শোকের ছুরিতে প্রত্যয়ের শান চাই

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: শনি, ২৮/০২/২০১৫ - ৪:২৯পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

মুক্তমনা অভিজিৎ রায়কে হত্যা করা হয়েছে। চিন্তার চর্চাকারীদের সকলেই এখন অনেকটা বিহ্বল, আমারই মতন। এটাই স্বাভাবিক। আমরা এখন বিচারের দাবি করছি, করতেই থাকবো। হুমায়ুন আজাদ স্যার, অভিজিৎ রায়, রাজিব হায়দার, অধ্যাপক ইউনুসসহ সকল হত্যার বিচার আমরা চাইবো। চাইতেই থাকবো। আমরা শোক করবো, স্মরণ করবো। কিন্তু একইসাথে আমাদের খুঁজে বের করতে হবে, এইসব হত্যাকা-ের কারণ, প্রকরণ এবং আমাদের করণীয় সম্পর্কে।

অভিজিৎ রায়কে হত্যা করার কারণ কী?

উত্তর খুব সহজ-

১। অভিজিৎ রায় একজন ব্যাক্তি থেকে প্রতিষ্ঠান হয়ে উঠছিলেন ক্রমেই।
২। তিনি ধর্মীয় গোষ্ঠীগুলোর দ্বিচারীতাকে আঘাত করেছিলেন। বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে তার লক্ষ্য হয়ে উঠছিলো মূলত মুসলিমরা।
৩। যৌক্তিক নানা ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ এবং বৈজ্ঞনিক নানা তথ্য-প্রমাণের মধ্যদিয়ে তিনি বিশ্ব ও মহাবিশ্বকে ব্যাখ্যা করার চেষ্টায় রত ছিলেন। এমন কাজ অন্য ভাষায় অনেক হয়েছে, কিন্তু বাংলা ভাষায় বিশেষত বাংলাদেশে কম হয়েছে তুলনামূলকভাবে। যতটা যা হয়েছে তাও মানুষের কাছে খুব একটা সাড়া ফেলতে পারেনি।
৪। অভিজিৎ রায় আবেগী নাস্তিক ছিলেন না। তিনি তাঁর নাস্তিক্যকে ব্যাখ্যা করতে জানতেন এবং তা সুচারুভাবেই করতেন।
৫। অভিজিৎ রায় মুক্তচিন্তার চর্চা বিচ্ছিন্নভাবে করতে চাননি। চেয়েছিলেন একটা সাধারণ প্লাটফর্ম নির্মাণ করতে যেখানে এসে সকল মুক্তচিন্তকরা মিলিত হতে পারবে।
৬। তিনি সংঘ অর্থে সংঘ না করলেও, অন্য আরো চিন্তকদের এক জায়গায় এনে একটি সংঘের রূপ দিতে পেরেছিলেন।
৭। তাঁর প্রতিটি লেখা ছিল বৈজ্ঞানিক ও যৌক্তিক তথ্য-প্রমাণ সম্বলিত।

আরো এমন অজস্র কারণ তুলে ধরা যেতে পারে। তবে আমার কাছে সবচেয়ে বড় কারণ হিসেবে মনে হয়, মুক্তমনাদের জন্য একটি সাধারণ প্লাটফর্ম নির্মাণ, তার জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি এবং তাঁর যুক্তি-তর্ক সম্বলিত লেখা। তিনি যদি আরেকটু স্থির হয়ে লিখতে থাকতেন তাহলে বৌদ্ধিক বিচারে ধর্মবাদীদের পায়ের তলা থেকে মাটি সরে যেত।

অভিজিৎ হত্যার প্রকরণ-

১। ইসলামি জঙ্গিগোষ্ঠীর হামলায় মৃত্যুবরণ করা প্রায় সবারই মৃত্যুর ধরনটা একই। এক্ষেত্রে তারা প্রথমে বিচ্ছিন্নভাবে হত্যার হুমকি দিয়ে থাকে। আগে বাসায় কাফনের কাপড় পাঠাতো। এখন এত কিছু না করে, ফেসবুক বা ব্লগে হুমকি ধামকি দিয়ে থাকে।
২। ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে হত্যা।
৩। দুঃখজনক হলেও সত্য যে, হত্যার মাস হিসেবে তারা ভাষার মাস ফেব্রুয়ারিকেই বেছে নেয়। এখানে তাদের মূল উদ্দেশ্য কী? আমার কাছে যা মনে হয়, তা হলো- তুমি মুক্তচিন্তা করো আর যাই করো, তা বাংলা ভাষায় বা বাংলাদেশের মানুষের বোধগম্য করে প্রকাশ করা যাবে না।
৪। জনপ্রিয়তার বিচারে যাই হোক, কেউ প্রভাবের বিচারে বিশেষ হয়ে উঠলেই বা কারো লেখা বা বক্তব্য এক ধরনের সাধারণ মঞ্চ তৈরি করলে, বা কারো লেখায় বা কথায় অনুপ্রাণিতর সংখ্যা বৃদ্ধি পেলে তার উপরে হামলাটা নেমে আসে।
৫। এ ধরনের জঙ্গিগোষ্ঠী সম্পর্কে আমরা যখনই কিছুটা নির্লিপ্ত হয়ে উঠি তখনই অর্থাৎ আমাদের অন্য ব্যস্ততার জন্য উদ্ভুত সুযোগে তারা হত্যাকা-টি ঘটায়।

এক্ষেত্রে মনে পড়ে, গণজাগরণ আন্দোলন চলাকালীন সময়ে, কিছু অনুজকে যারা অনেক সক্রিয় ছিল, তাদের বলেছিলাম যে, এ সময়ে তেমন কিছু না হলেও, যখন সব ঠা-া হয়ে আসবে, ফোকাসটা অন্যদিকে যাবে তখন তারা হামলা করবে। এটা আমার মনে হওয়া। উপাত্ত বিশ্লেষণ করলে এমন কিছুই হয়তো পাওয়া যাবে। এ সময়ে ফোকাসটা ছিল রোদেলা কেন্দ্রিক, সাথে রাষ্ট্রীয় নানা ঘটনা।

আমাদের করণীয়-

১। মুক্তচিন্তার সকল চর্চাকারীদের এক জায়গায় সমবেত হওয়া। পারষ্পরিক যোগাযোগ বৃদ্ধি করা। ঘোষিত না হলেও অঘোষিত হিসেবে হলেও সংঘবদ্ধ হওয়া।
২। মুক্তমনার মতো করে, অনলাইনে যেমন তেমনি হার্ড ভার্সনেও বিজ্ঞানভিত্তিক কাগজ করা। কারণ বাংলাদেশে এখনো অগ্রসর অংশ বাদে কাগজের বই বা পত্রিকার পাঠকই বেশি।
৩। স্কুল প্রতিষ্ঠা সম্ভব না হলেও, বিভিন্ন স্কুলে বা শিক্ষপ্রতিষ্ঠানে পরিকল্পিত কর্মসূচী নেওয়া। এটা খুব ক্ষুদ্র পরিসর থেকে শুরু হতে পারে। সংগঠিত করতে পারলে কর্মীর অভাব হবে না বলে আশা করি। মাদ্রাসার বিপরীতে শুধু ব্লগ লিখে বা বক্তব্য দিয়ে আগালে আর চলবে না। একে প্রতিহত করার জন্য চাই নিজস্ব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করা। হেফজতি তা-বের সময় বলেছিলাম- ‘ইশকুল খুলি চল’। একটা আন্দোলনের মতো দাঁড় করাতে চেয়েছিলাম। কিন্তু হয়নি।
৪। নিজের আশেপাশের মানুষদের মধ্যে চিন্তার চর্চার বিষয়টি ছড়িয়ে দেয়া। কারণ চর্চাই শাসন করে।
৫। নিজের মত সবলভাবে সোচ্চারে জানান দেয়া।
৬। আর একইসাথে হত্যার (সবগুলো) আলামত বা যার কাছে যা কিছু আছে তাকে এক জায়গায় করে জড়ো করা যাতে করে রাষ্ট্র প্রমাণের অভাবে বা গুপ্ত ঘাতককে চিহ্নিত করতে পারা যায়নি এমন কথা বলে বিষয়গুলোকে এড়িয়ে যেতে না পারে। আইনিভাবে লড়াই করতে হবে।

সময়টা অবশ্যই শোকের, সময়টা অবশ্যই বিপরীত। কিন্তু এই বিপরীত সময়ে শোক সন্তপ্ত হয়ে বা গুটিকয় একসাথ হয়ে হাত উত্তোলন করলেই কেবল চলবে না। হত্যার বিচারের জন্য যেমন দাবি করতে হবে তেমনি, পরবর্তী আঘাতকে প্রতিরোধ করার জন্যও প্রস্তুত হতে হবে। সংঘবদ্ধতার কোনো বিকল্প নাই। তাই শোকের ছুরিতে দিতে হবে প্রত্যয়ের শান। আমাদের শোক, আমাদের যেন বোধহীন না করে তোলে। বরং আমাদের শব্দের চাকুগুলো যেন আরো ধারালো হয়। আরো ভীষণ কর্মোদ্যোগী হতে পারি যেন আমরা। সবাই একসাথে এক কাজ করলে চলবে না। কেউ স্কুলে, কলেজে বিশ্ববিদ্যালয়ে চিন্তার সম্প্রসারণে কাজ করবে (এখানেও গ্রুপগুলো আলাদা হতে হবে)। কেউ লেখার মধ্যদিয়ে তুলে ধরবে। কেউ ধর্মের খোলস খুলবে। কেউ বিজ্ঞানকে সহজপাচ্য করে তুলবে। কেউ কাজটা করবে সাহিত্যে, সঙ্গীতে।

(মাথা জট পাকিয়ে আছে, কিন্তু লেখায় আশ্রয় খোঁজা ছাড়া কিছু করার নেই। যা বলতে চাইলাম তার কতটা বলতে পেরেছি জানি না। তবে মনে হলো এটা প্রকাশ হলে অন্যদের কাছ থেকেও অনেক কিছু প্রস্তাব হিসেবে আসতে পারে।)

স্বয়ম


মন্তব্য

এক লহমা এর ছবি

হত্যার বিচারের জন্য যেমন দাবি করতে হবে তেমনি, পরবর্তী আঘাতকে প্রতিরোধ করার জন্যও প্রস্তুত হতে হবে। সংঘবদ্ধতার কোনো বিকল্প নাই। চলুক

--------------------------------------------------------

এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।

এক লহমার... টুকিটাকি

অতিথি লেখক এর ছবি

আমাদের শত্রুরা সংঘবদ্ধ। আমাদেরও হতে হবে নূন্যতম সহমতের ভিত্তিতে হলেও। যার যেই রাজনৈতিক বা সমাজনীতিগত অবস্থান থাকুক না কেন, যারাই তর্কে ও যুক্তিতে শেষব্দি আস্থাশীল তাদের মধ্যে মেলবন্ধনটা ঘটতে হবে। তা যদি আমরা না পারি তবে এ তাবৎ হত্যার দায় নিতে আমাদেরই প্রস্তুত থাকা উচিৎ।

স্বয়ম

অতিথি লেখক এর ছবি

আমার কেন জানি মনে হয় এখনই সময় আর কোনো অভিজিত কে যাতে হারাতে না হয় তার জন্য আসলেই সঠিক সংঘবদ্ধতা দরকার। সব দিক থেকে সঠিক কৌশল প্রনয়নের। কারন এই যুদ্ধে জিততে হয়তো কয়েক দশক বা শতকও লাগতে পারে । কিন্তু সংঘবদ্ধতার জোরে তা ছড়িয়ে দেয়া যাবে আমাদের প্রজন্ম ও তার পরবর্তী প্রজন্মের মধ্যে।কলম চালানোর সাথে সাথে বুদ্ধিদীপ্ততাকে কাজে লাগাতে হবে আরো অনেক ভাবে । যাতে করে প্রগতির পথের বন্ধুরা একে অন্যকে ছেড়ে চলে না যায় ও হারিয়ে না যায় ।

-----------
রাধাকান্ত

অতিথি লেখক এর ছবি

ঠিক, ভাবনাকে নিজেদের মাঝে, নিজের পরিচিত (অনলাইন অফলাইন) কাঠামোর ভিতরে আবদ্ধ না রেখে, আমাদের মনযোগ দেয়া দরকার সহচর বাড়ানোর দিকেও। সে জন্যই মাঠ পর্যায়েও কিছু কাজ করা জরুরী।

মূলত, তুমি আমার মতের নাই হতে পার, তুমি ধর্মভীরু হতেই পার, কিন্তু আমার মত শুনে তোমার হাতে কেউ যেন অস্ত্র তুলে দিতে না পারে- এটাই আমাদের নিশ্চিত করতে হবে।

স্বয়ম

অতিথি লেখক এর ছবি

চলুক

দেবদ্যুতি

অতিথি লেখক এর ছবি

কী করা যেতে পারে। মানে প্রতিরোধের উপায় কী হতে পারে। এ নিয়ে আলোচনা হোক।

ধন্যবাদ।

স্বয়ম

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।