বাক্স

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: বুধ, ১৩/০৯/২০১৭ - ৯:৩০অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

ঘুম থেকে উঠে গুণে গুণে তিরিশটা বুকডন আর উনিশবার সিঁড়ি দিয়ে উঠানামা করার পর ভাদ্রমাসের তালপাকা গরমে হাঁপাতে থাকা ধাঙ্গড়দের তিনঠ্যাঙে নেড়ি কুকুরটার মতো আধা হাত জিব্বা বের করে দম নিতে নিতে বাম চোখের কোনা দিয়ে দেখলাম বাক্সটা এখনও মেঝের উপর পড়ে।

বাক্সটা ভিটালির, এসেছে দিন সাতেক আগে। আমার রুমমেট ভিটালির কেনার বাতিক আছে। এমন নয় যে তার বিস্তর টাকা, বরং উল্টোটাই সত্যি, তবে কিনা আজকাল তো আর কিনতে টাকা লাগেনা- তাই যখন তখন যা ইচ্ছে তাই কিনছে। কিনছে-খুলছে-ধরছে-নাড়ছে আর দুদিন পর ফেরত পাঠাচ্ছে। টাকা যে লাগে না সে কি আর এমনি এমনি বলি! টাকা তার ট্যাঁকেই ট্যাঁসে থাকে।

দেখে দেখে আমার সয়ে গিয়েছে। আজকাল ফিরেও তাকাই না, তা সে সেলাইয়ের কল কিংবা সৌরচালিত হামানদিস্তা অথবা নেপালি কুকরি যাই হোক। তবে এবারের ব্যাপারটি আমাকে ভাবিয়ে তুলেছে। সাতদিন ধরে মেঝের উপরে একটা বাক্স দুই ঘনফুট জায়গা নিয়ে অনড় অচল বিন্ধা পর্বত হয়ে বাথরুমে যাবার পথটাকে দুর্গম করে রেখেছে অথচ ভিটালির কোন বিকার নেই। তিন দিনের দিন আর থাকতে না পেরে জিগ্যেস করেছিলাম,

“খুলবে না?”
“ভাবছি।”

ভাবনা আর ফুরোয় না। কিসের এতো ভাবনা!

ভিটালি গিয়েছে শপিং মলে রেকি করতে। দোকানে দোকানে ঘুরে কিছু একটা পছন্দ করবে, তারপর ফিরে এসে অনলাইনে অর্ডার। বাক্স আসে বাক্স যায়, তিন চারদিনের বেশি স্থায়ী হয়না কোনটিই- এই বাক্সটা ব্যাতিক্রম। খুব শক্ত করে নাইলনের দড়ি দিয়ে বাঁধা, গায়ে মোটা মোটা হরফে লেখা- হ্যান্ডেল উইথ কেয়ার। কী আছে ভেতরে!

ভাবতে ভাবতেই ভিটালির ফোন এলো -
“আমাকে একটা কাজে দু দিনের জন্য শহরের বাইরে যেতে হচ্ছে। তোমার কাছে একটা ফেভার চাইছি।”
“কী ফেভার?”
“একটা ডেলিভারি আসবে কাল। তেমন কিছু না, শুধু একটা রিটার্ন স্লিপ। তুমি যদি দয়া করে স্লিপটা বাক্সের গায়ে সেঁটে পোস্টঅফিসে দিয়ে আসো তাহলে বড় উপকার হয়।”

সেকি, না খুলে না দেখে ফেরত দিয়ে দেবে বাক্সটা! ভেতরে কী রয়েছে জানার জন্য আমার প্রাণটা কুড়কুড় করে উঠে।

ভীষণ প্যাঁচালো গিঁট, ডানহাতের বুড়ো আঙুলের নখটা ভেঙেই গেলো খুলতে গিয়ে। রান্নাঘরে গিয়ে ভিটালির নেপালি কুকরিটা নিয়ে এলাম, এই একটা জিনিসই সে ফেরত দেয়নি।

খুব সাবধানে বাক্সের গায়ে কোন আঁচড় না লাগিয়ে দড়িটা কাটলাম, বলা তো যায়না, ছিঁড়ে গেলে যদি ফেরত না নেয়! একটা প্লাস্টিকের র‍্যাপার দিয়ে তুতানখেমেনের মমির মতো স্তরে স্তরে মোড়ানো বাক্সটা। র‍্যাপারেই শেষ নয়, শেষ ধাপে ঢাকনার এমাথা ওমাথা জুড়ে রয়েছে পুরু টেপ। কুকরি দিয়ে টেপ কেটে ঢাকনা খুলতেই নাকে ভেসে এলো মিষ্টি একটা গন্ধ। মন ভালো করে দেওয়া মিষ্টি। পারফিউম নাকি!

নাহ পারফিউম নয়, গন্ধটা শোলার। সুগন্ধি শোলা, খদ্দেরদের ধরে রাখার জন্য কত যে কায়দা বেরিয়েছে আজকাল! ভিটালির মতো মানুষ তো আর কম নেই। শোলার টুকরো গুলো সরিয়ে দেখি ভেতরে আরেকটা বাক্স, তার উপর একটা চিঠির খাম, আঠা দিয়ে মুখ বন্ধ। এত দূর চলে এসে থেমে যাবার কোন মানে হয় না। যা আছে কপালে বলে ছিঁড়েই ফেললাম খামের মুখ।

একপাতার একটা চিঠি। সেখানে গোটা গোটা অক্ষরে লেখা,

“অভিনন্দন!! বকারিনি এন্ড কোং এর একশ একত্রিশতম ক্রেতা হিসেবে আপনাকে ভাগ্যবানই বলতে হবে। এটিই আমাদের শেষ চালান। আপনাকে আরও একবার মনে করিয়ে দিতে চাই যে বাক্সটি খুলে ফেলার পর ভেতরে যা রয়েছে তার দায়িত্ব শুধুই আপনার। নিজ দায়িত্বে খুলবেন। কোন দ্বিধা থাকলে না খুলে ফেরত পাঠিয়ে দিন। আমাদের কাছে পৌঁছানোর চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে আপনি আপনার টাকা পেয়ে যাবেন।”

কী করব এখন! ইচ্ছে করছে খুলে দেখি, আবার মন বলছে যথেষ্ট হয়েছে, আর নয়।

বাক্সটা বেশ ভারি। তুলে একটু ঝাঁকুনি দিয়ে দেখলাম, একেবারে নিরেট। খুলবো নাকি খুলবো না, খুলবো নাকি খুলবো না! দুত্তোর, খুলেই ফেলি।

খুলতেই মুখে আগুনের হলকা লাগার মতো একটা অনুভূতি হলো, চোখ বন্ধ করে ফেলেছিলাম। বন্ধ রাখলেই ভালো হতো।

বাক্সের ভেতরে একটা মাথা। মানুষের মাথা, একুশ বাইশ বছরের অনিন্দ্য সুন্দরী কোন এক তরুণীর ফ্যাঁকাসে মুখ, চোখ দুটো খোলা, নিস্পলক চেয়ে আছে আমার দিকে। গলার কাছটা মোম জাতীয় কিছু একটা দিয়ে মসৃণ করে আটকানো।

আমি জ্ঞান হারালাম।

…………………………………

“অ্যাই ওঠো, অনেক বেলা হয়েছে।”

ট্যামির যন্ত্রণায় চোখ বুজে থাকার উপায় নেই। চোখ বুজে থেকেই বা কী লাভ, কান তো আর ঢেকে রাখা যায়না।

“বলি আর কত পড়ে পড়ে ঘুমোবে, স্কুলের দেরি হয়ে যাচ্ছে!”

আমাদের দুটি ছেলে, ইভান আর নিহিল। ট্যামির পাল্লায় পড়ে বছর পাঁচেক আগে ওদের পিয়ানো স্কুলে ভর্তি করে দিয়েছিলাম। তখন ঘুণাক্ষরেও ভাবিনি ব্যাপারটা দু মাসের বেশি টিকবে। ইভান-নিহিল দুটোই ভীষণ দুরন্ত, ডে কেয়ার থেকে জানিয়েছিলো এ ডি এইচ ডি না কী যেন একটা সমস্যা আছে দু ভাইয়ের। আমি পাত্তা না দিলেও ট্যামি ঠিক ঠিক ইন্টারনেট ঘেঁটে এ ডি এইচ ডির নাড়িনক্ষত্র উদ্ধার করে ছেড়েছে। একদিন ডেকে বলল,

“আমি খোঁজ নিয়ে দেখেছি পিয়ানো শিখলে এ ডি এইচ ডি সেরে যায়।”
“কী সেরে যায়?”
“এ ডি এইচ ডি।”
“সেটা আবার কী! কার হল?”
“মিসেস কার্মালিটা যা বলেছেন সব ভুলে বসে আছো! আমার ধারণা তোমারও এ ডি এইচ ডি আছে। তোমারটা তো আর ঠিক করা যাবে না, টুইনদের নিয়েই ভাবছি আমি। ওদেরকে পিয়ানো শেখাবো। ডাউনটাউনে খুব ভালো একটা স্কুল পেয়েছি, প্রিন্সিপালের সাথে আমার ফোনে কথা হয়েছে। কাল তুমি ছেলেদের নিয়ে যাবে।”

“কাল তো শনিবার!”
“শনিবার তো কী?”
“শনিবারে কোন স্কুল খোলা থাকে নাকি!”

থাকে বৈকি, আর সেকারণেই আমার জীবন থেকে শনিবারগুলো উধাও হয়ে গিয়েছে। সাত সকালে ঘুম থেকে উঠে মুখে একটু খাবার গুঁজেই শুরু হয় আমার ছোটা, ডাউনটাউন প্রায় একঘণ্টার ড্রাইভ। আমি জানতামই না শনিবার সকালে এত ভিড় জমে থাকে হাইওয়েতে। বেশির ভাগ গাড়িতেই বাচ্চাকাচ্চা- কেউ যাচ্ছে গানের স্কুলে, কেউ বাজনার, কেউ বেসবল, কেউ সাঁতার, কেউ আর্ট, কেউ কেউ মার্শাল আর্ট- ডাউন টাউনে যেন শনিবারের স্কুল দিয়ে ঠাসা।

ট্যামির অনেক বুদ্ধি। নিজে না গিয়ে আমার কাঁধে চাপিয়ে দিয়েছে এ ডি এইচ ডির ভার। আমি না জানি গান না বুঝি পিয়ানো। আজকাল অবশ্য সয়ে গিয়েছে, কী বাজাচ্ছে না বুঝলেও কেমন বাজাচ্ছে তা এক আধটু ধরতে পারি।

দুই ভাই হই হই করতে করতে গাড়িতে গিয়ে বসেছে। ট্যামি ঘরের দরজা ধরে দাঁড়িয়ে, স্টার্ট দিতে গিয়েই মনে হল কী যেন একটা বলার ছিল ওকে। গাড়ি থেকে নেমে ট্যামির কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম।

“ফিরে এলে যে! লাঞ্চ ব্যাগ ফেলে গিয়েছো বুঝি?”
“না, তা নয়।”
“তাহলে কী!”
“ভুলে গিয়েছি। ট্যামি, তোমাকে খুব সুন্দর দেখাচ্ছে আজ। আর খুব চেনা চেনা লাগছে, মনে হচ্ছে কোথায় যেন দেখেছি আগে।”
“কী যে ছাই পাঁশ বল তার ঠিক নেই। দশ বছর ধরেই তো আমাকে দেখছ। নাকি অন্য কারো কথা ভাবছিলে?”

চোখ নাচিয়ে আদুরে গলায় বলে আমার বউ। সুন্দর দেখাচ্ছে বললে কোন মেয়েই না খুশি হয়!

ছেলেদের প্রথম ক্লাস হেলেন জ্যাকবস্টেইনের সাথে। হেলেনের বয়স হয়েছে, বেশ দিদিমা দিদিমা চেহারা, সারাদিন বসে বসে উল বোনে। ভেবেছিলাম ছেলেরা পিয়ানো নিয়ে ব্যাস্ত হয়ে পড়লে করিডোরের সোফাতে একটু ঘুমিয়ে নেবো, সে আর হয়ে উঠলো না। আমাকে দেখেই হেলেন উলের গুটি নামিয়ে রেখে বলল,

“নতুন যে বইটা কিনতে বলেছিলাম সেটা পেয়েছো?”

একদম ভুলে গিয়েছিলাম। কিন্তু সত্যি বলে দিদিমাকে কষ্ট দিতে ইচ্ছে করলো না। বললাম,

“এই যাহ্‌ হেলেন, বইটা গাড়িতে ফেলে এসেছি ভুল করে। এক্ষুনি নিয়ে আসছি।”

স্কুলের উল্টো পাশেই ছোট্ট একটা দোকান, ডাউনটাউনের ঝকমকে পরিবেশের সাথে দারুণ বেমানান এই দোকানটার নাম বকারিনি এন্ড কোং।

আমাকে দেখেই অলিভার একগাল হেঁসে বলল,

“সুপ্রভাত ভিটালি। কেমন আছো?”

“আচ্ছা বুড়ো, যতবার আমাকে দেখ ততবার এই বিদঘুটে নামটা ধরে ডাকো, তোমার ডাক্তারের কাছে যাওয়া উচিৎ।”

অলিভার খুব অপ্রস্তুত হয়ে চোখ থেকে চশমা নামিয়ে জামার হাতায় মুছতে মুছতে বলল,

“বয়স হয়ে গিয়েছে ভাস্কর, এ বয়সে মাথায় একবার কিছু ঢুকে গেলে আর বেরুতে চায়না। দোকানের খাতায় ভুল করে তোমার নামের জায়গায় ভিটালি লিখে রেখেছিলাম। দুটো নামই ভি দিয়ে শুরু হওয়াতে এই বিপত্তি।

“সে তো পাঁচ বছর আগের কথা, প্রথম দিনেই না শুধরে দিলাম?”

“তোমার কাছে পাঁচ বছর, আমার তো মনে হয় এই সেদিন। যাই হোক, ছেলেরা কোথায়, ক্লাসে?”
“হ্যাঁ, হেলেনের কাছে রেখে এসেছি। একটা বই লাগবে।”

“কী বই”
“বকারিনির মিনুয়েট, ভলিউম সিক্স। দুটো কপি দিও।”
“বইঘরে তো নেই! তুমি বরং ওইখানটাতে গিয়ে বোসো, আমি স্টক থেকে নিয়ে আসছি।”

বাইরে থেকে ছোটো মনে হলেও দোকানটা আসলে বেশ বড়। ভেতরে তিনটে রুম, একটায় বিভিন্ন ধরনের বাদ্যযন্ত্র, একটায় বই, তৃতীয়টা গুদামঘর। বইঘরে কিছু চেয়ার রাখা, তারই একটায় হেলান দিয়ে বসলাম।

বইঘরে সব সুদ্ধ এগারোটা শেলফ, ছোট খাটো একটা লাইব্রেরি বলা চলে। সামনের সারির কয়েকটা ছাড়া বাকি সবকটা শেলফে ধুলোর আস্তর পড়ে আছে। আজকাল কাগজের বই খুব একটা কেনেনা লোকে, সবার হাতে হাতে হয় ই-রিডার নয়তো ট্যাবলেট। অলিভারের বইঘরটা যেন হারিয়ে যাওয়া একটা সময়ের সাক্ষী। আমি মাঝে মাঝে ধুলোয় ঢাকা সে সময়ে ঘোরাঘুরি করি। ওর সংগ্রহ দারুণ বৈচিত্র্যময়, সংগীতের বই তো রয়েছেই, আছে ভ্রমণ কাহিনী, বয়োগ্রাফি, রান্নার বই, পপসায়েন্স,…………, আর আছে রূপকথা-বিভিন্ন দেশের, বিভিন্ন কালের। আমার খুব ভালো লাগে রূপকথার বই গুলো ধরতে, মোটা মোটা মলাট, তার উপর সোনার জলে ছাপানো নাম, ভেতর হলদে হয়ে আসা পাতা, পাতায় পাতায় টলমলে শৈশব। মাঝ বয়সে এসে নতুন করে রূপকথায় পেয়েছে আমাকে। অলিভার এগুলো বেচবে না, আমি তাই সময় পেলে এসে এসে পড়ে যাই।

অলিভার এতো সময় নিচ্ছে কেন কে জানে! হেলেন নিশ্চয়ই বিরক্ত হয়ে অন্য কিছু একটা শুরু করে দিয়েছে। তা দিক, শনিবার তো আর শেষ হয়ে যাচ্ছেনা। আরও অন্তত পাঁচ বছর, ছুটিছাঁটা বাদ দিলে কম করে হলেও আরও শ’দুয়েক শনিবার। ততদিন সে টিকলে হয়।

চেয়ার থেকে উঠে নয় নম্বর সেলফের তৃতীয় তাক থেকে একটা বই বের করলাম, রূপকথার বই। ভারি অদ্ভুত নাম বইয়ের, “একশ তিরিশটা রঙিন পাখি”।

এমন নাম যে বইয়ের তার মলাট না খুলে থাকা যায়না। খুলতেই চোখে পড়লো প্রথম পাতায় প্যাঁচানো অক্ষরে লেখা,

“যা জানো তা সত্যি নয়, যা দেখ তা মিথ্যে নয়”।

বাহ, মজার কথা তো! পরের পাতায় একটা ছবি- আদ্যিকালের ব্লক প্রিন্টে ছাপা- একটা গোলাপি গাছে পাশাপাশি গা ঠেকিয়ে বসে আছে এক জোড়া হলদে পাখি। ছবির নিচেই গল্পের শুরু-

এক যে ছিল গাছ। সে গাছের গোলাপি শাখা, গোলাপি পাতা, গোলাপি গোলাপি ফুল আর গোলাপি গোলাপি ফল। একটি শাখায় পাখির বাসা। সেই বাসাতে হলদে পাখি, মা পাখি আর বাবা। পাখির বাসায় অনেক ডিম, এক, দুই,……একুশ,………আশি,………একশ তিরিশ। গাছের পরে নিঝুম গাঁ, সেই খানে এক বুড়ো। বুড়োর আছে কলের ঘর। কলের গায়ে হাজার বাতি, হাজার তাদের রং।

কী হয় সেই কলে! জানে বুড়ো, আর জানে তার ছেলে। ছেলের নাম পটাং আর বুড়োর নাম চিৎ। চিৎ পটাং এর এই বাড়িতে কেউ থাকেনা আর। একটা কেবল ছবি আছে, ওই পটাং এর মা’র। কোথায় থাকে মা? হারিয়ে গেছে, কেমন করে, কেউ তা জানেনা।

পাখির বাসায় ঘুমতা ঘুমায় একশ তিরিশ ডিম। একশ তিরিশ স্বপ্ন কাঁপে, বাবা ও মা’র উত্তাপে, দিরিম দিরিম দ্রিম। চোখ উঁচিয়ে বুড়ো, ভাবলো- আরে দুরো, খুব বেশি নয় ওই তো গাছের চুড়ো! যেই ভাবা সেই কাজ- পটাং রে তুই আনতো পেড়ে সবকটা ডিম আজ!

হলদে পাখির হলুদ ডানায়, সবুজ সবুজ ছাট। সবুজ হলুদ লেপটে গেলো, বুকের তলায় লালচে কালো- রক্ত ঝরে, বাবার-মায়ের টলমলে পা, আছড়ে পড়ে। একশ তিরিশ কোমল কুসুম একলা অকস্মাৎ।

চিৎ-পটাং এর কলের ঘরে একশ তিরিশ হাড়ি। একশ তিরিশ স্বপ্ন দেবে আকাশ নীলে পাড়ি। স্বপ্নগুলো কার? নয় ডিমেদের, নয় কো তাদের বাবার কিংবা মা’র। কলের ঘরে কলের বাতি, স্বপ্ন আঁকে কলে। একশ তিরিশ দেশের রাজা খুব রেখেছে বলে।

হাজার বাতির ছয় কুড়ি দশ জ্বলছে টিমটিমিয়ে, ঘুমায় পটাং, চিৎ পাহারায়, সেও পড়ে ঝিমিয়ে।

তারপর একদিন।

নিঝুম গাঁয়ের নিঝুম রাতে ঠক ঠকা ঠক ঠক। চিৎ-পটাং এর কলের ঘরে, উফ কী ভয়ানক! কে মেরেছে তাদের? কলটা কোথায়, কই হারালো একশ তিরিশ শখ?

লোক মুখে যায় শোনা, কে নাকি একা বংশীবাদক, চিৎ এর জানাশোনা। সেই করেছে চুরি।

যদি স্বপ্ন কিনতে চাও, যদি সাহস থাকে বুকে। অনেক দূরের সাগর পাড়ে, অজানা মুল্লুকে। সে এক আজব মানুষ থাকে সন্ধানে যাও তার।

যা জানো তা সত্যি নয়, যা দেখো তা মিথ্যে নয়। স্বপ্ন কেবল অটুট থাকে……………

ঠিক এই সময়ই পকেটে থাকা ফোনটা বেজে উঠলো। ট্যামি ফোন করেছে। হাত থেকে বই নামিয়ে ফোন ধরলাম। ওপাশে ট্যামির উত্তেজিত কণ্ঠ,

“ভাস্কর তুমি কোথায়? হেলেন ফোন করেছিলো, ক্লাস শেষ হয়ে গেছে সেই কখন! ছেলে দুটোকে রেখে কোথায় হারালে তুমি?”

“এই যাহ্‌, বই কিনতে এসে বই পড়তে বসে গিয়েছিলাম। সময়ের কথা আর মনেই ছিল না। আমি এক্ষুনি যাচ্ছি”

“তাই যাও। আর শোন, আসার সময় কেকটা আনতে ভুলো না কিন্তু।”

“কিসের কেক!”

“বাহ ভুলে বসে আছো! ইভান-নিহিলের জন্মদিনের কেক।”

“সরি ট্যামি, কিভাবে যে ভুলে গেলাম!”

আমার ছেলেদের আজ নয় বছর হয়ে গেলো। আমার বিশ্বাস হয় না। এই তো সেদিন ওদের ডায়াপার পাল্টে দিয়েছি, দুজনকে দু’কাঁধে নিয়ে হেঁটে বেড়িয়েছি, এই না সেদিন দাঁত উঠলো ওদের! ফোকলা দাঁতে ফোকলা হাসি, আহারে!
অলিভারের কী হল, বুড়ো গেলো কই?

“অলিভার, অলিভার?”

ক্যাঁচ ক্যাঁচ শব্দ তুলে গুদাম ঘরটার দরজা খুলে বেড়িয়ে এলো বুড়ো। ওর হাতে বিদঘুটে দেখতে একটা বাতি।

“বাতিটা ফেলে দিতে যাচ্ছি। নষ্ট হয়ে গিয়েছে। সব কি আর টিকে থাকে বল? বাড়ি যাও ভিটালি, সময় হয়েছে।”

“আবারও সেই ভিটালি! আমার নাম ভাস্কর হে ভাস্কর”

“ভাস্কর? কিন্তু এই বাতিটার গায়ে যে ভিটালি লেখা!”

বুড়ো কেমন যেন দুখি দুখি একটা চোখে আমার দিকে তাকায়। যাকগে, বয়স্ক মানুষেরা কী ভাবে আর কী বলে তারাই জানে! আরেক শনিবারে জেনে নেবক্ষণ। আজ ইভান-নিহিলের জন্মদিন। আমার সেই ফোকলা ফোকলা বাচ্চা দুটোর জন্য কেক নিয়ে বাড়ি যাবো। ট্যামি আমাদের জন্য অপেক্ষা করে আছে।

দোকান থেকে বের হয়ে চোখ পড়লো আকাশে। আরে আকাশটার রং এমন গোলাপি হয়ে গেলো কখন! ওটা কি মেঘ? কিন্তু মেঘ কি এমন গলে গলে পড়ে! আমার চোখের সামনে রাস্তাটাও গোলাপি হয়ে যাচ্ছে নাকি!

-সমাপ্ত।


মন্তব্য

অতিথি লেখক এর ছবি

আমি লক্ষ্য করিনি আমার আরেকটি লেখা (গ্রহণ) অতিথির কীর্তিকলাপে রয়ে গিয়েছে। তাছাড়া এই লেখাটি বেশ তাড়াহুড়া করে নামানো। আরও কিছু কাজ করে তারপর জমা দেবো ভাবছি। আপাতত মুছে ফেললে কৃতজ্ঞ থাকবো।

----মোখলেস হোসেন

অতিথি লেখক এর ছবি

এই যাহ্‌! দিয়ে দিলেন! আচ্ছা ঠিক আছে।
---মোখলেস হোসেন।

সাক্ষী সত্যানন্দ এর ছবি

আগে সচলের নীড়পাতায় লেখা দেখে ঘুমুতে গেলে সকাল হতে হতে দু'পাতা পেছনে পড়ে যেত। এখন দু'সপ্তাহ গেলেও প্রথম পাতা থেকে সরে না! সচল আবার জমজমাট হয়ে উঠুক। ইয়ে, মানে...

____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?

অতিথি লেখক এর ছবি

আপনি ভাই প্রথম ব্যাচের সাক্ষী। আমি শেষ ব্যাচের বেচারা। হাতে বোরহানির গ্লাস নিয়ে বসে থাকি কিন্তু কাচ্চি আর আসে না। আসলেও দুম করে শেষ হয়ে যায়। তারপর খালি প্লেট নিয়ে বসে থাকি। শেষ ব্যাচের খাওয়া কেমন হইলো যদি একটু জানাইতেন!

---মোখলেস হোসেন।

তাহসিন রেজা এর ছবি

বেশ ভালো লাগলো!

------------------------------------------------------------------------------------------------------------
“We sit in the mud, my friend, and reach for the stars.”

অলীক জানালা _________

অতিথি লেখক এর ছবি

ধন্যবাদ তাহসিন রেজা।
--মোখলেস হোসেন

অতিথি লেখক এর ছবি

বেশ অনেকদিন পর সচলে ঢুঁ মারলাম, এবং শুরুতেই দেখি আপনার নতুন লেখা! নতুন করে মুগ্ধতা প্রকাশ করার প্রয়োজনীয়তা দেখছি না। তবে পুরোন অভিযোগ এখনো আছে। বেশ কিছু কাজ আধখ্যাঁচড়া করে রেখে দিয়েছেন। সেটা কিন্তু খুব অন্যায় হচ্ছে।

-ইকরাম ফরিদ চৌধুরী

অতিথি লেখক এর ছবি

ধন্যবাদ ইকরাম ফরিদ চৌধুরী। আসলে সময়টা অণুকুলে নেই অনেকদিন।

----মোখলেস হোসেন

মেঘলা মানুষ এর ছবি

একটু জটিল লেগেছিল, প্রথমে বুঝতে পারছিলাম না ব্যাপারটা। দ্বিতীয়বার পড়ার পর মোটামুটি বুঝেছি (যদিও এখন নিশ্চিত না অন‌্যকিছু বুঝে বসে আছি কী না!

শুভেচ্ছা হাসি

অতিথি লেখক এর ছবি

পড়ার জন্য ধন্যবাদ মেঘলা মানুষ। আপনি যা বুঝেছেন তাইই গল্প। লেখাটি জমা দিয়েই মনে হয়েছিলো আরেক্টু লিখি। কিন্তু সচল প্রকাশ করে দিয়েছে।

----মোখলেস হোসেন

মৃদুল আহমেদ এর ছবি

আমি বেশ কয়েকবার পড়লাম মোখলেস ভাই। কিন্তু এখনো এন্টেনার ওপর দিয়েই যাচ্ছে। আপনার গদ্য কিন্তু ওস্তাদ দুর্দান্ত!
এনিওয়ে, সচলে স্বাগত!

--------------------------------------------------------------------------------------------
বললুম, 'আমার মনের সব কপাট খোলা ভোজরাজজী। আমি হাঁচি-টিকটিকি-ভূত-প্রেত-দত্যি-দানো-বেদবেদান্ত-আইনস্টাইন-ফাইনস্টাইন সব মানি!'

অতিথি লেখক এর ছবি

আরও কিছু কাজ করার ইচ্ছে ছিলো, প্রকাশ না করার জন্য অণুরোধও করেছিলাম। কিন্তু যাত্রী আসিবার আগেই ট্রেন চলিয়া গিয়াছে।

----মোখলেস হোসেন।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।