মহাসমুদ্রের বাঁকে বাঁকে - ভূমিকা (প্রথম পর্ব)

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: শনি, ২২/০৬/২০১৯ - ১:২৬পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

১০৬ মিলিয়ন বছর আগেকার কথা,। অস্ট্রেলিয়ার দক্ষিণ পূর্ব উপকূলের অটওয়ে সমুদ্রতট। সেসময় এই উপকূলের তাপমাত্রা আজকের চেয়ে অনেক কম, কারন অস্ট্রেলিয়া ছিল এন্টার্কটিক সাইকেলের ভেতরে। সুবিস্তীর্ণ সমুদ্রের সুনীল জলরাশি নিরন্তর আছড়ে পড়ছে অনাদিকালের নিরবতা কে ছিন্নভিন্ন করে দিয়ে। যেন প্রতিমুহূর্তে সগৌরবে মহা কালকে মুচকি হেসে বলছেঃ "তুমি একাই প্রাচীন নও, হিসেব করে দেখো, আমিও ছিলাম; আছি; আর থাকবো।" সৈকত শেষ হতে না হতেই মৌন দাঁড়িয়ে আছে কাটাঝোপ আর সামুদ্রিক গুল্মে ভরা পাহাড়ের সারি। আর সেই প্রাচীন রাজ্যে রাজত্ব করত দুই রাজ বংশ- Leaellynasaura amicagraphica আর Timimus hermani. ঠিক ধরেছেন, এরা ছিল দুটি ভিন্ন প্রজাতির ডাইনোসর।

Timimus hermani ছিল তুলনামূলক ভাবে ছোট প্রজাতির (৮ ফুট লম্বা), শাকাহারী ডাইনোসর যারা প্রচন্ড শীত সহ্য করতে পারতো এবং বৈরি পরিবেশে খাদ্যাভাব দেখা দিলে শীতনিদ্রায় চলে যেত। আর Leaellynasaura amicagraphica ছিল আরও ছোট আকারের (৩.৫ ফুট লম্বা), এদের ছিল দেহের আকারের ৩ গুন লম্বা লেজ! এরাও গাছ পালা/নিরামিষ খেয়েই এই গ্রহ থেকে বিদায় নিয়েছে। ১৯৯১ সালে কেইপ অটোয়ার এক গুহা থেকে এদের ফসিল সংগ্রহ করা হয়। এই গুহার নামকরন করা হয় ডাইনোসর এর গুহা নামে। মজার ব্যাপার হচ্ছে ফসিল গবেষণায় পাওয়া যায় যে এদের চোখের অপ্টিক লোব সমসাময়িক অন্য যেকোন ডাইনোসরের চেয়ে বেশ বড় ছিল। ধারণা করা হয়, এই উপকূলে প্রচন্ড ঠান্ডায় কখনো কখনো দিনের পর দিন সূর্য উঠত না। তখন অন্ধকারে দেখতে দেখতে এদের চোখ অভিযোজিত হয়ে যায়, ফলে এরা সূক্ষদৃষ্টি লাভ করেছিল।

চিত্র ১ঃ Leaellynasaura amicagraphica আর Timimus hermani

এরপর কেটে গেছে কয়েক লক্ষ বছর। অস্ট্রেলিয়ার ভূপ্রকৃতিতে এসেছে ব্যাপক পরিবর্তন। অস্ট্রেলিয়া আর এন্টার্কটিক এর সাথে সংযুক্ত নেই। একই সাথে প্রকৃতিতে এসেছে নতুন শিশু, মানব সম্প্রদায়। তাই ডাইনোসরদের ছেড়ে দিতে হয়েছে স্থান। তাপমাত্রাও আর আগের মত ঠাণ্ডা নেই। তাই উদ্ভিদ জগতেও এসেছে পরিবর্তন। ঘনবর্ষণ বনাঞ্চলে (রেইন ফরেস্ট) ঢেকে গেছে পাহাড় আর সমতল। উপকুলীয় বনাঞ্চল জুড়ে এখন গাডুবানুড আদিবাসীদের বাস। শুধু নিরামিষ খেয়ে ওদের চলে না। চাই আমিষ, চাই সামুদ্রিক মাছ, শৈবাল আর স্কুইড, আর মাঝে মাঝে বুনো পাখির ঝলসানো মাংস!

১৮৩০ সালের দিকে এই অটোয়া উপকূল ইউরোপ থেকে অস্ট্রেলিয়া আসার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ সমুদ্রপথ হিসাবে ব্যাবহার শুরু হয়। কিন্তু প্রায়ই এই অঞ্চলের সামুদ্রিক বৈরি আবহাওয়ায় নাবিকরা পথ হারিয়ে ফেলে, পরে নিউ সাউথ ওয়েলস এর উপকূলে পাড়ি জমায় (সেই পথেই জেমস কুক অস্ট্রেলিয়া আবিষ্কার করেছিলেন)। এই সমস্যা সমাধানে ১৮৪৮ সালে তৈরি করা হয় কেইপ অটোয়া বাতিঘর। নাবিকরা আর বনলতা সেন কবিতার মত হাল ভেঙে পথের দিশা হারায় না, ফলে এই অঞ্চলে বিপুলভাবে ইউরোপীয় অভিবাসন ঘটতে থাকে। এত বাড়তি মানুষের জন্য চাই বাসস্থান, তাই ১৮৮০ সাল থেকে পাহাড়ী বন উজাড় করে কাঠ কেটে বানানো হয় ঘরবাড়ি, এই কাঠের কিছু অংশ সমুদ্রপথে পাঠানো হয় ইউরোপ। বুদ্ধিমান, দুঃসাহসী আর নৃশংস সাদা মানুষের দাপটে গুডাবানুডরা কোথায় যেন হারিয়ে যায়, তাদের কেউ কেউ আবার উদ্বাস্তু হয়ে সমুদ্র পাড়ি দিয়ে অন্যদীপে আশ্রয় খুঁজতে গিয়ে সলিলসমাধি লাভ করে। সমুদ্র তাদের দেহ বুকে জড়িয়ে নেয়, স্রোতের শুভ্র ফেনায় মিশে যায় গুডাবানুডদের অশ্রু আর অভিমান। সাগরের নিরন্তর গর্জন আজও বুঝি শুনিয়ে যায় তাদের হাহাকারের মহাকাব্য!

চিত্র ২ঃ শিল্পীর আঁকায় গুডাবানুড সমাজে ইউরোপীয় অনুপ্রবেশ।

এখন শুধু গাছ কাটলেইতো হবেনা, তা থেকে কাঠ বানাতে হবে। গাছ থেকে কাঠ প্রস্তুত করার উদ্দেশ্যে ইউরোপীয়রা উপকূল জুড়ে প্রায় ৩০ টি স' মিল বসায়। এদিকে স' মিল থেকে শহরে কাঠ বহন করাও এক কষ্টসাধ্য কাজ। এই সমস্যা নিরসনে ১৮৮০ সাল থেকেই এই অঞ্চলকে নিকটস্থ শহরগুলোর সাথে সংযুক্ত করতে রাস্তা তৈরির পরিকল্পনা হচ্ছিল। কিন্তু তা নানা কারণে বাস্তবায়িত হয়নি। ইতোমধ্যে ১৯০২ সালে বীচ ফরেস্ট থেকে নিকটস্থ শহর কোলাক পর্যন্ত রেল বসানো হয়।তার উপর চলা শুরু করে কাঠ বহনকারী ট্রাম। রাস্তা বানানো আপাতত স্থগিত থাকে।

১৯১৪ সালে শুরু হয় প্রথম বিশ্ব যুদ্ধ যা ১৯১৮ সাল পর্যন্ত স্থায়ী হয় এবং প্রায় ৬০,০০০ অস্ট্রেলিয়ান সৈনিক এই যুদ্ধে মারা যান। তাই যুদ্ধফেরত সৈনিকেরা শহীদদের স্মৃতি অমর করে রাখার উদ্দেশ্যে অটোয়া উপকূলের সব শহরকে সংযুক্ত করতে প্রায় ২৪৩ কি. মি. লম্বা সড়ক বানানোর কাজ শুরু করেন। প্রায় ১৪ বছর পর ১৯৩২ সালে সড়ক বানানোর কাজ শেষ হয় আর সাধারনের ব্যাবহারের জন্যে উন্মুক্ত করে দেয়া হয়। এই সড়কের নাম দেয় হয় গ্রেট ওশান রোড। গ্রেট ওশান রোড শহীদের স্মৃতিতে নির্মিত মানুষের তৈরি সবচেয়ে বড় স্মৃতিসারক আর সৈনিকদের ভ্রাতৃত্ববোধের এক অভূতপূর্ব দৃষ্টান্ত। প্রথমে এই সড়ক উদ্বোধনের পর তা ব্যাবহারের জন্য কর প্রদান করতে হতো। মাত্র চার বছর পর ১৯৩৬ সালে স্থানীয় সরকার এই সড়ক কেন্দ্রীয় সরকারকে উপহার দেয়,আর কেন্দ্রীয় সরকার সবার জন্য বিনামূল্যে তা উন্মুক্ত করে দেয়। যেই ট্রাম লাইনটার কথা বলেছিলাম তা ১৯৬২ সাল পর্যন্ত চালু ছিল। বর্তমানে ট্রাম লাইন তুলে সে স্থানে পর্যটকদের জন্য ৪৫ কি.মি. দীর্ঘ পায়ে হাটা পথ আর তার পাশাপাশি সাইকেল চালানোর পথ তৈরি করা হয়েছে।

চিত্র ৩ঃ সৈনিকেরা সড়ক তৈরি করছে

চিত্র ৪ঃ সৈনিকেরা সড়ক তৈরি করছে

আজকের দিনে গ্রেট ওশান রোড প্রায় ৩৫৬ কিমি লম্বা। অস্ট্রেলিয়ার ভিক্টোরিয়া স্টেটের দক্ষিণ পূর্ব উপকূলে টরকি থেকে পোর্ট ল্যান্ড পর্যন্ত পাশাপাশি মোট ১০ টা শহর নিয়ে গ্রেট ওশান রোড। টরকিকে যদি আমরা শুরু (০ কিমি) ধরে হিসাব করি, ক্রমান্বয়ে ১০টা শহর হল এঙ্গেল সি (১৮ কি.মি.), এরিস ইনলেট (২৮ কি.মি.), লরন (৪৭ কি.মি.), এপোলো বে (৯০ কি.মি.),জোহানা (১২৫ কি.মি.), পোর্ট ক্যাম্বেল (১৮৮ কি.মি.), ওয়ারানাম্বুল (২৫৩ কি. মি.), পোর্ট ফেয়ারী (২৮৩ কি.মি.), এবং পোর্টল্যান্ড (৩৫৬ কি.মি.) এছাড়া আরও ৩ টি বড় শহর গ্রেট ওশান রোডের অদূরে অবস্থিত। কোলাক, পিটারসব্রো, আর তেরাং। টরকি শহরটা ভিক্টোরিয়া স্টেটের দক্ষিন পশ্চিমে আর পোর্টল্যান্ড প্রায় সাউথ অস্ট্রেলিয়া স্টেটের সীমানার কাছাকাছি।

চিত্র ৫ঃ গ্রেট ওশান রোডের মানচিত্র

এই ধারাবাহিক ভ্রমণ প্রবন্ধে টরকি থেকে পোর্টল্যান্ড অবধি মনোমুগ্ধকর গ্রেট ওশান রোডের বিখ্যাতসব প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ঠাসা পর্যটনস্থান নিয়ে আলোকপাত করা হবে। যেহেতু আমি ভিক্টোরিয়া থাকি, তাই আমিও টরকি থেকে দেখতে দেখতে আস্তে আস্তে পোর্টল্যান্ডের দিকে গিয়েছি, তাই টরকি থেকেই শুরু করছি। তবে অবশ্যই আমি এক ছুটিতে গ্রেট ওশান রোড ঘুরিনি,কয়েকবারের ছুটির অভিজ্ঞতা এখানে লিপিবদ্ধ করা হবে। কারনটা ক্রমশ প্রকাশ্য, চলুন তবে শুরু করা যাক!

চিত্র ৬ঃ গ্রেট ওশান রোড (ড্রোন থেকে তোলা চিত্র)


মন্তব্য

নীড় সন্ধানী এর ছবি

চমৎকার সূচনা। পরবর্তী পর্ব আসুক। লেখকের নাম থাকা দরকার ছিল।

এই অংশটি শুদ্ধ করে দিলে ভালো হতো-

এরপর কেটে গেছে কয়েক লক্ষ বছর। অস্ট্রেলিয়ার ভূপ্রকৃতিতে এসেছে ব্যাপক পরিবর্তন। অস্ট্রেলিয়া আর এন্টার্কটিক এর সাথে সংযুক্ত নেই। একই সাথে প্রকৃতিতে এসেছে নতুন শিশু, মানব সম্প্রদায়

এখানে কয়েক লক্ষ বছর তথ্যটি ঠিক নয়। ডায়নোসর যুগের অন্তত বিশ কোটি বছর পর পৃথিবীতে মানবজাতির আবির্ভাব ঘটেছিল।

‍‌-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?

হিমু এর ছবি

ডাইনোসরদের আবির্ভাব তেইশ কোটি বছর আগে। অস্ট্রেলিয়া অ্যান্টার্কটিকা থেকে পৃথক হতে শুরু করে সাড়ে আট কোটি বছর আগে। ডাইনোসর বিলুপ্ত হয় সাড়ে ছয় কোটি বছর আগে। মানুষের আবির্ভাব কয়েক লক্ষ বছর আগে।

সৌখিন  এর ছবি

ধন্যবাদ, আমি একমত। ব্যাপারটা গুরুত্ত দেয়া উচিত ছিল। আমি যেই উৎস থেকে লিখেছিলাম,তারা এতটা স্পেসিফিক হিসাব দেয়নি। আমি অতিথি লেখক তাই এখন আর সংশোধন এর সুযোগ নেই।

অনেক অতিথি লেখক দেখলাম লেখকের নাম কি ওয়ার্ড এ দেয়। তাই আমিও তাই দিয়েছিলাম।

অতিথি লেখক এর ছবি

১। একটা সিরিজের প্রতিটি পর্বে ক্যাটেগরিতে কিছু অভিন্ন কী-ওয়ার্ড দিতে হবে তাহলে পরবর্তীতে পাঠক ওই কী-ওয়ার্ডগুলোর কোনটাতে ক্লিক করলে ওই সিরিজের সব লেখা একসাথে পেয়ে যাবেন। অতিথি পর্যায়ে লেখার শেষে আর ক্যাটেগরিতে - দুই জায়গাতেই লেখকের নাম দেয়া শ্রেয়।

২। অটওয়ে/ওটওয়ে বেশিরভাগ জায়গায় অটোয়া হয়ে গেছে।

৩। এই সিরিজটা শুরু করার কায়দা চমৎকার হয়েছে। নিজস্ব ছবি না হলে ছবির নিচে সোর্স উল্লেখ করতে হবে। লেখা পোস্ট করার আগে অভ্র স্পেলচেকার দিয়ে বানান নীরিক্ষা করে নিলে অনেক টাইপো এড়ানো যাবে।

৪। বৃহত্তর ভিক্টোরিয়া অঞ্চলে দফায় দফায় সাদাদের এনে বসানো হয়েছে। এমনকি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরেও দলে দলে ইউরোপীয়দের এনে বসানো হয়েছে। স্থানীয়দের পাইকারী হারে খুন করে দেশ দখল করার ব্যাপারে শীর্ষস্থান দখলের ক্ষেত্রে আমেরিকা আর অস্ট্রেলিয়ার মধ্যে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হবে।

সিরিজ চলুক!!

আরিফ

সৌখিন  এর ছবি

ধন্যবাদ

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।