দাম তু-আ’র পথে হড়কাবান

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: রবি, ১২/১১/২০১৭ - ১:২৪অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

আড়মোড়া ভাঙা পাহাড়ের কোলে কেবল মিঠে রোদ এসে পড়েছে। না গরম, না ঠাণ্ডা-এমন একটা সকালে শিশির ঝরা ঘাষ মাড়াতে শহরের বুকে ত্রস্ত পায়ে হেঁটে যাওয়া প্রাতঃরাশকারীদের ঢল নামে। পাহাড়ে সেসবের বালাই নেই। কেমন একটা রিল্যাক্স ভাব চারদিকে। ধীরস্থির সবাই যেন বলছে, এত তাড়া কীসের বাছা, একটু জিরো।

বান্দরবানের এই অংশটায় উঁচু পাহাড়ের দেয়াল। দূরে ডিম পাহাড়, কাছের জনপদটা ১৭ মাইল হিসেবে পরিচিত। দার্জিলিং, কালিম্পং বা গ্যাংটকের ওদিকটায় এভাবে মাইলের হিসাব রেখে স্থানীয় অধিবাসীদের জায়গার নাম নির্ধারণ করতে দেখেছি। একই প্রবণতা আছে নেপালের গ্রামগুলোয় বা কান্ট্রিসাইডে। হিমালয় অঞ্চলের মত অতটা ঠাণ্ডা আর উচ্চতা হয় না এখানে। তার তুলনাও করা চলা না। কিন্তু একটা বিষয় কমন, সব পাহাড়ের মধ্যেই কেমন যেন একটা ঔদ্ধত্য ভাব। যেন বুক চিতিয়ে গিরিশৃঙ্গ তার উচ্চতার বড়াই করছে। কঠিন কপট সেই ঔদ্ধত্যের পর্দাটা যারা সরিয়ে দেখেছে, তারা জানে; পাহাড় সবুজ আচ্ছাদনে মিশে যেতে ডাক দিচ্ছে অনবরত।

আলীকদম থেকে ১৭ মাইল বা আদুপাড়া পর্যন্ত এসেছি স্থানীয় স্কুল শিক্ষক মিজান ভাইয়ের সহযোগীতায়। সাথে প্রেসক্লাবের সভাপতি মমতাজ ভাইয়ের দেয়া কিছু তথ্য। মুরংদের একটা ঝর্ণা আছে এদিকটায়। ওরা বলে ‘দাম তু-আ’। মুরুং ভাষায় দাম শব্দের অর্থ মাছ আর তুয়া শব্দের অর্থ শেষ আশ্রয়স্থল। বাংলায় যা দাড়ায় ‘মাছের শেষ আশ্রয়স্থল’। সেনাবাহিনীর অনুমতি নিতে হয় ১৭ মাইল পর্যন্ত বা তার পর যেতে। পাহাড়ি এ রাস্তাটা আলীকদম বাজারের কাছ থেকে শুরু হয়ে ডিম পাহাড়ের নিচ দিয়ে থানচি পর্যন্ত এসে ঠেকেছে। খুব নিরিবিলি, চলাফেরা কম এদিকটায়। সেনাবাহিনী তার রসদ আনা নেওয়া করতে এই রাস্তাটি ব্যবহার করে। ৩৩ কিলোমিটার দীর্ঘ সড়কপথটি এই মুহূর্তে বাংলাদশের সবচেয়ে উঁচু রাস্তা। এই সড়কের মাঝামাঝি জায়গাটাই ১৭ মাইল। এখান থেকেই একটা পাহাড়ি পথ ধরে নিচের দিকে হাঁটা শুরু করেছি সকাল সকাল। সেনাবাহিনীর কড়া নির্দেশ ফিরতে হবে দিনের আলো থাকতে থাকতে। অর্থাৎ থাকার ব্যবস্থা নেই, থাকলেও বা যোগাড় করতে পারলেও সেভাবে থাকা নিষেধ। কী আর করা, দাম তু-আ সাকুল্যে ৬ ঘন্টার ট্রেইল জেনে নিয়ে ১৭ মাইল বা আদুপাড়া থেকে হাঁটা শুরু করলাম। সাথে পাড়ার কারবারি নিয়াধু মুরুংয়ের পক্ষ থেকে দেয়া গাইড থং প্রুং মুরুং ও তার ছোট ভাই রেং সম।


যদিও গাইড নিতে রাজি ছিলাম না আমি। আমার যুক্তি ছিল চারজনের দল আছে আমাদের রাস্তা চিনে ঠিক চলে যাব। সেক্ষেত্রে একটা ম্যাপ এঁকে দিতে বললাম। ওরা রাজি না। বুঝলাম, স্থানীয়দের রোজগারের সুযোগ হাতছাড়া হওয়ার ভয়ে লোনলি ট্রাভেল উদ্বুদ্ধ করা হয় না। কী আর করা, রওয়ানা হলাম অবশেষে ৬ ঘন্টার টার্গেটে ফেরার লক্ষ্য নিয়ে।

ট্রেইলের শুরু থেকেই ছোট ছোট পাড়া, জুম ঘর, ফসলের সবুজ ঢাল মোহাবিষ্ট করে রাখছে।

নিরিবিলি মেঠোপথের দুপাশে কেবল মাঝেসাঝে অচেনা পাখির ডাক। পাতার ঝিরিঝিরি শব্দ, কোথাও হঠাৎ থমকে যাচ্ছি তীব্র স্রোতস্বীনি ঝিরির ডাকে। বার্মিজ পাড়ার পর নাম না জানা এক খাল পাড় হতে হলো। বড় বড় বোল্ডার খালটাকে অনেকটা ঝিরিপথের রূপ দিয়েছে। দুপাশে বুনো ঝোপ ঝুঁকে পড়ে পরিবেশটা রহস্যময় করে তুলেছে। এপথে যেতে একে একে পড়লো তমথৈই পাড়া, নামছাক পাড়া, কাখৈই পাড়া।


শেষ পাড়ায় যখন এসে পৌছলাম ততক্ষণে দুপুর। সময় চলে গেছে আড়াই ঘণ্টা। তারমানে ৬ ঘন্টার ট্রেইলের অর্ধেক মানে, দাম তু-আ যেতে তিন ঘন্টার বেশি খরচ হচ্ছে আমাদের। কারণটা হচ্ছে সাথে থাকার আমার সঙ্গীদের একজন পাহাড়ে হেঁটে অভ্যস্থ নন। এরা সবাই আনকোরা ট্রেকার। তারউপর থেমে থেমে বৃষ্টি হচ্ছে পাহাড়ের এদিকটায়। একজনের জন্য পুরো টিম পিছিয়ে পড়েছি। গাইডকে তাই তার সাথে দিয়ে এগিয়ে গেলাম। পথ চিনতে অসুবিধা হচ্ছিল না। কাখৈই পাড়ায় এসেও থামলাম না। সোজা নেমে গেলাম ঝিরিপথের দিকে। কিছুক্ষণের মধ্যে কানে আসলো পানির শব্দ। কিছুদূর এগিয়ে যেতেই দেখি একটা ক্যাসকেড। অবিরত জল ঝরছে ঢালু শরীর বেয়ে।

মুহূর্তের জন্য ভুলে গেলাম হেঁটে আসার ক্লান্তি। ধারণা করছি এই ক্যাসকেডের পানিই গড়িয়ে দাম তু-আ পর্যন্ত যাবে। থামলাম না। অল্পকিছুদূর পরেই পেলাম নিচ থেকে কান ফাটানো শব্দ। দাম তু-আ।

অপার্থিব গর্জনে সে বুনো পরিবেশটা ভেঙেচুরে দিচ্ছে। কেড়ে নিচ্ছে সবটুকু আকর্ষণ। কোন এক অমোঘ টানে ধীরে ধীরে নেমে গেলাম। তারপর হাঁ করে তাকিয়ে থাকলাম সামনে দিকটায়। দাম তু-আ বা মাছের শেষ আশ্রয়। মূলত তিনটি ধারা বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে ঝর্ণার পানি। আলাদা পাথ সৃষ্টির কারণে তিনটি ঝর্ণা মনে হলেও উৎস একই মনে হলো।

উপরে মুখ তুললাম। আকাশের ততক্ষণে মুখ ভার। অঝোরে নামবে খানিক বাদেই। তাড়া জাগলো মনে। দাম তু-আ’তে কিছু সময় কাটিয়ে ফিরতি পথ ধরলাম। এবার চড়াই বেশি। পনের মিনিটের মত হেঁটেছি কেবল। আকাশ ভেঙে শুরু হলো বর্ষার অঝোর ধারা। দ্রুত পা চালিয়ে অর্ধেক ভিজে অবশেষে চলে এলাম কাখৈই পাড়ায়। কিন্তু দুশ্চিন্তা হচ্ছিল পেছনে থাকা দুইজনের জন্য। ভয় পাচ্ছিলাম বলে তাদের তাড়া দিয়েছি অনেক। সবচেয়ে বেশি ভাবাচ্ছিল বৃষ্টি বাড়লে পাহাড়ি ঢাল আর ঝিরিগুলো। ওরা পানি পেলে মারাত্মক রূপ নেয়। একাধিকবার এ পরিস্থিতি বা হড়কাবানের মুখোমুখি হয়েছি আমি। কিন্তু হায়, কাখৈই পাড়ায় আধঘন্টা অপেক্ষার পরও দুই ভ্রমণসঙ্গীসহ গাইড আসছে না দেখে আবার একটু পিছিয়ে দেখতে গেলাম। আর খাল পাড়েই গিয়েই তাজ্জব বনে গেলাম। খালটা এখন দ্বিগুন চওড়া হয়ে গেছে, আর তার বুক বয়ে চলেছে কাদা গোলানো জল। কী তীব্র সেই স্রোতের গর্জন। কী ভয়ঙ্কর! মানুষ কেন এই পানিতে হাতি পড়লেও খড়কুটোর মত ভাসিয়ে নিয়ে যাবে নিশ্চিত। ওদিকে বেলা বাড়ছে। বৃষ্টি থামার প্রায় দুই ঘণ্টা পর হড়কাবান কমলো। একটা লম্বা গাছ কেটে আমদের গাইডের সহায়তায় ট্রেকারদের খাল পার করলাম। জানি প্রকৃতিকে উপেক্ষা করার ক্ষমতাে এখনো মানুষ আয়ত্ত করেনি। বোঝালাম সবাইকে। তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে নতুন বিপদের মুখে যেন পড়তে না হয় তা বোঝালাম সবাইকে। তারপর ফিরতি পথে একে একে অন্তত ৫-৬ জায়গায় দড়ি বেঁধে ও গাছ কেটে ব্রিজ সাপোর্ট বানিয়ে খাল পার হলাম। এতে অনেকটা সময় লেগে গেল। সময়ের সাথে ক্লান্তি চলে আসায় ট্রেইলের বাকি পথটা আরও দুর্গম হয়ে পড়লো। যখন পথের ৮০ শতাংশ এসেছি, তখন টুপ করে ডুব দিলো সূর্যটা। অন্ধকারে একজন প্রায় খোড়া ট্রেকারকে কাঁধে, পিঠে বয়ে কখনো ঘাড়ে নিয়ে আসছিল আমাদের গাইড। পথের যখন ১০ শতাংশ বাকি তখন গাইডের ছোট ভাইটা ধারালো অস্ত্রে তার আঙ্গুল কেটে ফেললো! কী বীভৎস সেসময়। গামছায় হাতটা পেঁচিয়ে কোনমতে ছেলেটাকে আগেভাগে পাঠিয়ে দিলাম। সবাই তখন তাড়াহুড়ো করছে রাতের মধ্যে আলীকদম পৌঁছাতে। চাঁদের আলোয় বাকি পথটা গন্তব্যের উদ্দেশে হাঁটছি আমরা। রাত তখন ৮ পার হয়েছে। ধারণা করছি আরও একঘন্টা লাগবে আদুপাড়া পৗঁছাতে।অথচ যাওয়া আসায় তিন ঘন্টার বেশি সময় লাগা উচিত না এই ট্রেইলে।


মন্তব্য

সোহেল ইমাম এর ছবি

হড়কাবানের ফুসে ওঠা কাদাগোলানো স্রোতের ছবি পেলে বেশ হতো। কাহিনিটা মনে হলো বেশ হুট করেই শেষ হয়ে গেলো আরো দু’কথার জন্য একটা অপক্ষো থেকেই যায় পড়ার পর।

---------------------------------------------------
মিথ্যা ধুয়ে যাক মুখে, গান হোক বৃষ্টি হোক খুব।

অতিথি লেখক এর ছবি

প্রচণ্ড সে বৃষ্টিতে মোবাইল বা ক্যামেরা কিছুই ব্যাগ থেকে বের করা যায়নি। সে এক দুর্যোগপ্রবণ সময় ছিল। আর লেখার কাঠামো প্রসঙ্গে আপনার দেয়া পরামর্শের জন্য অনেক ধন্যবাদ। আগামীতে এ বিষয়ে লক্ষ্য রাখবো।

মেঘলা মানুষ এর ছবি

একটু বড় ছবি পেলে ভালো লাগতো। সাহসী অভিজান‌গুলো (এবং সাথের এই লেখাগুলো) অব্যাহত থাকুক। আর একটা নিক নিয়ে নিন লেখার জন্য।

শুভেচ্ছা হাসি

অতিথি লেখক এর ছবি

আমি তো এখনো অতিথি লেখক। ৫ বছর আগে একবার ট্রাই করে সচলায়তনের জটিলতা দেখে চলে গিয়েছিলাম। এখন আবার ঢুঁ মারলাম। এখনো নজরদারিতে আছি। ছবি বড় করার প্রসেসটা এখনো বুঝে উঠতে পারিনি। কখা দিচ্ছি সুযোগ পেলে ভালো করার ইচ্ছা আছে।

অতিথি লেখক এর ছবি

আপনার লেখার ধরন খুব ভালো লেগেছে। একটা জায়গায় কেমন যেন খটকা লাগলো, "না গরম, না ঠাণ্ডা-এমন একটা সকালে শিশির ঝরা ঘাষ মাড়াতে শহরের বুকে ত্রস্ত পায়ে হেঁটে যাওয়া প্রাতঃরাশকারীদের ঢল নামে।" এখানে প্রাতঃভ্রমণকারি হবে কি? আর ওই ঘাস বানানটা......। অবশ্য সকাল বেলা প্রাতঃরাশের সন্ধানে শহরে হেঁটে বেড়াতে আমার ভালোই লাগে।

----মোখলেস হোসেন

অতিথি লেখক এর ছবি

ভুল শুধরে নিচ্ছি। ধন্যবাদ।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।