সানাউল্লাহর যুদ্ধ

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: মঙ্গল, ২৪/০৩/২০১৫ - ২:০৬পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

সানাউল্লাহ ছুটছেন গ্রামকে গ্রাম পেছনে ফেলে। পতিত জমির আল ধরে, মেঠো পথ ধরে, স্বাধীন বাংলার মানচিত্র আঁকা পতাকার খুঁটি ধরে। পতপত করে সে পতাকা উড়ছে ডিসেম্বরের শীতল হাওয়াকে পোষ মানিয়ে। মনে তাঁর আজ বিষম আনন্দ। তিনি ছুটছেন বাড়ীর উদ্দেশ্যে, যেখানে রেখে এসেছিলেন কিশোর পুত্র আর কৈশোর পেরোনো কন্যাকে। নিশ্চয় তারা দেশ স্বাধীন হওয়ার খবর শুনেছে? নিশ্চয় দিন গুনছে বাবার ফিরে আসার? নিশ্চয় শুষ্ক ঠোঁট দুটো ঘোমটার আড়ালে লুকিয়ে চিন্তিত চোখে রাস্তার দিকে তাকিয়ে আছে আমেনা বেগম? খুশীতে সানাউল্লাহর চোখ চকচক করে উঠলো। আর পাকবাহিনীর আতংকে দিন কাটাতে হবে না। পাকিদের আসার খবর শুনে ছেলে, মেয়ে, বউকে বাড়ীর পেছনের বাঁশ ঝাড়ে লুকাতে হবে না।

আহা! কতদিন ছেলের মুখে বাবা ডাক শোনেন না, কতদিন মেয়ের বেড়ে দেওয়া ভাত খান না, কতদিন ঝগড়া করেন না বৌয়ের সাথে। হু! আমেনা। এই মহিলার একটাই কাজ, চেঁচামেচি করা। সকালে সানাউল্লাহর গুষ্টি উদ্ধার করবে বাড়ীর পেছনের ঝোপঝাড় কেন পরিষ্কার করা হয় নি তা নিয়ে। আবার বিকেলে চিৎকার করবে, কেন পরিষ্কার করতে গিয়ে সানাউল্লাহ মানকচুর ক্ষেত উপড়ে ফেলেছেন, তা নিয়ে। এই মহিলাকে তিনি বশে আনবেন নিজের বীরত্বের কাহিনী শুনিয়ে। দেশ স্বাধীন করতে তাঁর অবদান তো বড় কম নয়!

সানাউল্লাহ ছোটা থামালেন। বড় বড় শ্বাস নিয়ে হাতের পতাকাটা পুঁতে ফেললেন রাস্তার ধারে। ওজন একটু কমলো। ছেলে নিশ্চয় পতাকা যোগাড় করেছে? পতাকা হাতে বন্ধুবান্ধবের সাথে আনন্দ মিছিলে বেরিয়েছে? থাক তবে এটা। এভাবে জায়গায় জায়গায় পতাকা পুঁতে জানান দেওয়া দরকার, দেশটা এখন কার।

হনহন করে হেঁটেও সানাউল্লাহর আশ মিটছে না। আর কতো দূর? নাহ ওই তো! ওই দেখা যায় তালগাছ, ওই সানাউল্লাহর গাঁ। গাঁয়ের সীমানায় এসে সানাউল্লাহর শরীর যেন ভেঙ্গে পড়লো। প্রচণ্ড ক্লান্তিতে ধপ করে বসে পড়লেন তিনি। এড্রেনালিন হরমোনের কারবার। ভীষণ উত্তেজনার পর অবসাদে একেবারে নুইয়ে দেয় মানুষকে। হাঁপরের মতো শব্দ করে কিছুক্ষণ বাতাস টানার পর উঠে দাঁড়ালেন সানাউল্লাহ। পা চালালেন তাঁতি পাড়ার উদ্দেশ্যে। তাঁতি পাড়া, জেলে পাড়া পার হয়ে তবে চাষাদের পাড়া। সানাউল্লাহ পুরোদস্তুর চাষী।

যুদ্ধে আসার সিদ্ধান্ত নেওয়াটা সহজ ছিল না তাঁর জন্য। কিন্তু একসময় মনে হল, প্রতিদিন মরার চেয়ে পাকিদের মেরে মরা অনেক ভালো। তাই পাশের গ্রামের যুবকেরা যখন যুদ্ধে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে, সানাউল্লাহও গিয়ে নাম লেখালেন। আমেনা বেগমের কান্নাকাটি, কন্যার শূন্য দৃষ্টি, কিছুই তাঁকে বেঁধে রাখতে পারলো না। বরং পুত্রের আব্দারের কারণে তাকেও সাথে নেওয়ার একটা চিন্তা সানাউল্লাহর মাথায় এসেছিল। কিন্তু আমেনার বজ্রমুষ্টি থেকে পুত্রের হাত ছাড়ানোর মতো সাহস তাঁর হয় নি। আর আসার সময় পরিবারকে কিছুই জানিয়ে আসতে পারেন নি তিনি। কোথায় যাচ্ছেন, কবে ফিরবেন, কোনো সমাচারই জানা ছিল না সানাউল্লাহর। এমনকি তিনি চলে গেলে তিনটা মানুষ কী খেয়ে বাঁচবে, কীভাবে নিজেদের রক্ষা করবে, তাও তিনি জানতেন না। কিন্তু দেশ প্রথম, পরিবার দ্বিতীয় হয়ে গেলো। নক্ষত্র ভরা এক রাতে সানাউল্লাহ বেরিয়ে পড়লেন।

তাঁতি পাড়ার দিকে যেতে যেতে সানাউল্লাহর মনটা খারাপ হয়ে গেলো। আমেনা বেগম কি এখনো রাগ পুষে রেখেছে? এতো মাস পর সানাউল্লাহকে দেখলে কী করবে সে? মারতে আসবে? নাকি ঝগড়া শুরু করবে?... সানাউল্লাহর চিন্তায় ছেদ পড়লো। এটা কি তাঁতি পাড়া? নাকি ভুল করে অন্য গ্রামে চলে এসেছেন তিনি? কিছুই তো চেনা যাচ্ছে না! বাড়িঘর লণ্ডভণ্ড, এখানে ওখানে পুড়ে যাওয়া জিনিস। না না, ওই তো জোড়া তালগাছ। ওই তালগাছের পাশেই ছিল যোগেন তাঁতির বাড়ী। কিন্তু এখন সেখানে কিচ্ছুটি নেই। ধক করে উঠলো সানাউল্লাহর বুক। বাতাসের চেয়েও দ্রুতগতিতে পা চালিয়ে তিনি তাঁতি পাড়া পার হয়ে জেলে পাড়ার দিকে ছুটলেন।

জেলে পাড়া শুরু হয়েছে আবুল জেলের বাড়ী থেকে। কলাপাতার বেড়া দিয়ে তাঁতি পাড়া আর জেলে পাড়ার সীমানা নির্ধারণ করা। সেই বেড়াটা এখনো থাকলেও আবুল জেলের বাড়ী বলতে অবশিষ্ট নেই কিছু। পুড়ে যাওয়া খড়কুটো পড়ে আছে এখানে সেখানে। হঠাৎ কিছুদূর থেকে চিৎকার চেঁচামেচি কানে এলো। সানাউল্লাহ দৌড় দিলেন সেদিকে। ওসমান জেলের উঠোনে দুই তিনজন লোক ইতস্তত ঘুরছে, এটা ওটা হাতে নিচ্ছে, পছন্দ না হলে ফেলে দিচ্ছে। কিন্তু কাউকেই চেনা গেলো না।

“ওই! সানাউল্লাহ নাকি?” মাতব্বরের হাঁক শুনে পিলে চমকে গেলো সানাউল্লাহর। ধড়ে প্রাণও ফিরে এলো। এতক্ষণ পর পরিচিত একজনের দেখা পাওয়া গেছে।
“হ্যাঁ মাতব্বর। কিন্তু এখানে কী হইতেছে? ওসমানরা কই?”
“অ্যাঁ, তুমি জানো না? ওসমানরে তো মাইরা ফালাইছে। আর ওর পরিবারের যে কী হইছে কইতে পারি না।”
সানাউল্লাহর মাথায় বজ্রপাত হল।
মাতব্বর একটু কেশে বলল, “আমরা তো ভাবছি, তুমিও মইরা গেছো।”

সানাউল্লাহ শূন্য দৃষ্টিতে তাকালেন চারপাশে। এরা সবাই মাতব্বরের চেলা চামুণ্ডা। এতক্ষণে চেনা গেছে। এরা কি বাড়ীতে বাড়ীতে ঘুরছে জিনিসপত্র, টাকা কড়ি খুঁজে পাওয়ার আশায়? কিন্তু চারদিকে এতো ধ্বংসযজ্ঞ, এতো ছন্নছাড়া পরিস্থিতি, এর মাঝেও মাতব্বরের গায়ে সিল্কের পাঞ্জাবী, চোখে সুরমা, গালে মেহেদি রাঙানো দাড়ি কীভাবে? যুদ্ধ কি উনাকে স্পর্শ করতে পারে নি? সানাউল্লাহর হিসাব মেলে না। দৌড় লাগান নিজের বাড়ীর দিকে।

যাওয়ার পথে মাতব্বরের বাড়ীটাও চোখে পড়ে। অক্ষত অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছে দোচালা টিনের বাড়ী। উঠানে খেলছে মাতব্বরের নাতী নাতনী, দূরেই শুকাতে দেওয়া হয়েছে ডালের বড়ি। সুন্দর পারিবারিক আবহ। কিন্তু সব পাড়ার বাড়িঘর চুরমার করে মাতব্বরের বিশাল বাড়ী কেন পাকিরা ছোঁয় নি, তার হিসেব মেলে না।
...

নিজের বাড়ীতে পৌঁছে সানাউল্লাহ চিনতে পারেন না স্তূপটাকে। মাটিও পুড়ে কালো হয়ে গেছে। শুধু একইরকম ভাবে দাঁড়িয়ে আছে বাঁশঝাড়টা। সানাউল্লাহ ঠাণ্ডা মাথার মানুষ। চিন্তা করলেন, পাকবাহিনীর কথা শুনে হয়তো ছেলেমেয়ে, বউ সবাই পালিয়েছে। কিন্তু পালিয়ে গেছে কোথায়? এতো বড় দেশে সানাউল্লাহ কোথায় খুঁজে পাবেন তাদের?

কিছুক্ষণ বসে থেকে সানাউল্লাহ ফিরে চললেন মাতব্বরের কাছে। হয়তো উনার কাছেই খবরাখবর পাওয়া যাবে! যাওয়ার সময় সানাউল্লাহ প্রাইমারী স্কুলে উঁকি দিলেন। আশ্চর্যের বিষয়, স্কুলঘরও কেউ পুড়িয়ে দেয় নি। সানাউল্লাহ ইতিউতি তাকিয়ে একটা মিলিটারি পোশাক পড়ে থাকতে দেখলেন মেঝেতে। বুক ধড়ফড় করে উঠলো তাঁর। আরেকটু এগিয়ে মিলিটারি ক্যাপ, বুট, বেল্টও খুঁজে পেলেন। কোন সন্দেহ নেই এই স্কুলকে মিলিটারিরা তাদের আড্ডাখানা বানিয়েছিল। সানাউল্লাহ দ্রুত ঘর থেকে বেরিয়ে পেছনের পুকুর পাড়ে গেলেন। কী কারণে সেখানে গেলেন, কোন অমোঘ টান তাঁকে সেখানে নিয়ে গিয়েছিলো, আজও জানেন না সানাউল্লাহ। কিন্তু গিয়ে যা দেখলেন, তাতে তাঁর নরকের শাস্তি ভোগ করা হয়ে গেলো পৃথিবীতেই।

ওসমানের মেয়ে, যোগেন তাঁতির বউসহ আরও অনেকগুলো মেয়ে পড়ে আছে দলামোচা করে। একজনের উপর আরেকজন। হতভম্ব সানাউল্লাহ নিজের অজান্তেই খোঁজা শুরু করলেন আমেনা বেগম আর কন্যাকে। হঠাৎ দেখলেন মেয়েকে, আলুথালু বেশে। কিন্তু আমেনা কোথাও নেই। পুকুর পাড়, স্কুলের ভেতর, কোথাও নেই। হঠাৎ ঝটকা দিয়ে বমি এলো সানাউল্লাহর। হড়হড় করে বমি করে তিনি ভাবলেন, মাথা গরম করলে চলবে না। খুঁজে পেতে হবে পুত্র আর জায়াকে। কিছুক্ষণ পর ঝিমঝিম মাথা নিয়ে তিনি কোলে তুলে নিলেন মেয়ের লাশ। পা বাড়ালেন মাতব্বরের বাড়ীর দিকে। যদি মাতব্বর কিছু জেনে থাকে!

মাতব্বরের উঠোনে পা দিতেই টিনের চালার উপর ছোট্ট একটা পতাকায় চোখ আটকে গেলো সানাউল্লাহর। আগেরবার চোখে পড়ে নি পাকিস্তানের চাঁন তারা আঁকা পতাকাটা। আকারে ছোট, আর লাগিয়েছেও এমন জায়গায় যে হঠাৎ করে চোখে পড়ে না। কিন্তু পতপত করে উড়ে সে জানান দিচ্ছে, আমি আছি। আমি আছি এখানে, স্বাধীন বাংলার বাতাস মাখছি গায়ে।

সানাউল্লাহ ঠাণ্ডা মাথার মানুষ। দুইয়ে দুইয়ে চারের হিসেব মিলিয়ে ফেললেন। মাতব্বরের সিল্কের পাঞ্জাবী, অক্ষত বাসা, স্কুলঘরে পাকবাহিনীর আস্তানায় মেয়ে পাঠানো... সব পরিষ্কার হয়ে গেলো। মেয়েকে উঠোনে শুইয়ে রেখে মাতব্বরের পাকঘরে গিয়ে জিজ্ঞেস করলেন সে বাড়ী এসেছে কিনা। মাতব্বরের বউ ঘোমটা টেনে বললেন, “হ আইছে। এখন খাইতে বইবো। তুমি পরে আসো।”
সানাউল্লাহ মাথা ঝাঁকিয়ে বললেন, "দা বটি কিছু একটা দ্যান তো ভাবীসাব।"
"কী করবা?"
“ময়লা সাফ করুম।”

এরপরের ইতিহাস খুব সংক্ষিপ্ত। সটান বাড়ীর ভেতর ঢুকে মাতব্বরের কল্লা নামিয়ে সানাউল্লাহ মেয়েকে পাঁজাকোলা করে হাঁটা শুরু করলেন।
এই গ্রামে কবর দেওয়া যাবে না ওকে।


.......
- নির্ঝর রুথ।

ছবি: 
24/08/2007 - 2:03পূর্বাহ্ন

মন্তব্য

মুক্তমন এর ছবি

ছবিটার উৎস জানালে ভাল হত৷

অতিথি লেখক এর ছবি

ছবিটার উৎস নীচে দিলাম। আলোকচিত্রী ছিলেন মার্ক এডওয়ার্ড। তাঁর বর্ণনা থেকে জানা যায়, একজন ব্যক্তি তাঁর কলেরায় আক্রান্ত বৌকে শরণার্থী শিবিরে নিয়ে যাচ্ছেন।

http://rarehistoricalphotos.com/refugee-carrying-cholera-stricken-wife-away-fighting-bangladesh-war-1971/

অতিথি লেখক এর ছবি

মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন...

দেবদ্যুতি

এক লহমা এর ছবি

---------

--------------------------------------------------------

এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।

এক লহমার... টুকিটাকি

গগন শিরীষ এর ছবি

দুর্দান্ত! কিন্তু দুঃখ একটাই, সত্যিকারের সানাউল্লাহদের গল্পটা আলাদা।তারা মাতব্বরদের কল্লাটা নামাতে পারেনি,বরং চুয়াল্লিশ বছর পরে মাতব্বররাই অন্যদের কল্লা নামায়।

অতিথি লেখক এর ছবি

ওঁদের দিয়ে কাজটা করানোর খুব ইচ্ছে হচ্ছিলো। তাই করিয়ে ফেললাম।

সুলতানা সাদিয়া এর ছবি

ছবিটার দিকে তাকাতে পারিনি দ্বিতীয়বার। এই অংশটা বেশ লাগলো,

সানাউল্লাহ মাথা ঝাঁকিয়ে বললেন, "দা বটি কিছু একটা দ্যান তো ভাবীসাব।"
"কী করবা?"
“ময়লা সাফ করুম।”

এইরকম একটি লেখার টাইপোগুলো বলতে ইচ্ছে হচ্ছে না। ভাল থাকুন, আরও লিখুন।

-----------------------------------
অন্ধ, আমি বৃষ্টি এলাম আলোয়
পথ হারালাম দূর্বাদলের পথে
পেরিয়ে এলাম স্মরণ-অতীত সেতু

আমি এখন রৌদ্র-ভবিষ্যতে

অতিথি লেখক এর ছবি

আপনাকে ধন্যবাদ।

তারপরও টাইপোগুলো ধরিয়ে দিলে ভবিষ্যতে সচেতন থাকতে পারতাম!

সাক্ষী সত্যানন্দ এর ছবি

আহা, সবাই যদি যার যার ঘরের ময়লাটুকুই সাফ করত...

ছবিটা যতদুর মনে পড়ে শরনার্থী শিবিরের, প্রতীকী হলেও এখানে ব্যাবহার ঠিক মানতে পারছি না।

____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?

অতিথি লেখক এর ছবি

দাদা,
আসলে এই ছবিটা দেখেই গল্পের প্লটটা মাথায় এসেছিলো। তাই জুড়ে দিতে ইচ্ছে করছিলো খুব।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।