ওয়ালীউল্লাহর চাঁদের অমাবশ্যা ও আমাদের অনড় বাস্তবতা (শেষ পর্ব)

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: সোম, ০৭/১২/২০১৫ - ৩:৩০পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

(২)
চাঁদের অমাবশ্যা’উপন্যাসের ‘যুবক শিক্ষক’একটি অপরাধ চাক্ষুষ করাবার পর থেকে যেতে থাকে এক সীমাহীন ভাবনাপুঞ্জির ভেতর দিয়ে। এই ভাবনার নির্মাতা যে সমাজ তা তাকে প্রতিনিয়ত বলে পলায়নের কথা। বাঁশঝাড়ে মৃতদেহ এবং তার পরপর কাদেরকে দেখার পরই সে তার মনের ভেতরে নিশ্চিত জেনে যায় যে কাদেরই এই হত্যার সংঘঠক। কিন্তু বড়বাড়ির আশ্রিত যুবক শিক্ষকের মনে কাদের সমন্ধে রয়েছে এক অবিশ্বাস মিশ্রিত শ্রদ্ধার ভাব। অবিশ্বাসটি হচ্ছে কাদের সমন্ধে দরবেশ বিষয়ক প্রচারণার বিপরীতে। আর শ্রদ্ধা রয়েছে দাদাসাহেব যে কিনা বড়বাড়ির মূল কর্তা এবং যুবক শিক্ষকের অন্ন সংস্থানের যোগানদাতা, কাদেরের প্রতি তার অপত্য স্নেহ ও শ্রদ্ধার ভাবের কারণে। কাদের যে দরবেশ এই বিষয়টি মূলত দাদাসাহেবের প্রচার। তিনি তাঁর বংশের গৌরব অক্ষুণ্ন রাখতে নিপুন কৌশলে ব্যবহার করেন ধর্মকে।

এই ব্যবহার, কোন এক ভিন দেশে কে ইসলাম প্রচার করছে সেই আনন্দে গ্রামের দরিদ্রদের একবেলা খাওয়ানো থেকে শুরু করে কাদেরের দরবেশি বিষয়ক প্রচারণা পর্যন্ত বিস্তৃত। বিত্তের পতনের কারণে প্রতিপত্তি যেন কমে না যায় তা নিশ্চিত করবার জন্য দাদাসাহেব বংশের গায়ে ধর্মের একটি বাড়তি আলোয়ান সেঁটে দিতে চান। দাদাসাহেবের পড়তি অবস্থা কিন্তু প্রাক্তন জৌলুস ও বংশগৌরবের পুনরুদ্ধারও করতে চান ধর্মের জায়গা থেকেই। ‘মুসলমানদের শানশওকাত আজ নাই, কিন্তু তাই তাদের অন্তস্থিত মূল্য কী কিছু কমেছে? অবশ্য এ যুক্তি তাঁরই।’ আরেকটি উদ্ধৃতি দেয়া যেতে পারে, “আমিই তাকে শিখিয়েছি। আমার হাতেই সব শিখেছে, তোমাদের কাদের দাদা, অবশ্য দরবেশকে কে কী শেখাতে পারে?” অর্থাৎ কাদেরের দরবেশি নিতান্তই দাদাসাহেবের সৃষ্টি।

দাদাসাহেবের এই যে চরিত্র তা কিন্তু আর একটি গ্রামে সীমাবদ্ধ থাকছে না। এখনকার সময়েও আমাদের চারপাশে এ চরিত্র বিস্তর ঘোরাফেরা করে। সুপথ বা কুপথে অর্থ উপার্জনের পর চারপাশের মানুষের কাছ থেকে সমীহ অর্জনের একটা পন্থা হিসেবে এদেশে ধর্মের চেয়ে বড় অস্ত্র তখনো ছিল না এখনো নাই। সম্পদশালী লোকমাত্রই মসজিদ নির্মাতা (ব্যতিক্রম প্রায় নেই বললেই চলে), ঢাকঢোল পিটিয়ে যাকাতের কাপড় দেয়া, মাঝে মধ্যে স্বপ্ন বা দুঃস্বপ্ন দেখার অজুহাতে জেয়াফত খাওয়ায়। এই দান বা আপাতদৃষ্টে সামাজিক কাজের পেছনে না আছে কোনো কল্যাণ কামনা, না আছে কোনো ধর্মভাবনা। এর পেছনে যদি কিছু কাজ করে, তা হলো নিজের কালো দিকগুলোকে আড়াল করা ও প্রতিপত্তি লাভের চেষ্টা। সাম্প্রতিক সময় থেকেও এ ধরনের উদাহরণ দেয়া যেতে পারে। বর্তমান সময়েও প্রতিবছর যাকাতের শাড়ি লুঙ্গি দেয়ার মহাযজ্ঞে সাধারণ নিম্নবিত্ত মানুষ প্রাণ হারায়। আলোচ্য উপন্যাসটিতেও আমরা দেখি দাদাসাহেবের ধর্মীয় আলোয়ানটি মূলত হত্যার অপরাধ থেকে কাদেরকে রক্ষার কাজেই ব্যবহৃত হয়। যুবক শিক্ষক এই ক্ষমতা ও শ্রেণি বিষয়ক অমোঘ সত্যটি সমন্ধে জানে। কিন্তু তারুণ্যের কারণেই তার নৈতিক স্খলন এখনো এমন মাত্রায় পৌঁছায়নি, যে তার কারণে সে বিনা যুক্তিতে পলায়ন করতে পারবে। তারুণ্যের কারণেই সে নিজেকে দুর্বল ও মেরুদণ্ডহীন বলে মানতে নারাজ। এই যে দ্বন্দ্ব এই দ্বন্দ্বই সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর কাছে ঘটনা বর্ণনার চাইতে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছে। ফলে তিনি বাঁধানো রাস্তায় না হেঁটে অপ্রচল সড়ক ধরেই এগিয়েছেন।

ঔপন্যাসিক সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ তাঁর ‘চাঁদের অমাবশ্যা’উপন্যাসটিতে যে এই পথ ধরেই হাঁটবেন তার একটি ইঙ্গিত কিন্তু তিনি দেন শুরুতেই। একটি প্রশ্নে এসে আমরা থমকে দাঁড়াই। ওয়ালীউল্লাহ প্রশ্ন করেন- ‘কীভাবে রাত্রির অত্যাশ্চর্য ঘটনাটি শুরু হয়?’ আমরা ভাবিত হই ঔপন্যাসিকের অভিসন্ধি বিষয়ে। আমরা থমকে ভাবতে বাধ্য হই যে, উপন্যাসটি কী হত্যাকাণ্ডের পরবর্তী নাকি পূর্ববর্তী ঘটনার দিকে অগ্রসর হবে। কিন্তু প্রচল বলেই হয়তো ঔপন্যাসিক এ দুটির কোনো পথেই হাঁটেন না। তিনি হাঁটেন সংশয়ী কিন্তু স্বাপ্নিক, দুর্বল কিন্তু সামষ্টিক চেতনাকে এখনো ধারণ করা যুবক শিক্ষকের মনের আলপথে সত্যের স্বরূপ অনুসন্ধানে। সত্য সম্পর্কিত এই যে দ্বিধা তার রূপ আমরা উপন্যাস থেকেই পেতে পারি- ‘এক মুহূর্ত আগে যা সত্য মনে হয়েছিল, তা যে সত্যই সে কথা কে বলতে পারে? সত্য চোখ-কানের ভুল হতে পারে, সত্য আবার চোখ-কানে ধরা না-ও দিতে পারে।

এই যে সত্য, এই সত্যের মুখ আলোতে দেখবার জন্যই বারবার যুবক শিক্ষকের মনের গহীনে ডুব দিয়েছেন লেখক। সেখানে পলায়নপরতার স্বার্থে বহুবিচিত্র সব যুক্তির মুখোমুখি হয়েছেন তিনি। ‘গভীর রাতে বাঁশঝাড়ের মধ্যে আলুথালু বেশে মৃতের মত পড়ে থাকলেই মানুষ মৃত হয় না। জীবন্ত মানুষের পক্ষে অন্যের জীবন সম্পর্কে নিরাশ হওয়াও সহজ নয়।.....মৃত মানুষ উত্তর দেয় না।’অর্থাৎ যুবক শিক্ষক এক পর্যায়ে তার স্বার্থ ভাবনার দরুন মৃতদেহটিকে মৃত হিসেবে অস্বীকার করবার চেষ্টা করেছে। এমনকি সেখানে ব্যর্থ হয়ে সে আবার হত্যাকারী সমন্ধে নিশ্চিত হওয়ার জন্য অবচেতনে মৃতের মুখ থেকেই স্বীকারোক্তি চেয়ে বসছে। এই পুরো দ্বন্দ্বটাই এ কারণে যে, যুবক শিক্ষক হত্যাকাণ্ডটি প্রত্যক্ষ না করলেও হত্যাকারীকে ঠিকই প্রত্যক্ষ করেছে। কিন্তু তার প্রকাশ তার স্বার্থবিরোধী। তাই সে এমন কোনো যুক্তি খুঁজছে, যাতে করে কাদেরকে হত্যার দায় থেকে মুক্ত করতে পারে এবং নিজে নিস্কৃতি পায়। কিন্তু ‘একটি দৃশ্যই কেবল তার চোখে ভাসে। সে দৃশ্য থেকে তার নিস্তার নাই, তার মনে-প্রাণে ও দেহের রন্ধ্রে রন্ধ্রে তার বিভীষিকাময় ছায়া।’এই দৃশ্য যেমন তাকে নিষ্কৃতি দেয় না, তেমনি কাদেরও তাকে নিষ্কৃতি দেয় না। কাদের হত্যাকারী নয় বরং তার মতই একজন প্রত্যক্ষদর্শী এই ধারণা প্রথম কাদেরই ভেঙে দেয়। কাদেরই জানিয়ে দেয় যে, সে নিজেই তাকে (মাঝি-বৌকে) হত্যা করেছে। অবশ্য এক্ষেত্রে কাদের জানতই না যে, সত্যটি যুবক শিক্ষক নিশ্চিত করে জানে না। ফলে যুবক শিক্ষকের আর কোনো পথ থাকে না। তবুও সে আরেকটি পথ খোঁজার চেষ্টা করে। সে নিজেকে বিচারকের আসনে বসিয়ে ভাবে যে, যদি কাদের ও মাঝি-বৌয়ের মধ্যে প্রণয়ঘটিত বিষয় থেকে থাকে, তবে এটি দুর্ঘটনাবশত হত্যা, যার দায় এমনকি তার ওপরেও বর্তায় সমানভাবে। লক্ষ্যণীয় বিষয় হচ্ছে যুবক শিক্ষক এখানে তার শ্রেণি ধারণা দ্বারাই চালিত হচ্ছে। সে বুঝতে পারছে নিজের অবচেতনেই যে, ক্ষমতাধর পরিবারটির সবচেয়ে শ্রদ্ধার পাত্র কাদেরের অপরাধ তার চাক্ষুষ করাটাই একটি অপরাধ। এবং এই অপরাধের জন্য তার শাস্তি পাওয়াটাই উচিৎ। এমনকি সে কাদের ও মাঝি-বৌয়ের প্রণয় সম্ভাবনা সমন্ধে এই কারণে নিশ্চিত হতে চায়, যাতে করে সে কাদেরকে ক্ষমা করে দিতে পারে!

যুবক শিক্ষকের মনে যখন এমন প্রলয় উপস্থিত তখন গ্রামে ঠিক কী কী ঘটছে? পরদিন মৃতদেহ নদীতে ভাসিয়ে দেয়ার পর তা স্টিমারের সারেং দেখতে পেয়ে উদ্ধার করে। কিন্তু তা গ্রামটিতে কেবল মৃদু একটি তরঙ্গ সৃষ্টি ছাড়া আর কিছুই করে না। উপন্যাসে মধ্যবিত্ত হিসেবে উপস্থাপিত শিক্ষক সমাজ কমনরুমে বসে এই মৃত্যু সমন্ধে ময়নাতদন্তে বসে। যার কাছে এই সংবাদটি প্রথম আসে, সে আসরের মধ্যমনি হয়ে ওঠে। সে ঘটনার সাথে আরো বিস্তর ডালপালা মিশিয়ে ঘটনার বর্ণনা করে। এই আলোচনা থেকে আমরা সামগ্রিকভাবে সমাজের এই শ্রেণিটি সমন্ধে একটি ধারণা পাই। অধ্যায় ছয়ে বিধৃত এই আলাপচারিতা পাঠকের বিশেষ মনোযোগ দাবি করে। ‘তারই কণ্ঠ বিশৃঙ্খল কোলাহলের মধ্যে জয়লাভ করেছে। কারো মুখে টু’শব্দ নাই। সে মনস্থ করে, তার জয় সম্পূর্ণভাবে উপভোগ করবে সে।’এই হচ্ছে মধ্যবিত্ত, যে কিনা হারজিতের নানা সমীকরণে বেঁচে থাকতে থাকতে এবং অধিকাংশ দিনে পরাজিত হতে হতে এরকম কোনো একটি দিন হঠাৎ জয়ী হওয়ার আপাত স্বাদ পায়। আপাত এই কারণে যে, এখানে এই জয়ে তার কোনো সক্রিয় ভূমিকা নেই। সে কেবল এর বর্ণনাকারী। এই হচ্ছে সেই মধ্যবিত্ত, যাদেরকে আমরা প্রতিদিন পথে ঘাটে বা চায়ের দোকানে দেশ-জাতি, বিশ্বরাজনীতি প্রভৃতি সমন্ধে বিস্তর জ্ঞানগর্ভ এবং মাঝে মাঝে প্রতিবাদী কথাও বলতে শুনি।

তারপর সেই একদিনের বরপ্রাপ্ত ব্যক্তি, যে কিনা একটা পুরোদস্তুর আস্ত নারী মৃতদেহের প্রাপ্তির সংবাদ সবার আগে জানতে পেরেছে, সে তার বর্ণনা দিতে থাকে, যেখানে সে নদীতে ভাসতে থাকা নারীটি যে বিবস্ত্র ছিল এবং তার বয়স যে কম ছিল তা বারবার করে কামজ উদ্দিপনায় উল্লেখ করে। শিক্ষকদের নানাজনের নানা চিন্তার স্রোত তৈরি হয় এই মৃত নারীদেহটি ঘিরে। নীতিবিদ শিক্ষকের চিন্তায় দেখা যায় একটি বিবস্ত্র সুন্দরী নারী কলাগাছের ভেলায় চড়ে নদীতে ভেসে যাচ্ছে। অনেকটা বেহুলার নগ্ন রুপের মতো। তার ভাবনায় ‘তার দেহ যদি কিছু স্ফীত হয়ে থাকে, তার কারণ দুর্দমণীয় যৌবনভার।’ নীতিবিদের চিন্তার কাঠামোটিই যখন এমন, তখন বাকিদের ভাবনার হদিস নেয়ার প্রয়োজন পড়ে না। কিন্তু তারপরও লেখক এগিয়ে যান মূলত মধ্যবিত্ত শ্রেণি চরিত্রকে আরো সুস্পষ্টভাবে বর্ণনা করবার জন্য।

যখন জানা যায় যে, মৃতদেহটি আর কারো নয়, তাদেরই গ্রামের মাঝি-বৌয়ের তখন নীতিবিদের যেমন গোপন লালসার প্রাসাদটি ভেঙে যায়, তেমনি সবার চরিত্রই শ্রেণি প্রশ্নে প্রকাশ পেয়ে যায়। যারা এতক্ষণ মন্তব্য করা থেকে বিরত ছিল তারাও যোগ দেয়। কারণ মৃতদেহটি নিচুশ্রেণির একজনের এবং তারা এই কটূক্তির কোনো মিমাংসা করবার ক্ষমতা রাখে না। যেমন, আরবি শিক্ষক বলে ওঠেন- ‘তওবা তওবা! নীচ জাতীয় মেয়েমানুষ হবে। ’আর নীতিবিদ বলে ওঠে- ‘এর মধ্যে নিশ্চয় কোন কথা আছে। বলে দিলাম, মেয়ে লোকটির ক্ষেতখামারে যাবার অভ্যাস ছিল।’আর এই পুরো আলোচনাটিতে যুবক শিক্ষক সংশয়মিশ্রিতি অভিব্যক্তিতে নির্বাক হয়ে বসে ছিল। তার ভাবনা মূলত নিজেকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হয়, যেখানে সে তার প্রত্যক্ষদর্শী হওয়ার সত্যটাকে প্রাণপনে লুকাতে চায়।

ওয়ালীউল্লাহ এখানে বর্ণনার আতিশয্যে জাননি। ছোট কথাতেই বুঝিয়ে দিয়েছেন ঘটনা উপস্থাপনের চারত্র্যি। বিবস্ত্র কথাটির উপস্থাপন ও তা নিয়ে রশিকতাকে কেন্দ্র করে আমরা লেখকের বয়ানে জানতে পারি ‘কলাগাছের মত ফাঁপা ফোলা ভাসমান প্রাণহীন নারীদেহের পক্ষেও বিবস্ত্র হওয়া যেন দূষণীয়।’ বিবস্ত্র কথাটার বারবার উদ্ধৃতি সমাজের তুলনামূলক শিক্ষিত শ্রেণীরও নারী সম্পর্কিত আচরণ ও ভাবনাকে উলঙ্গভাবে প্রকাশ করে। চিন্তার এই দৈন্য, এই পুরুষতান্ত্রিক মনোভাব যে সমাজে এখনো প্রকটভাবেই বর্তমান তা আমাদের সাম্প্রতিক নানা ঘটনার মাধ্যমেই প্রমাণিত। এদেশে নারী নির্যাতিত হলে সে যে বয়স বা শ্রেণিরই হোক না কেন তার চরিত্র নিয়েই প্রথম ময়নাতদন্তটি হয়। শরীরের অনুপস্থিতিতেও চলে শরীর মন্থন। নীতিবিদেরা নীতির ছদ্মবেশের আড়ালে নির্মাণ করতে থাকে উপদ্রুত ব্যক্তিটির কামজ অবয়ব। সেখানেই তার সম্ভোগ ঘটে এক ব্যাখ্যাতীত সমেহন প্রক্রিয়ায়। আর সেই প্রকল্প ভেঙে গেলেই শুরু হয় নির্যাতিতের প্রতিই অশীল আঘাত। সাম্প্রতিক সময়ের পহেলা বৈশাখকে কেন্দ্র করে আমরা এ ধরনের বাস্তবতা প্রত্যক্ষ করেছি। বিস্তৃত পরিসরে যেখানে রাষ্ট্র, বুদ্ধিজীবি, শিক্ষক থেকে শুরু করে কেউই বাদ পড়েনি। সত্য ও ভবিষ্যতদ্রষ্টা হিসেবে সাহিত্যিকের যে ভূমিকা সেখানে ওয়ালীউল্লাহ তাই নিশ্চিতরুপে স্বার্থক হয়েছেন- এ কথা বলাই যায়।

যুবক শিক্ষক এইসব ঘটনা ও আলাপনের মধ্যদিয়ে যায়। তার বিবমিশা হয় এমন নিচুতায়। সে তার সহকর্মীদের সাথে আলাপে উৎসাহী নয়। আমরা লেখকের বয়ান থেকে জানতে পারি যে, সে শিক্ষকদের আড্ডায় নিরব ভূমিকা পালন করে। তার অংশগ্রহণ কেবল কমনরুমের কোনায় কোনো একটি বই হাতে নিশ্চুপ পড়ে যাওয়ার মধ্যে। কিন্তু মৃতদেহ আবিষ্কার ও কমনরুমে তার উন্মোচনের কারণে তার এক ধরনের ঘৃণাবোধ হতে থাকে তার সহকর্মীদের প্রতি। যদিও সত্য প্রকাশ পেলে তার নিজ শ্রেণি অর্থাৎ এই শিক্ষকদের থেকে ছিটকে পড়ার ভয়ও তার মধ্যে বিদ্যমান ছিল। যার পরিচয় আমরা সত্য প্রকাশের পর তার প্রতি সহকর্মীদের সম্ভাব্য আচরণ বিষয়ক ভাবনার মধ্যদিয়ে পাই। যুবক শিক্ষক একজন সংবেদনশীল যৌক্তিক মানুষের মতোই ঘটনা এবং তার পরিক্রমায় অবশ্যম্ভাবি নানান পরিণতিতে পৌঁছানোর দিক নির্দেশ করে। এই পথ খুঁজে নেয়ায় তাকে সহায়তা করে তার সংশয়ী ও যুক্তি-নিবিষ্ট মন। তার এই মনের পরিচয় পাওয়া যায় বিশ্বাস বিষয়ক ভাবনায়- ‘সব বিশ্বাসেরই কোন না কোন হেতু থাকে। জীবনের একমাত্র অবলম্বন হোক, তবু তার মধ্যে একটা যুক্তির কাঠামো থাকে।’প্রচলিত মিথ যেমন ‘কাদের একজন দরবেশ’-এই ধরনের ধারণার প্রতি তার মনোভাব বুঝতে হলে আমাদের প্রবেশ করতে হবে যুবক শিক্ষকের শ্রেণিকক্ষে। আমাজন সম্পর্কে বলতে গিয়ে, যখন যুবক শিক্ষক বইয়ের বাইরে থেকে তথ্য তুলে ধরে তখন বুঝতে হয়, সাধারণ সীমার বাইরেও তার পাঠ ও জানার বিস্তার আছে। এখানে যুবক শিক্ষক আরেফ আলীর বয়ানে- ‘সে রহস্যও নাই, নদীটির সমন্ধে সে রূপকথাও নাই। অজ্ঞানতার রহস্য রূপকথার জন্ম দেয়।’ তাই যুবক শিক্ষক চরিত্রটি সমাজের অন্যান্য নানা অনুষঙ্গের বিস্তারে এখনো সর্বোতভাবে সাধারণ হয়ে উঠতে পারেনি বলে আমরা সহজেই ধরে নিতে পারি যদিও তার শ্রেণি বা সাহস বা স্বার্থপরতার চিন্তা তাকে বারবার প্রচল পথেই টেনে আনতে চায়।

যুবক শিক্ষকের ভাবনায় যে দ্বিধা বারবার ফিরে এসেছে তার মূল ভিত্তি খুঁজে পাওয়া যাবে নিম্নের উদ্ধৃতিতে- ‘কী করে সে পুলিশকে খবর দেয়? সে বড়-বাড়ীর আশ্রিত মানুষ এবং কাদের বড় বাড়ীরই লোক। তার পক্ষে কথাটা প্রকাশ করা কী সহজ? উত্তরটা কিন্তু তার পছন্দ হয় না। তাতে কেমন দুর্বলচিত্ত স্বার্থপরতার ছাপ।

বাঁশঝাড়ের সেই মৃত নারী যে কিনা নদীতে ভেসে সবার চোখের অন্তরালে যাওয়ার চেষ্টায় ছিল তা আবার ফিরে এলে নিজ গ্রামে যে প্রতিক্রিয়ার মুখোমুখি হয়, তাও সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ খুব সুচারুভাবে তুলে ধরেছেন। এই প্রতিক্রিয়াসমূহ শ্রেণি নিরপেক্ষ নয়। এখানে নারী নিজেই একটি শ্রেণি তা আমাদের স্মরণে রাখতে হবে। মধ্যবিত্ত শ্রেণিটির প্রতক্রিয়া আমরা ইতোমধ্যেই আলোচনা করেছি। নারীটির প্রতি তার নিজ শ্রেণির মনোভাব, সেই মাঝি পরিবার তার ননদ ও শাশুড়ির মাধ্যমে যাদের প্রতিক্রিয়া আমরা জানতে পারি। মৃত হয়ে ফিরে আসার পর তারা এর বিচার চাওয়ার বদলে একটি জ্বিনের গল্প বা অশরীরি গল্প চালু করে দেয়। এটাই তাদের সান্ত্বনা। তারা জানে বিচার তারা পাবে না। বরং চাইতে গেলে তাদের দারিদ্র্যের কারণেই বা সমাজে তাদের অবস্থানের কারণেই আরো বড় কোনো বিপদে পড়ে যেতে পারে। এ কারণে তারা বরং একটা অশরীরির আছরের গল্পকেই বিশ্বাস করতে চায়। অন্যদিকে উচ্চবিত্ত শ্রেণিটি অর্থাৎ উপন্যাসে যা দাদাসাহেব ও তার পরিবার দিয়ে চিত্রিত তারা একে ঢেকে দিতে চায়। অপরাধী নিজে এই উচ্চবিত্ত পরিবারের অংশ, সে যে কোনো মূল্যে এই অপরাধকে ঢাকতে চায় তার বংশগৌরব রক্ষার স্বার্থেই। সে দরকারে ভীতি দেখায়, অনুনয় করে। এবং শেষতক ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী যুবক শিক্ষকের ঘাড়েই দোষ চাপিয়ে দেয়। তখন আর ধর্মের মুখোশটার কথা মনে পড়ে না। এই অপরাধ স্থানান্তরের মধ্যে দাদাসাহেব কোনো অধর্ম দেখতে পান না। আর এইসব বাস্তবতার ধারণা যুবক শিক্ষকের মননে সামাজিক প্রাণী হিসেবে আগে থেকেই প্রবিষ্ট থাকার ফলে আমরা তার ভাবনার বয়ানে ক্রমাগত সম্মুখীন হতে থাকি নানা অনিশ্চয়তাজ্ঞাপক শব্দের সাথে। ‘কিন্তু, যেন, তবে...’ ইত্যাদি অজস্র শব্দ এবং বাক্যের সম্মীলনে এগিয়ে যেতে থাকে উপন্যাস। আর আমরা পাঠক হিসেবে একটি চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের জন্য যুবক শিক্ষকের দিকে চেয়ে থাকি। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ এভাবে সমাজ, ধর্ম, অর্থনৈতিক শ্রেণি এইসবকে দারুনভাবে তুলে আনেন দ্বন্দ্বের জটিল ছকের ভেতর দিয়ে অনেকটা অলক্ষ্যেই।

সামগ্রিকভাবে যুবক শিক্ষকের দ্বন্দ্ব মূলত সমাজ এবং তার নিজের যথেষ্ট পরিমাণে সামাজিক হয়ে না উঠতে পারার মধ্যেই বিরাজ করে। উপন্যাসের কাহিনী সন্নিবেশে পাঠককে এত বেশিমাত্রায় স্বাধীনতা সম্ভবত অন্য কোন বাংলা উপন্যাসে দেয়া হয়নি। বাঁশঝাড়ের যুবতীটি অর্থাৎ মাঝি-বৌ যে কাদেরের হাতেই খুন হয়েছে, এ নিশ্চয়তা পাওয়ার জন্য আমাদের অষ্টম অধ্যায় পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়। আর নবম অধ্যায়ে প্রথম স্পষ্ট করে জানা যায় যে- ‘আজ সকালে কাদের স্বীকার করেছে, সে-ই যুবতী নারীর হত্যাকারী। তবে সেটি ঠিক হত্যা নয়, একটি দুর্ঘটনা।’এখানেও সেই অনিশ্চয়তা এবং এ পর্যায়ে নতুন বিশ্লেষণে ঘটনাটি বিবৃত হয়। আপাত চলৎশক্তিহীন এ ঘটনায় বারবার নতুন নতুন মাত্রাও যুক্ত হয়ে চলে এইসব নানা দ্বিধার মধ্য দিয়ে।

দ্বাদশ অধ্যায়ে শুরুর ঘটনাটির পুনর্বিন্যস্ত হয়েছে এবং তা করা হয়েছে কাদেরের দৃষ্টিকোণ থেকে। ভিন্ন কৌণিক এ বিশ্লেষণে পাঠকের সামনে উপস্থিত করে এক অভিনবতর মাত্রা। কাদেরের হাতে কীভাবে যুবতী নারীর মৃত্যু হলো তার ব্যাখ্যাসহ কেন সে মৃত নারীদেহটিতে নদীতে নিক্ষেপ করার সিদ্ধান্ত নেয়, সে বিবরণও এখানে উপস্থিত করা হয়েছে দারুনভাবে। আর এভাবেই উপন্যাসের মূল সত্যটি পাঠকের সামনে পুরোপুরি সরলভাবে উপস্থাপিত হয়। পাঠক অপেক্ষা করতে থাকে সত্যের উন্মোচন বিষয়ক সিদ্ধান্তের জন্য। শেষধাপে এসে কাদের যুবক শিক্ষককে আরেক ধাঁধায় এনে ফেলে, যেখানে উঠে আসে কাদেরের সাথে তার পরিচয় আর মাঝি-বৌয়ের সাথে তার অপরিচয়ের প্রসঙ্গটি। কাদেরের কণ্ঠ এখানে তার স্বভাবজাত উচ্চতা থেকে নত হয়ে আসে। যুবক শিক্ষক আবারো দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে ওঠে। কিন্তু এই দ্বিধা যতটা জীবন ও মৃত্যুর দোলাচলের কারণে, তার চেয়েও অনেক বেশি তার নিজের অবস্থান হারানোর সম্ভাবনার কারণে। পুরো উপন্যাসটি পাঠের সময় আমরা কেবলই অপেক্ষা করি যুবক শিক্ষকের সিদ্ধান্তের জন্য। আপাতদৃষ্টে নিরীহ মনে হলেও আমরা চেয়ে থাকি যুবক শিক্ষকের সেইসব অমোঘ সংকটের দিকে, যার কথা ঔপন্যাসিক খুব কমই উদ্ধৃত করেছেন। সত্য প্রকাশের দরুন যুবক শিক্ষকের সামনে গোল হয়ে বসে থাকা আসন্ন সংকটসমূহের দিকে তাকিয়েও আমরা প্রত্যাশা করি সে নির্ভীক হবে, এবং দাদাসাহেব তার প্রতি সদয় হবে, যেন সে নিঃশঙ্কভাবে তার প্রত্যাশিত উন্নতির পথে হাঁটতে পারে। এ হলো আমাদের সেই প্রত্যাশা যা আমাদের মধ্যবিত্ত মনে ‘অতঃপর তাহার সুখে শান্তিতে বসবাস করিতে লাগিল’ধরনের এক ব্যাখ্যাতীত চাহিদার জন্ম দিয়েছে, অথচ যা কিনা আমাদের তাবৎ দ্বিধাপ্রসূত অ-সুখের কারণ।

সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর চরিত্রগুলোর অসরল ও বহুবিচিত্র সম্মুখবেগই তার রচনাকে গভীর করেছে। কিংবা এমনও বলা যায়, সেসব জীবনের অসরল সম্মুখভাগে যে বিপুল যন্ত্রনাবোধ ব্যধির মতো লেপ্টে থাকে, সেটিকেই অত্যন্ত মূল্যবান মনে করেছেন তিনি; শুধু তাই নয়, সেই অশেষ দ্বন্দ্বের রূপায়ণযোগ্য এক কুশলি ভাষাভঙ্গিও তার করতলগত ছিল। ফলে এ দুইয়ের সার্থক সম্মীলনই তাকে এমন এক জায়গায় নিয়ে গেছে, যা শিখরস্পর্শী। আর এটা হয় বলেই তাকে ছকবন্দী করা যায় না। সত্যিকার অর্থে তাকে ছকবন্দী করা তো দূরে থাক, তার রচনাশৈলীর ধরনই সেই অযৌক্তিক আরোপিত ছককে ভেঙে দেয় বরং।

উপর্যুক্ত সাহিত্যভাবনার সাথে তুলনায় আনা যেতে পারে ফিওদর দস্তয়ভস্কিকে। ‘চাঁদের অমাবস্যা’উপন্যাসের আরেফ আলী চরিত্রটির সাথে মিলিয়ে পাঠ করা যেতে পারে দস্তয়ভস্কির ‘ক্রাইম অ্যান্ড পানিশমেন্ট’উপন্যাসের রাসকালনিকভ চরিত্রটিকে। দেশ-কালের সীমানা ডিঙিয়ে এই দুটি চরিত্র পরস্পর জড়াজড়ি করে আছে। রাসকালনিকভ, যেখানে অপরাধ সংঘটন করে আত্মপীড়নের মধ্যদিয়ে গিয়ে শেষ পরিণতির দিকে ধাবিত হয়, তেমনি আমরা আরেফ আলী তথা যুবক শিক্ষককে দেখি অপরাধ প্রত্যক্ষণের কারণে এক সীমাহীন আত্মপীড়নের মধ্যদিয়ে গিয়ে শেষতক তা প্রকাশ করতে। দুটি চরিত্রেরই মনোবিশ্লেষণী একটি বৈশিষ্ট্য রয়েছে। রাসকালনিকভকে সহায়তা করে তার প্রেমিকা, যে কিনা তাকে সিদ্ধান্ত গ্রহণে উদ্বুদ্ধ কের। সেখানে আরেফ আলী বা যুবক শিক্ষক একেবারেই একা। তাকে সিদ্ধান্ত নিতে হয় নিজের সাথে বোঝাপড়ার মাধ্যমে। আরেফ আলীর সিদ্ধান্ত গ্রহণে সহায়ক যদি কেউ থেকে থাকে সে একমাত্র কাদের, যে প্রতি মুহূর্তে প্রতিটি আত্মপ্রবঞ্চনা ও পলায়নপর যুক্তির বিপরীতে সত্যকে টেনে নামিয়েছে যুবক শিক্ষকের সামনে। দুটি উপন্যাসেরই শুরু অনেকটা থ্রিলারধর্মী চমকের মধ্যদিয়ে। কিন্তু দুটির একটিও থ্রিলারের আপাত জনপ্রিয় ও মোটাদাগের সাহিত্য কাঠামোয় প্রবেশ না করে এগিয়েছে অপ্রচল সড়কের বন্ধুর পথ ধরে এবং শেষব্দি উত্তীর্ণ হয়েছে বিশ্ব সাহিত্যের অনন্য কীর্তি হিসেবে। পরিধী ও মূল্যায়নের বিবেচনায় ‘ক্রাইম এন পানিশমেন্ট’উপন্যাসটি ‘চাঁদের অমাবশ্যা’উপন্যাস থেকে বহু মাত্রায় এগিয়ে থাকলেও, এটা নিশ্চিতভাবে বলা যায় যে, দ্বিতীয়টি বিশ্বদরবারে বা বাংলা সাহিত্যে তেমন একটা মূল্যায়ন না পাওয়ার পেছনের কারণ সাহিত্যমান নয় বরং আমাদের অজ্ঞানতা ও প্রবণতা। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর ভাষাশৈলী ও আলোচ্য উপন্যাসের ভিত্তি এতোটাই জোরালো যে, তা কেবল বাংলা সাহিত্যে নয় বিশ্ব সাহিত্যেও অনায়াসে স্থান করে নিতে পারে।

স্বয়ম
আগের পর্ব- http://www.sachalayatan.com/guest_writer/55296#comment-668304


মন্তব্য

অতিথি লেখক এর ছবি

লেখাটি পপ্রথম পাতায় দেখা না যাওয়ার কারণ কি? মডারেশনে বাদ পড়া নাকি কোনো যান্ত্রিক ত্রুটি।

স্বয়ম

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।