বৃক্ষ রানা ও কিছু নষ্টালজিয়া

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: রবি, ০৩/০১/২০১৬ - ৯:৩৬পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

পড়ুয়াদের ২০১৫, শিরোনামটা দেখেই স্মৃতিতে সদ্য বিগত হয়ে যাওয়া বছরে পড়া বইগুলো একে একে ঝলক দিয়ে উঠলো যেন! ২০১৫, পুরো বছরটাতে আমি সৈয়দ মুজতবা আলী, জাহানারা ইমাম এবং শাহাদুজ্জামানে বিভোর ছিলাম। দেশে বিদেশে-এর মত এমন সরেস রস সাহিত্যে আমি কখনোই আস্বাদন করেনি। অন্যদিকে শাহাদুজ্জামানের ছোট গল্প আমাকে সাহিত্যের নতুন স্বাদ ও ভাবনার দিগন্তে হাটিয়েছে।

তবে আমার আজকের লেখা বই পড়া নিয়ে নয়। আমার ধ্যান-জ্ঞান জুড়ে সারা বছর জাপ্টে থাকে বাংলা গান। নতুন, পুরাতন … সব। সচলে ‘শ্রোতাদের ২০১৫’ নামে কোন ইভেন্ট নেই তাতে কী! গান নিয়ে লিখতেতো দোষ নেই!

শ্রোতা হিসেবে ২০১৫ নিয়ে লেখার আগে ২০১৬-এর শুরুতেই একটা আক্ষেপের কথা বলি।

হাছন রাজা, লালন শাই, মনমোহন দত্ত ও রাধারমনের গান নিয়ে ‘বাপ্পা মজুমদার ও ফ্রেন্ডস’-এর ফোক গানের কম্পাইলেশন ‘বেনানন্দ’ শুক্রবার, ১ জানুয়ারি, ২০১৬। এই একটি মাত্র অ্যালবাম ছাড়া কেনার মত কোন অ্যালবাম পাইনি। প্রায় ২০ বছর পর জনপ্রিয় ব্যান্ডদল ‘উইনিং’ তাদের তৃতীয় অ্যালবাম ‘বহুদূরে’ ১-জানুয়ারি রিলিজের সম্ভাব্য তারিখ দিলেও সেটা পিছিয়ে ১০-ই জানুয়ারি করা হয়েছে। এর বাইরে এত এত সঙ্গীত শিল্পী, গীতিকবি, কম্পোজারদের ভিড়ে কারো কোন অ্যালবাম নেই! সঙ্গীতাঙ্গনের এমন খরা দিনকে দিন আরও প্রকট হয়ে উঠছে। অথচ আমার কৈশোরের দিনগুলোতে আমি দেখে এসেছি এর ঠিক উল্টো চিত্র।

২০১৫, মিশ্র অ্যালবামগুলো বাদ দিলে সারা বছরে হাতে গোনা কয়েকটা মাত্র অ্যালবাম। মেইনস্ট্রীম এবং জনপ্রিয় আন্ডারগ্রাউন্ড ব্যান্ডগুলোর উপস্থিতি নেই বললেই চলে। প্রায় এক যুগেরও অধিক সময় পর প্রকাশিত হয়েছে ফিডব্যাকের নতুন অ্যালবাম ‘এখন’, তাও জিপি মিউজিকে। সিডি আকারে কবে নাগাদ সেটা আলোর মুখ দেখবে আমরা কেউ জানিনা। জনপ্রিয় ব্যান্ড মাইলস্ তাদের সর্বশেষ অ্যালবাম ‘প্রতিচ্ছবি’ জিপি মিউজিকে প্রকাশ করেছে তাও সব মিলিয়ে বছর চারেক হয়ে যাবার কথা। আজ অব্দি সেই অ্যালবাম ‘সিডি’ আকারে আলোর মুখ দেখেনি। এল আর বি-র মেইনম্যান এবি-র সলো ‘জীবনের গল্প’-ও ডিজিটালি প্রকাশিত হয়েছে।

এর বাইরে অবস্কিওর-এর ‘মাঝরাতে চাঁদ’, সানী জুবায়ের-এর সলো অ্যালবাম ‘চাঁদের সরোবরে’, গাছ ব্যান্ডের ‘গাছ-এর কান্ড’, বাপ্পা মজুমদারের রবীন্দ্রনাথের গানের কম্পাইলেশন ‘বেঁধেছি আমার প্রাণ’, নস্টালজিক ব্যান্ডের সেলফ টাইটেলড অ্যালবাম, জন সুমিতের করজোড়ে দাঁড়িয়ে, ঘুণপোকা’র সং, ব্লু জীনস্-এর বন্ধু সহ গুটিকয় অ্যালবাম মাত্র। প্রত্যাশা আর প্রাপ্তি মিলিয়ে সার্বিকভাবে নতুন গান শুনে যদিও অতটা তৃপ্তি পাইনি তবুও ‘নষ্টালজিক’ ব্যান্ডের সেলফ্ টাইটেলড অ্যালবামটি এককভাবে সেই অপূর্ণতা ঘুছিয়ে দিয়েছে।

নষ্টালজিক, শেখ রানা কিংবা বৃক্ষ রানা একে অন্যের পরিপূরক। বৃক্ষ রানা, একজন সৃজনশীল গীতিকবি। শেখ রানা, একজন সফল শব্দচাষী। আর নষ্টালজিক রানা, এই পোড়া শহরে মেদুর আকাশ, গাছ, বৃষ্টি, পরি, স্যাটেলাইট, গেটলক সার্ভিস এই সবকিছু নিয়ে এক নাগরিক কবি। আর হলো ‘নষ্টালজিক’ নাগরিক গানের অ্যালবাম। তবে নষ্টালজিক রানা নিয়ে লেখার আগে ‘বৃক্ষ রানা’র সাথে আমাদের পরিচয়টা খুব জরুরী।

১৯৯৯, বাপ্পা মজুমদার প্রকাশ করতে যাচ্ছে থার্ড সলো অ্যালবাম ‘রাতের ট্রেন’। ততদিনে প্রকাশ পেয়েছে দুই গান পাগল মানুষ বাপ্পা ও সঞ্জীব দা’র দলছুটের ডেব্যু অ্যালবাম ‘আহ্’। ‘রাতের ট্রেন’ অ্যালবামে ‘বিশ্বাসেতে বস্তু মেলায়’ গানের মাধ্যেমে শেখ রানা গীতিকবি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। বাংলাদেশের সঙ্গীতমঞ্চে তখনো বৃক্ষ রানার আবির্ভাব হয়নি।

দলছুটের সাথে আমার পরিচয়ের কথা লিখেছিলাম ‘সঞ্জীব দা’কে নিয়ে লেখা ব্লগে। দুটি গানপাগল মানুষের ব্যতিক্রমী প্রয়াস যে দুর্বোধ্য প্রাচীর ভেঙে বুকের গহীন অন্ধকারে আলোর ফোয়ারায় নেচে-গেয়ে মেতে উঠবে সেটা হয়ত শুরুতে কেউই ভাবেনি। সৃষ্টিতে বিশ্বাস ছিল, স্বকীয়তা জুড়ে ছিল দৃষ্টি খোলা সবুজ দিগন্ত। গানের কথা ও সুরে ছিল গভীর উপলব্ধির বিশালতা। বৃষ্টির ধারা থেকে ছিটে আসা এক একটি উপমার মত এক একটি গান শুধু মুগ্ধতায় ঘোর লাগিয়েছে শ্রোতা হৃদয়ে।

‘ইয়াসমিন’ ও অধিক জনপ্রিয় ‘রঙ্গিলা’ গান দিয়ে ইতিমধ্যে দলছুট পরিচিত হয়ে উঠেছে। ২০০০ সাল, দলছুটের দ্বিতীয় অ্যালবাম ‘হৃদয়পুর’-এর প্রকাশকাল। এই অ্যালবামে শাহ্ আব্দুল করিমের ‘গাড়ি চলে না’ গানটি দলছুটকে যেমন ব্যপক পরিচিতি ও অধিকতর জনপ্রিয় করে তুলেছে ঠিক তেমনি সারাদেশে ‘গাড়ি চলে না’ গানটির ব্যপক প্রচার ও প্রসারে দলছুট ভূমিকা রেখেছে। তবে আজকে সঞ্জীব দা কিংবা দলছুট নিয়ে লিখতে বসিনি। আজকে এই লেখার আয়োজন ‘বৃক্ষ রানা’-কে নিয়ে।

বাংলাদেশের সঙ্গীতাঙ্গনে দলছুটের অনন্য অসাধারণ কনট্রিবিউশন এই ‘হৃদয়পুর’। এই অ্যালবামের ‘বৃষ্টি’, ‘সবুজ যখন’, এবং ‘গাছ’ এই তিনটি গানের গীতিকবি হলেন শেখ রানা। সঞ্জীব দা’ যাকে ‘বৃক্ষ রানা’ বলে ডাকতেন।

খোলা আকাশ -একটি গাছ
সবুজ পাতা –একটি গাছ
স্মৃতির বৃক্ষ পাতারা জানে
মেঘের চাষবাস”

গাছ - সঞ্জীব চৌধুরী
লিরিকঃ শেখ রানা
সুর ও সঙ্গীতঃ বাপ্পা
অ্যালবামঃ হৃদয়পুর

গাছ - সঞ্জীব চৌধুরী

অসাধারণ কথামালায় সঞ্জীব দা’র বিষাদী কণ্ঠে অপার্থিব ঢেউ উঠে। কত অসংখ্য রাত হৃদয়পুর শুনে কাটিয়েছি। কত জোছনা ধোয়া রাতে বৃষ্টি মুখর দিনে সবুজ পেরুনো দিগন্ত বিস্তৃত মাঠে গানের আবেশে ভাবনার গুঞ্জন উঠেছে। দলছুট কিংবা বাপ্পা মজুমদারের সলো অ্যালবামে ‘বৃক্ষ রানা’ প্রেম-প্রকৃতির অবিচ্ছেদ্য ও অপরুপ চিত্র অংকন করেছে।

দলছুট ও বাপ্পার অ্যালবামের এক শক্তিশালী উপাদান হয়ে উঠে ‘বৃক্ষ রানা’। ২০০১-এ প্রকাশিত বাপ্পা মজুমদারের ৪র্থ সলো অ্যালবাম ‘ধূলো পড়া চিঠি’তে ‘পরী’ ও ‘ভালোবাসা’ গান দুটির গীতিকবি হলেন বৃক্ষ রানা। এবং আমি বিশ্বাস করি বাপ্পা মজুমদারের গাওয়া গানগুলোর মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় গান হলো ‘পরী’।

আজ তোমার চোখের কোণে জল
বৃষ্টিও অবিরাম কাঁদে তোমার সাথে সাথে
আমার পথে পথে
আমি তোমার জন্য এনে দেব, রোদেলা সে ক্ষণ
পাখিকে করে দেবো তোমার আপনজন
পরী তুমি ভাসবে মেঘের ভাঁজে

লিরিকঃ শেখ রানা

পরী - বাপ্পা মজুমদার

আহা! কী অসম্ভব সুন্দর কথায় মোড়ানো মন ভালো করে দেয়া গান। এই গান আমার কাছে আশার গান। বিশ্বাসের গান। স্বপ্নের গান। আমার বড় ভাই বাপ্পা মজুমদারের ভক্ত। নরসিংদীর রায়পুরার এক অজপাড়া গাঁয়ে সন্ধ্যার পরই চারপাশ নিরব নিশ্চুপ হয়ে আসতো। চারপাশে ঝিঁ ঝিঁ পোকার গুঞ্জন, সাথে গৃহত্যাগী জোছনা, এমন অসংখ্য রাতে বেজে উঠেছে

আজ তোমার জোছনা হারায় আলো
প্রজাপতির ডানায় বিষাদ করে ভর, যখন তখন
আমি তোমার জন্য এনে দেব, অঝোর শ্রাবণ
আকাশ ছোঁয়া জল জোছনায়
পরী তুমি ভাসবে মেঘের ভাঁজে

প্রেম-প্রকৃতির রুপ-রস-গন্ধ শেখ রানার লিরিকের অন্যতম উপজীব্য। তার স্বাক্ষর তিনি প্রায় প্রতি অ্যালবামেই রেখেছেন। ২০০৩-এ প্রকাশিত দলছুটের তৃতীয় অ্যালবাম ‘আকাশচুরি’-র “আমি ফিরে পেতে চাই সেই বৃষ্টি ভেঁজা সুর, আমি ফিরে পেতে চাই সেই সুখের সমুদ্দুর” সঞ্জীব দা’র গানে যেই নষ্টলজিয়া তৈরি করে, ফেলে আসা সময়ের মত আবারও একই পথের পথিকের বেশে একই সুরে গলায় গলা মেলানোর যে ব্যকুলতা, যে দৃঢ়তা আমাকে মুগ্ধ করে নিয়ত। আমার অসম্ভব প্রিয় গানগুলোর মধ্যে ‘ফিরে পেতে চাই’ অন্যতম।
আমি ফিরে পেতে চাই - সঞ্জীব দা ও বাপ্পা মজুমদার

নষ্টালজিয়ার লষ্টালজিক রানা সম্পর্কে বলার আগে বৃক্ষ রানার যে আখ্যান দেবার প্রয়োজন বোধ করেছিলাম তা আসলে শেষ হবার নয়। সেই ৯৯ থেকে এখন অব্দি পর্যন্ত দলছুট ও বাপ্পার প্রতিটি অ্যালবামে ‘বৃক্ষ রানা’র লিরিক একটা উল্লেখযোগ্য অংশ দখল করে আসছে।

নষ্টালজিক রানা একজন মুক্তবুদ্ধি চর্চার ধারক, একজন সৃজনশীল গীতিকবি, সুরকার, একজন নাগরিক গায়ক, এবং সর্বোপরি একজন অসাধারণ মানুষ। ফেসবুকে প্রকাশিত তার “টুকরো নাগরিক জার্নাল” গুলো সবসময়ই নান্দনিক ও সুখপাঠ্য।

নষ্টলজিক-এর অ্যালবাম প্রকাশিত হয় ২০১৫-এর এপ্রিলে। তবে গান নিয়ে টুকরো লেখালেখির সুবাদে পরিচয় হয় শেখ রানার সাথে। তখনো নষ্টালজিক অ্যালবাম রিলিজ হয়নি। তবে বৃক্ষ রানার সাথে পরিচয়ের সুবাধে আন-রিলিজড কিছু ট্র্যাক শোনার সৌভাগ্য হয়েছিল। প্রথম যেদিন শুনি ‘তোমার কি আর দুঃখ পেলে চলে, মেদুর আকাশ বৃক্ষ সবুজ তোমার কথা বলে’। এক অপার্থিব মুগ্ধতার আবেশে ঘোর তৈরি হয়। আমি ঠিক কতবার শুনেছি গানটা সঠিক মনে নেই। তবে সেই রাতে টানা কয়েকট ঘন্টা বারবার শুনছিলাম এই গান।

আমি এখনো বিভোর হয়ে থাকি এই গানে। প্রায়ই আনমনে মাথার মধ্যে বেজে উঠে

এক একটা রাত এক একটা শব্দ
নৈঃশব্দের দীর্ঘ পথের শেষে
স্বপ্ন যখন চন্দ্র কতর হয়
আকুল বর্ষা গান ধরে আবেশে

তোমার কি আর আকুল হলে চলে
অঝোর ধারায় বৃষ্টি শুধু তোমার কথা বলে

তোমার কি আর দুঃখ পেলে চলে - শেখ রানা
লিরিকঃ শেখ রানা
টিউনঃ বনি আহমেদ
অ্যালবামঃ নষ্টালজিক

তোমার কি আর দুঃখ পেলে চলে - নষ্টালজিক

আমার শোনা অসংখ্য গানের ভিড়ে খুব কম সংখ্যক গানেই পেয়েছি ভালোলাগার ভালোবাসার মানুষকে স্বান্তনার বাণী শুনাতে। এমন সহজ সাবলীল কথায় গাঁথা এমন চমৎকার উপমার গান সত্যিই খুব কম হয়েছে। নাগরিক কবিয়াল যখন গেয়ে উঠেন “তোমার কি আর আকুল হলে চলে, অঝোর ধারায় বৃষ্টি শুধু তোমার কথা বলে” তখন আমি মুগ্ধতায় আর উচ্ছ্বাসে হত-বিহবল হয়ে পড়ি। এই গান সেই তখন অব্দি থেকে এক অর্থবহ উপমা হয়ে আমার জীবনের সাথে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে আছে।

নষ্টালজিক! অ্যালবাম শুরু হয় ‘পোড়া শহর’ গান দিয়ে।

পোড়া শহর, এক একটা উত্তাপ
খামচে ধরে বুক পাঁজরের হাড়
আগুন আলোয় মুহুর্ত শ্মশান
ভিড় বাড়ে, ঘুম ভাঙ্গে-অন্ধকার

নিমতলি-র ভয়াবহ ট্র্যাজেডি মূর্ত হয়ে উঠে এই গানে। গানের কথা, সুর ও গায়কী রক্তে শিহরণ জাগিয়ে তোলে। গানের লিরিকে চোখের সামনে ভেসে উঠে সেই রাতের ভয়াবহতা। শিল্পী যখন গেয়ে উঠেন

হলুদ আগুন, হলুদ গায়ে রঙ
বিস্ফোরণে সমস্ত বিভ্রম

–এই অন্তরা শুনতেই কেমন যেন হাহাকার করে উঠে সব কিছু। বুকে ভাঙ্গনের ঢেউ জাগে। এই অন্তরার ঠিক পরের লাইনগুলোতেই শিল্পী অসার কণ্ঠে একই ঢঙ্গে গেয়ে যান “দেয়াল ঘড়ি সময় বাড়ে রাত, সব পুড়ে যায়, আগুন পুড়ে যাক” এ যেন সদ্য পুত্র হারানোর শোকে স্তব্ধ মা’র অভিসম্পাত, বাবার নিশ্চল চোখের চাহনি।

এরপরের অন্তরাতে শিল্পীর প্রার্থনা, স্বকরুণ আবেদনের মত মনে হয় এ যেন অকূল পাথারের কোন প্রার্থনা সঙ্গীত।

আগুন, তুমি পাহাড়ে হারাও
আগুন, তুমি সমুদ্রজল নাও
আগুন, তুমি নির্বাসনে যাও
মধ্যরাতের ভুল পথ, ভুল বাতাস

পোড়া শহর - নষ্টালজিক
সরল-সাবলীল লিরিক, সুরের চমৎকার গাঁথুনি এবং কণ্ঠের দারুণ সন্নিবেশ যেমন নিমলতির ভয়াবহতা তুলে ধরে তেমনি সঙ্গীত হিসেবে একে অনবদ্য করে তুলে।

ঠিক পরের গানটাই হলোঃ ‘তোমার কি আর দুঃখ পেলে চলে’। খুব সম্ভবত ২০১৫-তে এর থেকে ভালো কোন গান আমি শুনিনি। আমার অসংখ্য ভালোলাগা স্মৃতি জড়িয়ে এই আছে এই গানের পরতে পরতে।

ইট-পাথরের দালান-কোঠা, আকাশচুম্বি উচু উচু ফ্ল্যাট, খুপরি জানালা কি করে শহুরে মানুষকে বন্দি করে রেখেছে তারই প্রতিচ্ছবি উঠে এসেছে এই অ্যালবামের ‘স্যাটেলাইট’ শিরোনামের গানটিতে। গানের মুখটা এমন

“আকাশ ভর্তি তারা দেখতে চাই
স্যাটেলাইটে ভর্তি আকাশ, একটা তারাও নাই”

অনেকটা ঠাট্টা-তামাশার ঢঙ্গে বলা সত্য সরল ভাষণ। গানের লিরিকে উঠে এসেছে অধঃপতনের চিত্র, ভারতীয় আগ্রাসন, উঠে এসেছে আমাদের ধ্যান-জ্ঞান ফেসবুক কেন্দ্রিক উটকো প্রতিবাদ ঝড়।

এই গানের সবচেয়ে প্রিয় লাইনগুলো তুলে ধরলামঃ

উঠে গেলো আকাশ ছোঁয়া ফ্ল্যাট
এই শহরে আমরা চিবুই ইন্ডিয়ান কিটক্যাট
এত বড় হয়নি বুকের পাটা
দাদা-দিদি বন্ধু সবাই, সীমান্তে তারকাঁটা
কাঁটাতারে মরছে যে, সে চোর
ফেসবুকে ঝড় তুলে টুলে আমরা হই খবর

লিরিক এণ্ড টিউনঃ শেখ রানা

স্যাটেলাইট - নষ্টালজিক

শুধু লিরিক হিসেবেই নয়, গানের টিউন ও কণ্ঠের উপস্থাপন সব মিলিয়ে অসাধারণ একটা কম্পোজিশন।

“গেটলক সার্ভিস” তেমনই আরেকটি গান। আমাদের পরিবহন সেক্টরের নানা অনিয়ম ও দুর্দশার চিত্র হয়ে ফুটে উঠেছে এই গানে। ট্র্যাফিক পুলিশের হয়রানি, পকেট ভারি করা, ভূতুরে ট্র্যাফিক সিগন্যাল সিস্টেম, যাত্রী হিসেবে আমাদের ভোগান্তী সব কিছু দৃশ্যকল্প হয়ে চোখে ধরা দেয়। ট্র্যাফিক সিস্টেমের অব্যবস্থাপনা নিয়ে খুব সম্ভবত এটাই প্রথম গান। অন্য কেউ করেছে কিনা ঠিক জানা নেই। তবে, শেখ রানা’র গেটলক সার্ভিস নিঃসন্দেহে এক চমৎকার ভ্রমণ, স্পেশালি গানের শেষে দিকে বাসের হেল্পার ও যাত্রীর (শিল্পী নিজে) কথোকপথের অংশটুকু দুর্দান্ত।
গেটলক সার্ভিস - নষ্টালজিক

অ্যালবামের বাকী গানগুলো ‘গুচ্ছ গাছের সবুজ, আকাশ নীল’, ‘প্রহরীর মত রাত’, ‘আমি যখন স্বপ্ন দেখি’, ‘রোদ হয়ে ছুঁই’, ‘বর্ষা অনুভূতি’ এবং ‘ঘুমায় শহর’ এক একটা গান এক একটা চমৎকার অনুভূতি, নান্দনিক দৃশ্যকল্প।

নষ্টালজিক অ্যালবামটি কারুকার্য শোভিত মনোমুগ্ধকর ও আনন্দদায়ক এক ভ্রমণের উৎস। সবকটি গানের গীতিকবিঃ বৃক্ষ রানা, অধিকাংশ গানই তারই সুর করা এবং সবকটি গানে কণ্ঠ দিয়েছেনও তিনি।

২০১৫-এ প্রকাশিত অ্যালবামগুলোর মধ্যে নষ্টালজিক লিরিক্যালি অনেক সমৃদ্ধ, সরল-সাবলীল সুর উপমা শোভিত গানের কথায় এক নান্দনিক মাত্রা যোগ করেছে। আমি বিশ্বাস করি, নষ্টালজিক যেমন আমার শোনা সেরা অ্যালবামগুলোর তালিকায় এক নতুন ও উজ্জ্বল সংযোজন, তেমনি বাংলা সঙ্গীত ভান্ডারেও অনন্য সংযোজন।

ঘুমায় শহর, নোলক খুঁজছে মেয়ে
দমকা হাওয়ায় উড়ছে বুকের চাদর
ঘুমায় শহর, নীল নীল ধোঁয়া
স্নেহমহী জাগছে রমনা মোড়
ক্লান্ত হয়ে থামার কেউ নেই,
ছোট্ট নদী ফিরেও ডাকে না

লিরিকঃ স্বদেশ হাসনাইন
টিউনঃ অমিত

ঘুমায় শহর - নষ্টালজিক

--------------------------------------------
মোখলেছুর রহমান সজল - ০৩.০১.২০১৬


মন্তব্য

রানা মেহের এর ছবি

রানা নামের মানুষেরা এত গুণী হয় কেন? খাইছে

-----------------------------------
আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস

মোখলেছুর রহমান সজল  এর ছবি

হা হা হা। প্রকৃতির একটা বিশেষ দূর্বলতা থাকতে পারে। খাইছে

অতিথি লেখক এর ছবি

পরের গানগুলো শোনা হয়নি। তবে দলছুটের অদ্ভুত ভালোলাগা সেই গানগুলো!! সিলেট রেলস্টেশনে বন্ধুরা মিলে কাটিয়ে দেয়া রাতগুলোর স্মৃতি মনে পড়ে গেল। বেসুরো গলায় গাওয়া "খোলা আকাশ একটি গাছ...সবুজ পাতা একটি গাছ"। ভালো লিখেছেন। ধন্যবাদ।
______________________
সৌমিত্র পালিত

মোখলেছুর রহমান সজল এর ছবি

আহা! সিলেট! আমার অসম্ভব প্রিয় শহর। নষ্টালজিক সময়ের স্বাক্ষী। সিলেট শহরের আনাচেকানাচে আমার নষ্টালজিয়া লেগে আছে। বেসুরো বলা কোন অর্থেই ঠিক হবেনা। সঞ্জীব দা'র কণ্ঠে বিষাদী ভাবটা প্রকট ছিলো। তবে সেটা বেসুরো নয়।

শেখ রানার লেখা গানগুলো বরাবরই অসাধারণ। উনার নষ্টালজিক ব্যান্ডের গানগুলো শুনে দেখবেন। আশা করি, শেখ রানার গানগুলোও আপনাকে ছুঁয়ে যাবে।

মন্ত্যবের জন্য ধন্যবাদ।

অতিথি লেখক এর ছবি

না! না! আমার লেখাতে অস্পষ্টতা ছিল। আমাদের গলা বেসুরো---তাই বলছিলাম। সঞ্জীবদা অলওয়েজ অসাধারণ!
______________________
সৌমিত্র পালিত

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।