ভোর হয়ে এলো

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: বিষ্যুদ, ২৭/০৬/২০১৯ - ১:১৫অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

রাত হলে ঘুমিয়়ে পড়ি, সকাল হলে ঘুম ভেঙ্গে যায়। নিত্য দিনের অভ্যাস -- খুব সহজ বোধ আমাদের। জন্মাবার তিন মাসের মধ্যেই এই নিয়মে অভ্যস্থ হয়ে যাওয়া। এই দিন-রাতের বেলাকে আমরা ভেঙ্গে নেই আরও বেলায়। বিষন্ন দুপুর, ফুরফুরে বিকেল , গোধুলী সন্ধ্যা, সোনালী ভোর।

পৃথিবীর সবথেকে দুর্ভাগ্যজনক শহরে বসবাস আমাদের। গায়ে গায়ে লাগানো অট্টালিকার সারি, যানবাহন, কোলাহল। হেথা যানবাহন চলে না, থেমে থাকে ঘন্টার পর ঘন্টা, আর ভেপু বাজায় বেসুরা কন্ঠে। মানুষের স্রোত। না, স্রোতের গতি নেই, যেন নোংরা ড্রেনে কিলবিল করছে পোকা। শীত আসে ভয়ে ভয়ে, ক্ষনিকের জন্য। বর্ষা নারীর মুখে যেন কেউ এসিড মেরে ঝলসে দিয়েছে, সৌন্দর্য হারিয়েছে সে। গ্রীষ্মের একচেটিয়া আধিপত্য। যেন প্রকৃতির সমাধী হয়েছে এখানে। হেথা দিন আর রাত হয় শুধুমাত্র নিয়মে। দিনের আলো ফোটে, রাতের আঁধার নামে। নিস্তব্ধ রাত নয়, দিনের কর্কশতা গ্রাস করে রাতকেও। ভোরের সোনালী আভা দৃশ্যমান নয়, গোধলী সন্ধ্যাও নয়। নিয়ম করে ঘুমাতে যাওয়া, নিয়ম করে ঘুম ভাঙ্গা। ঝিঝি পোকার মন্ত্রে ঘুম নয়, ঘুম আসে সারাদিনের যুদ্ধের ক্লান্তিতে। ভোরের আলো চুমু খেয়ে ঘুম ভাঙ্গায় না। ঘুম ভাঙ্গে ঘড়ির এলার্মে। বৌ-ঝিদের উঠান ঝাড়ু দেয়া শব্দ নেই। মোরগের ডাক নেই। ভোরের মৃদুমন্দ বাতাস নেই। কেবল মাত্র আজানের ধ্বনি আছে। কিন্তু যখন আজানের ধ্বনির পরেই মুয়াজিমের কন্ঠে ভেসে আসে - মসজিদে পানি নেই, দয়াকরে বাসা থেকে অজু করে আসবেন। তখন সেই চেনা ভোর আর চেনা থাকে না।

জনকের মৃত্যু সংবাদ পেয়ে রাত করে নিজেদের গ্রামের বাড়িতে যাত্রা তিন ভাই বোনের পরিবার মিলে। যখন পৌঁছান হলো তখন মধ্য রাত। জনক শুয়ে আছেন কফিনে। আশি উর্ধ বয়স। কখনও হাসপাতালে ভর্তি হননি। এ মৃত্যু অগ্রহনযোগ্য নয়। তবুও কফিনে জনকের নিথর দেহ সহজে কি মেনে নেয়া যায়। নিস্তব্ধ রাত, নিস্তব্ধ গ্রাম। শুধু বাড়িটিতেই জনসমাগম। আরেক সন্তান পৃথিবীর আরেক প্রান্তে, সেখানে তখন ভোর। মুঠফোনে তার কান্নাও তখন ভেসে আসছে। কফিনের সামনে তখন গ্রাম্য বাজনা - ঢোল করতাল বাজিয়ে কির্তন হচ্ছে। বউ-ঝিরা স্বজনদের দেখাশুনায় ব্যস্ত। পুরুষেরা মৃতদেহ সৎকারের পরিকল্পনায় রত।

রাত প্রায় শেষ। একজন ঠাকুরমা কাঁদতে কাঁদতে বললেন;- আমি একটু ঘুমাতে যাই তোমরাও কিন্তু একটু ঘুমিয়ে নিও। যারা কীর্তন গাইছিলেন তারা একটু ঘুমিয়ে নিতে বিছানায় গেলেন। সারাদিনের পরিশ্রমে ক্লান্ত বৌ-ঝিদের খুব ভোর থেকেই আবার কাজে লেগে যেতে হবে। তারও একটু গা-এলিয়ে দিলো। পুরুষেরা কেউ কেউ উঠানে রাখা বেঞ্চেই বসে বসে একটু ঝিমিয়ে নিচ্ছে।ভাইয়েরা, জামাইরা কফিনের পাশেই হোগলায় কেউ একটু গা এলিয়ে দিয়েছে, কেউ বসে বসেই চোখ বন্ধ করেছে। বোনেরা কফিনের পাশেই নির্ঘুম বসে। তাদের জননীর মৃত্যু একটা বিভীষিকার মধ্যে দিয়ে গেছে। তার মৃতদেহ ছুঁয়ে দেখায় শক্তি যেন হারিয়ে গিয়েছিল। তাই জনকের মুখখানি যতক্ষন ধরে রাখা যায়। বাচ্চারা কেউ ঘুমাতে চায় নি;--কিন্তু কতক্ষণ আর জেগে থাকা। যেথায় সেথায় ঘুমিয়ে পড়েছে তারা। ছোট ছেলে মায়ের কোলে মাথা রেখে হোগলায় ঘুমিয়ে পড়েছে। বড় ছেলের চোখে ঘুম নেই। মায়ের গা ঘেষে বসে আছে।

রাতের অন্ধকার তখন ফিকে হয়ে আসছে। বাড়ির উঠনে কফিন। হোগলায় বসে থেকে চোখ চলে যায় সামনের দিগন্তে। জনকের হাতে লাগনো সৌখিন গাছ গাছালির ফাঁক দিয়ে দেখা যায় ধানের জমি। জমির কোল ঘেষে সরু খাল। খালের ওপারেও ধানের জমি। সেখানেই চোখ থেমে যায়। মনেহয় আকাশ সেখানে নেমে পড়েছে। ধীরে ধীরে সে আকাশ জুড়ে সোনালী আলো ফুটে উঠেছে। সে সোনালী আলো একটু একটু করে ছড়িয়ে পড়ছে চারিধারে। অন্ধকারে বসে ছিলাম। সেই অন্ধকার মিলিয়ে গিয়ে মিষ্টি আলোতে আমার চারিপাশ একটু একটু করে আলোকিত হচ্ছে। গাছের পাতারা কেঁপে কেঁপে উঠছে। মৃদুমন্দ বাতাস এসে শরীরে শীতলতা দিয়ে যাচ্ছে। কুণ্ডলী পাকানো কুকুরের লেজটা নড়ে উঠছে। দুটি বিড়াল চোখ পিটপিট করে চাইছে কিন্তু ঘুমের আলস্য ত্যাগ করতে পারছে না। ঠাকুরমার বাগানে ফুলের সুবাস ভেসে আসছে। শিউলী তলায় তখনও টুপ টাপ করে শিউলী ঝরছে। কয়েকটা পাখি কিচির মিচির করে উঠছে। মোরগের ডানা ঝাপটানোর শব্দ কানে এলো। পরক্ষণেই মোরগ ডেকে উঠল। ধীরে ধীরে এমন ভোর হয়ে যাওয়ার সাক্ষী এর আগে কখনো হইনি। বড় ছেলেকে ফিসফিস করে বললাম;- দেখে নাও বাবা রাত কেটে গিয়ে ভোর হয় কিভাবে।

লেখক - করবী মালাকার


মন্তব্য

অতিথি লেখক এর ছবি

অনেক অনুভবের লেখা। গলা ধরে আসে তবু সুন্দর। কিছু কিছু অনুভূতি আছে যেখানে আমরা সবাই একীভূত।
--জে এফ নুশান

সৌখিন  এর ছবি

কখনো কখনো মনে হয় সময় খুব ধীরে বয়।

কর্ণজয় এর ছবি

স্মৃতি হলেও গল্পের মতো।
গল্প হলেও স্মুতির মতো।

অতিথি লেখক এর ছবি

অনবদ্য রচনা ❤

করবী মালাকার এর ছবি

সকলকে ধন্যবাদ সুন্দর মন্তব্যের জন্য। আমি অনুপ্রাণিত হলাম।

আব্দুল্লাহ এ.এম. এর ছবি

এলিজি কবিতাটির কথা মনে পড়লো।

নীড় সন্ধানী এর ছবি

এত চমৎকার বর্ণনায় দৃশ্যগুলো যেন চোখের সামনে দেখতে পেলাম। এইসব বেদনা অনেক ভেতরে ছুঁয়ে দেয়।

‍‌-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?

অতিথি লেখক এর ছবি

খুব সুন্দর লেখা।শহরের অলি গলিতে কত স্মৃতি পড়ে রয়!

এক লহমা এর ছবি

খুব সুন্দর লেখা।

--------------------------------------------------------

এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।

এক লহমার... টুকিটাকি

অতিথি লেখক এর ছবি

পড়ে চমৎকার লেগেছে। "দেখে নাও বাবা রাত কেটে গিয়ে ভোর হয় কিভাবে।" এই লাইনটা কয়েকবার পড়েছি।

--আমিননোমান

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।