাকে বেশ কষ্ট দিয়েছেন তিনি; যদিও রাহেলা বেঁচে থাকতে তা কোনোদিন মনে হয় নি। যাপিত জীবনে নুরুল ইসলাম বেশ ভদ্র আর সজ্জন ছিলেন। কিন্তু রাহেলার শেষ দিনগুলোতে তিনি কেমন যেন খ্যাপাটে হতে থাকেন। বড় ছেলে বদরুল ভার্সিটিতে পড়ার সময়ই এক সহপাঠীকে বিয়ে করে আলাদা হয়ে যায়। খুব একটা টান ছিল না বাবা মার প্রতি। পড়াশোনায় ভালোই ছিল। একদিন শুনতে পান কানাডা চলে যাচ্ছে বউ সহ। দুবছর পর ওখানেই স্থায়ী হয় বদরুল। শেষ এসেছিল রাহেলা মারা যাবার পর- সেও প্রায় নয় বছর হতে চলল। প্রথম জীবনে রোজগার, পরিবার আর এই বাসার জায়গা সামলাতে গিয়ে এতোটাই ব্যস্ত ছিলেন তিনি যে ছেলেটার প্রতি স্বাভাবিক হৃদ্যতার সম্পর্ক গড়ে ওঠেনি তার। যখন কিছুটা থিতু হয়েছেন বদরুল তখন কলেজ শেষ করার পথে। এতোটা সময় পরে এসে সম্পর্ক আর সহজ হয় না। বদরুলকে তিনি যেন হারিয়ে ফেললেন। মেয়ে হাসনাও হঠাৎ বড় হয়ে গেলো। বদরুল আর হাসনা ছিল তিন বছরের ছোট-বড়। কলেজের শেষ বর্ষে পড়ার সময় কাপড়ের ব্যবসা করা এক ছেলের সাথে বিয়ে দিয়ে দিলেন। হাসনার বড়মামা বিয়ের সম্বন্ধ এনেছিলেন। বলেছিলেন ছেলের পড়াশোনা না থাকলেও পরিবার ভালো। উনার জারিজুরিতেই বিয়েটা হয়ে যায়। খুব ভালো কিছু হয় নি তাতে। এখনও টেনেটুনে সংসার পার করছে হাসনা।

সে হিসেবে রুহেল কে তিনি বড় করেছিলেন নিজের মত করে। বদরুল আর রুহেলের বয়সের ব্যবধান ছিল প্রায় তের বছরের। রুহেল ছিল তার শেষ বয়সের সন্তান। রুহেলের বড় হওয়ার সাথে সাথে নুরুল ইসলাম ও নতুন করে বড় হতে থাকেন- বাবা হিসেবে। ক্লাস এইট পর্যন্ত নিজেই পড়িয়েছেন। টাকা বাঁচানোর জন্য নয়, ছেলেকে সঙ্গ দেয়ার জন্য- ছেলের সঙ্গ পাওয়ার জন্য। কি ভালোই না বাসতেন তিনি রুহেল কে! এখনও কি ভালোবাসেন না? নুরুল ইসলাম হঠাৎ-ই খুব চিন্তিত হয়ে পড়েন।

অনেক কাক জোড় হয়েছে বস্তির টিনের চালে; কর্কশস্বরে তার চিন্তার সুর কেটে যেতে থাকে। আশেপাশে কোথাও কি কাক মরে পড়ে আছে? না হলে এতো কাক কোত্থেকে আসলো? একটা বিরক্তির ভাঁজ ফুটে ওঠে নুরুল ইসলামের কপালে। কাজের ছেলে তো বলে গেলো একটা লাশ ভেসেছে নিচের ডোবায়- এমনটা ভাবেন। এক সময় আবার ডুবে যান তিনি। আজ তাকে নেশায় পেয়েছে।

রুহেলের বড় হতে থাকা আর নুরুল ইসলামের পিতৃত্ব উপভোগ করতে থাকার সাথে সাথে আরেকটা ব্যাপার ঘটতে থাকে- রাহেলা বানু অসুস্থ হতে থাকেন, ভেঙে যেতে থাকেন। সেটা শারীরিক আর মানসিক দু'ভাবেই। ক্রমাগত অসুখের বিস্তার তাদের আর্থিক সামর্থ্যকেও প্রকট করতে থাকে। প্রতিদিনের এক গাদা ওষুধ মাস শেষে অনেকগুলো টাকা বের করে নিত। এরই মাঝে নুরুল সাহেব হার্ট এটাক করে বসলে এক বিপর্যয়ের মুখে পড়ে পুরো পরিবার। তারপরও ভালোই যাচ্ছিল। বদরুল মাঝে মাঝে যা টাকা পাঠাতো- বলার মত কিছু ছিল না। বাসা ভাড়ার টাকাই তখন সব। রাহেলার শরীর দিন দিন খারাপ হতে থাকে। দিন বুঝি এভাবেই শেষ হয়ে যায়!

নুরুল সাহেব রুহেলের প্রতি যতটা দুর্বল ছিলেন, রুহেল ছিল তারচেয়েও বেশি মা-ন্যাওটা। সবকিছুতে সে মাকে খুঁজে বেড়াতো। মায়ের কাছে তার যত আবদার, উচ্ছ্বাস, কান্না, জেগে থাকা, ঘুমিয়ে পড়া। নুরুল সাহেব রুহেলের যত কাছে যেতে চাইতেন রুহেল ততই বাবাকে এড়িয়ে চলত। এতে তিনি রাহেলার প্রতি যে কিছুটা ঈর্ষা অনুভব করতেন, তা বোঝা যেত। কিন্তু রাহেলার অসুস্থতা সব কিছু বদলে দিতে থাকে। ধীরে ধীরে এমন হল একা একা টয়লেট করতে পারেন না, গোসল করতে পারেন না, বিছানায় শুলে পাশ ফিরতে পারেন না, একা একা হাঁটতে পারেন না- সব সময় কাউকে সাথে থাকতে হয়। আর সেই কেউ একজন হলেন নুরুল ইসলাম। দিনের পর দিন, মাসের পর মাস এভাবে যেতে থাকে। একসময়ের ভদ্র শান্ত সৌম্য নুরুল ইসলাম ভয়াবহ ধরনের খ্যাপাটে স্বভাবের হতে থাকেন।

তারও বয়স হচ্ছিল, রাহেলার আট বছরের বড় ছিলেন তিনি। রাহেলা তখন চলাচলে প্রায় অক্ষম। তাছাড়া তার কষ্ট সহ্য করার ক্ষমতা একেবারেই ছিল না। একটুতেই কান্না কাটি শুরু করতেন। একদিন দেখা গেলো নুরুল ইসলাম তার স্ত্রীর সাথে খারাপ ব্যবহার করতে শুরু করেছেন, গালিগালাজ করছেন। কয়েকদিন বৃদ্ধ-অসুস্থ স্ত্রীর উপর হাতও তুলেছেন। রাতের বেলা টয়লেটে নিয়ে যাও, গোসল করিয়ে দাও, খাবার টেবিলে ভাত বেড়ে দাও- রাহেলার শেষ দিনগুলোতে এসব কিছুতেই নুরুল ইসলামের জীবন আটকে পড়েছিল। আজও ভাবেন, কতটা বিরক্ত ছিলেন তিনি স্ত্রীর প্রতি? অসুস্থতায় মানুষের হাত কতটুকু? এদিকে মায়ের প্রতি বাবার এমন আচরনে রুহেল ভেতরে ভেতরে ফুঁসতে থাকে। প্রথমদিকে খুব বাহাস করত বাবার সাথে। কিন্তু এতে নুরুল সাহেব আরও রেগে যেতেন আর রুহেলের মায়ের সাথে আরও খারাপ ব্যবহার করতেন। এক শীতের মাঝরাতে রাহেলা টয়লেটে যেতে নুরুল ইসলামকে ডাকেন। কাঁচা ঘুম ভেঙে যেতেই নুরুল ইসলাম রাগে ফেটে পড়েন। দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে রাহেলার গলা চেপে ধরেন। কতক্ষণ চেপে ধরেছিলেন? ছয়-সাত সেকেন্ড? তাতেই রাহেলা চলে গেলেন। ঘটনার আকস্মিকতায় ভড়কে যান নুরুল ইসলাম। কাউকে কিছুই বলেননি তিনি। রাতে ঘুমের মধ্যে মারা গেছেন- এমনটাই সবাই জানতে পারে।

রাহেলার মৃত্যুশোক এক সময় স্বাভাবিক হলেও বদলে যেতে থাকেন নুরুল ইসলাম আর তার ছেলে রুহেল। নুরুল সাহেব নিজেকে সব কিছু থেকে গুটিয়ে নিতে থাকেন আর রুহেল হতে থাকে বাবার অবাধ্য। যেদিন রুহেল তার বাবাকে বলে,''আমার মায়ের মৃত্যুতে আশা করি খুশি হয়েছ, এখন আরাম করো...'' সেদিন থেকেই তাদের সম্পর্ক শীতল হতে শুরু করে। এখন সম্পর্ক প্রায় নাই বললেই হয়, অথচ একই বাসায় থাকেন দুজন। রুহেল কখন বাসায় আসে কখন যায় তিনি জানেন না। জানতে চান ও না। প্রথম প্রথম হুট করে রুহেলের সামনে পড়লে খুবই বিব্রত হতেন তিনি। এখন কিছুই অনুভব করেন না। প্রায়ই শেষ রাতের কথা ভাবেন। আসলেই কি তিনি গলা চেপে ধরেছিলেন? পরিস্কার মনে করতে পারেন না। জীবনের শেষ অংশটা কেটে ফেলতে চাইতেন এক সময়। ধর্ম-কর্ম থেকে দূরে সরে গেলেন। কারো সাথে মেশেন না, কথা বলেন না। শুধু চেয়ে থাকেন আর ভাবেন। রুহেল ভয়াবহভাবে বখে যেতে থাকে। কলেজে থাকার সময় পড়াশোনা ছেড়ে দেয়। মায়ের প্রতি বাবার আচরণ সে কোনদিনও মেনে নিতে পারেনি। অনেকটা যেন বাবাকে দেখাবে বলে সে নষ্ট হতে থাকে। বাবা যেন তাকে বকেন এমনটাই প্রত্যাশা করে সে। কিন্তু নুরুল সাহেব কথা বলেন না, বকেন না, কিছুই করেন না। শুধুই বেঁচে থাকেন।

-''দাদাজান, আফনের ফুন'' কর্ডলেস এগিয়ে দেয় রুবেল। নুরুল ইসলাম বামকানে ধরেন। হাসনা কথা বলছে,

-''বাবা, কি করছ?''

-''বারান্দায় বসে আছি''

-''বাবা, তোমার জামাইকে নিয়ে আসছি। কদিন থাকবো।''

-''কেন?''

লাইনটা কেটে যায়। নুরুল ইসলাম আবার সামনে তাকিয়ে অর্থহীন দৃষ্টি মেলে ধরেন। এই চেয়ে থাকার মাঝে দেখার কোন আকাঙ্খা নাই, তৃপ্তি নাই। প্রায়ই তার মনে হয় চেয়ে থাকা আর চোখ বন্ধ করে থাকার মাঝে কোন তফাৎ নাই, অন্তত তিনি বুঝেন না। মানুষের সবার আগে বুঝি চোখটা মরে যায়। তিনি ভাবতে থাকেন-রাহেলা তো দেখতেই পেত না ভালো করে... নিচে আবারও কিছুটা হট্টগোল শোনা যায়। পচে যাওয়া গলে যাওয়া মাংসের উৎকট গন্ধ নাকে এসে লাগে। পুলিশের গাড়ি এসেছে, সাইরেন বাজিয়ে। নুরুল ইসলাম এবার দাঁড়াতে চেষ্টা করেন। চেয়ারে মট করে শব্দ হয় আর হাঁটুর ব্যথাটা একটু চড়ে যায়। এবার আর তিনি হাঁটুতে হাত চেপে ধরেন না। অর্থহীন দৃষ্টি মেলে ধরেন।

কলিং বেল বেজে ওঠে। নড়ে চড়ে বসেন নুরুল ইসলাম। বাইরের ঘর থেকে হাসনার গগন বিদারী কান্নার আওয়াজ ভেসে আসছে। অনেক ভেবেও তিনি মনে করতে পারেন না হাসনার ঘরে তার কোনো নাতি-নাতনি আছে কিনা। থাকার তো কথা!

রুবেল ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটে আসে, ''দাদাজান, পুলিশ আইসে!''


মন্তব্য

সৈয়দ নজরুল ইসলাম দেলগীর এর ছবি

গল্পটা পড়া শেষ করে শিরোনামটা আবার পড়লাম। ভালো লাগলো।
লেখকের নাম কী?

______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

মাসুদ সজীব এর ছবি

গল্প ভালোলেগেছে।

দখিনে=দক্ষিনে
দুইশ=দুইশো

মোটামুটি দুইশ ভেতরে কোন উঁচু ভবন নেই

কি দুইশো মিটার নাকি গজ কিছুর তো উল্লেখ নেই?

পরের গল্পে অবশ্যই নাম দিবেন। শুভকামনা

-------------------------------------------
আমার কোন অতীত নেই, আমার কোন ভবিষ্যত নেই, আমি জন্ম হতেই বর্তমান।
আমি অতীত হবো মৃত্যুতে, আমি ভবিষ্যত হবো আমার রক্তকোষের দ্বি-বিভাজনে।

সৈয়দ নজরুল ইসলাম দেলগীর এর ছবি

দক্ষিণে হাসি

______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

সাক্ষী সত্যানন্দ এর ছবি

চলুক

ল্যাখল কিডা? চিন্তিত

____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?

আয়নামতি এর ছবি

গল্প ভালু হলে আমি! আমিইই লিখছি।
খ্রাপ হলে জানিনা বাপু! খাইছে

সাক্ষী সত্যানন্দ এর ছবি

আন্নের নামডারে আবার শর্ট করতে হইব দ্যাহন যায় চোখ টিপি

____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?

অতিথি লেখক এর ছবি

অসাধারন একটি গল্প

অতিথি লেখক এর ছবি

চলুক

রোমেল চৌধুরী এর ছবি

স্বচ্ছতোয়া বহতা নদীর মতো লেখা। বেশ ভালো লাগলো।

এমন চমৎকার লেখার লেখকের নাম জানা হলো না বলে মনে একটা কষ্ট থেকেই গেল।

এই জায়গায় বোধকরি একটু পরিমার্জনা প্রয়োজন,

শরতের স্বচ্ছ আকাশ, নরম উজ্জ্বল আলোয় চারপাশ।

------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
আমি এক গভীরভাবে অচল মানুষ
হয়তো এই নবীন শতাব্দীতে
নক্ষত্রের নিচে।

সুলতানা সাদিয়া এর ছবি

ভাই/বোন একবার এসে তো দেখে যান, আপনার লেখা প্রকাশিত হয়েছে, সবাই ইতিবাচকও বলছে। এসে নামটাও বলে যান।

-----------------------------------
অন্ধ, আমি বৃষ্টি এলাম আলোয়
পথ হারালাম দূর্বাদলের পথে
পেরিয়ে এলাম স্মরণ-অতীত সেতু

আমি এখন রৌদ্র-ভবিষ্যতে

মেঘলা মানুষ এর ছবি

ভাল লাগলো গল্পটা। আরও আসুক এমন গল্প।

শুভেচ্ছা হাসি

আয়নামতি এর ছবি

উত্তম জাঝা!
লেখার হাত কিন্তু বেশ আপনার! আরো লিখুন হে ।

অতিথি লেখক এর ছবি

লেখার ধরণ নিঃসন্দেহে ভালো। গল্পের শিরোনাম পড়ে যে ধরণের চিত্র ভাসে সেটা গল্প পড়ার পর উবে গেলো। গল্পটার পুরোটা জুড়ে নুরুল সাহেবের জীবিকার শুরু থেকে এই বয়স পর্যন্ত যা যা হয়েছে তার আত্মকাহিনী মনে হলো। শিরোনাম নিয়ে আবার ভাবতে পারেন।

শুভকামনা রইলো।

অপর্ণা মিতু

এক লহমা এর ছবি

গল্প এগিয়েছে চমৎকার, ভাল বুনোট। তবে শিরোনামে "আত্মকাহিনী" বলা থাকায়, গল্পের এই চল-টা গল্পর সাথে একাত্ম হতে খানিকটা অসুবিধা ঘটিয়েছে।

যদি আবার কোনদিন নাটকে ফিরি, আপনার অনুমতি থাকলে এই গল্প নাট্যরূপান্তরে ইচ্ছা রাখি।
কিন্তু, চিন্তিত আপনার নামটা?

--------------------------------------------------------

এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।

এক লহমার... টুকিটাকি

তাহসিন রেজা এর ছবি

সুন্দর গল্প।

কিন্তু লিখলেন কে ??? চিন্তিত

------------------------------------------------------------------------------------------------------------
“We sit in the mud, my friend, and reach for the stars.”

অলীক জানালা _________

রংতুলি এর ছবি

ভাল লাগল।

ত্রিমাত্রিক কবি এর ছবি

ভালো লেগেছে। লিখতে থাকুন।

_ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _
একজীবনের অপূর্ণ সাধ মেটাতে চাই
আরেক জীবন, চতুর্দিকের সর্বব্যাপী জীবন্ত সুখ
সবকিছুতে আমার একটা হিস্যা তো চাই

প্রোফেসর হিজিবিজবিজ এর ছবি

ভালো লাগলো। গল্প বলার ধরনটা বেশ। সবার মতো আমারও কৌতূহল - লেখক কে?

____________________________

অতিথি লেখক এর ছবি

সুন্দর লিখেছেন। শুভো কামনা।

তিথীডোর এর ছবি

লেখা ভাল্লেগেছে। দু-একটা টাইপো আছে, তবে লেখকের লেখার জোরও আছে। চলুক

ট্যাগ ব্যবহারে যত্নবান হন, যাতে পরে লেখাগুলো জড়ো করতে সুবিধা হয়। এবং অবশ্যই পোস্টের শেষে নিজের নিক উল্লেখ করবেন।

সচল থাকুন, সচল রাখুন। হাসি

________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"

অতিথি লেখক এর ছবি

খুব ভালো লাগলো লেখাটি পড়ে...চালিয়ে যান

আব্দুল্লাহ আল ফুয়াদ

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।