অমরশশি

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: সোম, ১৪/১২/২০১৫ - ১০:২৫অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

আমদের স্কুল এ একটি লাইব্রেরি ছিল, যেমনটি আর দশটা স্কুল এ থাকত আশির দশক এ। স্কুল এর অবহেলিত কোনো একটি কোনে, মরচে ধরা লোহার তালায় বন্দী। দরজার খড়খড়ি তে উঁকি দিয়ে দেখতাম আলো আঁধারীর আড়ালে দাড়িয়ে থাকা সারি সারি আলমারি, শত শত বইয়ে ঠাসা। আলমারির কাঁচে রাজ্যের ধুলো, ঘরময় মাকড়সার জাল। দারুন ইচ্ছে করত তালা ভেঙ্গে একবার ঘরটায় ঢুকে পড়ি। একটি বইয়ের প্রতি ছিল আমার দুর্নিবার আকর্ষণ, "গ্রিস ও ট্রয় এর উপাখ্যান"। কতবার যে খড়খড়ি দিয়ে ওই বইটির দিকে তাকিয়ে থেকেছি! বইটি বাজারে পাওয়া যেতনা তখন। একদিন শিশু একাডেমিতে গিয়ে জিগ্যেস করে জেনেছিলাম লেখকের নাম আবদার রশিদ। আমার পঞ্চম শ্রেনীর উত্সুক মনটা সারাক্ষণ পড়ে থাকত মাকড়সার জালে ঘেরা, ধুলোয় মোড়ানো, আলমারিতে বন্দী আবদার রশিদের কল্পনায় - না জানি কী লিখেছেন তিনি!

পাড়ার স্কুল, টাকা নেই পয়সা নেই, নেই লোকবল। কে নেবে ধুলোয় ধুসরিত ওই স্বপ্নলোকের দায়িত্ব। দরজা তার তালাবন্ধই থেকে যায়। স্বপ্নলোকের চাবি পড়ে পড়ে ঝিমোয় হেড মাস্টারের ড্রয়ারে। তিনি তখন ব্যাস্ত তাঁর নতুন খেলনা নিয়ে। জাপান সরকারের কী বিভ্রম হয়েছিল কে জানে! একদিন ক্লাসে এসে দেখি দেয়ালে যেখনে ব্ল্যাক বোর্ড থাকে তার ঠিক উপরে একটা বাক্স মতন। ওটা যে কী এই নিয়ে গবেষণা করতে করতেই হঠাত শুনি রাশভারী একটি কন্ঠ, বাক্সটার ভেতর দিয়ে হেড স্যার কথা বলছেন! "ছেলেরা, আমি তোমাদের হেড মাস্টার বলছি। মন দিয়ে লেখা পড়া করবে, নইলে কান ধরে বের করে দেব স্কুল থেকে।" সেই থেকে শুরু, যখন তখন, কারণে অকারণে হেড স্যার আবির্ভূত হতেন তাঁর দৈব বাণী নিয়ে।  জাপান সরকারের বদান্যতায় সেবছর ঢাকার অনেক স্কুলের ক্লাস রুমই সজ্জিত হয়েছিল অমন স্পিকার দিয়ে। কার বুদ্ধিতে জানিনা, একদিন লাঞ্চ পিরিয়ডে দেখি স্পিকার এ রেডিও চলছে। অনুরোধের আসর - রংপুর থেকে ইলা নীলা মালা বেলা, পাবনা থেকে সান্তা কান্তা, টাঙ্গাইল থেকে হাবলু, বাবলু ডাবলু..........। 

লাঞ্চের অবসরে সবাই যখন ইলা নীলা মালা বেলার পছন্দের গান শোনায় ব্যাস্ত আমি তখন তালাবন্ধ বইঘরের খড়খড়ি উঁচিয়ে দেখি দুই রঙে আঁকা গ্রিস ও ট্রয় এর উপাখ্যান এর মলাট। আমার আশ মেটেনা। আশ মিটত না আরো চার জনের। শিশির মন্ডল, শহিদুল হাসান, অখিল চন্দ্র পাল আর রঞ্জিত কুমার সাহা। আমার চার বন্ধু, স্কুল জীবনের দারুন আনন্দময় একটি এডভেঞ্চারের সঙ্গী। আমাদের বই পড়তে ভালো লাগে, কিন্তু কারো কাছেই বই টই তেমন একটা নেই। টাকা পয়সাও নেই যে সপ্তায় সপ্তায় বই কিনব। সকাল বেলা মা দুটাকা দেন, এক টাকার চটপটি, আট আনার পেয়ারা আর আট আনার আইসক্রিম। ঐটি বাঁচিয়ে বই কিনব তাই কি হয়! "চল একটা লাইব্রেরি দেই", একদিন কথায় কথায় শিশিরের প্রস্তাব।

লাইব্রেরির নাম "অমরশশি", আমাদের সবার নামের প্রথম অক্ষর দিয়ে তৈরী নাম। মনে আছে পাড়ার দুলাল দা, দুলাল আর্ট নাম খ্যাত, আমাদের রাবার স্ট্যাম্প বানিয়ে দিয়েছিলেন। আমাদের সবার বইয়ের পাতায় পাতায় অমরশশি'র স্ট্যাম্প। লাইব্রেরির কোনো নির্দিষ্ট ঠিকানা নেই, কিছুদিন এর বাড়ি কিছুদিন ওর বাড়ি - ঘুরে ফিরে আমাদের পাঁচ জনের বাড়ি। কিছু বই পেয়েছিলাম অন্য বন্ধুদের কাছ থেকে, কিছু কিনতাম স্কুল এর পাশের দোকান থেকে। দোকানটা চালাতেন সুমন ভাই, অভিনেত্রী সুইটির বড় ভাই। আমাদের লাইব্রেরির সদস্য হয়েছিল অনেকেই, কোনো সদস্য ফী নেই, কেবল বই প্রতি আট আনা | লেট ফী চার আনা। 

অমরশশি টিকেছিল অনেকদিন। তারপর কলেজে প্রবেশ, প্রথম যৌবন। সমর সেনের কবিতার মতই। কোথায় গেল অমরশশি, কবে কখন আমার পঞ্চম শ্রেনীর কৌতুহলী মনটা চাপা পড়ে গেল জীবনের জালে! মাঝে মাঝে, যখন খুব মন খারাপ থাকে, ধুলো মাখা খড়খড়িটা আলতো করে তুলে উঁকি দিয়ে দেখি, আছে। মনের কোনে লুকিয়ে আছে দুলালদার বানিয়ে দেওয়া সেই স্ট্যাম্প। বহু বছরে অস্পষ্ট হয়ে এসেছে, কিন্তু এখনো পড়া যায় - অমরশশি।

--মোখলেস হোসেন


মন্তব্য

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।