ব্লগার ও কাপুরুষ (দেবানন্দ সরকার)

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: সোম, ১৬/০৫/২০১৬ - ৯:২০অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

বই মেলার প্রাঙ্গনে দাঁড়িয়ে কড়কড়ে নতুন বইয়ের পাতা উল্টেপাল্টে দেখছিল সুমন। একটি মেয়ে এসে দাঁড়াল ওর সামনে। তাকে সুমন আগে কখনো দেখেনি। কিন্তু ফেসবুকের কল্যাণে চেনাজানা আছে দু’জনের।
‘কি সৌভাগ্য আমার! আমার সাথে দেখা করতে এসেছে স্বনামধন্যা শুভ্রা! এ আনন্দ কোথায় রাখি?’ সুমন উচ্ছ্বাসে ফেটে পড়ে।
ওরা এসে বসল কোনের রেস্তোরাঁয়। শুভ্রার পটভূমি জানে সুমন। বড় ভাইয়ের বন্ধু সোমের সাথে গভীর প্রেমের পর বিয়ে। এক বছর পার হতে না হতে সড়ক দুর্ঘটনায় সোমকে হারাল শুভ্রা। শুভ্রা আর কারো সাথে সম্পর্ক করেনি। সোমের শূন্যতা ভুলেছে পড়াশোনায় ডুবে থেকে। একটা কলেজে পড়ায় আর বাকীটা সময় কাটে বই পড়ে। বিজ্ঞান থেকে দর্শন, উপন্যাস থেকে কবিতা, ধর্মপুস্তক থেকে মার্ক্স-ডারউইন সবকিছু আত্মস্থ করে শুভ্রা। সেই জ্ঞান নিয়ে নিজের দৃষ্টিতে শুভ্রা পৃথিবীকে দেখে। বিশ্লেষণ করে। তৈরি করে নিজের মতাদর্শ। আর ব্লগের পাতায় নিয়মিত স্থান পায় ওর চিন্তা-চেতনা-জীবনবোধের প্রতিচিত্র। ব্লগার শুভ্রাকে সবাই চেনে। মেদহীন, ঋজু, টানটান, যুক্তিবাদী লেখা দিয়ে শুভ্রা পাঠকের মনোযোগ ধরে রাখতে পারে। পৌঁছে দিতে পারে ওর বার্তা।
কয়েকবছর আগে শুভ্রার ফেসবুক বন্ধু হয়েছে সুমন। শুভ্রার লেখার মাঝে নিজের ভাবাদর্শের প্রতিচ্ছবি খুঁজে পায় সুমন। শুভ্রা কিছু লিখলে সবার আড়ালে ইনবক্সে গিয়ে শুভ্রার সাথে তাত্ত্বিক আলোচনা করে। সুমন কবিতা লেখে। ছোটবেলা থেকে লেখার অভ্যাস। দীর্ঘদিন প্রবাসে থাকলেও তাতে ভাঁটা পড়েনি। সুমনের বেশ কিছু কবিতার বই পাঠকপ্রিয়তা পেয়েছে। কবিতার প্রশংসা অথবা বস্তুনিষ্ঠ সমালোচনার মধ্যে দিয়েও সুমন আর শুভ্রার চেতনার বন্ধন দৃঢ় হয়েছে।
আজ এই প্রথম মুখোমুখি দু’জনার দেখা। শুভ্রা হাস্যোজ্জ্বল, প্রাণবন্ত। শ্যামল মিষ্টি মুখ হাসলে চকমক করে ওঠে। ছিপছিপে তণ্বী শরীর। বয়স আঁচড় ফেলেনি শুভ্রার কপালে। শুভ্রার চিন্তার স্বচ্ছতা, ব্যাপ্তি আর বোধের গভীর সুমনকে আগেই মন্ত্রমুগ্ধ করেছিল। আজ ওর বাহ্যিক সৌন্দর্য তাকে যেন পরিপূর্ণতা দিল।
কথা বলতে বলতে সুমন মাঝে মাঝে তাকিয়ে দেখছিল শুভ্রার দিকে। শুভ্রাও সমান উৎসাহে সেই দৃষ্টি ফিরিয়ে দিচ্ছিল। মোটা ফ্রেমের চশমা আর অগোছালো চুলের সুমনকে দেখলেই মনে হয় ও কবি। শুভ্রা জানে যমজ মেয়ের জন্ম দিতে গিয়ে সুমনের স্ত্রী শাশ্বতী প্রয়াত হয়েছে। সেদিন থেকে গত সতের বছর ধরে একা একা সুমন বড় করছে দুই মেয়েকে। ওর কবিতার মাঝে নিংড়ে উঠেছে মৃতা স্ত্রীর জন্য ভালোবাসা, একাকীত্বের যন্ত্রণা আর সেই যন্ত্রণার ওপর বাৎসল্যের পরিত্রাণকর প্রলেপ। সুমনের লেখার মাঝে শুভ্রা খুঁজে পেয়েছে ওর বৈধব্যের যাতনার প্রতিবিম্ব। মনের মাঝে একা একা উচ্চারণ করেছে সুমনের কবিতার স্তবক। শুভ্রার আবেগের গভীরে সুমন স্থান করে নিয়েছে।
ন’টা নাগাদ উঠে পড়ল ওরা। শুভ্রার মা হাসপাতালে। জ্বর থেকে নিউমোনিয়া। মাকে দেখে শুভ্রা বাড়ি ফিরবে। সুমন ফিরে এল ছোট বোন রুমার ফ্ল্যাটে। মাঝ রাত কিন্তু চোখে ঘুম নেই সুমনের। ওর প্রতিদিনের পৃথিবীতে এখন দুপুর দু’টো। ঘুম আসে নাকি?
‘এখনো জেগে আছ তুমি?’ ফোনের ওপাশ থেকে শুভ্রার কন্ঠস্বর ভেসে এল।
‘জেট ল্যাগ। তুমি ঘুমোও নি?’
‘না ঘুম আসছে না। মনটা খারাপ। মায়ের অবস্থা ভালো না। প্রচন্ড কাশি। শ্বাস নিতে পারেনা। অক্সিজেন চলছে। ডাক্তার আজকে আরো একটা অ্যান্টিবায়োটিক যোগ করেছে। দেখা যাক।’
‘ওঁর বয়স কত হল?’
‘বেশি না। সত্তর। তবে শরীরটা একদম ভেঙে গেছে। দু’বছর আগে বাবা চলে যাবার পর মা যেন সংসার থেকে মন তুলে ফেলেছে। আমার ভয় হচ্ছে এবার মনে হয় হাসপাতাল থেকে আর বাড়ি ফেরা হবে না।’
‘তোমাকে কি সান্ত্বনা দেব শুভ্রা? এই তো জীবন। কাউকে হারিয়ে ফেলব আবার কাউকে নতুন করে পাব।’
‘বুঝি। কিন্তু মা-বাবার চলে যাওয়াটা মেনে নিতে খুব কষ্ট হয়। মন খারাপ হলে মাকে একটু জড়িয়ে ধরলেই বুকটা হাল্কা হয়ে যায়। মা চলে গেলে কোথায় যাব আমি? আমার আশেপাশের সবাই বলে মৃত্যু মানুষকে অদৃষ্টবাদী করে তোলে। ধর্মের প্রতি, স্রষ্টার প্রতি বিশ্বাস, ভক্তি গভীর হয়ে ওঠে। আমার কিন্তু উল্টোটা হয়। আমার পৃথিবী থেকে একেক জন করে মানুষ চলে যায় আর আমি আরো বেশি বিশ্বাসহীন, যুক্তিবাদী হয়ে উঠি। আমার লেখা আরো প্রখর হয়ে ওঠে। আচ্ছা তুমি তো আমার লেখা নিয়ে অনেক মন্তব্য কর। বোঝা যায় তোমার পড়াশোনার ভিত অনেক গভীর। কিন্তু তুমি নিজে কেন কিছু লেখ না? কবিতার মায়ার মাঝে লুকিয়ে থাক। সোজাসাপ্টা কথায় নিজের ভেতরের অনুভূতিকে কেন প্রকাশ কর না?’
‘সে কাজটা তো তুমি করছ এবং তোমার মত আরো অনেকেই করছে। আজকের পৃথিবীর পরিপ্রেক্ষিতে হাজার বছরের পুরোনো জীবনপ্রণালীর নীতিমালা পরিবর্তনের প্রয়োজনিয়তা সবাইকে বোঝানো দরকার। কিন্তু যুক্তি দিয়ে কি আসলেই বিশ্বাসের বলয়ে চিড় ধরানো যায়? আমি আগে তর্ক করতাম। কিন্তু দেখলাম তর্ক করে কারো চিন্তা-চেতনা তো পরিবর্তন করতে পারছিই না বরং আমার যুক্তিকে খন্ডন করতে না পেরে প্রতিপক্ষ আরো বেশি রক্ষণশীল হয়ে উঠছে। বন্ধুর সংখ্যা কমছে আর বেড়ে উঠছে শত্রুর সংখ্যা। আমি নির্বিরোধী মানুষ। দু’টি মেয়ের বাবা। মেয়েদেরকে নিয়ে আমি দেশে আসতে চাই। খোলা মনে ঘুরে বেড়াতে চাই। কি দরকার আমার শুধু শুধু আনসারুল্লাহর লিস্টে নাম তোলার? কবিতার মধ্যে আমি অনেক কিছু বলি। অনেক সময় তোমার চাঁচাছোলা গদ্যের চেয়েও কঠিন কিছু লিখি। কিন্তু ভাষার মায়ায় তার গভীর স্পর্শ করতে পারেনা চাপাতিওয়ালারা। আমি আমার মন খুলে ধরতে পারি। ক্যাথারসিস হয়। আবার নিজেকে বাঁচিয়েও রাখতে পারি।’
‘তোমার মত গা-বাঁচিয়ে চলা মানুষদের জন্যই আজ দেশের এই দুর্দশা।’ শুভ্রা আক্ষেপ করে বলে।
‘শুভ্রা সবাইকে দিয়ে কি যুদ্ধ হয়? আমি না হয় পর্দার আড়ালের সৈনিক হয়েই রইলাম। আমার জন্য কিন্তু দেশের দুর্দশা নয়। দেশের দুর্দশা হল সেইসব বুদ্ধির ফেরিওয়ালাদের জন্য যারা যুদ্ধ তো করেই না বরং তোমার মত যারা আলোর সন্ধান দেবার প্রয়াসী তাদের নাম আনসারুল্লাহর লিস্টে তোলায় সক্রিয় মদদ দেয়। যারা ধর্মের নামে হত্যাকে বৈধতা দেয়। তোমার যুক্তিকে খন্ডন করতে না পেরে, সত্যের মুখোমুখি হবার সাহস না খুঁজে পেয়ে তোমাকে পুরোপুরি নির্মূল করার পথ বাতলায়। আমাকে আমার মত থাকতে দাও শুভ্রা।’
‘আমি কে যে তোমাকে বদলাব? তুমি যদি নিজের বিবেকের কাছে পরিষ্কার থাক তাই যথেষ্ট। ঠিক আছে অনেক রাত হয়েছে। ঘুমুতে যাই। কাল সকালে ক্লাসে যেতে হবে।’ শুভ্রার গলাটা শুকনো শোনায়।
ফোন রেখে দেয় শুভ্রা। সুমন টের পায় সন্ধ্যাবেলা যে অদৃশ্য আকর্ষণ তৈরি হয়েছিল ওদের মধ্যে মধ্যরাতের কথোপকথনে তা ছিন্ন হয়ে গেছে। সেটা আর জোড়া লাগবে কি?
সারারাত জেগে থাকার পর ভোরের আজানের শব্দ শুনে ঘুম এল সুমনের। সুষুপ্তির গভীর থেকে ওকে তুলে আনল বালিশের পাশা রাখা ফোনের আওয়াজ। ঘুম-মাখা জড়ানো কন্ঠে সুমন বলল, ‘হ্যালো। কে বলছেন?’
‘এই সুমন, আমি শুভ্রা। হাসপাতাল থেকে ফোন করেছিল। মা আর নেই। আমি রওয়ানা দিয়েছি কিন্তু প্রচন্ড ট্রাফিক জামে আটকা পড়ে আছি। তোমার বাড়ি থেকে তো স্কয়ার হাসপাতাল কাছে। তুমি কি একটু যেতে পারবে?’
সুমনের চোখ থেকে ঘুম উধাও হয়ে যায়। লেক সার্কাসে রুমাদের ফ্ল্যাট থেকে স্কয়ার হাসপাতালে প্রায় উড়ে চলে আসে সুমন। সাদা কাপড়ে ঢাকা শুভ্রার মায়ের মরদেহের পাশে সুমন এসে বসে। শুভ্রা এসে পড়ে কিছুক্ষণ পরে। মুখ ফোলা। চোখ টকটকে লাল। বোঝা যায় সারা পথ শুভ্রা কাঁদতে কাঁদতে এসেছে।
‘আমি একদম একা হয়ে গেলাম সুমন। সোম চলে যাবার পর মাকে জড়িয়ে ছিলাম গত পঁচিশ বছর। মার কাছ থেকে শক্তি নিয়ে আমি একা পথ চলেছি। এখন কি নিয়ে বাঁচব আমি? মায়ের মত এত ভালো একজন মানুষ কেন এত তাড়াতাড়ি চলে গেল?’ শুভ্রা আর্তকন্ঠে বলে।
সুমন কোনো কথা খুঁজে পায় না। শুভ্রাকে আলতো করে জড়িয়ে ধরে। সুমনের বুক ভিজিয়ে শুভ্রা কাঁদে অনেকক্ষণ।
পোস্তগোলা শ্মশানঘাটে শুভ্রার পরিবারের সাথে সুমনও আসে। শুভ্রার দাদা সম্রাট যখন মায়ের চিতায় মুখাগ্নি করেন শুভ্রা অপলক তাকিয়ে থাকে। ওর চোখ থেকে জল শুকিয়ে গেছে। চিতার আগুনের প্রতিফলন হয়ে ওর চোখে ক্রোধের আগুন জ্বলজ্বল করতে থাকে। সুমন বোঝে শুভ্রার শোক ছাপিয়ে স্থান করে নিয়েছে কিছু করতে না পারার অক্ষমতার আক্রোশ। এই বোধের সাথে পরিচিত সুমন। শাশ্বতী চলে যাবার পর এই বোধ ওকেও পুড়িয়েছিল অনেক দিন। মেয়ে দু’টো না থাকলে সুমন জ্বলে ছাই হয়ে যেত। ওদের হাত ধরে সুমন আবার ফিরে এসেছিল সাম্যতার পৃথিবীতে। সোম চলে যাবার পর মাকে অবলম্বন করে শুভ্রা ফিরে পেয়েছিল স্বাভাবিকতা। এখন কে মুছবে শুভ্রার শোক? বিষণ্নতার কুয়াশা থেকে কি বের হয়ে আসতে পারবে শুভ্রা?
দু’দিন পর সুমন ফোন করে শুভ্রাকে, ‘কেমন আছ?’
‘এ সময় যেরকম থাকা যায়।’ শুভ্রা শুকনো স্বরে বলে।
‘কলেজে যাওয়া শুরু করেছ?’
‘হ্যাঁ। কাজে ডুবে যতটুকু ভুলে থাকা যায়।’
‘বই মেলায় আসবে আজকে?’
‘না হৈচৈ ভাল্লাগে না।’
‘আমি আসব তোমার বাড়িতে?’
‘আসতে চাইলে আসতে পার।’
সুমন হেঁটে পনের মিনিটের মধ্যে পৌঁছে যায় শুভ্রার এ্যাপার্টমেন্টে। বেশ কড়াকড়ি এই কমপ্লেক্সে। দু’ দফা তালা দেওয়া গেট। তার সাথে চব্বিশ ঘন্টা দু’জন উর্দি পরা সিকিউরিটি গার্ড। সুমনের নাম ফোন নম্বর খাতায় লিখল। তার পর শুভ্রাকে ফোন করে খবর দিল সুমনের আগমনের কথা। সিসিটিভি ক্যামেরায় দেখে শুভ্রা বলল সুমনকে উপরে নিয়ে আসতে।
‘এ দেখি কঠিন অবস্থা! এত কড়াকড়ি আর কোথাও দেখি নি।’ সুমন সোফায় বসতে বসতে বলে।
‘আমার যা অবস্থা তাতে এটুকু সতর্কতা নিতে হয়। প্রতিদিন ফোনে, চিঠিতে, ই-মেলে, ফেসবুকে আমার মৃত্যুর পরওয়ানা আসে। শুনেছি আনসারুল্লাহর লিস্টে আমার নাম উঠেছে। এই দূর্গের মধ্যে থাকি। সবসময় গাড়িতে করে চলাফেরা করি। একা কোথাও যাই না বিশেষ করে সন্ধ্যার পর। এভাবেই দিন পার করছি। সাবধানে। সতর্কতায়।’
‘শুভ্রা তুমি শুধু শুধু কেন পড়ে আছ এই দেশে? ব্লগিং তো তুমি যে কোনো জায়গা থেকেই করতে পারবে। তোমার এডুকেশনে অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির পিএইচডি। কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি পাওয়া তোমার জন্য কঠিন হবে না। তোমার যে শেষ টানটুকু ছিল তাও তো চলে গেল। শুধু শুধু এই পোড়ার দেশে সারাক্ষণ ভয়ের যন্ত্রণায় পড়ে থেকে কি করবে?’
‘কোথায় যাব সুমন? আমার তো কেউ নেই বিদেশে। বিদেশে চলে গেলে হয়তো নিরাপত্তা আসবে কিন্তু আমার একাকীত্ব কি কাটবে? এই মাটিতে জন্ম থেকে আছি। আমার ছাত্র-ছাত্রী, বন্ধু-বান্ধব আর সর্বোপরি এই মাটির মায়া আমাকে ছায়া দিয়ে রাখবে।’
‘কিন্তু তোমার যদি কিছু হয়ে যায়?’
‘সেটা যেন না হয় তার জন্য তো প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা করছি।’
‘তবু...’ বলতে বলতে সুমনের গলা ধরে আসে। তারপর বুকের ভেতর সাহস জমা করে বলে, ‘শুভ্রা বিদেশে গেলে তুমি কিন্তু একা থাকবে না। তোমার পাশে থাকার লোক আছে। আমার ওপর ভরসা হয় না তোমার?’
সুমনের কথায় একটু চমকে ওঠে শুভ্রা, ‘তুমি কি নিউ ইয়র্কে তোমার সাথে থাকার প্রস্তাব দিচ্ছ?’
‘হ্যাঁ প্রস্তাব দিচ্ছি। যদিও জানি এটা ঠিক সময় নয়। তোমার মন মায়ের শোকে বিপর্যস্ত। আবার হয়তো বা এটাই ঠিক সময়। তোমার যন্ত্রণা, একাকীত্ব আমার সাথে ভাগ করে নেওয়া যায় না?’
শুভ্রা চোখ তুলে স্পষ্ট করে তাকায় সুমনের দিকে। পর্দার আড়ালে থাকা পলায়নপর এই মানুষটাকে কি ওর যুদ্ধের সঙ্গী করা যায়? সুমনকে ভালো লাগে শুভ্রার। ভালো লাগে ওর কবিতা, ব্যক্তিত্ব, কথা বলার ভঙ্গী। কিন্তু প্রতিদিনের পাশে থাকার মানুষের সাথে যদি জীবনপ্রণালীর মিল না হয় তাহলে কি তার সাথে থাকা যায়? মা কোনোদিন শুভ্রার কোনো কাজে বাধা দেননি। শুভ্রাকে বলেছেন যদি নিজের কাছে শুভ্রা স্বচ্ছ থাকে তাহলে মায়ের জন্য সেটুকু যথেষ্ট। সুমনের সাথে নিউ ইয়র্কে গেলে সুমন কি শুভ্রাকে বদলে ফেলতে চাইবে? শুভ্রাকে কি বলবে, ‘তোমার লেখালেখি বন্ধ কর। তোমার জন্য দেশে গিয়ে মন খুলে ঘুরতে পারি না।’ না সেরকম জীবন শুভ্রার চাই না। আবার শুভ্রার তো একজন সঙ্গী দরকার। মনে মনে কিছু কথা গোছায় শুভ্রা।
‘সুমন, এত কিছুর পরও আমি কেন দেশে আছি যেন? আমি মনে করি আমার একটা কর্তব্য আছে। পরবর্তী প্রজন্মকে তৈরি করার কর্তব্য। তুমি বলেছিলে না তর্ক করে তুমি কোনো কিছু বদলাতে পার না। তার কারণ কি জানো? যার সাথে তর্ক করছ তার জ্ঞান আর শিক্ষার সীমাবদ্ধতা। ধর্মের মূল দর্শন যদি আত্মস্থ করতে পার তাহলে কেন তুমি অসহিষ্ণু হবে? কেন ধর্মের নামে তোমার হাতে চাপাতি তুলে নেবে? মানুষকে প্রকৃত শিক্ষায় শিক্ষিত করতে হবে। আমি কিন্তু আমার ব্লগে কোনো নোংরা কথা লিখি না। আমার ভাষা পরিশীলিত, মার্জিত। আমি যুক্তি দিয়ে কুযুক্তিকে খন্ডন করি। আমি কাউকে দোষ দেই না। আমি আমার উপলব্ধি, আমার বোধকে উপস্থাপন করি। তাই আমার ছাত্র-ছাত্রীরা আমার লেখা এত পছন্দ করে। আমি কাউকে বলি না কি করতে হবে। আমি বলি তোমরা সবকিছু পড়। ধর্মগ্রন্থ, বিজ্ঞান, দর্শন সব। জন্মসূত্রে আরোপিত বিশ্বাসে নিজেকে বন্দী না করে মনের সব জানালা খুলে দাও। তারপর সব কিছু আত্মস্থ করে নিজে ঠিক কর তুমি কি করবে। আর যাই ঠিক কর না কেন কখনো ভেব না তুমি যা ভাবছ তাই ঠিক আর অন্যরা যা ভাবছে তা বেঠিক। কখনো মনে কর না তোমার ধর্ম, তোমার চিন্তা, তোমার দর্শন সবচেয়ে ভালো, সবচেয়ে ওপরে। যুগে যুগে এই বোধ থেকেই সৃষ্টি হয়েছে ধর্মযুদ্ধ, হলোকস্ট, এথনিক ক্লিনজিং। আমি বলি সহিষ্ণু হও। উদার হও। শিক্ষিত হও। কি জানো সুমন গত পনের বছর ধরে এই চর্চায় আমার সফলতা কিন্তু কম নয়। আমার হাত ধরে যে সব ছাত্র-ছাত্রী বের হয় আমি দৃঢ় বিশ্বাসী তাদের কেউ কোনোদিন চাপাতি তুলে নেবে না, শরীর জড়াবে না আত্মঘাতী বেল্টে। স্বীকার করি দেশে অনেক সমস্যা আছে। কিন্তু অন্য অনেক দেশের তুলনায় আমাদের অবস্থা কিন্তু অনেকটাই ভালো। আর তাতে আমার মতো আরো অসংখ্য মানুষের অবদানকে কিন্তু খাটো করে দেখতে পারবে না।
বরং তুমি এক কাজ কর সুমন। তোমার মেয়েদের তো কলেজে যাবার সময় হয়ে গেছে। ওরা বাড়ি ছেড়ে চলে গেলে একা একা কি করবে তুমি নিউ ইয়র্কে? চলে এস আমার পাশে। আমরা দু’জনে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে আগামী প্রজন্মকে গড়ে তুলি। তোমার কাজ কম্পিউটার নিয়ে। কত সুযোগ এখন দেশে! তোমাকে চাকরিও করতে হবে না। শুধু কনসালটেন্সি করেই জীবন চালাতে পারবে। আমি ডাক দিচ্ছি তোমাকে সুমন। তুমি আসবে?’
শুভ্রা হাত বাড়িয়ে দেয় সুমনের দিকে। সুমনের বুকের ভেতর পরস্পরবিরোধী চিন্তা আর যুক্তির সংঘাত চলতে থাকে। একদিকে শুভ্রাকে পাশে পাবার প্রলোভন, নতুন প্রজন্ম গড়ে তোলার উঁচু আদর্শ। অন্যদিকে নিউ ইয়র্কের বলয়ের মধ্যে সুমনের সুষম জীবন। এই তো একা একা হেঁটে সুমন চলে এল শুভ্রার বাসায়। ঢাকায় এসে শুভ্রার সাথে থাকলে হারিয়ে যাবে এই স্বাধীনতা। সুমনের কর্মপ্রণালী কি ছাপ ফেলবে না রুমা আর ওর পরিবারের ওপর? সুমন সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। হাত বাড়িয়ে ধরতে পারে না শুভ্রার হাত। মাথা নীচু করে চুপ করে বসে থাকে। শুভ্রা কিছুক্ষণ পর বাড়ানো হাত গুটিয়ে আনে কোলের ওপর॥


মন্তব্য

সুজন চৌধুরী এর ছবি

ভাল লাগলো পড়ে।
আমাদের এই সময়ের গল্প-উপন্যাসে ব্লগারদের বিষয়টা আসা খুবই প্রয়োজনীয় হয়ে উঠেছে, না হলে এই সময়ের চরিত্রটা বোঝা খুব মুশকিল হবে পরে।

সোহেল ইমাম এর ছবি

আরো লেখা আসুক। চলুক

---------------------------------------------------
মিথ্যা ধুয়ে যাক মুখে, গান হোক বৃষ্টি হোক খুব।

অতিথি লেখক এর ছবি

ভাল লাগলো।

ফাহমিদুল হান্নান রূপক

সাক্ষী সত্যানন্দ এর ছবি

চলুক

____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?

সুলতানা সাদিয়া এর ছবি

‘তোমার লেখালেখি বন্ধ কর।

আজকাল এই কথাটা ঘরের লোকজন নিয়মিত বিরতিতে বলছে। ব্লগার জানলে তো আঁতকে উঠবে।

-----------------------------------
অন্ধ, আমি বৃষ্টি এলাম আলোয়
পথ হারালাম দূর্বাদলের পথে
পেরিয়ে এলাম স্মরণ-অতীত সেতু

আমি এখন রৌদ্র-ভবিষ্যতে

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।