মহাসমুদ্রের বাঁকে বাঁকে- টরকি (দ্বিতীয় পর্ব)

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: বিষ্যুদ, ২৭/০৬/২০১৯ - ১:১০অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

রৌদ্রজ্জ্বল একটি দিন, একপাশে সবুজ পাহাড়ের গা ঘেঁষে আঁকাবাঁকা রাস্তা, অন্যপাশে বিস্তীর্ণ সৈকত ছুয়ে নীলে রঙের সাত আটটা শেড তৈরি করতে করতে সমুদ্র মিশেছে গাড় নীল দিগন্তে। ভয়ংকর সুন্দর বুঝি একেই বলে! তবে গ্রেট ওশান রোডের মূল সৌন্দর্য এর বৈচিত্র্যতায়। সববয়সী মানুষের জন্যই মনমুগ্ধকর সব আয়োজন নিয়ে প্রকৃতি সদা প্রস্তুত সাথে যুক্ত হয়েছে পর্যটন শিল্পকে পৃষ্ঠপোষকতা করতে স্থানীয় প্রশাসনের উদ্যোগ। যারা ঘুরতে গিয়ে ব্যাস্ত থাকতে পছন্দ করেন তাদের জন্য যেমন গ্রেট ওশান রোড অন্যতম তীর্থস্থান, যারা একটু আলসে কিংবা আয়েশ করে বসে ২/১ টা কবিতা পড়তে চান কিংবা লিখতে চান তাদেরকে তৃপ্ত করতেও প্রকৃতির এতটুকু কার্পণ্য নেই। আপনাকে শুধু আপনার চাহিদামত পছন্দসই জায়গাগুলি গুগল করে বেছে নিতে হবে, কারন গ্রেট ওশান রোডে অনেক কিছু করার আছে। তাই আপনার রুচি এবং শারিরীক ও আর্থিক সামর্থ্যের উপর অনেকাংশে নির্ভর করে যে আপনি কি কি করবেন আর কি কি করবেন না।

আমার মনে হয় গ্রেট ওশান রোডে যত দেখার মত সুন্দর জায়গা এবং অভিজ্ঞতা নেয়ার মত কর্মকাণ্ড আছে আমি কয়েকবার ভ্রমণে তার মাত্র ১০ ভাগ দেখতে পেরেছি।এই ধারাবাহিক ভ্রমণ প্রবন্ধে শুধু সেগুলো নিয়েই লেখা হবে, যা আমি কিছূটা হলেও দেখেছি। বাকিগুলো না-হয় বাকি ই থাক, এমনিতেও অমন ব্যাপক প্রাকৃতিক সৌন্দর্য কলমবন্দী করার প্রতিভা আমার নেই; সেজন্য আফসোসও নেই, আমি তো আর শ্রী বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায় নই!

মেলবোর্ন শহর থেকে গ্রেট ওশান রোডে ঢুকতে প্রথমেই পরবে টরকি শহর। মেলবোর্ন থেকে মাত্র ১০০ কি. মি. দূরে অবস্থিত এই উপকুলীয় শহরটিতে রয়েছে ২০ টির বেশি বীচ (সৈকত) । টরকির বীচগুলি সার্ফিং এর জন্য আদর্শ। বিখ্যাত জ্যাঞ্জাক আর বেলস সার্ফিং বীচ এখানেই অবস্থিত। সারা গ্রীষ্মজুড়ে আর শীতকালে যেকোন রৌদ্রজ্জ্বল দিনেই সার্ফার আর প্যারাগ্লাইডারদের দেখা মিলে টরকির বীচগুলোতে। আদ্যোপান্ত রঙ্গিন সার্ফিং পোশাকে মোড়া সারফাররা,ঢেউয়ের তালে পাল্লা দিয়ে একবার তলিয়ে যাচ্ছে আবার ভেসে উঠছে। ওদের উদযাপন দেখলে একবারের জন্য হলেও মনে হবে, শুধু মুঠোফোনে মুখগুজে এতগুলো বছর পার করে দিলাম! জীবনে আরও কত কিছুই না করার ছিল!

চিত্র ১ঃ টরকির সৈকতগুলোর অবস্থান

চিত্র ২ঃ ড্রোন থেকে টরকির একাংশ

চিত্র ৩ঃ টরকিতে সারফিংরত সারফার।

সমুদ্রসমতলে সৈকতে দাড়িয়ে সমুদ্র দেখতে একরকম, পাহাড়ের উপর থেকে দেখতে সম্পুর্ন অন্যরকম। পাহাড়ে উঠা বা হাইকিং এ যারা আগ্রহী তারা সহজেই হাইকিং করে চূড়ায় উঠে সমুদ্র দেখতে পারবেন। কিন্তু হাইকিং এ যাদের আগ্রহ নেই পাহাড়ের চুড়ায় উঠাটাই তো তাদের জন্য হাঙ্গামা। ভাবনা নেই, গ্রেট ওশান রোড জুড়ে আছে অসংখ্য লুকআউট পয়েন্ট যেখানে পাহাড়ের চূড়ায় চূড়ায় গাড়ি নিয়ে যাওয়া যায়। আর এত চমৎকার রাস্তা যে চোখ বন্ধ রাখলে আপনি টেরই পাবেন না কখন পাহাড়ে উঠেছেন! শুধু টরকিতেই এমন ১০-১২ টা লুক আউট পয়েন্ট আছে। এখানে আমি শুধু বার্ড রক লুক আউট এর একটা বিবরণ দেয়ার চেষ্টা করব। তাতে মোটামুটি অন্য লুক আউট গুলি সম্পর্কে একটা প্রাথমিক ধারণা পাওয়া যেতে পারে। যদিও দেখার মত চোখ থাকলে গ্রেট ওশান রোডের সব লুক আউটই স্বীয় বৈশিষ্টে আলাদা।

বার্ড রক লুক আউট পুরো জ্যানযুক বীচ আর টরকি উপকুলের অনেকটা একসাথে দেখার সুযোগ করে দেয়।যাকে বলে সত্যিকারের প্যানারোমিক ভিউ। যারা হাইকিং করতে চান, তারা বেলস বীচ কিংবা টরকি বীচ থেকে হাইকিং ট্র‍্যাক ধরেও বার্ড রকে উঠতে পারেন। এই লুক আউটটার উপরে বিশাল কাঠের পাটাতনে বসার যায়গা, সামনে নিরাপত্তার জন্য কাঠের রেলিং দেয়া আছে। সাধারণত অস্ট্রেলিয়ার সব লুকআউট আর বীচে এমন ব্যাবস্থাই করা আছে। রেলিঙের ধারে গেলে দেখতে পাবেন যে পাটাতনটা একদম পাহাড়ের কিনারায় ঝুলে আছে। এ যেন সত্যিই পাখির চোখে দেখা। প্রকান্ড ঢেউগুলি বিস্তৃত সৈকতে সুসজ্জিতভাবে একটার উপর একটা পরতে পরতে আছড়ে পড়ছে, আর নীল সমুদ্রের উপর ভাসছে রঙিন গ্লাইডিং পোশাক পরা প্যারাগ্লাইডারের দল। সাগরের জল এতই স্বচ্ছ যে সূর্যের আলো পড়লে পাহাড়ের উপর থেকেও পানির নিচের পাথর আর গাছপালা দেখা যায়!

চিত্র ৪ঃ বার্ড রক থেকে সৈকতের দৃশ্য (ছবি তুলেছেঃ সোহেলী ইয়াসমিন)

চিত্র ৫ঃ বার্ড রক থেকে সৈকতের দৃশ্য (ছবি তুলেছেঃ সোহেলী ইয়াসমিন)

চিত্র ৬ঃ বার্ড রক থেকে সৈকতের দৃশ্য (ছবি তুলেছেঃ সোহেলী ইয়াসমিন)

আমার স্ত্রী সারাক্ষণই চেষ্টা করলেন নিচের সমুদ্র আর দিগন্তকে ক্যামেরাবন্দি করার, আসল সৌন্দর্যের ৩০ ভাগও ধরা পড়লনা। ভিডিও করলে তা ও একটু বোঝা যায়। একটা সী-গাল দেখলাম আমাদের মাথার উপর দিয়ে পাক খেয়ে একটু সামনে গিয়ে শুন্যে ঠায় স্থির হয়ে রইল, যেন বাতাসে ব্যাল্যান্স করা অনুশীলন করছে আর গুন গুন করছে “ আমি পাহাড়ের চূড়ায়, দাড়াতে পারি ঠায়, আমি সাগরের উত্তাল তরঙ্গ ভেদে যাই…” কিছু সী-গাল দেখলাম সমুদ্র থেকে মাছ ধরে খাচ্ছে, অবশ্য পর্যটকদের কাছ থেকে ফ্রেঞ্চ ফ্রাই খাওয়ার লোভই ওদের বেশী। সী-গাল ছাড়া আপাতত অন্য কোন পাখি চোখে পড়লনা। লুকাউটের এক ধারে দেখলাম ফলকের মধ্যে লেখা আছে যে অক্টোবর-নভেম্বরের দিকে গেলে বার্ডরক থেকে হঠাৎ হঠাৎ তিমি মাছের পিঠ আর লেজের ভেসে উঠা আবার তলিয়ে যাওয়া দেখার সৌভাগ্যও হতে পারে! আমার মতে শুধু এখানে বসেই একটা সকাল বা বিকাল কাটিয়ে দেয়া যেতে পারে। সূর্যাস্ত আর সূর্যোদয় যে বার্ডরক লুকআউট থেকে কেমন অবিশ্বাস্য সুন্দর দেখাবে, তা সহজেই অনুমেয়।

চিত্র ৭ঃ টরকিতে প্যরাগ্লাইডারদের ওড়াউড়ি

নিজে তো অনেক ঘুরলেন, কিন্তু আপনার পোষা কুকুরটার গলায় তো বেল্ট বাঁধা। সে সমুদ্র উপভোগ করতে পারল কি? স্বাচ্ছ্ন্দে কুকুরের গলার বাঁধন খুলে দেয়ার জন্য টরকিতে রয়েছে ৫-৬ টি ডগ বীচ। এসব পোষা কুকুরটিকে উন্মুক্ত করে দিতে পারবেন, নিজেও সেটার পিছনে ছুটতে ছুটতে সকাল বা সান্ধ্যভ্রমণটা সেরে নিতে পারবেন। আমি ডগ বীচের পারকিং এ গাড়ি রেখে আশেপাশে হাটলাম। আমার স্ত্রী আর বোনের ডগ ফোবিয়ার কারনে তাদেরকে গাড়ি থেকে নামানো যায়নি। তাই কুকুরের সমুদ্রে অবগাহন তেমন দেখা হয়নি (সত্যি বলতে আমি নিজেও কুকুর ভয় পাই)। আমার বাবাকে দেখলাম হাটতে হাটতে ক্যাফেটেরিয়ার দিকে চলে গেল, ক্যাফের নাম “ দি সল্টি ডগ ক্যাফে”। ফিরে এসে জানাল, উৎসবমুখর পরিবেশে মানুষ এবং কুকুর উভয়ের জন্যই গরম গরম খাবার পরিবেশন করা হচ্ছে সেখানে।

চিত্র ৮ঃ সল্টি ডগ ক্যাফের সাইনবোর্ড

চিত্র ৯ঃ আজ কোথাও আমার হারিয়ে যাবার নেই মানা

যারা যাদুঘর ঘুরতে ভালোবাসেন তাদের জন্য টরকিতে রয়েছে অস্ট্রেলিয়ান জাতীয় সার্ফিং যাদুঘর। আন্তর্জাতিক সার্ফিং সংস্থার মতে এটি পৃথিবীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও ঐতিহ্যবাহী বীচ এবং সার্ফিং যাদুঘর। গত একশ বছরে অস্ট্রেলিয়াতে গড়ে ওঠা বীচ আর সার্ফিং সংস্কৃতির নানা উপাদান যাদুঘরটিতে প্রদর্শিত। অস্ট্রেলিয়ার কিংবদন্তী সারফারদের অর্জন আর সার্ফিং বোর্ডগুলিও রাখা আছে এখানে। সার্ফিং করার উপকরণ আর পোশাকের বিবর্তন ইতিহাস আর কলাকৌশল দেখানো হয়েছে অতীত থেকে আজকে অবধি। এককথায় সারফিং এর আদ্যোপান্ত এখানে পাওয়া যাবে যা বেশ গুছিয়ে পরিবেশন করা হয়েছে। সার্ফিং যাদুঘরের প্রবেশ মূল্য ১২ অস্ট্রেলিয়ান ডলার , শিশুদের জন্য ৮ অস্ট্রেলিয়ান ডলার। আমার মনে হয় যাদুঘর দেখার আগ্রহ থাকলে টাকা টা জলে যাবে না।

চিত্র ১০ঃ সার্ফিং যাদুঘর

চিত্র ১১ঃ সার্ফিং যাদুঘরের হল অফ ফেইম

চিত্র ১২ঃ সার্ফিং যাদুঘর

সেই ১৯০০ সাল থেকেই টরকি অন্যতম জনপ্রিয় অবকাশকেন্দ্র। টরকি শহরটাও ঘুরে দেখা যেতে পারে। ছিমছাম আর কোলাহলহীন উপকুলীয় শহর। ঘুরে বেড়াতে পারেন বিশ্ববিখ্যাত সব সার্ফিং সরঞ্জাম বিক্রির দোকানে। মাঝারি আকারের শপিং মল আর স্যুভেনির বিক্রির দোকান। শহরে ঘোরার সুযোগ হলে,টরকি লেখা ফ্রিজ চুম্বক বা পছন্দসই স্যুভেনির কিনতে ভুলবেন না।

চিত্র ১৩ঃ টরকি শহর

টরকিতে আছে ৪৪ কি.মি. লম্বা পায়ে হাটা পথ। উপকুলীয় গুল্মের বনের মাঝে হাটতে পারেন ঘণ্টার পর ঘন্টা। যেখানেই যান সমুদ্র আপনার পাশাপাশি থাকবে। আর ইচ্ছে হলেই চোখ বুলিয়ে নিতে পারবেন সাগরনীলে।এছাড়াও টরকিতে অ্যাডভেঞ্চার প্রিয়দের জন্য আছে স্কাই ডাইভিং এর সুযোগ। আরামপ্রিয়দের জন্য অসংখ্য স্পা রিসোর্ট। সুরা পানে আগ্রহী দের জন্য আঙ্গুর বাগানে বসে তাজা ওয়াইন পানের ব্যাবস্থা। অবশ্য এগুলো একটু খরচান্ত ব্যাপার, নির্ভর করে আপনার উপর, পরিবারসুদ্ধ এসব উপভোগ করতে হাজার ডলার লেগে যেতে পারে। কথায় বলেনা, সখের দাম হাজার ডলার... না মানে...ইয়ে...লাখ টাকা……(লাখ টাকায় হাজার ডলারই তো হয়!)

চিত্র ১৪ঃ টরকিতে সাউথ ডেভন আঙ্গুরবাগান

চিত্র ১৫ঃ টরকিতে সাউথ ডেভন আঙ্গুরবাগান

চিত্র ১৬ঃ উইন্ডহ্যাম রিসোর্ট টরকি

চিত্র ১৭ঃ টরকি বীচ থেকে তিমি দেখার বিরল মুহূর্ত

চিত্র ১৮ঃ স্কাই ডাইভিঙ্গের সময় টরকি অঞ্চলের সমুদ্র যেমন দেখায়।

মহাসমুদ্রের বাঁকে বাঁকে -ভূমিকা (প্রথম পর্ব) পড়তে হলে এখানে ক্লিক করুন

-সৌখিন


মন্তব্য

অবনীল এর ছবি

দারুন জায়গা। ভ্রমন বর্ণনা এবং চিত্রগুলি অনবদ্য। ভালো লাগলো। কপালে থাকলে হয়ত যাওয়া হবে কোনদিন।

___________________________________
অন্তর্জালিক ঠিকানা

সৌখিন  এর ছবি

ধন্যবাদ। সবে তো শুরু। এখনও মূল আকর্ষণের জায়গাগুলি সম্পর্কে লিখিই নি। আসিতেছে…....

কর্ণজয় এর ছবি

আহা! বেশ, বেশ, বেশ---

সৌখিন  এর ছবি

হাসি

অতিথি লেখক এর ছবি

১।

তাই আপনার রুচি এবং শারিরীক ও আর্থিক সামর্থ্যের উপর অনেকাংশে নির্ভর করে যে আপনি কি কি করবেন আর কি কি করবেন না।

প্রশ্নের উত্তর হ্যাঁ/না হলে প্রশ্নে 'কি' হবে। যেমন,
প্রশ্নঃ আপনি কি খাবেন?
উত্তরঃ হ্যাঁ, আমি খাবো। অথবা
না, আমি খাবো না।

প্রশ্নের উত্তর বহুবিধ হলে প্রশ্নে 'কী' হবে। যেমন,
প্রশ্নঃ আপনি কী খাবেন?
উত্তরঃ আমি কাচ্চি বিরিয়ানী খাবো। অথবা, আমি বার্গার খাবো। অথবা, আমি সাগু-বার্লি খাবো। ইত্যাদি ইত্যাদি

২। কিছু ছবিতে সোর্স উল্লেখ করা হয়েছে আবার কিছু ছবিতে তা নেই। সব ছবিতেই সোর্স উল্লেখ করতে হবে।

৩। ডগ ফোবিয়া নয়, কাইনোফোবিয়া (Cynophobia)।

সিরিজ চলুক!!

আরিফ

সৌখিন  এর ছবি

পরামর্শগুলোর জন্য ধন্যবাদ

এক লহমা এর ছবি

লেখা ছবি দুই মিলিয়ে বেশ উপভোগ করা গেল। পরের পর্বের অপেক্ষায় থাকলাম।

--------------------------------------------------------

এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।

এক লহমার... টুকিটাকি

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।