ইন দা উডস আর ট্যানা ফ্রেঞ্চঃ রহস্যগল্পকে ছাপিয়ে

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: রবি, ০৩/০১/২০১৬ - ১২:২৮অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

পাঠক হিসেবে ২০১৫ চমৎকার কেটেছে, গুডরিডসের হিসেব মতে ৫৪টা বই পড়েছি, প্রকৃত সংখ্যা আরো একটু বেশি হতে পারে। ২০১৫ সালে প্রথম আবিষ্কার করেছি এমন কোন একজন লেখকের বই নিয়ে লিখতে বসে দেখলাম এই সংখ্যাটাও বাংলা ইংরেজি মিলিয়ে নেহায়েত কম না। শেষ পর্যন্ত এমন একটা বইতে কম্পাসের কাঁটা স্থির করলাম যেই লেখক/ যার লেখা বই এর কথা গুডরিডস রেকমেন্ডেশানের আগে কখনো শুনিনি-বই এর নাম ‘ইন দা উডস’, লেখিকার নাম ট্যানা ফ্রেঞ্চ (Tana French).

বছরের মাঝখানে খুব মার্ডার মিস্ট্রি পড়ার মেজাজে ছিলাম তাই ভালো রেটিং আর মোটামুটি ইন্টারেস্টিং সারসংক্ষেপ দেখে ইন দা উডস হাতে নিলাম। গুডরিডস পাঠকদের ভাষ্যমতে এটি একটি সাইকোলজিকাল থ্রিলার – এডাম রায়ান নামে একটি ছেলে বাড়ির পাশের বনে খেলতে গিয়ে তার ছোটবেলার দুই প্রিয় বন্ধুকে হারিয়ে ফেলে, আতঙ্কে কাঁপতে থাকা এবং ঘটনার পুরো স্মৃতি হারিয়ে ফেলা অবস্থায় খুঁজে পাওয়া যায় শুধু এডামকে। এই ট্রাজেডির আড়ালে, প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজতে খুঁজতে এডাম নিজেই একসময় আয়ারল্যান্ডের ডাবলিন মার্ডার স্কোয়াডে গোয়েন্দা হিসেবে যোগ দেয়। নিজের অতীত সম্পর্কে সে খুব অল্প মানুষকে জানতে দেয়, এডাম পরিচয় ঢেকে সে এখন পরিচিত ‘রব’ নামে। তার একমাত্র বন্ধু সহকর্মী ক্যাসি – ক্যাসি আর রায়ান মার্ডার স্কোয়াডের সবচেয়ে কার্যকর গোয়েন্দা জুটি হয়ে ওঠে অচিরেই।
২০ বছর পর সেই জঙ্গলে আবারো একটি মেয়ের মরদেহ পাওয়া গেছে। চিরাচরিত গোয়েন্দা কাহিনীর নিয়ম অনুসারে এডাম আর ক্যাসির হাতেই কেস সমাধানের দায়িত্ব পড়ে। পরবর্তী কাহিনী নিয়ে আর কিছু বলবোনা-চিরাচরিত গোয়েন্দা কাহিনীও এখানেই শেষ। রহস্যগল্প সাধারণত কিছু প্রশ্ন তোলে, দোষী কে? অপরাধ কেন করা হয়েছিলো? অপরাধী শাস্তি পাবে তো? প্রত্যেকটা প্রশ্ন এই বইতেও আছে, সাথে আরো আছে এডামের অতীতের সেই ভয়াবহ অভিজ্ঞতার বোঝা, আর সেই সম্পর্কিত আরো অনেক অনেক প্রশ্ন। কিন্তু অদ্ভুতভাবে বই শেষ করতে করতে এই একটা প্রশ্নও পাঠকের কাছে গুরুত্বপূর্ণ থাকেনা। মার্ডার মিস্ট্রি কাহিনীর কোন একটা পর্যায়ে একটা প্রচন্ডভাবে ব্যক্তিগত, চরিত্রনির্ভর গল্প হয়ে ওঠে। খুন-খুনী-সমাধান সবকিছুকে ছাপিয়ে যায় এডামের নিজেকে খুঁজে পাওয়া, অথবা আরো হারিয়ে ফেলার গল্প।

গুডরিডসের রিভিউতে লিখেছিলাম, If you're looking for two and two equaling four, this is not the book for you. If you want a story of justice, crime and punishment, some sort of redemption - this is not the book for you. ইন দা উডস পাঠককে কোন সরল সমীকরণ দেয়না। রহস্য উদঘাটন করতে পারার আত্মতুষ্টিও আপনি পাবেন না।

বইটা মাঝরাতে শেষ করে বাকি সারারাত থম মেরে বসে থেকে পার করেছিলাম। রহস্যগল্পের খোঁজে বইটা হাতে নিয়ে, শেষে সম্পূর্ণ অন্য কিছু পেলাম। মন খারাপ হয়েছে, খালি খালি লেগেছে, হতাশায় আচ্ছন্ন হয়েছি – কিন্তু সেই সাথে অদ্ভুত লেখনীশক্তির এক লেখককেও আবিষ্কার করেছি।

ডাবলিন মার্ডার স্কোয়াড সিরিজে এখনো পর্যন্ত পাঁচটা বই লেখা হয়েছে, প্রতিটা বইতে আগের বই এর কোন একজন চরিত্র বর্ণনা করেছে – কিন্তু তারা একে অন্যের সিকুয়াল নয়। ইন দা উডসের পরের বই ‘ দা লাইকনেস’ পড়েছি, সেখানে মূল চরিত্র এডামের পার্টনার ক্যাসি। দুটা বই শেষে বুঝলাম ট্যানা ফ্রেঞ্চ অবশ্যই প্রথম বই লিখে নিজেকে ফুরিয়ে ফেলা ওয়ান হিট ওয়ান্ডার নন। লেখিকা একটা সাক্ষাৎকারে বলেছেন, রহস্যগল্পকে সাধারণত সেই সীমায় বেঁধে রাখা হয় তিনি সেই গন্ডিকে ভাঙতে চান; হয় টান টান উত্তেজনা থাকবে, নাহলে ভালো লেখনী থাকবে – এই পারসেপশান থেকে বেরিয়ে আসাই তার লক্ষ্য। আমার মনে হয়েছে তিনি পেরেছেন এই ভারসাম্যে আসতে।

ট্যানা ফ্রেঞ্চের লেখা, তার চরিত্রগুলোকে পড়েই সাথে সাথে ভুলে যাওয়া যায়না। তার কোন চরিত্র নির্ভেজাল সাদা বা কালো নয়, তুড়ি বাজিয়ে জটিল সব রহস্য এক লহমায় সমাধান করে ফেলা তুখোড় গোয়েন্দাও তারা নয়। তাদের দেখানো হয়েছে মানুষ হিসেবেই, আমাদের মতই তাদের হাজারো ক্ষুদ্রতা, আমাদের মতই কিছু অদ্ভুত ভুল আর সিদ্ধান্তহীনতা তাদের জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। নিজের জীবনের সাথেও অনেক ক্ষেত্রে তাদের মিলাতে পেরেছি – রহস্যগল্পে যা সচরাচর ঘটেনা।

বই শেষে অনেকদিন ধরে নিজের মাঝে চরিত্রগুলোকে, তাদের টানাপোড়েনকে বয়ে বেড়াতে হয়েছে। তাই লেখিকার পরের বইগুলিও পড়বো অবশ্যই, কিন্তু নিজেকে একটা লম্বা বিরতি দিয়ে।

- অনন্যা রুবাইয়াত


মন্তব্য

দেবদ্যুতি এর ছবি

চলুক হাসি

...............................................................
“আকাশে তো আমি রাখি নাই মোর উড়িবার ইতিহাস”

রিসালাত বারী এর ছবি

চলুক

চমৎকার লাগলো। ট্যানা ফ্রেঞ্চের বই পড়ার জন্য পর্যাপ্ত আগ্রহ আপনি তৈরি করতে পেরেছেন।

হিমু এর ছবি

লেখকের "অদ্ভুত লেখনীশক্তি"র কিছু উদাহরণ এই পোস্টে পেলে ভালো হতো।

দময়ন্তী এর ছবি

ইন্টারেস্টিং!!
পড়তে হবে।

ধন্যবাদ পরিচয় করানোর জন্য।

-----------------------------------------------------
"চিলেকোঠার দরজা ভাঙা, পাল্লা উধাও
রোদ ঢুকেছে চোরের মত, গঞ্জনা দাও'

তাহসিন রেজা এর ছবি

বইটি পড়ার ইচ্ছে রইল। হাসি

------------------------------------------------------------------------------------------------------------
“We sit in the mud, my friend, and reach for the stars.”

অলীক জানালা _________

রানা মেহের এর ছবি

৫৪টা বই পড়েছেন? আপনিতো মহামানব!

-----------------------------------
আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।