কে বলল, 'দয়া' ভালো গুণ? —মিথ্যে কথা

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: বুধ, ১৯/০৬/২০১৯ - ১১:৩০পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

ব্যস্ত রাস্তার চলমান বাস ট্রাক টেম্পু অটো-বাইক সামনে এসে ডাইনে বাঁয়ে চলে যাবার পরপরই, এপার থেকে ওপারে চোখ ফেললেই, আলিশান বাড়িটার বন্ধ গেটের সামনে যে ভিড়টা দেখতে পাওয়া যাচ্ছে— সেটা মানুষের। মানুষের ভিড়।

মানুষগুলো কি আমাদের ঝাঁ চকচকে সভ্য সমাজের? শরীরে ময়লা কাপড়, তেলছোঁয়াহীন রুক্ষ চুল, কোটরের গর্তে ঢুকে যাওয়া চোখ, ভাঙা বা তোবড়ানো গাল— মানুষগুলোর বেশির ভাগেরই। এপার থেকেই বোঝা যাচ্ছে।

ডাইনে বাঁয়ে দেখে নিয়ে সাবধানে রাস্তা পার হলাম। তারপর যাঁর দিকে এগিয়ে গেলাম, তিনি একজন বৃদ্ধা। চুপচাপ বসে আছেন। ছিঁড়ব ছিঁড়ব টাইপ সাদা শাড়ি, ময়লায় কালচে হয়ে যাওয়া ব্লাউজটাও সাদা, আর শাড়ি-ব্লাউজের ভেতর যে শরীরটা, সেটায় মাংস কতটুকু— কে জানে! তবে দৃশ্যমান হাত দুটো জুড়ে চামড়ার উপর দিয়ে ভেসে আছে কেঁচোর মতো নীল নীল ধমনী। মাথায় সামান্য কিছু চুল, যেগুলোকে পাটের আঁশ থেকে পৃথক করা শক্ত। চোখে ঘোলা গ্লাসের রংচটা ডাটির বয়সী চশমা, যার ভেতর দিয়ে চোখ দুটো স্পষ্ট দেখা যায় না। মুখে বয়সের শত ভাঁজ।

মুখ তুললেন।

'দাদীমা, কেমন আছেন?'

'ভগবান রাইখেছে।'

'আচ্ছা, এখানে কী হবে?'

'কিছু হবে না, বাবা।'

'তাহলে এত লোক যে?'

বৃদ্ধা বেশ পরিচিত একটা জুট মিলের নাম বললেন। তারপর বললেন, 'এইডা ঐ মিলির মালিকির বাড়ি। ইকেনে আমরা যারা গরিব-গুরোব ফকির-ফাকরা লোক আছি, তারা পতি শুক্কুরবার সকালে আসি। মালিক আমাইগের পত্যেক লোককে একশ কইরে টাকা দেয়। এই তো, ইট্টুকুন পরেই গেট খুইলে টাকা দিয়া শুরু করবেনে।'

আমি বিস্মিত হলাম? নাকি আনন্দিত?

হলাম কিছু একটা। কিন্তু উক্ত মিল-মালিকের এহেন দানকার্যে বিস্মিত বা আনন্দিত হয়ে মালিককে ভূয়সী প্রশংসা করা কর্তব্য না? করলাম কি তা? কেন করলাম না? কে জানে! বললাম, 'তাই!'

'হ্যাঁয়, বাবা।'

'মালিক তো তাহলে খুব ভালো লোক।'

'হ্যাঁয় বাবা, খুবই ভালো লোক। এই দেখেন, আমি হিন্দু মানুষ, তারপরেও আমাকে ইট্টুও ঘিন্না করে না। আর বড়লোকগের মতো না, উনার কাছে হিন্দু মোসলমান সবাই সুমান।'

'বাহ্। কতদিন থেকে টাকা দেন?'

'মেলাআআ দিন। আমার মতো ইকেনে অনেকে আছে, যাইগেরকে মেলাআআ দিন ধইরে রেগুলার দেয়। আগে পঞ্চাইশ টাকা কইরে দিত, একন একশ টাকা কইরে দেয়।'

আমি সবার দিকে তাকিয়ে একটু অনুমান করার চেষ্টা করলাম, কত জন হতে পারে। তা ২০-২৫ জন তো হবেই। বললাম, 'এত লোক— সবাইকেই দেন?'

'আগে তো আরো কত কোম লোক আইসত। একন যেই পরিমাণ আসে, আগে এর অদ্দেকও আইসত না। দিন গেলিই লোক বাইড়েই চইলেছে। কিন্তু তাতে কী? মালিক মানুষডা এত ভালো— কারোর উপর ইট্টু বিরক্তও হয় না। ইট্টুও জ্বালাপিটি হয় না, ইট্টুও দুচ্ছাই করে না। আরো কয় গরীব-গুরোব ফকির-ফাকরা যদি আরো পাও, ধইরে আনবা। বুইঝলেন বাবা, কত দয়ালু মানুষ, কত মহান মানুষ?'

ধনী মিল-মালিকের সাপ্তাহিক দয়ার প্রশংসায় দীর্ঘদিন ধরে হাত পেতে দানের অর্থ গ্রহণ করা অনুন্নত বৈষয়িক অবস্থার বৃদ্ধা মানুষটার কণ্ঠে যে ঝরঝরে স্বতস্ফূর্ততা, তাতে তাঁর বয়সী চশমার ঘোলা গ্লাস ভেদ করে দৃষ্টি স্পষ্ট করে না পৌঁছোলেও অনায়াসেই দেখে নেয়া যায়— গ্লাসের তলার চোখ দুটো ভোরের সূর্যালোকের মতোই চিকচিক করছে! বিস্ময়ানন্দে।


এলাকার নাম বলছি না, তবে বাড়ির নাম বলছি। হাজী বাড়ি। বাড়ির কর্তা হজ্জ করে আসার পর এই নামকরণ, আগে অন্য নাম ছিল।

গ্রামের মেইন রোড থেকে বাঁক নিয়ে নেমে গেছে প্রশস্ত ইটরাস্তা। রাস্তার দু'ধারে পাতা-বাহারের সুদৃশ্য গাছ লাইন দিয়ে চলে গিয়ে ছুঁয়েছে বিশাল গেট।

গেট সাধারণত বন্ধই থাকে। খোলা থাকে বিশেষ বিশেষ আনুষ্ঠানিক দিনে। বিশেষ বিশেষ অনুষ্ঠান, যেমন— বাড়ির কারো বিয়ে, মৃত কারো আত্মার মাগফিরাত কামনায় মিলাদ মাহফিল, গরিব-মিসকিনদের ভেতর জাকাতের কাপড় বিতরণ...।

সেদিন জাকাতের কাপড় বিতরণের দিন। হাজী বাড়ির গেট হাট করে খোলা। গ্রামের গরিব-গুরবোরা নিঃসংকোচে ঢুকে যাচ্ছে ভেতরে, বেরিয়ে আসছে অপেক্ষাকৃত হাসিমুখে। হাতে শাড়ি, লুঙ্গি, গামছা...।

মেইন রোড থেকে গেটের দিকে চোখ ফেলতেই দৃষ্টি আটকে গেল একজন খুব পরিচিত পঞ্চাশোর্ধ্ব মানুষের ওপর।

'চাচাজী, আপনি এইখানে!'

'এই যে বাবাজী, হাজী সাহেব আসতি কইছিল, তাই...।'

চাচাজীর বড়ছেলেটাকে একসময় আমিই পড়াতাম। কিন্তু একদিন হঠাৎ করেই পড়াশুনো থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে তাকে কাজে লাগিয়ে দেয়া হল, এসএসসি-টাও দেয়া হল না ছেলেটার। অবশ্য, তা ছাড়া কোনো উপায়ও ছিল না, চাচাজীর আয়-ইনকাম নেই। সংসার চলে খুব কষ্টেসৃষ্টে। বললাম, 'আরিফ তো এখন হাজী সাহেবের কারখানাতেই আছে, না?'

'হ্যাঁয় বাবাজী, এই তো দুই বছর ধইরে উনার কারখানাতেই আছে।'

'বেতন-টেতন কেমন পায়?'

'বেতন বড্ড কম, বাবাজী। বেতনে কোনোরকম মাসের চাইল-তরকারি ছাড়া আর কিছুই হয় না। তবু ছেইলেডার চাকরিডা না থাকলি যে কী হইত! ওর উপরেই সংসারডা টিকে আছে।'

'হাজী সাহেব বেতন বাড়ান না?'

'বাড়ায় আর কই, বাবাজী? এই বছর মাত্র পাঁচশ টাকা বাড়ায়েছে। তবে হাজী সাহেব লোক খুব ভালো।'

'আচ্ছা।'

'এই যে উনি আসতি কইছিল ঈদির কাপুড়-চোপুড় দেবে বইলে। যাকাত আরকি। পতি বছরই দেচ্ছে।'

'আচ্ছা।'

'তাছাড়া এই দেখো, গত বছরও সবাইকে হয় এট্টা লুঙ্গি, নায় এট্টা কইরে শাড়ি দিইছিল। আর এইবার? যারা জাকাত নিতি আইসতেছে, তাইগের পরিবারে যে কয়জন লোক আছে, সবাইর জন্যি কাপুড়-চোপুড় দেচ্ছে। আর অইন্যবার যত লোককে যাকাত দিয়েছে, এইবার তার ডবল লোককে দেচ্ছে! চিন্তা করো, কত বড় মন! মানুষির জন্যি উনার কত দয়া!'

ব্যবসাদার হাজী সাহেবের বাৎসরিক দয়ার প্রশংসায় ছেলের স্বল্প বেতনের টাকায় সংসার চালিয়ে সারাবছর কষ্টেসৃষ্টে বেঁচে থাকা মানুষটার কণ্ঠশব্দে যে আনন্দ, তা সামনে থেকে না দেখলে কেউ বুঝতে পারবে না— আমাদের এইসব সাধারণ সরল মানুষগুলো কত সহজেই খুশি। কিংবা সুখী।


নাসির সাহেব শহরে থাকেন। গ্রামে আসেন শুধু যাকাত, ফিতরা আর কোরবানি দিতে। যাকাত-ফিতরায় তাঁর নাম আছে বরাবরই। নাম ছিল না কোরবানিতে। ছাগল কোরবানি দিতেন। এবার থেকে দেবেন গরু। ইতিমধ্যে প্রতিবেশীদের মধ্যে তা প্রচারিত হয়ে গেছে।

'গত বছর কতজন গোস্ত ভাগে না পায়ে ফেরত গেছে! নাসির সাহেব তা নিজি চোখি দেখিল।'

'হুঁ। তাই দেইখে কীরাম আপসোস করতিল।'

'কতডা ভালো মানুষ না হলি গরিব-গুরোব মানুষির জন্যি কেউ ঐরাম আপসোস করতে পারে!'

'সেই জন্যিই তো এইবার গরু কুরবানি দেবে।'

'হুঁ, যাতে বেশি লোক গোস্ত পায়।'

'যারা গোস্ত তেমন কিনে খাতি পারে না, তাইগের জন্যি নাসির সাহেবের কীরাম মায়া! সত্যি, মানুষডা বড় মহান, মানুষডার অনেক দয়া।'

গ্রাম ছেড়ে যাওয়া প্রতিষ্ঠিত শহরবাসী নাসির সাহেবের বিশেষ কিছু উপলক্ষ্যদিনের দয়ার প্রশংসায় ভেসে যাওয়া চায়ের দোকানের সে আসরে হঠাৎ আমি মুখ ফসকে বলেই ফেলি, "এই যে বছরের পর বছর ধরে কিছু মানুষের এক-দুই দিনের দয়া পাওয়ার জন্য অপেক্ষা করা, এটা কি ভালো গুণ?"

পরপরই সবাই চুপ! চোখগুলো আমার দিকে। গোল গোল। গরম গরম। হাঁটুর বয়সী ছ্যামড়া তুই— মানুষির ভালো-মন্দ গুণির তুই কী বুঝিস রে?


দয়াও কি আমাদের ভালো গুণ?

কী জানি! কে জানে! দয়াপ্রার্থীদের হাঁটুর বয়সী ছ্যামড়া আমি চোখ বুজলেই কেবল দেখতে পাই— ধনী মিল-মালিক, বড় ব্যবসাদার হাজী সাহেব, প্রতিষ্ঠিত নাসির সাহেবরা দিন গেলেই তাঁদের উত্তরোত্তর দানকার্য দ্বারা যতই মহান দয়াবান হয়ে গর্বভরে মাথা উঁচু করে দাঁড়ান, তাঁদের সামনের দয়াপ্রার্থী দারিদ্র্যক্লিষ্ট হেটমাথা মানুষের লাইনগুলো ততই তুচ্ছাতিতুচ্ছ রূপ নিয়ে দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয়ে সীমানা ছাড়ায়...।

সুপণ শাহরিয়ার
১৩ জুন ২০১৯


মন্তব্য

মন মাঝি এর ছবি

লেখাটা গল্প না হয়ে নীতিকথামূলক প্রবন্ধ হয়ে গেল! মন খারাপ

****************************************

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।