জুন ৫ , লে। রাত ৯ টা ৪৫
দূরে ধুসর পাহাড়, নীল আকাশ, দিগন্ত বিস্তৃত নীল জলরাশি। আমির খান খেলনা এরোপ্লেন ওড়াচ্ছেন আকাশে। সঙ্গে একরাশ কচিকাচা। ক্লোজ শটে করিনা এগিয়ে আসছেন একটা পুরোনো স্কুটার চড়ে।পরনে কনের বেশ। ব্যাকগ্রাউন্ডে নীল অতল জলরাশি ।
কাট টু ট্র্যাভেলার গাড়ীর জানালায় ছোট্ট জলরাশি বড় হচ্ছে। দূরের পাহাড়ে ঠিকরে পড়ছে বিকেলের রোদ্দুর। গাড়ী যত এগোচ্ছে, তত ওয়াইড অ্যাঙ্গেলে নীলজলরাশি, দূরের পাহাড় প্রসারিত হচ্ছে।
প্রথমটা আমির খান অভিনীত ‘থ্রি ইডিয়টস’ ছবির শেষ দৃশ্য। আর দ্বিতীয়টি আমাদের প্যাংগং লেক দেখার প্রাথমিক অভিঘাত।
ভারত- চীন সীমান্তে অবস্থিত এই প্যাংগং লেক। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১৪২৭০ কিলোমিটার উঁচুতে অবস্থিত এই নোনা জলের হ্রদ ১৩৪ কিলোমিটার লম্বা, যা ছুঁয়ে আছে দুটো দেশকে – ভারত ও চীন।
লে শহর থেকে প্রায় ১৭০ কিলোমিটার দূরে এই স্বপ্নের যায়গায় পৌছাতে গেলে সকাল সকাল রওনা হতে হবে আপনাকে, লে থেকে, যেমনটা আমরা বেড়িয়েছিলাম। গাড়ী এগোচ্ছে লে-মানালী হাইওয়ে দিয়ে।। তো, লে শহর থেকে ১৫ কিলোমিটারের মত এগোলেই সে মনেস্ট্রী।
১৬৫৫ সালে স্থাপিত। বেশ পুরোনো সেটা অবশ্যি দেখে বোঝার উপায় নেই। মনেস্ট্রীতে দেখা মিলল আবাসিক লামাদের সাথে। আরো একটু গিয়ে, কারু থেকে চাংলা পাসের দিকে এগোলে জানালার বাইরে তাকালে চোখ আঁটকে গেল চেমরে মনেস্ট্রীতে (Chemrey Monestry)। আপাতদৃষ্টিতে দেখে মনে হবে যেন একটা ধ্বংসপ্রাপ্ত টিলা।
রাস্তা কোথাও মসৃন, কোথাও হিমবাহের বয়ে আনা পাথর দিয়ে কিছুটা বিপদসংকুল, যা প্রতিনিয়ত যানবাহন চলাচলযোগ্য করে রেখেছে বি.আর.ও ( বর্ডার রোড অর্গানাইজেশন)। একটা সময় গাড়ী থামল চাংলা পাসে।
সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১৭৫৯০ ফুট উঁচুতে অবস্থিত এই পাস বিশ্বের দ্বিতীয় উচ্চতম গাড়ী চলাচলের রাস্তা।আর আছে চাংলা বাবার মন্দির। স্থানীয় লোকেদের বিশ্বাস, এই চাংলা বাবাই সমস্ত প্রাকৃতিক বিপর্যয় থেকে রক্ষা করে। একটু পরেই গাড়ী থেকে নামতেই সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে এগিয়ে দেওয়া ধোঁয়া ওঠা গরম চায়ের আদুরে আতিথেয়তা। সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে তৈরী করে দেওয়া হয়েছে চা ক্যান্টিন, শৌচালয়। পুরোটাই নিখরচায়। উষঢ় উপত্যকায় কোথাও জন্মেছে ঘাস। আর তার খোঁজেই হাজির কয়েকটা ঘোড়া। পেছনে সারিবদ্ধ পর্বত শ্রেণী, আর উপত্যকায় চারণরত সাদা ঘোড়া।
আবার গাড়ী ছাড়ল। কিছুক্ষন এগোনোর পর আরো এক বিস্ময়। বিরাট উপত্যকার একটা অংশ পুরোটাই সাদা বরফে ঢাকা।
কোথাও হিমবাহ গলা জল পুনরায় বরফে পরিণত হয়েছে, কোথাও জল জমে বরফে পরিণত হবে, অপেক্ষায় আছে। সেখানেই হুটোপুটি, ক্লিকবাজি। আর উচ্চতাজনিত কারনেই হাঁসফাঁস।
পাহাড়ের গা বেয়ে আরো একটু এগোতেই নিচে চোখ রাখতেই দেখলাম সেনা ছাউনি। ওপর থেকে দেখে মনে মচ্ছে দেশলাইয়ের বাক্স সাজিয়ে রাখা হয়েছে একের পর এক।
এখানেই বসে আছে এক মাঝবয়েসী। সামনের দুটো ভাঙা দাঁতের কারনে হয়ত ক্যামেরার সামনে হাসতে লজ্জা পাচ্ছেন। প্রাথমিক অভিবাদনের পর লজ্জা কাটল একটু। একটা হাসি হাসলেন মন খুলে।
এবারে লাঞ্চ ব্রেক। প্রবল শৈত্যে আড়ষ্ট হাতেই চলল পেটপুজো। সেখানে দেখা মিলল একদল অভিবাসী শ্রমিকদলের সাথে। ওরা নেপালে থাকে। এই জনমানবহীন প্রান্তরে রাস্তা সারাইয়ের শ্রমিক হিসাবে কাজ করে ওরা। ক্যামেরার সামনে বাপ বেটিতে মিলে পোজ দিল।
কারাকোরামের গা বেয়ে গাড়ী এগোচ্ছে আর রুক্ষ উষড় পর্বতমালা তার মেকাপ বিহীন সৌন্দর্য নিয়ে অবাক করবে আপনাকে। কোথাও চারদিক পাহাড়ে ঘেরা ছোট উপত্যকা, হিমবাহের জলসিঞ্চনে সিক্ত কিছুটা সবুজ, উষড় পর্বতমালার মাঝে যা চোখের ‘ষ্ট্রেইন রিলিভার’। কোথাও উপত্যকার মাঝে চোখে পরবে চারণরত লাদাখি মহিলা আর তাকে ঘিরে শ-খানেক পশমিনা ছাগল, যা দিয়ে তৈরী হয় সুবিখ্যাত কাশ্মিরী পশমিনা শাল।
রাস্তার ধারে চোখে পড়ল একটা বোর্ড। ‘মারমট ক্রসিং পয়েন্ট’। ব্যাপারটা কি, দেখার জন্য গাড়ি থেকে নামলাম। উত্তরবঙ্গের বাসিন্দা হবার সুবাদে ‘এলিফ্যান্ট ক্রসিং পয়েন্ট’এর সাথে আমরা পরিচিত। ব্যাপারটা কি? দেখতেই হয় তাহলে। ইতিউতি ঘুড়ে বেড়াচ্ছে কাঠবিড়ালি সদৃশ্য ‘মারমট’।
কখনো আপনার মোবাইল ক্যামেরার সামনে পোজরত আবার কখনো গাড়ীর সামান্য আওয়াজেই গর্তে লুকোনো আদুরে খাস লাদাখি জন্তু।
এভাবেই চড়াই উৎড়াই পেরিয়ে এগোচ্ছে গাড়ি। একটা উত্তেজনা কাজ করছে ভেতর ভেতর। দুটো পাহাড়ের মাঝে গাঢ় নীলের আভা। ওটাই আমাদের স্বপ্নের প্যাংগং।
আকাশটা যেন আরো বেশী বেশী নীল। হ্রদের জলটাও তাই। গোটা আকাশটাই যেন নেমে এসেছে হ্রদের জলে। দূরে কারাকোরামের শ্রেনী। সারিবদ্ধ। বিকেলের রোদে রাঙা।
ক-হাত দূরে জলে ভাসমান বাদামী গলা ওয়ালা হাঁস(Brown headed gull)। খাস প্যাংগং এর বাসিন্দা। কখনো উড়ছে, আবার চক্কর খেয়ে নীল জলে।
আরো দেখা মিলল কিছু নাম না জানা পরিযায়ী পাখির সাথে।
আর ঐ যে ধুসর পাহাড়ের গায়ে উড়ছে হলুদ রঙের হাঁস(Brahminy duck)।
জনমানবহীন এই অঞ্চলে গুটিকয়েক পর্যটক আবাস। সাগরপিঠ থেকে চোদ্দ হাজার ফুট উঁচুতে প্রবল শৈত্যপ্রবাহকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে পর্যটকদের মনোরঞ্জনের জন্য নিরলস পরিশ্রমে রত এখানকার হোটেলকর্মীরা।
রাতে প্রবল হাওয়ার দোসর হয়ে আসে জলের শব্দ। আর সকাল হওয়ার আগেই ঘুম ভাঙে হ্রদের দেশের ভোর দেখার নেশায়। এই ভোর ধীরে ধীরে সকাল হয়। গাঢ়তর হয় বিস্ময়। সকাল দুপুর হয়। আর রাত নামে। লে তে ফিরেও সে বিস্ময়ের ঘ্রান মলিন হয় না মোটেই।
***********************
# দীপালোক
মন্তব্য
এ জনমে আর লাদাখ যাওয়া হবে না মনে হয়!
অনেকদিন পরে সচলায়তনে লগ-ইন করলাম। ঢুকেই চোখে পড়া লেখা আর ছবি ভালো লাগলো।
___________________
ঘুমের মাঝে স্বপ্ন দেখি না,
স্বপ্নরাই সব জাগিয়ে রাখে।
ছবিগুলি অনেক ভালো এসেছে। ম্যাচ বাক্সগুলির ছবিটা সবচেয়ে ভালো লেগেছে, আর ওখানে যে মারমট আছে সেটা আমার জানা ছিল না।
লাদাখ দেখার ইচ্ছেটা ধীরে ধীরে অবসেশনে পরিণত হচ্ছে।
------------------------------------------------------------------------------
জিপসিরা ঘর বাঁধে না,
ভালবাসে নীল আকাশ
চার পর্বই একসাথে পড়ে শেষ করলাম। অসাধারণ। রোমাঞ্চকর। আনন্দময়। ছবিগুলো স্বপ্নের মতো সুন্দর। ছবির পেছনের গল্পগুলোও। লাদাখ ভ্রমণের স্বপ্নটা স্বপ্নেই থেকে গেছে। তাই আপনাদের গল্প শুনেই এ যাত্রা আনন্দিত।
লেখা প্রকাশের আগে বানানগুলো একটু দেখে দিলে ভালো হতো। আরো আনন্দ ভ্রমণের লেখা আসুক।
-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?
লাদাখ যাওয়ার ইচ্ছেটা তীব্র থেকে তীব্রতর করে তুললেন। না যাওয়া পর্যন্ত শান্তি পাব না। ছবিগুলো দারুণ, সেইসাথে মচমচা বর্ণনা। চলুক।
ফাহমিদুল হান্নান রূপক
নতুন মন্তব্য করুন