হোয়াইট ক্লিফে একদিন

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: শুক্র, ৩১/০৭/২০১৫ - ৭:২২পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

বাংলা আর সমাজ পরীক্ষা ছাড়া এখন পর্যন্ত কোনো ক্রিয়েটিভ লেখালেখি করেছি বলে মনে পড়ে না। মোটিভেশনের অভাব ছিল হয়ত। হঠাৎ মনে হল লিখেই দেখি না! বিষয় ঘোরাঘুরি। ঘুরতে তো ভালোই লাগে কিন্তু আমার মত আলসে মানুষের জন্য তা বেশ কঠিন। কোনো না কোনো অজুহাত বের হয় সবসময়ই। আর ব্রিটিশ ওয়েদারের কথা তো বলাই বাহুল্য! হুট করে বৃষ্টি নামা নিত্যদিনের রুটিন। তাও ইচ্ছা ছিল এই সামারে কিছু ঘোরাঘুরি করার। একা তো গিয়ে মজা নেই তাই দলের সবার স্বার্থ দেখে প্ল্যান করতে হয়। দল বলতে মা-বাবা, ভাই আর এক আঙ্কেল তার পরিবার সহ। তো অরিজিনাল প্ল্যান এর চার সপ্তাহ পর মনে হল হয় এই উইকেন্ড অথবা না। আমাদের অবাক করে দিয়ে আবহাওয়া যথেষ্ট ভালো। ভালো বলতে বৃষ্টি নেই আর কি। তো যাওয়া হবে ডোভার। দেখার মত অনেক কিছুই আছে কিন্তু আমাদের পরিকল্পনা সীমাবদ্ধ হোয়াইট ক্লিফ আর সাউথ ফোরল্যান্ড লাইটহাউস পর্যন্ত।

বাবা মার সাথে কোথাও যাবার সুবিধা হচ্ছে যে আর যাই হোক খাবার সংক্রান্ত চিন্তা বাদ। সকালে খাবার দাবারের বোঁচকা নিয়ে সবাই গিয়ে চারচক্রযানে অধিষ্ঠান। লন্ডন থেকে ডোভার মাত্র সত্তুর মাইল; দেড় ঘন্টার ড্রাইভ। একঘেয়ে লাগার আগেই পৌঁছে যাবার কথা। ব্রিটিশ মোটরওয়েগুলো সুচতুরভাবে তৈরি করা; সাইটসিয়িং এর কোনো অবকাশ নেই। নিরাপত্তার কথা ভাবলে ঠিক ই আছে। তাও মাঝে মাঝে যা কিছু চোখে পড়ে তা এককথায় নয়নাভিরাম। মাইলের পর মাইল বিরান প্রান্তর। হঠাৎ হয়তোবা দেখা যায় একপাল ঘোড়া একমনে নিজের কাজে ব্যস্ত। পুরো ভিউকার্ড টাইপের দৃশ্য।

সাধারনত টমটমের প্ল্যান করা রুটে গেলে ঠিক সময়েই গন্তব্যে যাওয়া যায়। কিন্তু ড্রাইভার যে আমি! ভাগ্যানুযায়ি বরাবরের মত কোনো না কোনোভাবে ভুল যায়গায় গিয়ে উপস্তিত হবোই। তবে এখেত্রে আশেপাশের দৃশ্যেরও বেশ কিছুটা দায় আছে। ঝকঝকে নীল আকাশ, দূরে সাগর আর টিলার উপর ডোভার ক্যাসেলের দৃশ্য যথেষ্ট মনোযোগ নষ্টকারী। যাই হোক খানিক ডি ট্যুর শেষে যায়গামত পৌছে গাড়ি থেকে নামামাত্র খাবারের আয়োজন। পেটপুঁজো হয়ে গেলে শুরু হলো হাঁটা। গন্তব্য লাইটহাউস; যাবার পথ ক্লিফের পাশে দিয়ে। কিন্তু সাথে পিচ্চি থাকায় মোটামুটি সিওর যে দলের সবার যাওয়া হচ্ছে না। কিন্তু আমি আর আমার ভাই গাছগোঁয়াড়ের মতন সিদ্ধান্তে অটল যে যাবই যে ভাবেই হোক। ভাবটা যেন এ আর কি এমন কঠিন! মাত্রই তো আড়াই মাইলের পথ।

ডোভার সাউথ ইস্ট ইংল্যান্ডের বেশ গুরুত্বপূর্ণ একটি বন্দরশহর। খড়ি আর চকমকি পাথরে তৈরি ধবধবে সাদা এই ক্লিফ ফ্রান্সের দিকে মুখ করা ইংলিশ কোস্টলাইনের অংশবিশেষ। মহাদেশীয় ইউরোপের দিকে মুখ করে থাকা এই ক্লিফ বিখ্যাত ইংলিশ চ্যানেলের সবচেয়ে সরু অংশ। বিমান ভ্রমণের আগেকার সময়ে এই রুট ছিলো ইংল্যান্ড থেকে মহাদেশীয় যোগাযোগের প্রথম পছন্দ। আর এ কারণে যুদ্ধপ্রিয় ইংলিশরা দেশের এ অংশে নিয়মিত টহল রাখত। এখনো এই পথ বেশ গুরুত্বপূর্ণ; তা বন্দরের আশেপাশের কর্মযজ্ঞ দেখেই বোঝা যায়। সারাদিন একটার পর একটা ফেরী ছেড়ে যাচ্ছে। যেকোনো পরিস্কার দিনে ফ্রান্স থেকে সহজেই দেখা যায় এই সাদা ক্লিফ। কিন্তু ইংল্যান্ড থেকে ফ্রান্স দেখা যায় না। ঐ পাড়ে এইরকম সুন্দর কিছু নেই বলেই হয়ত! দেঁতো হাসি এক্সট্রিম ব্রিটিশ ওয়েদার আর প্রাকৃতিক কারণে এই ক্লিফের মুখও এখন ক্ষয়ের কবলে! সাঁতারুদের কাছে ইংলিশ চ্যানেল মনে হয় বেশ জনপ্রিয়। অবাক লাগে ব্রজেন দাস কিভাবে এই চ্যানেল পাড়ি দিয়েছিলেন! ২১ মাইল লম্বা চ্যানেল পাড়ি দেয়া সহজ ব্যাপার হবার কথা না। স্রোত, জোয়ার, বাতাসের দিক মিলে বেশ লম্বা দূরত্ব পাড়ি দেয়া লাগে। আমার ক্ষুদ্র মস্তিষ্কে ধরে না যে এই জিনিস পাড়ি দেয়ার দরকারটা কি রে বাবা! জাহাজ আছে তাহলে কি করতে!

উঁচুনিচু পাহাড়ি পথে হাঁটা সোজা ব্যাপার না, তাও আমার মত হাঁটাচলা-দৌড়াদৌড়ি না করা মানুষের জন্য। কিন্তু এতো কাহিনী করে এক জায়গায় এসে তো না ঘুরে চলে যাওয়া যায় না। আর পথে দেখলাম অনেক মানুষ আমাদের পথেই আছে। তাই লেগে থাকলাম। সাথে অকেশনালি থেমে থেমে বিশ্রাম আর প্রয়োজনীয়(!) ভাব ধরে ছবি তোলাতুলি তো আছেই। প্রথমে ভেবেছিলাম যে ব্যপার না। কিন্তু পথে নেমে বোঝা গেল যে ঘটনা তা না। আড়াই মাইলের পথ শুনতে বেশি লাগে না কিন্তু ঐ যে খাঁড়াই উতরাই ভরা পথ। সবকিছুরই শেষ আছে তাই একসময় পৌঁছে গেলাম সেই বাতিঘরে। শতবর্ষের নেভিগেশন দুর্যোগের অবসানের জন্য ভিক্টোরিয়ান আমলে নির্মিত এ বাতিঘর। মাইকেল ফ্যারাডে, মার্কনির মত বিজ্ঞানীরা এই স্থাপনার ইতিহাসের সাথে জড়িত। মার্কনি প্রথমদিককার কিছু রেডিও ট্রান্সমিশন সংক্রান্ত গবেষণা করেছিলেন এখান থেকে। যার মধ্যে শিপ টু শোর ট্রান্সমিশন অন্যতম। মাইকেল ফ্যারাডের রোল ছিল কিভাবে এই বাতিঘরকে টেকনোলজিক্যালি উন্নত করা যায়। তবে নিজের প্রাথমিক উদ্দেশ্য তথা জাহাজের দিকনির্দেশনা দেয়ার কাজ সফলভাবেই করে যাচ্ছে এ বাতিঘর। বাতিঘরের রক্ষণাবেক্ষণের জন্য নিয়োজিত নট (Knott) ফ্যামিলি সম্বভত বিশ্বের সবচে লম্বা সময় ধরে নিয়োজিত কিউরেটর পড়িবার। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় বাতিঘরের আশপাশ রীতিমত দুর্গ বানিয়ে ফেলা হয়। কিন্তু ব্রিটিশদের ভাগ্য ভালো যে ঐপথ দিয়ে কোনো আক্রমণ আসেনি। ১৯৬৯ সাল থেকে অবশ্য এ বাতিঘর সয়ংক্রিয়। ১৯৯০ সালে প্রথম জনগণের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া হয় আর নট ফ্যামিলিকে নেয়া হয় অন্য জায়গায়। ন্যশনাল ট্রাস্ট পরিচালিত দোকান থেকে স্মারক কিনে এরপর ফেরার রাস্তা‍য় উঠলাম।

আমার এমনি কপাল যে হাঁটতে হাঁটতেও পথ হারিয়ে ফেলি। ঘুরপথে গিয়ে একসময় জায়গামতন পৌঁছে আবার পেটপূঁজো। তারপর চায়ের কাপ হাতে নিয়ে আড্ডা। বিষয় নেক্সট কোথায় যাওয়া যায় আর দেখা যে বিশাল ফেরীগুলো পার্ক করে কিভাবে। সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে থাকার মাঝেও একরকম মজা আছে। আর যাই হোক বিরক্ত লাগে না। এর মাঝে সামুদ্রিক পাখি এসে আশেপাশে ঘোরাঘুরি শুরু করে দিয়েছে। ওদেরও উদরপূর্তির ব্যবস্থা করে এবার আমাদের ফেরার পালা নিজেদের ব্যস্ত নাগরিক জীবনে।

অর্ণব

পাদটিকাঃ ৩ নং ছবি গুগল থেকে নেয়া। লেখায় কোনো ভুল থাকলে ক্ষমাপ্রার্থী।

ছবি: 
24/08/2007 - 2:03পূর্বাহ্ন
24/08/2007 - 2:03পূর্বাহ্ন
24/08/2007 - 2:03পূর্বাহ্ন

মন্তব্য

অতিথি লেখক এর ছবি

বাতিঘরের আরো একটু বিবরণীর শূন্যতা অনুভব করেছি।
এ্যানি মাসুদ

অর্ণব এর ছবি

অনেক ধন্যবাদ মন্তব্যের জন্য। বাতিঘরের ইতিহাস বেশ সমৃদ্ধ। লেখায় শুধু হাইলাইটসগুলো তুলে ধরেছি আরকি। পরেরবার খেয়াল থাকবে।

অর্ণব

অতিথি লেখক এর ছবি

ভ্রমণ কাহিনী এমনিতেই ভাল পাই। আপনার লেখাটাও উপাদেয় হয়েছে। তবে ছবির পরিমাণ বেশি হলে আরও উপভোগ্য হত। চালিয়ে যান।

ফাহমিদুল হান্নান রূপক

অর্ণব এর ছবি

ইন্সপায়ারিং মন্তব্যের জন্য অনেক ধন্যবাদ। ছবির কোয়ালিটি তেমন ভালো ছিলনা বলে দেইনি। পরেরবার চেষ্টা থাকবে।

অর্ণব

আব্দুল্লাহ এ.এম. এর ছবি

চলুক

অর্ণব এর ছবি

ধন্যবাদ।

অর্ণব

অতিথি লেখক এর ছবি

প্রথমেই স্বাগত সচলে, আর লেখালেখি শুরু করার জন্যও ধন্যবাদ।

সবকিছুরই শেষ আছে তাই একসময় পৌঁছে গেলাম সেই বাতিঘরে।

এই লাইন একটি নতুন প্যারা দিয়ে শুরু করলে পড়তে আরও ভাল লাগত। এছাড়া, বিরাম চিহ্ন, বানান ইত্যাদি সামান্য সম্পাদনা করেই ত্রুটিমুক্ত করে নেয়া যেতে পারে।

আরও ভ্রমন কাহিনি বা অন্য যেকোন বিষয়ক লেখা আসুক!
।।।।।।।।।।
অনিত্র

অর্ণব এর ছবি

অনেক অনেক ধন্যবাদ। ব্যপারটা খেয়াল করেছি কিন্তু দেরীতে আরকি। ভেবেছিলাম এডিট করে নেবো কিন্তু ঐ সুযোগ নেই মনে হয়।

ঐ লাইন আলাদা প্যারাতেই ছিল ওয়ার্ডে কিন্তু পেস্ট করার পর এমন হয়ে গেছে। পরের বার পোস্ট করার আগে আরো সাবধানী হবার চেষ্টা করব। ধন্যবাদ ব্যাপারগুলো ধরিয়ে দেবার জন্য। মাচ এপ্রিশিয়েটেড। চলুক

অর্ণব

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।